| 29 মার্চ 2024
Categories
উপন্যাস ধারাবাহিক সাহিত্য

ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৫)

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

‘নীরা, তুই কি আমার ফোন ধরেছিলি?’

আমি বাবার দিকে ত্রস্তমুখে তাকালাম। কিন্তু বাবাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি। মুখে রাগ নেই, বরং কেমন একটা প্রশান্তি খেলা করছে।

আজ সকাল থেকেই বাসার পরিবেশটা কেমন যেন অদ্ভুতরকমের ঠান্ডা। প্রতিদিনের অবস্থার সাথে আজ কোনোই মিল নেই। অন্যদিন সকালে মা তপ্ত কড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে একই উষ্ণতায় ফুটতে থাকে। আমি আর নয়ন ঝটপট স্কুলড্রেস পরে রেডি হতে থাকি। যত দ্রুত সম্ভব বাসা থেকে বের হয়ে পড়তে হবে। মা-বাবার মধ্যে বেশিরভাগ দিন সাতসকালেই শুরু হয়ে যায়!

সম্ভবত দুজনে একটা অভিযোগের ফর্দনামা তৈরি করেছে। সেই ফর্দটা সকালবেলাতে খোলা হয়। সেটা চলতে থাকে সারাদিনব্যাপী। বাবা অফিস যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অভিযোগের তীরবর্ষণ ঠেকাতে থাকে। অফিসের জন্য রেডি হওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজেও দু’চারটা তীর ছুঁড়ে মারে। তবে সময়ের অভাবে তার আক্রমনটা এই সময়ে তেমন জোরালো থাকে না। আমি আর নয়ন রুদ্ধশ্বাসে নিজেদের কাজ সারতে থাকি। স্কুলবাস আমাদের বাসার গলিটাতে ঢোকে না। মোড়ের কাছ থেকে উঠতে হয়। তাই কিছুটা সময় হাতে নিয়েই বের হতে হয়। আমরা কিছুটার জায়গায় অনেকখানি সময় হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়ি। বাসায় থাকার চেয়ে স্কুলবাসের জন্য অপেক্ষা করাটাও অনেক আনন্দময় মনে হয় আমাদের কাছে।

অথচ আজকের সুর একেবারেই ভিন্ন। মা ডিম ভাজতে ভাজতে গুনগুন করে কী একটা যেন সুর ভাজছে।

নানাবাড়িতে থাকতে মায়ের নাকি টুকটাক গানের নেশা ছিল। বান্ধবীর বাসায় গিয়ে হারমোনিয়ামেও হাতেখড়ি হয়েছিল। গানের গলাও যথেষ্ট ভালো ছিল। তিন চারটা গান তুলে ফেলেছিল হারমোনিয়ামে। স্কুলের ফাংশনে সেই বান্ধবীর সাথেমাকেও গান গাইতে হতো।

মাঝে মাঝে যখন মন ভালো থাকে, তখন অতীতের এই গল্পগুলো মা আমার কাছে করে। স্বপ্ন দেখার অধিকার কেউ ভুলে যায় না।মায়ের স্বপ্ন ছিল অনেক। তার কিছুই বলতে গেলে পূরণ হয়নি। বিয়ের পর লেখাপড়া চালাতে পারেনি। পরের বছরই আমার জন্ম হয়। বাবা পাশে থাকতে চেয়েও এক সময় আলগোছে হাত ছেড়ে দিয়েছে। নুন তেল পেঁয়াজের খবর রাখতে গিয়ে পড়াশুনা নামক বিলাসিতাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। টেনেটুনে এইচএসসির দোড়গোড়াটা শুধু পার করতে পেরেছিল মা। একসময় ইচ্ছে ছিল, বড় চাকুরে হওয়ার। সংসারের অস্বচ্ছলতায়সেই ইচ্ছেকে পেছনে ফেলে আসতে হয়েছে।


আরো পড়ুন: ধারাবাহিক উপন্যাস: খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি (পর্ব-৪)

স্কুলশিক্ষক বাবার আর্থিক সামর্থ্য ছিল যৎসামান্য। এছাড়া রক্ষণশীলতার ব্যাপারটা তো ছিলই! মেয়েকে স্কুল ফাংশনে গান গাইতে দেখলে নানার মুখ যতটা না উজ্জ্বল হতো, মাথা হেঁট হতো তার চেয়েও বেশি। অন্য শিক্ষকেরাও হাল্কাসুরে বাঁকা কথা শুনিয়ে দিতেন।

‘তা সিরাজ সাহেব কি মেয়েকে গান শেখাতে শুরু করলেন নাকি? ভালো ভালো…বিয়ের বাজারে মেয়েকে দিয়ে গান গাওয়াতে হয়, নাচ দেখাতে হয়। ভালো পাত্র খুঁজে পেতে সুবিধা হয়। মেয়েদের লেখাপড়ার প্রয়োজনটা তো আর তেমন বেশি নয়! কিছুটা জানা থাকলে বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করার সময় কাজে লাগে, এর বেশি তো আর কিছু নয়!’

মেয়ের গান শেখাতে একসময় নানাকেও তাই আপত্তির খড়গ তুলতেই হলো। আমার মাকে বান্ধবীর বাসায় আসা যাওয়া কমিয়ে দিতে হলো। গান শেখার স্বপ্নটাও এভাবেই শেষ হয়ে গেল।

হঠাৎ কখনো মন ভালো থাকলে এখনো মা নিজের মনে গুনগুনিয়ে ওঠে।

আজকের দিনটা তেমনই একটি দিন। মায়ের মনটা খুশি খুশি। গতকাল আমাদের সবারই অন্যরকম একটা দিন কেটেছে। তার রেশ কারো মন থেকেই তখনো হারিয়ে যায়নি।

আমি আচমকা বাবার প্রশ্নটা শুনে একটু দিশেহারা হয়ে পড়লাম। চট করে মিথ্যে কথা বলে দেওয়া যায়। বলা যায়, ‘আমি না…নয়ন ধরেছিল। কিছু না বুঝেই ধরে ফেলেছিল। অপরিচিত গলা শুনে কেটে দিয়েছে।’ এভাবে বললে হয়ত দোষটা কিছুটা কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। বাচ্চা মানুষ, ভুল করে ফেলেছে।

কিন্তু আমি বেকায়দায় তাল হারিয়ে ফেললাম। নিজের অজান্তেই মাথাটা ওপরনিচে নামিয়ে দিলাম। ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম ফোনটা তোমাকে দিব। কিন্তু পরে ভুলে গিয়েছি…’

বাবার চোখের দৃষ্টি এখনো বেশ নরম। আমার বিস্ময়ের পালা কাটছেই না! বাবা রাগ করছে না কেন? আমি তার এমন একটা ব্যক্তিগত ফোন রিসিভ করেও তাকে কিছু জানাইনি। এই ব্যাপারটা তো বাবার এত সহজে মেনে নেওয়ার কথা নয়!

গতকাল রাতে ফোনটা ধরার পর থেকে আমি একরকম ধন্দের মধ্যে আছি। নিজের মধ্যে সেই ধন্দটাকে পুষে রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল আমার জন্য। তবু রাখতে হয়েছিল। আমার কোনো বন্ধু নেই। কাউকে এসব কথা বলা যায় না।

আমার জন্য এটা বিশাল এক ধাক্কা। বাবা এমনিতে মায়ের সাথে যতই ঝগড়াঝাঁটি করুক, অন্যকারো সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক চলছে… এটা আমার কখনও মনে হয়নি। বরং বিভিন্নসময়ে মনে হয়েছে, বাবার হয়ত কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। সেজন্যই দিনের পর দিন মাকে সহ্য করে যাচ্ছে।

মা তার অসুখী জীবনের হতাশা থেকে নানারকম কথা বলে ফেলতো। কথাগুলো কাকে বলছে…বলা উচিত কী না…এত সব ভাবনা ভাবার দায়িত্বজ্ঞান মায়ের মধ্যে দেখিনি কখনো।

বাবা অফিসে চলে যাওয়ার পর মা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে নিজের ঘরে বসে থাকে।

আমার সাথে মায়ের সম্পর্কটা একটু জটিল। আর দশটা মা-মেয়ের সম্পর্ক নেই আমাদের মধ্যে। তাই মন খারাপের এই সময়গুলোতে আমরা কেউ কাউকে সেভাবে আশ্রয় দিতে পারি না। আমি ভয় পাই, মা ব্যাপারটাকে কীভাবে নিবে। মাও হয়ত ভাবে, আমি কীভাবে নিব। এমন দু’মূখী ভাবনা থেকেই কেউ কারো বন্ধু হতে পারিনি কোনোদিন।

তবু নাড়ির টানেই কখনো কখনো কাছে যাই। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘মা…কী ভাবছো?’

এমনই দিনগুলোতে মা প্রায়ই নিজেকে আগাপাশতলা প্রকাশ করে ফেলে। ক্ষেদ আর হতাশা ঝরাতে ঝরাতে বলে, ‘এমন একটা লোককে পছন্দ করেছিলাম…এমন একটা লোককে…জীবনটা ত্যানা ত্যানা হয়ে গেল! শুধু তোদের কথা চিন্তা করেই এখনো এখানে পড়ে আছি আমি। নইলে কবেই চলে যেতাম, যেদিকে দু’চোখ যায়…বুঝলি?

ঐ লোক কী মনে করেছে, আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই? আছে কী নাই, দু’দিনেই দেখিয়ে দিতে পারবো! কত বয়স হয়েছে আমার? মাত্র পঁয়ত্রিশ। অল্পবয়সে এমন একটা লোকের পাল্লায় পড়ে লেখাপড়াকে জলাঞ্জলি দিয়েছি। বিনিময়ে কী পেয়েছি? এই ঘোড়ার ডিমের সংসার! না আছে সুখ না আছে সাচ্ছন্দ্য! ভালো একটা গয়না কোনোদিন গড়িয়ে দিয়েছে কী না, বলতে পারবে না। একদিন ঠিকই চলে যাবো! কথায় কথায় আমার বাবার আর্থিক অবস্থা নিয়ে কথা বলে। যখন পছন্দ করেছিল তখন মাথায় ছিল না এসব? তখন কেন পছন্দ করেছিল স্কুলমাস্টারের মেয়েকে?’

আমার কিছু বলার থাকে না এসব কথায়। তবু চলেও যেতে পারি না। মায়ের হয়ত সেই সময়গুলোতে একজন শ্রোতার দরকার পড়ে, নীরব শ্রোতা। যার সাথে সব কথা বলে মনটাকে হাল্কা করে নেওয়া যায়। আমি হচ্ছি সেই নীরব শ্রোতা। মাকে হাল্কা হওয়ার সুযোগ দিই। জন্মের ঋণ শোধ করি…একটু একটু করে।

মায়ের এসব আস্ফালন দেখে প্রায়ই মনে হতো, মা বুঝি কোনদিন সত্যি সত্যি চলে যাবে! তখন আমি আর নয়ন হয়ত বাবার কাছেই থাকবো। অথচ এখন বাবার জীবনেই কিছু একটা লুকিয়ে থাকতে দেখে আমি বড়সড় ধাক্কাই খেয়েছি গতকাল।

বাবা বললো, ‘ফোন ধরেছিস দেখে ভয় পেয়েছিস নাকি রে? ধরে ভালোই করেছিস। কিছু কথা তোকে অনেকদিন ধরেই বলবো বলবো ভাবছিলাম। কীভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তোর মাকে বলার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। ঐ আনকালচার্ড ওম্যান শুধু শুধু একটা সিনক্রিয়েট করবে! কিন্তু তুই আমার মেয়ে। তোর বুদ্ধিশুদ্ধি ভালো। হয়ত আমার কথাগুলো তুই বুঝতে পারবি। ইয়ে…নীরা…আমরা…মানে আমি বেশ অনেকদিন ধরেই আমার এক কলিগকে পছন্দ করি। ওর নাম ছন্দা। গতকাল ওরই আসবার কথা ছিল। কী একটা কাজে নাকি আটকে গেছে। বলেছে পরে আসবে। খুব ভালো মেয়ে। দেখিস…তোর খুব পছন্দ হবে ওকে।’

আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বাবা এসব কী বলছে? নিজের মেয়ের কাছে নিজের অবৈধ সম্পর্কের কথা একজন মানুষ এত অকপটে কীভাবে বলতে পারে!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত