এটা ছিল একজন স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্নময় রাত্রি। লক্ষ্মী তার বান্ধবী মিরান্ডাকে জানাল, বিবাহিত জীবনের নয়টি বছর পার করে তার মামাত বোনের স্বামী অন্য নারীর প্রেমে পড়েছে। স্বামীটা দিল্লি থেকে মনট্রিল যাওয়ার একটা প্লেনে ওই মহিলার পাশে বসেছিল। নিজের স্ত্রী, ছেলের কাছে না গিয়ে ভদ্রলোক ওই মহিলার সঙ্গে হিথরো নেমে পড়ল। তার স্ত্রীকে ফোন করে বলল, একজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে তার জীবনে পরিবর্তন এসেছে। পুরো বিষয়টা খতিয়ে দেখতে তার সময় প্রয়োজন। এ-ঘটনার পর অনিবার্যভাবে লক্ষ্মীর মামাত বোনটা শয্যা নিল।
‘তার মানে এই নয় যে, আমি মেয়েটাকে দোষ দিচ্ছি’, লক্ষ্মী বলে। হটমিক্সের জন্য সে হাত বাড়াল, সারাদিন মুখের ভেতর রেখে তা চিবোতে দেখে মিরান্ডার মনে হলো, এ যেন ধূলিময় কমলার প্রাতরাশ, ‘চিন্তা করো, একজন ইংরেজ মেয়ে, ভদ্রলোকের বয়সের অর্ধেক হবে।’ লক্ষ্মী মিরান্ডার চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড়। তার ইতোমধ্যেই বিয়ে হয়েছে। তাজমহলের সামনে একটা সাদা পাথরের বেঞ্চে স্বামীর সঙ্গে তার তোলা ছবিটা ছোট শয়নকক্ষে মিরান্ডার ছবির পাশে পেরেক দিয়ে লাগানো আছে। লক্ষ্মী ফোনে কমপক্ষে এক ঘণ্টা কথা বলে তার মামাত বোনকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কেউ খেয়াল করেনি, তারা পাবলিক বেতার কেন্দ্রের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ বিভাগে কাজ করে। সেখানে তারা অনেক লোকে পরিবেষ্টিত থাকে, আর্থিক আশ্বাসের জন্য প্রায় সারাদিন ফোনে কথা বলতে হয়।
‘ছেলেটার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে’ – লক্ষ্মী আরো বলে, ‘দিনের পর দিন সে ঘরে বসে থাকে। আমার মামাত বোন বলে, সে তাকে স্কুলেও নিয়ে যেতে পারে না।’ ‘ব্যাপারটা ভয়ংকর শোনাচ্ছে’, মিরান্ডা মন্তব্য করে। সাধারণত লক্ষ্মীর ফোনে কথা বলা, বিশেষ করে রাতের খাবারের জন্য কী রান্না হবে, তা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা তাকে বিক্ষিপ্ত করে তোলে। তখন সে চিঠি টাইপ করতে থাকে আর একটা থলে বা ছাতার বিনিময়ে বার্ষিক জামানত বৃদ্ধির লক্ষ্যে রেডিও স্টেশনের সদস্যদের অনুরোধ জানায়। লক্ষ্মীর সব কথা সে তাদের ডেস্কের মাঝখানে লেমিনেটেড দেয়াল ভেদ করে স্পষ্ট শুনতে পায়, তার সব বাক্যে প্রায়শই ভারতীয় শব্দ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে; কিন্তু সেদিন বিকেলে মিরান্ডা কিছুই শুনতে পায়নি। সে নিজেই দেবের সঙ্গে ফোনে আলাপ করছিল সন্ধ্যায় কোথায় দেখা করবে।
‘যা বলছিলাম, বাড়িতে কিছুদিন বসে থাকলে ছেলেটার তেমন ক্ষতি হবে না’ – লক্ষ্মী আরো কিছু হটমিক্স খেল, তারপর বাকিটা ড্রয়ারের ভেতর সরিয়ে রাখল। ‘ছেলেটা সত্যিই প্রতিভাবান। তার মা পাঞ্জাবি আর বাবা বাঙালি। যেহেতু স্কুলে ফরাসি আর ইংরেজি ভাষা শিখেছে তাই সে এখন চারটি ভাষায় কথা বলতে পারে। স্কুলে দুই গ্রেড মাড়িয়ে সে ওপরে উঠেছে।’
দেবও বাঙালি। মিরান্ডা প্রথমে ভেবেছিল, বাঙালি মানে একটা ধর্ম। কিন্তু দেব তাকে বোঝাল ভারতের একটি স্থানের নাম বঙ্গ। ইকোনমিস্টপত্রিকার একটি সংখ্যায় প্রকাশিত ম্যাপে এর অবস্থান প্রদর্শন করল। মিরান্ডার কাছে পৃথিবীর মানচিত্র বা ম্যাপ-সম্পর্কিত কোনো বই নেই জেনে সে তার অ্যাপার্টমেন্টে পত্রিকার সে-কপিটি নিয়ে আসে। যে-শহরে তার জন্ম দেব তা নির্দিষ্ট করে দেখাল; তার পিতা অন্য যে-শহরে জন্মেছে সেটাও দেখিয়ে দিলো। মানচিত্রে শহরগুলোর মধ্যে একটার চারপাশে বক্স করে দেখানো হয়েছে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। মিরান্ডা যখন প্রশ্ন তোলে বক্সটা কী অর্থ বহন করে, দেব তখন ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে রাখে আর বলে, ‘তোমার চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই’। এ বলে সে কৌতুকছলে তার মাথায় মৃদু আঘাত করে।মিরান্ডার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চলে আসার আগে সে ম্যাগাজিনটা ময়লার সত্মূপে ছুড়ে ফেলে দেয়। একই সঙ্গে নিক্ষেপ করে তার অবস্থানকালীন ধূমপানরত তিনটি সিগারেটের শেষাংশ। মিরান্ডা দেখতে পায়, তার গাড়িটা কমনওয়েলথ অ্যাভিনিউয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। দেব শহরতলি এলাকায় ফিরে যায়, যেখানে সে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছে। ও আসায় মিরান্ডার যেটুকু ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তা সারানোর চেষ্টা করে। ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে সিগারেটের যে-ছাই পড়েছিল তা ঝেড়ে ফেলে সেটাকে বিপরীত দিকে পাকাতে থাকে, যাতে প্রচ্ছদটা সমতল থাকতে পারে। বিছানায় শুয়ে থাকে সে, দেব ও তার মধ্যে শারীরিক ভালোবাসার কারণে পুরো বিছানা দুমড়ে-মুচড়ে এলোমেলো হয়ে আছে। শুয়ে শুয়ে সে বাংলার সীমানাগুলো গভীর মনোযোগ সহকারে দেখে। ওপরে পাহাড় আর নিচে উপসাগর রয়েছে। এ-মানচিত্রের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংক নামের একটা নিবন্ধের সংযোগ দেখা যাচ্ছে। মিরান্ডা পাতা উলটাতে থাকে, আশা করে দেব যে-শহরে জন্মগ্রহণ করেছে তার ছবি দেখতে পাবে; কিন্তু সে শুধু দেখল নকশা আর ঝাঁঝরি। তবু সে এসবের দিকে তাকিয়ে থাকে, দেবের সঙ্গে যে-সময়টা কাটিয়েছে তা নিয়ে ভাবতে থাকে। মাত্র পনেরো মিনিট আগে তার পা-দুটোকে দেব কীভাবে নিজের কাঁধের ওপর ঠেকা দিয়ে রেখেছিল আর হাঁটুদুটো ওরই বুকের কাছে চেপে ধরেছিল। তখন বারবার দেব বলছিল, সে পরিপূর্ণভাবে মিরান্ডাকে পায়নি। সপ্তাহখানেক আগে ফিলেনসে দেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল মিরান্ডার। দুপুরে খাবারের বিরতিতে সেখানে গিয়েছিল। নিচতলায় সুলভমূল্যে পেন্টিহোস কিনে চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে দোকানের মূল অংশে চলে এলো সে, যেখানে কসমেটিক্সের ডিপার্টমেন্টে সাবান, ক্রিম মণিরত্নের মতো সাজানো আছে। আই শ্যাডো আর পাউডারের কৌটোগুলো নিরাপত্তা আয়নার পেছনে আটকে থাকা প্রজাপতির মতো কেঁপে কেঁপে দীপ্তি ছড়াচ্ছে। মিরান্ডা লিপস্টিক ছাড়া অন্য তেমন কিছু কখনো কেনেনি। তবে এই ঘিঞ্জি গোলকধাঁধার পথে হাঁটতে তার বেশ লাগে, বোস্টনের আর কোনো জায়গা এত পরিচিত মনে হয় না। পথের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে করে এগিয়ে যেতে তার ভালোই লাগে, মহিলারা সুগন্ধি-মেশানো কার্ড বাড়িয়ে ধরে, আর একসময় তা বাতাসে নাড়তে থাকে। দু-একদিন পর সে তার কোট-পকেটে ভাঁজ করা কার্ড খুঁজে পায়, সকালের ঠান্ডা হাওয়ায় সুগন্ধি অ্যারোমা চায়ের জন্য সে অপেক্ষা করে, যা তাকে সবসময় উষ্ণ রাখে। সেদিন সুগন্ধি কার্ডগুলোর গন্ধ নেওয়ার জন্য মিরান্ডা একটু দাঁড়াতেই কাউন্টারের সামনে দেখল এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা কাগজের সিস্নপ, সুন্দর মেয়েলি হাতে মোড়ানো মনে হলো। দোকানের বিক্রয়কারিণী কাগজটার দিকে একবার তাকিয়ে ড্রয়ার খুলতে শুরু করে। মহিলা বের করে আনল একটা কালো বাক্সের মধ্যে চারকোনা সাবানের কেক, জল-চিকিৎসার মুখোশ, ছোট টিউবে ভরা জীবকোষ নবায়ন ড্রপস আর মুখের ক্রিমের দুটি শিশি। লোকটার গায়ের রং তামাটে, হাতের আঙুলের গাঁটে কালো চুল। পরনে মরালের মতো ফ্যাকাশে লাল শার্ট, নেভি বস্নু স্যুট, মৃদুভাবে দীপ্তি ছড়ায় এমন চামড়ার বোতামসহ উটের ওভারকোট। পাওনা টাকা মেটানোর জন্য হাতে পড়ে থাকা শূকরের চামড়ার দস্তানা সে খুলে ফেলে। ঢেউ-খেলানো বিলগুলো একটা বড় বারগান্ডি ওয়ালেট থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। তার হাতে বিয়ের কোনো আংটি দেখা গেল না। ‘আপনাকে কী দিতে পারি, প্রিয়ে?’ বিক্রয়কারিণী মিরান্ডাকে প্রশ্ন করে। কচ্ছপের খোলের তৈরি চশমার ওপর দিয়ে মহিলা তার চেহারা পর্যবেক্ষণ করে। মিরান্ডা জানে না সে কী কিনবে। সে কেবল চাচ্ছে লোকটা যেন তার চোখের আড়ালে চলে না যায়। লোকটাও মনে হয় একটু সময় নিচ্ছে, বিক্রয়কারিণীর সঙ্গে অপেক্ষা করছে ওর সঙ্গে কিছু কথা বলার জন্য। মিরান্ডা এবার কিছু বোতলের দিকে চোখ রাখে, কিছু লম্বা আবার কিছু খাটো বোতল – একটা উপবৃত্তাকার ট্রের ওপর এমনভাবে সাজানো যেন একটা পরিবারের লোকজন ছবি তোলার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
‘ক্রিম’, মিরান্ডা অবশেষে উত্তর দেয়।
‘আপনার বয়স কত?’
‘বাইশ।’
বিক্রয়কারিণী মাথা নেড়ে একটা বরফ-ঠান্ডা বোতল খুলল। ‘আপনি যা সচরাচর ব্যবহার করেন তার চেয়ে এটা একটু ভারী মনে হতে পারে। তবে আমি এখনই শুরু করতে বলব। পঁচিশ বছরের মধ্যে সব মুখের ভাঁজ আকার ধারণ করবে, তারপর সেগুলো একে একে প্রতিভাত হতে শুরু করবে।’
বিক্রয়কারিণী যখন মিরান্ডার মুখে ক্রিম আসেত্ম আসেত্ম বুলিয়ে দিচ্ছিল তখনো লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। গলার তলদেশ থেকে শুরু করে ওপরের দিকে দ্রম্নত স্পর্শে ক্রিমটি ঠিকমতো ব্যবহারের পদ্ধতি মিরান্ডাকে যখন বলে দেওয়া হচ্ছে তখন লোকটা লিপস্টিকের ঘূর্ণায়মান তাকটি আরো ঘোরাতে থাকে। সে একটা পাম্প মেশিনের ওপর চাপ দিলে চামড়া মসৃণ করার জেল বেরিয়ে আসে, যা সে দস্তানাবিহীন হাতের পেছন দিকে ঘষতে থাকে। একটা বড় বোতলের মুখ সে খুলে ফেলে, একটু ঝুঁকে ওটার এত কাছাকাছি মুখটা নিয়ে গেল যে, একফোঁটা ক্রিম ছিটকে তার নাকে এসে পড়ল। মিরান্ডা হেসে ওঠে। তবে যখন বিক্রয়কারিণী একটা বড় তুলি নিয়ে তার মুখম-লে বুলিয়ে দিলো, তখন মুখটা কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। ‘এটা হচ্ছে আরক্তিম আভা নম্বর-দুই’ মহিলা বলে, ‘যা আপনাকে কিছু রং উপহার দেবে।’ কাউন্টারের লাইন বরাবর যে কোনাকুনি আয়না আছে তাদের একটাতে নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে মিরান্ডা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মেয়েটার চোখ দুটো রুপালি, গায়ের ত্বক কাগজের মতো বিবর্ণ, এসপ্রেসো সিমের মতো তার কালো আর মসৃণ চুলের বিপরীতে অন্যেরা তাকে সুন্দরী না ভাবলেও আকর্ষণীয় বলতে পারে। তার সরু ডিম আকৃতির মাথা একটা লক্ষণীয় পর্যায়ে উঠে এসেছে। তার আকৃতিও সরু, নাকদুটো এত পাতলা যে, মনে হচ্ছে ক্লিপ দিয়ে সেগুলো ধরে রাখা হয়েছে। এখন তার সারামুখে দীপ্তির আভা, কপোল গোলাপ-রাঙা, ভ্রম্ন-রেখার নিচে ধোঁয়াটে। তার চোখ দুটো দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
লোকটাও একটা আয়নায় তাকাচ্ছিল। দ্রম্নত নাক থেকে ক্রিম মুখে নিল সে। মিরান্ডা ভাবছিল লোকটা কোথা থেকে এসেছে। স্প্যানিশ কিংবা লেবানিজ হতে পারে। যখন লোকটা আর একটা বোতলের মুখ খুলে বিশেষ কাউকে উদ্দেশ না করে বলল – ‘এটার গন্ধ আনারসের মতো লাগছে’ – তখন তার কথার স্বরভঙ্গি সম্পর্কে একটা ধারণা খুঁজে পেল সে।
‘আজকের জন্য আপনার আর কিছু লাগবে?’ মিরান্ডার ক্রেডিট কার্ডটা হাতে নিতে নিতে বিক্রয়কারিণী প্রশ্ন করে।
‘না, ধন্যবাদ।’
ভদ্রমহিলা ক্রিমের কৌটাটা লাল টিস্যুর অনেকগুলো প্রলেপ দিয়ে জড়িয়ে ফেলল। ‘এ-ক্রিমটি নিয়ে আপনি খুবই আনন্দে থাকবেন।’ রসিদে স্বাক্ষর করার সময় মিরান্ডার হাত কেমন যেন কাঁপছিল। লোকটি একটুও নড়ল না। ‘আমি আমাদের নতুন সংযোজিত আইজেলের নমুনার কথা বলছিলাম’, বিক্রয়কারিণী একটা ছোট শপিং ব্যাগ মিরান্ডার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল। কাউন্টারের পাশ দিয়ে ওর ক্রেডিট কার্ডটা পার করে দেওয়ার সময় সে কাউন্টারে একবার তাকাল, ‘বিদায় মিরান্ডা।’
মিরান্ডা হাঁটতে থাকে। প্রথমে সে দ্রম্নত পা চালায়। তারপর ডাউনটাউন ক্রসিংয়ে যাওয়ার রাস্তাগুলো দেখে হাঁটার গতি কমিয়ে দেয়।
‘আপনার নামের প্রথম অংশ ভারতীয়’ মিরান্ডার সঙ্গে পা চালিয়ে যেতে যেতে লোকটা বলে। একটা গোলাকার টেবিলের সামনে মিরান্ডা দাঁড়িয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে লোকটাও, যাতে সত্মূপ করে রাখা আছে সোয়েটার, পাশে বেষ্টনীর মতো পাইন গাছের মোচাকার ফল, মখমলে টাই। ‘মিরান্ডা?’
‘মিরা! আমার এক মাসি আছে, নাম মিরা।’
লোকটার নাম দেব। ওই পথের পেছনে একটা বিনিয়োগ ব্যাংকে কাজ করে। সাউথ স্টেশনের দিকে মাথা ঘুরিয়ে সে জানাল। এই প্রথম গোঁফওয়ালা একজনকে মিরান্ডা দেখতে পেল, যে সুদর্শনও বটে।
পার্ক স্ট্রিট স্টেশন পর্যন্ত তারা একসঙ্গে হাঁটতে থাকল। শামিয়ানা টানা ছোট দোকানগুলো যেখানে সস্তা বেল্ট, হাতব্যাগ দেদার বিক্রি হচ্ছে, সেসব পার হলো। জানুয়ারি মাসে প্রচ- বাতাসের ঝাপটা মিরান্ডার চুলের একপাশটা এলোমেলো করে দিলো। যখন সে তার নিজের কোটের পকেট থেকে একটা টোকেন তুলে আনতে গেল তখনই দেবের শপিং ব্যাগের ওপর চোখ আটকে গেল – ‘এসব কি সেই মহিলার জন্য?’
‘কে?’
‘আপনার মাসি মিরা?’
‘এগুলো আমার স্ত্রীর জন্য’, মিরান্ডার দিকে তাকিয়ে সে ধীরে ধীরে শব্দগুলো উচ্চারণ করল, ‘সে কয়েক সপ্তাহের জন্য ভারত যাচ্ছে।’ চোখদুটো ঘুরিয়ে সে বলে, ‘এসব জিনিসের প্রতি তার আসক্তি বেশি।’
স্ত্রী না থাকার কারণেই হয়তো তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। প্রথমদিকে দেব আর মিরান্ডা প্রায় প্রতি রাতই একসঙ্গে কাটাত। সে বোঝাত, মিরান্ডার ঘরে সারারাত সে থাকতে পারবে না। কারণ তার স্ত্রী প্রতিদিন সকাল ছয়টায় ভারত থেকে ফোন করে যখন ওখানে বিকেল চারটা। আর তাই সে রাত দুটা, তিনটা কিংবা দেরি হলে চারটায় মিরান্ডার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে গাড়ি চালিয়ে নিজের বাসায় চলে আসে। দিনের বেলায় সে মিরান্ডাকে নিজের কর্মস্থল থেকে কিংবা সেলফোন থেকে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় ফোন করে। যখনই সে তার শিডিউলটা জেনে যায়, তখনই প্রতিদিন সাড়ে পাঁচটায় সেলফোন থেকে একটা খুদে বার্তা পাঠিয়ে দেয়। ততক্ষণে মিরান্ডার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফেরার সময় হয়ে যায়। নিজের ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে মিরান্ডা তার গলার শব্দ শুনতে পারে। ‘আমি তোমার কথা ভাবছি’, নিজের টেপ থেকে দেব বলে, ‘আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।’ সে আরো বলে, এ অ্যাপার্টমেন্টে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে। অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘরের কাউন্টারটা রুটির বাক্সের চেয়ে বড় নয়, খসখসে মেঝের অংশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে আর লবিতে একটা ঘণ্টাধ্বনি আছে, ওটাতে সে যখন চাপ দেয় একটা বিরক্তিকর শব্দ শোনা যায়। মিরান্ডার বোস্টনে চলে আসার বিষয়টা সে মুগ্ধভাবে প্রশংসা করে। এখানে সে কাউকে চেনে না। সে আগে মিশিগানে ছিল, সেখানেই বড় হয়েছে। কলেজে পড়েছে। তবে মিরান্ডা যখন জানাল এখানে প্রশংসা করার কিছু নেই, সে নির্দিষ্ট কারণেই বোস্টন এসেছে তখন দেব মাথা নাড়ে। ‘আমি জানি, একা থাকতে কেমন লাগে’, হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে দেব বলে। সে-মুহূর্তে মিরান্ডার মনে হলো দেব তাকে বুঝতে পেরেছে; বুঝেছে সাবওয়েতে কয়েক রাত কাটানোর পর মিরিন্ডার কেমন লেগেছে, তার নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে এমন ছবি দেখা কিংবা ম্যাগাজিন পড়ার জন্য বইয়ের দোকানে যাওয়া, কিংবা লক্ষ্মীর সঙ্গে হালকা পানীয় পান করা, যে সবসময় এক-দুঘণ্টার মধ্যে অ্যালওয়াইফ স্টেশনে তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রস্ত্তত থাকে। যখন তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত থাকে না, তখন দেব তাকে বলে মাথা, হাত-পা ছাড়া তার শরীরের চেয়ে লম্বা পা-দুটোকে সে খুব পছন্দ করেছে। ঘরের একটা রুমে মিরান্ডা নগ্ন হয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় প্রথমবার সে বিষয়টি লক্ষ করেছে। ‘তুমিই প্রথম’, দেব বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রশংসা করে বলে – ‘প্রথম মহিলা দেখেছি, যার পা-দুটো এত লম্বা।’
দেবই প্রথম এ-কথা তাকে বলেছে। কলেজের ছেলেরা যাদের সঙ্গে তার প্রায়ই দেখা হতো তারাও কোনোদিন বলেনি। তারা তো তার চেয়ে একটু দীর্ঘকায় ছিল, স্কুলের ছেলেদের চেয়ে একটু লম্বা ভারিক্কি তো হবেই। দেব হচ্ছে প্রথম, যে সবসময় কোনো কিছুর জন্য মূল্য দিতে পারে, নিজের সব দরজা খোলা রাখে আর রেসেত্মারাঁয় টেবিলের অপর প্রান্তে গিয়ে মিরান্ডার হাতে চুমু খায়। সে-ই প্রথম, যে মিরান্ডার জন্য ইয়া বড় একটা ফুলের তোড়া এনেছিল, যা সে ছয়টি পানির গস্নাসে ভাগ করে সাজিয়েছিল। ওই প্রথম যে তাদের ভালোবাসাবাসির সময় বারবার তার কানে নাম ধরে ডেকেছিল। দেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মিরান্ডা ইচ্ছা প্রকাশ করল তার ও দেবের ছবি শয়নকক্ষের পার্টিশন করা ভেতরের অংশের ওপর টানিয়ে রাখবে, যেখানে তাজমহলের সামনে তোলা লক্ষ্মী ও তার স্বামীর ছবি রয়েছে। লক্ষ্মীকে সে দেব সম্পর্কে কিছু বলেনি। কাউকেই না। তার মন বলছিল, ওকে বলা যায় কারণ সে ভারতীয়। কিন্তু লক্ষ্মী এ কদিন তার মামাত বোনের সঙ্গে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল। ও এখনো শুয়ে আছে, তার স্বামী লন্ডনে এবং তার ছেলে এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। ‘তোমার কিছু মুখে দেওয়া উচিত’ – লক্ষ্মী কাতর স্বরে মামাত বোনকে বলে, ‘এভাবে স্বাস্থ্য নষ্ট করা ঠিক নয়।’ যখন মামাত বোনের সঙ্গে তার কথা হয় না তখন স্বামীর সঙ্গে কথা বলে, সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতায় রাতের খাবারে মুরগি নাকি ভেড়া থাকবে, এ-বিষয়ে তর্ক জুড়ে দিয়ে কথা শেষ করে। ‘আমি দুঃখিত’, একপর্যায়ে তার ভুল স্বীকারের বিষয়টি মিরান্ডা শুনতে পায়, ‘পুরো ব্যাপারটাই আমার মাথাটাকে একেবারে গুলিয়ে দিলো।’
মিরান্ডা আর দেব কোনো তর্কে লিপ্ত হলো না। তারা নিকেল অডিঅনে ছবি দেখতে গেল আর সারাক্ষণ দুজন চুমু খেতে ব্যস্ত ছিল। ডেভিস স্কয়ারে পোর্কের ছোট টুকরো আর ভুট্টার রুটি খেল। একটা কাগজের রুমাল দেবের শার্টের কলারে গলাবন্ধনীর মতো ঝুলে আছে। একটা স্প্যানিশ রেসেত্মারাঁর বারে তারা সানগ্রিয়া পান করছিল, তাদের আলোচনার টেবিলে মাথার ওপর দন্ত বিকশিত একটা শূকরের মাথা কর্তৃত্ব নিয়ে অধিষ্ঠান করছে। এমএফএ-তে গিয়ে মিরান্ডার শয়নকক্ষের জন্য শাপলা ফুলের একটা পোস্টার সংগ্রহ করল। এক শনিবার সিম্ফনি হলে বিকেলের কনসার্ট উপভোগের পর দেব তাকে এ-শহরে তার সবচেয়ে প্রিয় স্থান ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স সেন্টারে ম্যাপারিয়ামে নিয়ে গেল। সেখানে উজ্জ্বল রঞ্জিত কাচের প্যানেলে তৈরি কক্ষের ভেতর তারা দাঁড়িয়েছিল, যা আকারে অনেকটা একটা গেস্নাবের ভেতরের অংশের মতো হলেও দেখতে বাইরের আকৃতির মতো প্রতিভাত হয়। কক্ষটির ঠিক মাঝখানে একটা স্বচ্ছ সেতু রয়েছে আর তাই তাদের মনে হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুতে তারা দাঁড়িয়ে আছে। দেব ভারতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল, সেটা সেখানে লাল রঙে চিহ্নিত আছে, যা ইকোনমিস্ট পত্রিকায় ছাপানো ম্যাপের চেয়ে অনেক বেশি বিশদভাবে দেখানো হয়েছে। সে ব্যাখ্যা করল, সিয়াম আর ইতালিয়ান সোমালিল্যান্ডের মতো অনেক দেশের এখন আর অসিত্মত্ব নেই; বর্তমানে তাদের অনেকের নামও বদলে গেছে। ময়ূরের বুকের মতো নীল সমুদ্র দুধরনের রঙের বিভা নিয়ে হাজির হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর দাগ সে দেখিয়েছে মিরান্ডাকে, মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের ওপরে দাগটা প্রায় সাত মাইল গভীর। তারা সেতুর ওপর উঁকি মেরে দেখে দ্বীপবহুল সমুদ্র অ্যান্টার্কটিকা তাদের পায়ের কাছে পড়ে আছে, একসময় তাদের ঘাড় ধরে তুলে নিয়েছে আর দেখে একটা প্রচ- বৃহৎ ধাতুনির্মিত তারা ওপরে জ্বলজ্বল করছে। দেব যখন কথা বলছিল, তার গলার শব্দ কাচের কাছে গিয়ে চরমভাবে ফিরে আসছে, কখনো উচ্চৈঃস্বরে, কখনো আবার মৃদুভাবে। কখনো মনে হবে মিরান্ডার বুকে এসে তা নামছে, আবার কখনো কৌশলে তা তার শ্রবণশক্তিকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলে। যখন ট্যুরিস্টদের একটা গ্রম্নপ সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে যায়, মিরান্ডা শুনতে পায় তারা যেন মাইক্রোফোনের মাধ্যমে তাদের গলা পরিষ্কার করছে। দেব তখন ব্যাখ্যা করল যে, এটা শ্রবণবিজ্ঞানের কারণে হচ্ছে।
মিরান্ডা এবার ম্যাপে লন্ডনের অবস্থান খুঁজে পেল, যেখানে লক্ষ্মীর মামাত বোনের স্বামী বাস করেন; সঙ্গে সেই মহিলা থাকে, যাকে সে পেস্ননে দেখেছে। দেবের স্ত্রী ভারতের কোন শহরে থাকে কে জানে! ছোটকালে সে সুদূর বাহামায় ছিল। অনেক খুঁজল, কিন্তু কাচের প্যানেলে সে নাম পাওয়া গেল না। ট্যুরিস্টরা চলে গেলে সে আর দেব আবার একা হয়ে যায়। দেব তাকে সেতুর এক প্রান্তে দাঁড়াতে বলে। তারা দুজন দুদিকে প্রায় ত্রিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও দেব বলে, তারা একে অন্যের ফিসফিসানি শুনতে পাবে।
‘আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না’, মিরান্ডা বলল। এখানে ঢোকার পর এই প্রথম সে মুখ খুলল। সে অনুভব করে যেন তার কানে অনেকগুলো স্পিকার দৃঢ়ভাবে লাগানো আছে।
‘এগিয়ে যাও’ সেতুর ওপর পেছনে যেতে যেতে দেব বলে ওঠে। তার কণ্ঠস্বর হঠাৎ ফিসফিসানিতে রূপ নেয়। ‘কিছু বলো।’ মিরান্ডা খেয়াল করল দেবের ঠোঁট দুটো শব্দ তৈরি করছে, একই সঙ্গে সে সেসব এত পরিষ্কার শুনল যে, যেন সে তার ত্বকের নিচে তার শীতের কোটের তলায় অনুভব করতে পারছে। এত কাছে এবং এত উষ্ণতায় ভরা যে, সে-কথায় সে নিজের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা অনুভব করল।
‘ওহে’, মিরান্ডা ফিসফিস করল। সে নিশ্চিত নয় আর কী বলা যাবে।
‘তুমি সেক্সি’, দেব ফিসফিস করে উত্তর দেয়।
পরের সপ্তাহে কর্মস্থলে লক্ষ্মী মিরান্ডাকে বলে এটা প্রথমবার নয় যে, তার মামাত বোনের স্বামী একটা অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, স্বামীর মনের ভেতর শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার সুযোগ সে দেবে, অফিস থেকে বেরোনোর জন্য যখন তারা তৈরি হচ্ছিল তখন লক্ষ্মী কথাগুলো বলে। সে বলেছে, ‘এ-চিন্তা এসেছে ছেলেটার জন্য। তাদের সন্তানের জন্য সে তাকে ক্ষমা করতে রাজি আছে।’ লক্ষ্মী তার কম্পিউটার বন্ধ করার সময় মিরান্ডা অপেক্ষা করে। ‘সে হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে আসবে আর মহিলা সুড়সুড় করে তাকে মেনে নেবে’ – মাথা নেড়ে লক্ষ্মী কথাগুলো বলে।
‘আমার বেলায় তা হবে না। যদি আমার স্বামী অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকায় আমি সব বন্ধন পালটে ফেলব। তার শোয়ার ঘরে যেসব ছবি আটকানো আছে সেগুলো নিয়ে রীতিমতো চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছে। লক্ষ্মীর স্বামী তার হাতটা স্ত্রীর কাঁধে ছড়িয়ে রেখেছে, তার হাঁটুদুটো স্ত্রীর দিকেই ঝুঁকে আছে। এবার সে মিরিন্ডার দিকে তাকাল – ‘তুমি কি তাই করতে না?’
মিরান্ডা মাথা নাড়ে। পরের দিন দেবের স্ত্রী ভারত থেকে ফিরে আসছে। সেদিন বিকেলে সে মিরান্ডাকে কাজের মাঝখানে ফোন করেছে। জানিয়েছে, স্ত্রীকে আনার জন্য তাকে এয়ারপোর্ট যেতে হবে। বারবার বলল সময় পেলে তাকে ফোন করবে সে।
‘তাজমহল দেখতে কেমন?’ লক্ষ্মীকে প্রশ্ন করে মিরান্ডা।
‘পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে রোমান্টিক স্থান’, স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে লক্ষ্মীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ‘ভালোবাসার এক চিরস্থায়ী সৌধ।’
দেব যখন এয়ারপোর্টে মিরান্ডা তখন বাড়ির গৃহিণীর প্রয়োজন এমন সব জিনিসপত্র কেনার জন্য ফিলেন বেসমেন্টে চলে এসেছে। সে একজোড়া কালো হাইহিল জুতো খুঁজে পেল যার বগলস একটা শিশুর দাঁতের চেয়েও ছোট। অর্ধবৃত্তাকার খোলা আকারে কাটা একটা বোতামহীন জামা আর হাঁটুসমান লম্বা আঙরাখা পোশাকও সে খুঁজে বের করেছে। কাজে বের হলে সাধারণত যে-ধরনের নাইলনের টাইটস পরে, সেটার পরিবর্তে যে প্রান্তদেশ একত্রে সেলাই করে জুড়ে দেওয়া পুরোদস্ত্তর মোজাও সে খুঁজে পেয়েছে। পুরো সত্মূপের ভেতর সে খুঁজে বেড়ায়, তাকের পর তাক হেঁটে হেঁটে দেখে, আলনার পর আলনা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত বের করল রুপালি উপাদানে তৈরি একটা পাঁচমিশালি পোশাক, যা তার চোখের সঙ্গে সুন্দর মানিয়ে যায়। বাজার করতে করতে দেবের কথা মনে পড়ে, আর ভাবে, ম্যাপারিয়ামে ও তাকে কী বলেছে। দেবই সেই পুরুষ, যে প্রথমবার তাকে সেক্সি বলেছে। চোখদুটো বন্ধ করলেই সে এখনো তার ফিসফিস কথাগুলো ত্বকের নিচে অনুভব করতে পারে, যা তার সারাশরীরে শিহরণ জাগায়। কাপড় ট্রায়াল দেওয়ার রুমটা বেশ বড়, এর চারদিকে দেয়ালে আয়না। সেখানে মিরান্ডা একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখল, যার মুখ উজ্জ্বল আর হিমেল চুলগুলো অনেকটা রুক্ষ। মহিলা অন্তর্বাস পরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে আর পায়ের কাছে যে কালো কাপড়ের জাল শক্ত করে বাঁধা আছে তা আঙুলের ভেতর দিয়ে ওপরে টানছে।
‘সবসময় খেয়াল রাখবে অপ্রত্যাশিত বাধা আছে কিনা।’ ভদ্রমহিলা উপদেশ দেয় মিরান্ডাকে। মিরান্ডা এবার অর্ধবৃত্তাকারে কাটা-খোলা বোতামবিহীন জামাটি টেনে তুলে নিয়ে তা বুকের কাছ ধরে রাখে।
বয়স্ক মহিলাটি তার কথার স্বীকৃতি মিলেছে এমন ভাব নিয়ে মাথা নাড়ে – ‘ঠিক তাই।’
‘তাহলে এটার কী হবে?’ এই বলে মিরান্ডা রুপালি পাঁচমিশালি পোশাকটা ওপরে তুলে ধরে। ‘অবশ্যই’; মহিলা বলে, ‘সে চাইবে তোমার শরীর থেকে সঙ্গে সঙ্গে টেনেছিঁড়ে ফেলতে।’
মিরান্ডা ছবির মতো কল্পনা করতে থাকে। সাউথ এন্ডে একটা রেঁসেত্মারায় তারা দুজন বসে আছে, দেব হাঁসের যকৃত আর শ্যাম্পেন ও রাস্পবেরি ফলের স্যুপের অর্ডার দিয়েছে। সে নিজে তার পাঁচমিশালি পোশাক পরে আছে আর দেব তার স্যুট পরে টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে তার হাতে চুমু খাচ্ছে। পরের বার তাদের শেষ দেখার কয়েকদিন পর রোববার বিকেলবেলা দেব তাকে দেখতে আসে। ওর পরনে তখন ব্যায়ামের পোশাক। স্ত্রীর ফিরে আসার পর ওই অজুহাতেই রোববারগুলোতে সে গাড়ি নিয়ে বোস্টনে চলে আসত, অনেকটা দৌড়াতে দৌড়াতে চার্লসে এসে হাজির হতো। প্রথম রোববার মিরান্ডা আজানুলম্বিত পোশাক পরে দরজা খুলে দিলো। দেব তার পোশাকের দিকে খেয়ালই করেনি। ওকে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে গেল। তুলার পাজামা আর টেনিস খেলার জুতো পায়ে রেখেই কোনো কথা না বলে সে ওর ভেতর প্রবেশ করল। পরে সে চুপিসারে অন্য কক্ষ থেকে ওর সিগারেটের ছাই রাখার জন্য একটা ছোট পেস্নট আনতে গেল। তখন দেব অভিযোগ করল, মিরান্ডা তার লম্বা পা তাকে দেখানো থেকে বঞ্চিত করেছে। বলল ওটা খুলে ফেলতে। তাই পরের রোববার মিরান্ডা আর এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করল না। সে জিন্স পরে থাকল। ড্রয়ারের শেষ মাথায় মোজা আর প্রতিদিনের নিম্নাঙ্গের কাপড়চোপড় যেখানে রাখে, সেখানেই অন্তর্বাসটা রেখে দিলো। রুপালি সেই পাঁচমিশালি পোশাকটা তার ছোট রুমে ঝুলিয়ে রাখল, যার ফিতার প্রান্ত নিচে একত্রে সেলাই করা জায়গা থেকে ঝুলছে। প্রায়শই সকালবেলা ড্রেসটা মেঝেতে সত্মূপের মধ্যে পড়ে থাকে, চেইনের ফিতা প্রায় সবসময়ই ধাতব হ্যাঙ্গার থেকে ছিটকে সরে যায়।
তবু মিরান্ডা রোববারগুলোর জন্য অপেক্ষা করে। ওইদিন সকালে সে খাবারের দোকানে যায়, এক ধরনের বগেট রুটি আর দেব পছন্দ করে এমনসব খাবার যেমন জারিত সামুদ্রিক মাছ, আলুর সালাদ, পাস্তার জন্য ডিমের তৈরি ঘন সমৃদ্ধ কেক, আর নরম ক্রিমযুক্ত ইতালিয়ান পনির কেনে। বিছানায় শুয়ে শুয়েই তারা সেসব খেতে থাকে, আঙুল দিয়ে সামুদ্রিক মাছ তুলে নেয়। মিরান্ডাকে দেব তার শৈশবের গল্প শোনায়, কখন সে স্কুল থেকে ফিরে আমের শরবত খেত, যা একটা ট্রেতে হাজির করা হতো। তারপর সে লেকের ধারে ক্রিকেট খেলতে যেত, যেখানে সবাই সাদা পোশাক পরত। সে আরো বলে, আঠারো বছর বয়সে জরুরি অবস্থার সময় নিউইয়র্কের উত্তরাঞ্চলে তাকে একটা কলেজে পাঠানো হয়েছিল। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করলেও কীভাবে ছবিতে আমেরিকান উচ্চারণ অনুসরণ করার জন্য তার এত বছর সময় লেগেছে। যখন সে এসব বলছিল, তিন তিনটি সিগারেট সে সাবাড় করল আর সেগুলোর অবশিষ্টাংশ বিছানার পাশের পেস্নটে পিষে রেখে দিলো। মাঝে মাঝে সে মিরান্ডাকে প্রশ্ন করে, তার কজন প্রেমিক আছে (তিনজন), প্রথম প্রেমের সময় তার বয়স কত ছিল (উনিশ)। দুপুরের খাবারের পর তারা নরম তুলতুলে চাদরের ওপর ভালোবাসাবাসি করত। তারপর বারো মিনিটের জন্য দেব একটা হালকা ঘুম দিত। কোনো পূর্ণবয়স্ক লোকের হালকা ঘুমানোর বিষয়টি মিরান্ডার কখনো জানা ছিল না, তবে দেব জানাল ভারতে থাকতেই তার এ-অভ্যাসটা হয়েছে। সেখানে এত গরম পড়ত যে, মানুষ সূর্য না ডোবা পর্যন্ত ঘর ছেড়ে বের হতো না। তাছাড়া এটা আমাদের একত্রে ঘুমানোর সুযোগ করে দেয়, তার হাতটা একটা বড় ব্রেসলেটের মতো মিরান্ডার শরীরের চারপাশে বেড় দিয়ে ধরে হাসিঠাট্টার ছলে বিড়বিড় করে কথাটা বলে।
মিরান্ডা কখনো ঘুমিয়ে পড়ে না। বিছানার পাশে যে-ঘড়িটা আছে সেটা লক্ষ করে, দেবের আঙুলগুলোতে নিজের মুখ চেপে রাখে। ওর প্রতিটি আঙুলের গাঁটে প্রায় অর্ধডজন চুল গজিয়েছে, যা সে নিজের আঙুলে পেঁচাতে থাকে। ছয় মিনিট পর সে দেবের দিকে ঘুরে তার মুখোমুখি হয়, হাই তুলে আর আড়মোড়া ভেঙে দেখে দেব আসলে ঘুমাচ্ছে কিনা। তবে সে সবসময় এভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন সে নিশ্বাস নিচ্ছিল তখন তার চামড়ার ভেতর থেকে কণ্ঠহাড় পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে, তার পেটটা আসেত্ম আসেত্ম স্ফীত হচ্ছে। তার কাঁধে বেশ কিছু চুল গজিয়েছে বলে অনুযোগ করলেও মিরান্ডা ভাবে, ও ঠিকই আছে, অন্য কিছু ভাবার কোনো কারণ নেই।
ঠিক বারো মিনিট পর দেব চোখ খুলবে, যেন মনে হয় সে আগাগোড়াই জেগে ছিল। ওর দিকে হাসিহাসি মুখে তাকাল। পরিপূর্ণ আনন্দ মিরান্ডা অনুভব করে। ‘পুরো সপ্তাহে এই বারো মিনিটই শ্রেষ্ঠ।’ একটা হাত মিরান্ডার শরীরের পেছনে স্পর্শ করে সে হাই তোলে। তারপর দেব লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে তুলার পাজামাটা ওপরে টেনে নিয়ে টেনিস খেলার জুতোর ফিতা বেঁধে নিল। সে এখন বাথরুমে যাবে আর তর্জনীর আঙুল দিয়ে দাঁত মাজবে। মিরান্ডাকে সে বলেছে মুখে সিগারেটের গন্ধ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভারতীয়রা জানে কীভাবে ব্রাশ করতে হয়। সে যখন দেবকে বিদায়ী চুমু দিলো, তখনই তার চুল থেকে কিছু একটা গন্ধ পেল। কিন্তু সে জানে দেব একটা কৈফিয়ত দাঁড় করাবে, বলবে বিকেলে সে জগিং করে সময় কাটিয়েছে, বাসায় গিয়ে প্রথমেই গায়ে পানি ঢালার জন্য অনুমতি চাইবে।
ভারতীয়দের মধ্যে লক্ষ্মী আর দেব ছাড়া মিরান্ডা অন্য যাদের চেনে তারা হচ্ছে প্রতিবেশী দিক্ষিত পরিবার, যেখানে সে বড় হয়েছে। মিরান্ডাসহ প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের হাসিঠাট্টার খোরাক হিসেবে মি. দিক্ষিত প্রতিদিন বিকেলে শার্ট-পাজামা পরে অাঁকাবাঁকা পথ ধরে জগিং করতে থাকে। অ্যাথলেটিক অ্যাপারেল থেকে বিশেষ সুবিধা হিসেবে সে এক জোড়া সস্তা কেডস পেয়েছে। প্রতি সপ্তাহে পুরো পরিবার মানে মা, বাবা, দুই ছেলেমেয়ে গাদাগাদি করে তাদের গাড়িতে চড়ে অনেক দূরে চলে যায় – কোথায় যায় কেউ জানে না।
বিভিন্ন বাড়ির পিতারা অভিযোগ আনে, মি. দিক্ষিত তার লনে ঠিকমতো সার দেয় না, তার জায়গায় যেসব পাতা পড়ে থাকে তা ঠিক সময় অপসারণ করে পরিষ্কার করা হয় না; সবাই জেনে গেছে, দিক্ষিত বাড়ি প্রতিবেশীদের সবরকম আনন্দ থেকে আলাদা হয়ে আছে। মায়েরা কখনো মিসেস দিক্ষিতকে আর্মস্ট্রং সুইমিংপুলে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। রাস্তার এক পাশে বাসের জন্য দিক্ষিত পরিবারের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অন্য ছেলেমেয়েরা চাপা গলায় বলে, দিক্ষিত, দিগশিট। তারপর হাসিতে ফেটে পড়ে।
সেবার কোনো এক বছরে দিক্ষিত পরিবারের মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে প্রতিবেশী ছেলেমেয়েদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। মিরান্ডার মনে পড়ে সারাবাড়িতে ধূপ-ধুনার সৌরভ আর পেঁয়াজের ঝাঁঝালো গন্ধ। সামনের দরজার পাশে জুতোর সত্মূপ। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা মনে পড়ছে, সেটা হলো একটা বালিশের আবরণসদৃশ আকারের একটা কাঠামো, যা সিঁড়ির একেবারে নিচের অংশে দুদিকে ছুঁচালো মুখওয়ালা পিনের সহায়তায় ঝুলে আছে। ওটা একজন মহিলার নগ্ন ছবি, যার মুখটা নাইটের বর্মের মতো লাল। তার বিশাল সাদা চোখদুটো ললাটের পাশে কাত হয়ে তাকিয়ে আছে, চোখের মণির মধ্যে অনেকগুলো বিন্দু। একই বিন্দু দিয়ে ছবির কেন্দ্রে দুটি বৃত্ত মহিলার স্তনকে ইঙ্গিত করছে। একহাতে সে একটা খঞ্জর ঘোরাচ্ছে, মাটিতে কষ্ট পাচ্ছে এমন একজন লোককে সে পায়ে চেপে ধরেছে। তার শরীরের চারপাশে রক্তমাখা মাথা দিয়ে তৈরি ভুট্টার শেকলের মতো একটা হার ঝুলছে। তার জিহবা যেন মিরান্ডার দিকে তাক করে আছে।
‘এটা হচ্ছে দেবী কালী’, মিসেস দিক্ষিত আনন্দের সঙ্গে ব্যাখ্যা করতে থাকে। ছবিটিকে খাড়া করে রাখার জন্য এর সঙ্গে থাকা পিনটা একটু সরিয়ে দিলো। মিসেস দিক্ষিতের হাতদুটো মেহেদির রঙে রঞ্জিত – অাঁকাবাঁকা সর্পিল পথ আর তারায় খচিত একটা জটিল কারুকার্যময় নকশা তাতে। ‘দয়া করে আসুন। কেক কাটার সময় হয়েছে।’
মিরান্ডার বয়স তখন নয় বছর। ছবিটি দেখে সে এত ভয় পেয়েছে যে, কেক খেতে পারল না। তার ভয়ের মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে, পরবর্তী মাসের পর মাস রাস্তার যে পাশে দিক্ষিত বাড়ি সে-পাশ ধরে হাঁটাই সে বন্ধ করে দিলো। অথচ আগে দিনে দুবার ওপথ অতিক্রম করত – একবার বাসস্টপে যাওয়ার জন্য, আবার বাড়িতে ফিরে আসার সময়। স্কুলবাস যখন একটা কবরস্থান অতিক্রম করে, তখন সে পরবর্তী উন্মুক্ত স্থানে না পৌঁছা পর্যন্ত ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে রাখে।
এসব স্মৃতি এখন তাকে লজ্জা দেয়। সে আর দেব যখন ভালোবাসায় মত্ত থাকে, মিরান্ডা চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে, চোখের সামনে ভাসে মরুভূমি আর হাতির সারি, দেখে পূর্ণচন্দ্রের নিচে মর্মর পাথরের কারুকার্যময় ভবন হ্রদের ওপর ভাসছে। একদিন শনিবার, যখন কিছুই করার ছিল না, সে সেন্ট্রাল স্কয়ার পর্যন্ত পুরোটা হাঁটল, একটা ভারতীয় রেসেত্মারাঁয় গিয়ে এক পেস্নট তন্দুরি চিকেন অর্ডার দিলো। খেতে খেতে সে মেন্যুর নিচে ছাপানো লেখা ‘সুস্বাদু’, ‘পানি’ আর ‘দয়া করে পরীক্ষা করুন’ – এ ধরনের শব্দসমষ্টি মুখস্থ করার চেষ্টা করল। শব্দগুলো তার স্মৃতিতে ধরা দিলো না। আর তাই মাঝে মাঝে ক্যানমোর স্কয়ারের বইয়ের দোকানে বিদেশি ভাষা সেকশনে সে দাঁড়িয়ে পড়ে, আর ‘নিজে নিজে শিখো সিরিজে’ বাংলা বর্ণমালা অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করে। একবার সে নিজের নামের ভারতীয় অংশ ‘মিরা’কে তার ব্যক্তিগত ফিলোফ্যাক্সে দেখে দেখে লেখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তার হাত অপরিচিত গন্তব্যে চলে যেতে চায়, আবার কখনো থামে কিংবা ঘুরে যায়। সে না চাইলেও কলম উঠে আসে। বইয়ের মধ্যে যেসব তীর চিহ্ন রয়েছে তা অনুসরণ করে সে বাঁ থেকে ডানে একটা লম্বা রেখা টেনে দেয়, যেখান থেকে অক্ষরগুলো ঝুলতে থাকে। ওগুলোর মধ্যে একটা অক্ষরের চেয়ে সংখ্যা হিসেবেই বেশি প্রতিভাত হয়েছে। অন্য একটিকে ওর পাশে ত্রিকোনাকৃতির মতো দেখাচ্ছে। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর তার নামের অক্ষরগুলোকে বইয়ের নমুনা অক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পেরেছে। তথাপি সে নিশ্চিত নয়, তার নাম মিরা না মারা লিখেছে। এটা তার কাছে খারাপ বা অসতর্ক হস্তাক্ষর বলে মনে হলো। কিন্তু সে বেদনার সঙ্গে উপলব্ধি করল, এ-পৃথিবীর কোথাও এর কোনো মর্মার্থ রয়েছে।
সপ্তাহটা ততো খারাপ যাচ্ছিল না। কাজের মধ্যে ডুবে থেকে মিরান্ডা আর লক্ষ্মী একটা নতুন রেসেত্মারাঁয় দুপুরের খাবার খেল। এ-সময় লক্ষ্মী তার মামাত বোনের বিয়ের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে তাকে জানাল। মাঝেমধ্যে মিরান্ডা চেষ্টা করল আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করতে। কলেজজীবনে সে আর তার ছেলেবন্ধুর পিঠা হাউসের ভিড় থেকে খাবারের দাম না দিয়ে বেরিয়ে আসা যায় কিনা তা বোঝার যে-অনুভূতি জন্মেছিল, লক্ষ্মীর কথায় সেরকমই অনুভব করল। তবে লক্ষ্মী আর কিছু বলেনি। আমি যদি তার জায়গায় থাকতাম, সরাসরি লন্ডনে উড়ে গিয়ে ওদের দুজনকে গুলি করে মেরে ফেলতাম, সে একদিন কথাগুলো উচ্চারণ করেছিল। সে এবার ঝট করে একটা পুরির অর্ধেক কামড় দিয়ে তা চাটনির মধ্যে ডুবিয়ে নিল। ‘আমি বুঝতে পারি না, সে এভাবে কী করে অপেক্ষা করছে।’
মিরান্ডা অপেক্ষা করতে জানে। বিকেলে ডাইনিং টেবিলে বসে আহার সারল, তার নখগুলোতে স্বচ্ছ নখ পালিশের প্রলেপ লাগাল। সালাদের পাত্র থেকে সরাসরি কিছু সালাদ নিয়ে মুখে পুরে দিলো। টেলিভিশন দেখল আর রোববারের জন্য অপেক্ষায় থাকল। শনিবারগুলো মনে হলো বড়ই বিশ্রী, কারণ সেদিন আসলেই মনে হয়েছে রোববার আর কখনো আসবে না। এক শনিবার বেশ রাতে দেব ফোন করল। মিরান্ডার কানে বাজল অনেক লোক ওর পেছনে হাসছে, কথা বলছে। তাই সে জানতে চাইল ও কোনো কনসার্ট হল থেকে কথা বলছে কিনা; কিন্তু দেব শহরের উপকণ্ঠে তার বাড়ি থেকে ফোন করেছে। ‘আমি তোমাকে ভালো শুনছি না’ – দেব বলে, ‘আমাদের বাড়িতে অতিথি আছে, আমাকে কি তুমি মিস করছ?’ মিরান্ডা টেলিভিশনের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকে, একটা ধারাবাহিক কমেডি অনুষ্ঠান চলছে, ফোন বাজার পরপর সে রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে শব্দকে মৌনতার পর্যায়ে রেখে দেয়। সে কল্পনা করছে দেব বাড়ির ওপরের রুম থেকে মোবাইল ফোনে ফিসফিস করে কথা বলছে, এক হাত দরজার হাতলের ওপর রাখা, হলভর্তি অতিথি। ‘মিরান্ডা, তুমি কি আমাকে মিস করছ?’ সে আবার প্রশ্ন করে। মিরান্ডা বলে, সে করছে।
পরের দিন দেব ওর অ্যাপার্টমেন্টে এলে মিরান্ডা জানতে চায় তার স্ত্রী দেখতে কেমন? প্রশ্নটা উত্থাপন করার সময় সে একটু নার্ভাস ছিল। দেব তার কাছে থাকা সর্বশেষ সিগারেটটা শেষ করা, তারপর পেস্নটে জোরে চেপে ধরে পিষিয়ে নির্বাপিত করা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। ভাবল এ-প্রশ্নে তাদের মধ্যে আবার কোনো ঝগড়া হয় কিনা। কিন্তু এতে দেব অবাক হলো না। বরং রুপালি মাছের মতো ধূমায়িত হাওয়া সশব্দে বিদীর্ণ করে ছড়িয়ে দিতে দিতে সে বলে, তার স্ত্রী দেখতে অনেকটা ভারতীয় নায়িকা মাধুরী দিক্ষিতের মতো।
মিরান্ডার হৃৎপি- তৎক্ষণাৎ যেন থেমে গেল। কিন্তু না, দিক্ষিত মেয়েটার নামটা অন্যকিছু হবে, অন্যরকম, পি. স্টিল দিয়ে তা শুরু হয়েছে। নায়িকা আর দিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই তো! মেয়েটা একেবারে সাদাসিধে, হাইস্কুলে আগাগোড়াই ওর চুলে দুটো বিনুনি থাকত।
কয়েকদিন পর সেন্ট্রাল স্কয়ারে একটা ভারতীয় মুদিদোকানে মিরান্ডা গিয়েছিল। ওরা ভিডিও ভাড়াও দিয়ে থাকে। দরজা খুলতেই একটা গোলমেলে টুংটাং শব্দ বেজে উঠল। তখন ছিল দুপুরের খাওয়ার সময়, আর সে ছিল একমাত্র খরিদ্দার। দোকানের কোনায় ঝোলানো টেলিভিশনে একটা ভিডিও চলছিল। যেখানে সৈকতে লাইন ধরে যুবতী মেয়েরা রাজবাড়ির হেরেমের পোশাক পরে তাদের নিতম্বগুলো সমানলয়ে ওপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
‘আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ ক্যাশ রেজিস্ট্রারে যে-লোকটি দাঁড়িয়েছিল সে জানতে চাইল। লোকটা একটা পেস্নটে কালো-বাদামি সসে ডুবিয়ে সমুচা খাচ্ছিল। তার কোমর বরাবর কাচের কাউন্টারের নিচে ট্রেতে আরো অনেক গোলগাল, মোটাসোটা সমুচা রয়েছে, আছে ঈষৎ বিবর্ণ ডায়মন্ড আকারের মোড়ানো মিঠাই আর মিষ্ট তরল পদার্থে ভাসমান উজ্জ্বল কমলার ছোট ছোট কেক। ‘আপনার কি কোনো ভিডিও লাগবে?’
মিরান্ডা তার ফিলোক্যাক্সটা খুলল। এখানে সে লিখেছে ‘মটারি দিক্ষিত’। কাউন্টারের পেছনে তাকের ওপর যে ভিডিওগুলো রাখা আছে সেগুলো দেখল। সে খেয়াল করল মহিলারা স্কার্ট পরে নিতম্বের ওপর নিচু হয়ে বসে আছে আর শরীরের ওপরের অংশ এমনভাবে আছে যেন স্তনের মাঝখানে উজ্জ্বল ফুটকিওয়ালা রুমাল শক্তভাবে বাঁধা আছে। ওদের কেউ কেউ একটা পাথরের দেয়ালে কিংবা গাছে পিঠ লাগিয়ে ঝুঁকে আছে। যুবতী মেয়েগুলো সুন্দরী, তারা
সুরমা-লাগানো চোখে আর লম্বা কালো চুল নিয়ে যেভাবে সৈকতে নাচছে তা মনোহর। সে বুঝতে পারল মাধুরী দিক্ষিতও তাহলে সুন্দরী হবে। ‘মিস, আমাদের ভিডিওগুলোর সাব-টাইটেল ভার্সন রয়েছে’, লোকটা বলতে থাকে। সে তার হাতের আঙুলের ডগাগুলো দ্রম্নত জামার ওপর মুছে ফেলে তিনটি ভিডিও বের করে আনল।
‘না, না’, মিরান্ডা বলে, ‘ধন্যবাদ’। সে স্টোরটির ভেতরে হাঁটাহাঁটি করল, তাকগুলো লাইন করে লেবেলবিহীন প্যাকেট আর টিনগুলো দেখতে লাগল। সে খেয়াল করেনি যে, ফ্রিজারে পিঠা, রুটি আর শাকসবজির বাক্সতে ঠাসা রয়েছে। তার শুধু চোখ পড়েছে, একটা তাকে হটমিক্সের ব্যাগ সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে, যা লক্ষ্মী সবসময় খেতে চায়। সে লক্ষ্মীর জন্য কিছু হটমিক্স কেনার কথা ভাবল। তবে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বেও পড়ল – লক্ষ্মীকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবে ভারতীয় মুদির দোকানে সে কী করছিল।
‘খুবই মসলাযুক্ত’, লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, তার চোখ দুটো মিরান্ডার সারাশরীরে ভ্রমণ করতে থাকে, ‘আপনার জন্য খুবই মসলাদার হবে।’ ফেব্রম্নয়ারির মধ্যেও লক্ষ্মীর মামাত বোনের স্বামী স্বাভাবিক বোধে ফিরে আসেনি। সে মনট্রিল ফিরে এসেছিল, প্রায় দুসপ্তাহের জন্য স্ত্রীর সঙ্গে নিদারুণ ঝগড়া করেছে। দুটো স্যুটকেস ভরে নিয়ে আবার লন্ডন চলে গেছে। সে ডিভোর্স চাইছে।
মিরান্ডা তার ছোট শয়নকক্ষে বসে শুনছিল লক্ষ্মী তার মামাত বোনকে বলছে, পৃথিবীতে অনেক ভালো লোকও আছে, যারা তাদের গোপন সত্তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। পরের দিন মামাত বোন বলল, সে আর ছেলে তার মা-বাবার বাড়ি ক্যালিফোর্নিয়া যাচ্ছে, তাদের সম্পর্কটা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা আর কি। লক্ষ্মী তাকে বুঝিয়ে রাজি করাল ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার পথে সে যেন বোস্টনে এক সপ্তাহের জন্য যাত্রাবিরতি করে। ‘দ্রম্নত স্থান পরিবর্তন তোমার জন্য ভালো হবে’ লক্ষ্মী ভদ্র অথচ জোরালোভাবে বলে, ‘তাছাড়া কত বছর তোমাকে দেখিনি।’
মিরান্ডা তার সেলফোনের দিকে তাকাল, আশা করেছিল দেব ফোন করবে। চারদিন হয়ে গেছে তারা কথা বলেছে। সে শুনেছে লক্ষ্মী ডাইরেক্টরি সহকারীকে ফোন করেছিল, একটা ভালো বিউটি সেলুনের নাম্বার চেয়েছে। ‘খুব আরামদায়ক যেন হয়’ লক্ষ্মী তাকে অনুরোধ জানিয়েছে। সে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে ফেলেছে – শরীর মাসাজ করা, মুখের পরিচর্যা, হাত বা নখের প্রসাধন, পায়ের কড়া চামড়ার পরিচর্যা এসব সম্পন্ন করা। তারপর সে ফোর সিজনস রেসেত্মারাঁয় মধ্যাহ্নভোজের জন্য একটা টেবিলও সংরক্ষিত করে রেখেছে। তার মামাত বোনকে চাঙ্গা রাখার ফাঁকে ওর ছেলেটার কথা সে ভুলেই গেছে। হাতের গাঁট দিয়ে সে ফোনের পাতলা স্তরের দেয়ালে আঘাত করল। ‘শনিবার কি তুমি ব্যস্ত থাকবে?’
মামাত বোনের ছেলেটা হালকা-পাতলা। সে একটা হলুদ ব্যাগ বহন করছে, যা তার পেছন ফিতা দিয়ে বাঁধা। ধূসর ক্ষুদ্র সামুদ্রিক মাছের মতো নকশা করা লম্বা পাজামা তার পরনে, লাল ডি-গলার সোয়েটার আর পায়ে কালো চামড়ার জুতো। তার চুল এমনভাবে কাটা হয়েছে, যেন চোখের ওপর ললাটে ঘন কেশগুলো ঝুলে পড়ে নিচে কালো বৃত্ত তৈরি করেছে। এসবই প্রথম খেয়াল করল মিরান্ডা। তারা তাকে দেখতে অনেকটা বন্য করে তুলেছে। তার বয়স মাত্র সাত বছর হলেও মনে হচ্ছে যেন সে প্রচুর ধূমপান করে আর ঘুমায় খুব কম। সে একটা বড় স্কেচ প্যাড স্পাইরাল বাইন্ডিং করে আটকে রাখল। তার নাম রোহিন।
‘একটা দেশের রাজধানীর নাম আমাকে জিজ্ঞেস করো’, মিরান্ডার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে।
মিরান্ডাও তার দিকে একইভাবে তাকাল। শনিবার সকাল সাড়ে আটটা বাজে। কফির কাপে সে একটা চুমুক দিলো। ‘কী জন্য?’
‘এটা একটা খেলা যা সে খেলে’, লক্ষ্মীর মামাত বোন ব্যাখ্যা করে। সেও তার ছেলের মতো পাতলা গড়নের, মুখটা লম্বা আর চোখের নিচে একই অন্ধকার বৃত্ত। মামাত বোনের কাঁধে একটা মরিচা রঙের কোট ভারী হয়ে ঝুলছে। ব্যালে নর্তকীর মতো তার কালো চুল আর তার মাঝে দু-একটা ধূসর সুতার অাঁশ ললাটের দুই প্রান্তে এসে আবার পেছনে চলে গেছে। ‘তুমি তাকে একটা দেশের নাম বলো, সে রাজধানীর নাম বলে দেবে।’
‘গাড়ির ভেতর তার কথা তুমি শুনেছ’, লক্ষ্মী বলে, ‘ইউরোপের সব দেশের নাম সে মুখস্থ করে ফেলেছে।’
‘এটা খেলা নয়’, রোহিন বলল, ‘স্কুলে একটা ছেলের সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা আছে। আমরা সব রাজধানীর নাম মুখস্থ করার প্রতিযোগিতা করছি। আমি তাকে হারিয়ে দেবো।’
মিরান্ডা মাথা নাড়ল। ‘ঠিক আছে, ভারতের রাজধানীর নাম কী?’
‘ওটা ভালো প্রশ্ন হলো না’, সে হেঁটে দূরে চলে যাওয়ার সময় খেলনার সৈনিকের মতো তার বাহুগুলো দুলতে থাকে। তারপর সে আবার লক্ষ্মীর মামাত বোনের কাছে ফিরে আসে আর তার ওভারকোটের একটা পকেট ধরে জোরে টান দিলো। ‘তাকে একটা কঠিন প্রশ্ন করো।’
‘সেনেগাল’, লক্ষ্মী বলে।
‘ডাকার’ রোহান আনন্দের সঙ্গে উত্তর দিলো আর ঘুরে ঘুরে বৃহত্তর বৃত্ত তৈরি করতে শুরু করল। শেষে সে দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গেল। মিরান্ডা শুনতে পেল সে ফ্রিজের দরজা খুলছে আর তা বন্ধ করছে।
‘রোহিন, আমাকে জিজ্ঞেস না করে কোনো কিছু ছোঁবে না।’ লক্ষ্মীর মামাত বোন ক্লান্ত স্বরে বলে ওঠে। সে মিরান্ডার দিকে হাসিমুখে বলে – ‘চিন্তা করবেন না, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়বে, তার দিকে খেয়াল রাখার জন্য ধন্যবাদ।’
‘তিনটায় ফিরে আসব’, মামাত বোনের সঙ্গে নিচে বিল্ডিংয়ের করিডোরে যেতে যেতে লক্ষ্মী বলে, ‘আমরা ডাবল পার্কিং করেছি।’
মিরান্ডা দরজার ওপর চেইনটা শক্ত করে বেঁধে দিলো। রোহিনকে খুঁজতে সে গেল রান্নাঘরে, কিন্তু সে তখন সাধারণ রুমে খাবার টেবিলে পরিচালকদের জন্য ব্যবহৃত একটি চেয়ারে হাঁটু গেড়ে বসেছে। পিঠে ঝোলানো ব্যাগটার মুখ খুলল সে, মিরান্ডার হাত-নখের প্রসাধনীর ঝুড়িটা টেবিলের এক পাশে ঠেলে দিয়ে নিজের ছবি আকার পেনসিল বাক্স ছড়িয়ে রাখল। ও নিজে ছেলেটার কাঁধের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। সে লক্ষ করে, রোহিন একটা নীল পেনসিল দৃঢ় মুষ্টিতে আঁকড়ে ধরে উড়োজাহাজের বাইরের লাইনটা এঁকে ফেলল।
‘এটা সুন্দর হয়েছে’, সে বলল। ছেলেটা কোনো উত্তর না দেওয়ায় সে আরো একটু কফি ঢালার জন্য রান্নাঘরে গেল।
‘আমাকে একটু দেবে, প্লিজ?’ রোহিন উচ্চৈঃস্বরে বলে। সে সাধারণ রুমে ফিরে এসেছে।
‘একটু কি?’
‘একটু কফি। আমি দেখেছি পাত্রে অনেক কফি আছে।’ এবার সে হেঁটে টেবিল পর্যন্ত গিয়ে ছেলেটার মুখোমুখি বসল। একসময় সে একটা নতুন পেনসিল নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল। পরিচালকের চেয়ারে সে শুধু একটু খাঁজ কেটেছে।
‘কফি খাওয়ার বয়স তোমার হয়নি।’
রোহিন তার স্কেচ প্যাডের দিকে হেলে পড়ে, তার ছোট বুক আর কাঁধ যেন ওটাকে প্রায় স্পর্শ করে ফেলেছে, মাথাটাকে সে একপাশে কাত করল। ‘খাবার পরিচারিকা তো আমাকে কফি দেয়’ সে বলে, ‘সে দুধ আর প্রচুর চিনি দিয়ে বানায়।’ সে এবার খাড়া হয়ে বসল, উড়োজাহাজের পাশে একটা মহিলার মুখ বেরিয়ে আসে। মহিলার লম্বা ঢেউ-খেলানো চুল, চোখ দুটো তারকাচিহ্নের মতো। ‘তার চুল আরো উজ্জ্বল ছিল’ ছেলেটা নিশ্চিতভাবে বলে। ‘পেস্ননে একজন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে আমার বাবারও দেখা হয়েছিল’ সে মিরান্ডার দিকে তাকাল। তাকে কফিতে চুমুক দিতে দেখে ছেলেটার মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো, ‘আমি কি একটু কফি খেতে পারি না? পিস্নজ।’
মিরান্ডা অবাক হলো। ভাবে ছেলেটার শান্ত, ধ্যানী অভিব্যক্তি সত্ত্বেও যদি সে বদমেজাজি স্বভাবের হয়! সে কল্পনা করে রোহিন তার চামড়ার জুতো দিয়ে তাকে লাথি মারছে, কফির জন্য চিৎকার জুড়ে দিয়েছে, যতক্ষণ না তার মা আর লক্ষ্মী এসে তাকে নিয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত চিৎকার আর কান্নাকাটি করছে।
এবার মিরান্ডা রান্নাঘরে গিয়ে তার জন্য এক কাপ কফি তৈরি করে। সে একটা বড় মগ নেয়, ওটা ওর হাত থেকে পড়ে যেতে পারে – এটা ভাবেনি।
‘ধন্যবাদ’ কফির মগটা টেবিলের ওপর রাখায় সে মিরান্ডাকে ধন্যবাদ জানাল। রোহিন মগটা দুহাতে শক্ত করে ধরে ছোট ছোট চুমুকে কফি খেল।
যখন সে ছবি আঁকছিল, মিরান্ডা তার সঙ্গে বসেছিল। কিন্তু যখন সে তার নখের ওপর পরিষ্কার পলিশের প্রলেপ দিলো তখন রোহিন প্রতিবাদ করল। সে তার পিঠের বিশ্বপঞ্জিকা টেনে বের করে এনে তাকে প্রশ্ন করার জন্য বলল। সেখানে দেশগুলোর নাম মহাদেশ অনুযায়ী সাজানো আছে, রাজধানীর নাম রয়েছে স্পষ্টভাবে। তারপরই আছে দেশের জনসংখ্যা, সরকার এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর পরিসংখ্যান। মিরান্ডা বইটির আফ্রিকাপর্বে পাতা ওলটাল এবং তালিকায় চোখ রাখল।
‘মালি’ সে জিজ্ঞেসা করে।
‘বামাকো’ সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা উত্তর দেয়।
‘মালাউই’।
‘লিলংউ’।
আফ্রিকার দিকে তাকিয়ে ম্যাপারিয়ামের কথা তার মনে পড়ে গেল। মনে আছে ওটার উর্বর অংশ ছিল সবুজে ভরা। ‘বলতে থাকো’, রোহিন বলে।
‘মৌরিতানিয়া’।
‘নোকছট’।
‘মরিশাস’।
ছেলেটা একটু থামল, চোখ দুটো ছোট করে বন্ধ করে ফেলল, আবার খুলল, পারল না।
‘আমি মনে করতে পারছি না।’
‘পোর্ট লুইস’, মিরান্ডা জানিয়ে দিলো।
‘পোর্ট লুইস’ শব্দদুটো বারবার সে বলতে থাকে, চাপাগলায় মন্ত্রের মতো।
যখন তারা আফ্রিকার শেষ পর্যায়ের দেশগুলোতে চলে গেল, রোহিন বলল সে কার্টুন দেখতে চায়। মিরান্ডাকেও বলে তার সঙ্গে দেখতে। কার্টুন শেষ হলে সে মিরান্ডাকে রান্নাঘর পর্যন্ত অনুসরণ করে যখন সে আরো কফি বানায়, তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে। একটু পরে সে বাথরুমে ঢুকলে ছেলেটা সে কয়েক মিনিটের জন্য তাকে অনুসরণ করে না; কিন্তু বাথরুমের দরজা খুললে ছেলেটাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে চমকে গেল। ‘তোমার কি বাথরুম পেয়েছে?’
সে মাথা নাড়ে। তবে যাহোক, সে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। টয়লেটের ঢাকনা টেনে নামিয়ে দিলো, ওটার চূড়ায় উঠল আর পানির বেসিনের ওপর সরু কাচের তাককে ভালোভাবে জরিপ করে দেখল, যেখানে মিরান্ডার দাঁতের ব্রাশ আর প্রসাধনী রয়েছে।
‘এটি কী কাজ করে’ চোখের জেলটা তুলে নিয়ে ও প্রশ্ন করে যেটা দেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার দিন পেয়েছিল।
‘দমকা হাওয়া।’
‘দমকা হাওয়া কী?’
‘এখানে দেখ’, সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ব্যাখ্যা করল।
‘এটা কি তুমি কান্নার পর দাও?’
‘তাই তো মনে হয়।’
রোহিন ওটার টিউবটা খুলে ঘ্রাণ নিল। আঙুলে একফোঁটা ফেলে হাতে মেখে নিল। ‘ওটা পোড়াচ্ছে।’ সে তার হাতের পেছনটা নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করল, আশা করেছিল হাতের রঙে পরিবর্তন আসবে। ‘আমার মায়ের এটা আছে। মা বলে, ওটা ঠান্ডা। তবে সত্যিই মা কান্না করে, মাঝেমধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদে। কখনো কখনো রাতের খাবারের সময় পর্যন্ত কাঁদতে থাকে। মাঝেমধ্যে তার কান্না এত দুঃসহ হয়ে ওঠে যে, তার চোখ কোলা ব্যাঙের মতো ফুলে যায়।’
মিরান্ডা অবাক হয়ে ভাবে ওকে কিছু খাওয়াতে হবে কিনা। রান্নাঘরে সে এক ব্যাগ চালের পিঠা আর কিছু লেটুস পাতা খুঁজে পেল। খাবারের দোকান থেকে কিছু কেনার জন্য সে বাইরে যাওয়ার কথা তুললে রোহিন বলল, ‘তার তেমন খিদে নেই। একটা পিঠা দিয়েই তার চলবে। তুমিও একটা খাও’, ছেলেটা বলে। তারা টেবিলে বসল, মাঝখানে চালের পিঠা। সে এবার তার স্কেচ প্যাডের নতুন পাতা উলটে বলে – ‘তুমি অাঁকো।’ মিরান্ডা একটা নীল পেনসিল ঠিক করে দিলো। ‘আমি কী অাঁকব?’
সে একটুক্ষণ ভাবল। ‘আমি জানি’, সে বলে। সে মিরান্ডাকে লিভিংরুমের জিনিসগুলো অাঁকার জন্য বলে – সোফা, পরিচালকের চেয়ার, টেলিভিশন, টেলিফোন। ‘এভাবেই আমি মনে রাখার চেষ্টা করি।’ ‘কী মনে রাখো?’ মিরান্ডা বলে।
‘আমাদের একত্রে দিন কাটানো।’ সে আর একটা চালের পিঠা নেওয়ার জন্য এগিয়ে গেল।
‘তোমার মনে রাখার দরকার কী?’
‘কারণ আমরা একে অন্যের সঙ্গে দেখা করার জন্য কখনো যাব না, কখনো না।’ ছেলেটার বাক্যবন্ধনীর স্পষ্টতা তাকে চমকে দিলো। মিরান্ডা তার দিকে তাকাল, মনটা কেমন যেন একটু হতাশাগ্রস্ত। তবে রোহিনকে মোটেও মনমরা মনে হচ্ছে না। সে সেই পাতাটাই খুলল, যাতে লেখা আছে ‘চালিয়ে যাও।’
আর তাই মহিলা নিজের সাধ্যমতো ছবি আঁকল সোফা, পরিচালকের চেয়ার, টেলিভিশনের ছবি। ছেলেটা মিরান্ডার গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। এত কাছাকাছি যে, মাঝেমধ্যে সে কী করছে তা দেখাও বড় কঠিন হয়ে পড়ে। এবার রোহিন তার ছোট বাদামি হাত ওর হাতের ওপর রাখে। ‘এখন আমাকে অাঁকো’ মিরান্ডা বলে। সে ছেলেটার হাতে ছবি অাঁকার পেনসিল ধরিয়ে দিলো।
রোহিন মাথা নাড়ে, ‘না, আমাকেই অাঁকো।’
‘আমি পারি না’, মিরান্ডা বলে, ‘আমি অাঁকলে তা দেখতে তোমার মতো হবে না।’
রোহিনের সারামুখে বিষণ্ণতার ছাপ ছড়িয়ে পড়ল আবার, এ যেন তখনকার অবস্থা, যখন তাকে সে কফি দিতে চায়নি। ‘পিস্নজ অাঁকো না?’
মাথা আর ললাটের ওপর ঝুলে থাকা চুলের বাহ্যিক সীমারেখা নির্ধারণ করে সে তার মুখ অাঁকল। একটা ভদ্র আর বিষাদের অনুভূতি নিয়ে রোহিন নিখুঁতভাবে শান্ত হয়ে রইল। একপাশে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। মিরান্ডা ভাবল, সে একটা ভালো চেহারা অাঁকতে পারবে। মিরান্ডার চোখের দৃষ্টির সঙ্গে হাতটাও অজান্তে নড়াচড়া করছে। এটা অনেকটা সেদিন বইয়ের দোকানে তার নামটা বাংলা হরফে রূপান্তর করতে গিয়ে যা ঘটেছিল তারই মতো। এ-ধরনের ঘটনা সত্যিই বিরল। মিরান্ডা যখন তার নাকটা অাঁকার মাঝামাঝি অবস্থানে তখন রোহিন টেবিল ছেড়ে একটু এগিয়ে গেল।
‘আমার একঘেয়েমি লাগছে’, শোয়ার ঘরে যেতে যেতে রোহিন ঘোষণা করে। মিরান্ডা শুনতে পায় ছেলেটা দরজা খুলছে, টেবিলের ড্রয়ার বের করে আনছে, আবার বন্ধ করছে। শেষে সে তাকে খুঁজে পেল ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠের ভেতর। একটু পরে সে বেরিয়ে এলো, ছেলেটার মাথার চুল অবিন্যস্ত, হাতে ধরা আছে রুপালি ককটেল পোশাক। ‘এটা মেঝেতে পড়ে ছিল।’
‘ওটা হ্যাঙ্গার থেকে পড়ে গেছে।’ রোহিন পোশাকটার দিকে একবার দেখল, তারপর দেখল মিরান্ডার শরীর।
‘ওটা পরে ফেল।’
‘কী বললে?’
‘ওটা পরে নাও।’
পোশাকটা পরার কোনো কারণ ছিল না। ফিলিনে ফিটিংরুমে ট্রায়াল দেওয়ার পর সে কখনো ওটা পরেনি, আর যতক্ষণ পর্যন্ত সে দেবের সঙ্গে থাকে তখন তার ধারণা, কখনো তা পরতে হবে না। সে জানে তারা কখনো রেসেত্মারাঁয় যাবে না, যেখানে টেবিলের প্রান্তে বসে তারা চুমু খেতে পারত। তারা রোববার তার অ্যাপার্টমেন্টে মিলিত হয়। দেবের পরনে থাকে তুলার পাজামা, মিরান্ডার জিন্স। রোহিনের কাছ থেকে পোশাকটা নিয়ে ঝেড়ে ফেলল, যদিও তার মসৃণ কাপড়ে এতটুকু ভাঁজ পড়েনি। সে ছোট গোপন কক্ষে একটা খালি হ্যাঙ্গার আনতে গেল।
‘ওটা পরো না, পিস্নজ’, হঠাৎ তার পেছনে দাঁড়িয়ে রোহিন বলে ওঠে। তার মুখে মুখ চেপে ধরল, পাতলা দুটো বাহু দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে – ‘পিস্নজ?’ ‘ঠিক আছে’, তার হাতের মুঠির শক্তি দেখে অবাক হলো মিরান্ডা। সে হাসল। খুব খুশি হয়ে বিছানার এক পাশে বসে পড়ল।
‘তোমাকে একটু ওইখানে অপেক্ষা করতে হবে’ দরজার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সে বলল, ‘আমি তৈরি হলে বেরিয়ে আসব।’
‘কিন্তু আমার মা তো সবসময় আমার সামনেই তার কাপড় খুলে ফেলে।’
‘সে কি, তাই করে?’
রোহিন মাথা নাড়ে। ‘মা তো সেগুলো পরবর্তী সময়ে আর তুলেও না। বিছানার পাশে মেঝেতে ফেলে রাখে, সব এলোমেলো হয়ে থাকে। একদিন মা আমার রুমে ঘুমিয়েছিল’, সে বলতে থাকে, ‘সে বলল, তার নিজের বিছানা থেকে আমার বিছানায় বেশি আরাম বোধ করে। এখন তো আমার বাবা চলে গেছে।’
‘আমি তো তোমার মা নই’, মিরান্ডা ছেলেটাকে বগলে ধরে বিছানা থেকে তুলে আনতে আনতে বলল। যখন ছেলেটা দাঁড়াতে চাচ্ছে না, সে তাকে জোর করে উঠিয়ে দিলো। যা ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি ভারী সে, মিরান্ডাকে অাঁকড়ে ধরে থাকল সে, ছোট পা দুটো তার নিতম্বের চারপাশে জোরে জড়িয়ে ধরল আর মাথাটা তার বুকে ঠেস দিয়ে রাখল। সে জোর করে ছেলেটাকে করিডোরে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে সে দরজায় সিটকিনি মেরে দিলো। কাপড় বদল করে দরজার পেছনে রাখা পূর্ণ প্রসারিত আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল। তার গোড়ালির গাঁট অবধি মোজা দেখতে বোকা বোকা লাগছিল, তাই সে একটা ড্রয়ার খুলে মোজা খুঁজে নিল। সে ছোট রুমের পেছনে পুরোটা খুঁজল, ছোট্ট বগলস-অাঁটা হাইহিলের মধ্যে পা গলিয়ে দিলো। গলার হাড়ের কাছে পোশাকটার লম্বা চেইনের ফিতে কাগজের ক্লিপের মতো পাতলা। ওটা তার জন্য একটু ঢিলে হয়েছে, সে নিজে নিজে চেইনটা লাগাতে পারছিল না।
রোহিন দরজায় টোকা দিচ্ছিল। ‘আমি কি এখন আসতে পারি?’
মিরান্ডা দরজা খুলল। রোহিন তার বর্ষপঞ্জিটা দুহাতের মধ্যে চেপে ধরে আছে। চাপা গলায় বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। ওকে দেখে তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। ‘এ চেইনটার ব্যাপারে আমার সাহায্য দরকার’, মিরান্ডা বলে। বিছানার এক পাশে সে বসে পড়ে।
রোহিন চেইনটা ওপরের দিকে টেনে দিলো। মিরান্ডা এবার দাঁড়িয়ে পড়ল আর চারদিক ঘুরে এলো। রোহিন দিনপঞ্জিটা নিচে রাখল। ‘তুমি সেক্সি’ – সে ঘোষণা করল।
‘কী বলেছ?’
‘তুমি সেক্সি।’
মিরান্ডা আবার বসে পড়ল। যদিও সে জানে এর মানে কিছুই বোঝায় না, তবু তার মর্মদেশ লাফ দিয়ে কেঁপে উঠল। সে সম্ভবত সব মহিলাকে সেক্সি ভাবে। টেলিফোন কিংবা কোনো ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ থেকেই হয়তো শব্দটা শুনেছে। ম্যাপারিয়ামে সে-দিনটির কথা মিরান্ডার মনে পড়ে, যখন ব্রিজের ওধারে দেব আর সে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। সে-সময় সে ভাবল, এ-শব্দের অর্থ কি তার জানা আছে, এতে কী বোঝাতে চাচ্ছে, তাও প্রতিভাত হয়েছে।
মিরান্ডা তার বাহুদুটো বুকের ওপর রেখে রোহিনের চোখে চোখ রাখল। ‘আমাকে কিছু বলো।’
সে চুপ করে থাকে।
‘এটার অর্থ কী?’
‘কোনটা?’
‘শব্দটি। সেক্সি, এটার অর্থ কী?’
সে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কেমন যে লাজুক লাজুক ভাব। ‘আমি তোমাকে বলতে পারব না।’
‘কেন নয়?’
‘এটা একটা গোপন বিষয়’, সে তার ঠোঁটদুটো এত জোরে চেপে ধরল যে, ঠোঁটের কিয়দংশ সাদা হয়ে গেল।
‘গোপন বিষয়টাই আমাকে বলো। আমি জানতে চাই।’
রোহিন মিরান্ডার পাশে বিছানায় বসে তার জুতোর পেছন অংশ দিয়ে ম্যাট্রেসের কোনায় লাথি মারতে থাকে। সে ঘাবড়ে গিয়ে বোকার মতো হাসতে থাকে। তার হালকা-পাতলা শরীর সংকুচিত হয়ে আসে, যেন তাকে সুড়সুড়ি দেওয়া হয়েছে। ‘বলো, আমাকে বলো’, মিরান্ডা দাবি জানায়। একটু ঝুঁকে গোড়ালির গাঁট আর পায়ের পাতাকে শক্ত করে ধরে রাখল সে।
রোহিন তার দিকে তাকাল। তার চোখ যেন চিরে ফেলছে সব। সে আবার ম্যাট্রেসটাতে লাথি মারার জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু মিরান্ডা তাকে পাশ থেকে চাপ দিচ্ছে। সে পেছনে কাত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, তার পেছনের অংশটা যেন একটা কাষ্ঠদণ্ড। সে হাত দুটো পেয়ালার মতো করে তার মুখের চারপাশে রেখে ফিসফিস করে বলল, ‘এটার অর্থ হচ্ছে এমন কাউকে ভালোবাসতে যাওয়া, যাকে সে চেনে না।’
দেবকে সে যেভাবে অনুভব করে সেভাবেই রোহিনের কথাগুলো তার কাছে রেখাপাত করল গভীরভাবে। তবে রেগে না গিয়ে সে চুপ মেরে গেল। এ-অনুভূতি তাকে সেভাবেই মনে করিয়ে দিলো, যখন একটা ভারতীয় মুদিদোকানে একটা ছবির দিকে না তাকিয়েও যে-মুহূর্তে সে জানল দেবের স্ত্রীর মতো দেখতে নায়িকা মাধুরী দিক্ষিত অপরূপ সুন্দরী। ‘ওটাই আমার বাবা করল’, রোহিন বলতে থাকে, ‘সে এমন একজন মহিলার পাশে বসল যাকে সে চেনে না, এমন একজন যে সেক্সি। এখন সে আমার মায়ের পরিবর্তে ওই মহিলাকে ভালোবাসে।’
সে তার জুতো খুলে মেঝের ওপর পাশাপাশি রেখে দেয়। গলায় জড়ানো পশমি কাপড়টা খুলে বর্ষপঞ্জি নিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে মিরান্ডার বিছানায় চলে যায়। এক মিনিট পর হাত থেকে বইটি পড়ে যায়। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। মিরান্ডা দেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তার গলায় পশমি কাপড়টা নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে উঠছে আর নামছে। দেবের মতো বারো মিনিট পর সে জেগে ওঠেনি। এমনকি বিশ মিনিটেও না। সে রুপালি ককটেল পোশাক ছেড়ে আবার জিন্স পরেছে। ভেতরের প্রকোষ্ঠের পেছনে হাইহিল জুতো রেখে দিলো, মোজা ভাঁজ করে ড্রয়ারে তুলে রাখতে গিয়ে দেখল, এখনো ছেলেটা চোখ খোলেনি।
মিরান্ডা সবকিছু দূরে সরিয়ে রেখে বিছানার ওপর গিয়ে বসল। সে ছেলেটার দিকে কাত হতেই দেখে চালের পিঠার সাদা পাউডার তার মুখের কোনায় এখনো লেগে আছে। দিনপঞ্জি বইটি সে তুলে নিল। যখন মিরান্ডা বইটির পাতা ওলটাচ্ছে, তখন সে কল্পনা করে মনট্রিলের বাসায় রোহিন তার মা-বাবার ঝগড়া আড়ি পেতে শুনছিল। সে কি সুন্দরী? মিরান্ডা ভাবে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সে যে-ধরনের স্নানের পোশাক পরে আছে, একই ধরনের পোশাক নিয়ে তার মা তার বাবাকে এ-কথা জিজ্ঞেস করে থাকবে। তখন তার নিজের সুন্দর মুখটা ধীরে ধীরে ঘৃণায় আক্রোশপূর্ণ হয়ে উঠছে। সে কি সেক্সি? তার বাবা প্রথমে অস্বীকার করবে আর আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করতে চাইবে। ‘বলো আমাকে’, রোহিনের মা তীক্ষন চিৎকার করে উঠবে, ‘বলো, সে সেক্সি কিনা।’ শেষমেশ তার বাবা স্বীকার করবে, সে সেক্সি। তখন তার মায়ের চোখে শুধু কান্না আর কান্না, বিছানার চারদিকে কাপড়ের সত্মূপ, কোলা ব্যাঙের মতো তার চোখদুটো ফোলা ফোলা। ‘তুমি কীভাবে পারলে’, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে জানতে চাইবে, ‘তুমি কীভাবে একজন মহিলাকে ভালোবাসবে, যাকে তুমি ভালো করে চেনো না পর্যন্ত।’
মিরান্ডা যখন পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে, তখন সে নিজেই কাঁদতে শুরু করে। সেদিন ম্যাপারিয়ামে সব দেশকে স্পর্শ করার মতো কাছাকাছি মনে হচ্ছিল, দেবের কণ্ঠস্বর কাচের সঙ্গে বাধা পেয়ে তীব্রভাবে ফিরে এসেছিল। ব্রিজের ওপর ত্রিশ ফুট দূর থেকে তার কথাগুলো মিরান্ডার কানে এসে পৌঁছায়। সেগুলো এত কাছের এবং উষ্ণতায় ভরা যে, তা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। মিরান্ডা জোরে কাঁদতে থাকে, থামতে চায় না। রোহিন তখনো ঘুমিয়ে, সে ধারণা করে ছেলেটা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এমনকি মহিলার কান্নাতেও। রোববার দেব ফোন করে মিরান্ডাকে জানাল, সে তার আপার্টমেন্টে আসার জন্য যাত্রা করেছে। ‘আমি প্রায় প্রস্ত্তত। দুটার মধ্যে চলে আসব।’
মিরান্ডা টেলিভিশনে একটা রান্নার অনুষ্ঠান দেখছিল। একজন মহিলা একসারি আপেলের দিকে লক্ষ করে ব্যাখ্যা করছিল কোনগুলো সেঁকার জন্য ভালো। ‘তুমি আজ এসো না।’
‘কেন নয়?’
‘আমার ঠান্ডা লেগেছে’, সে মিথ্যা বলল। তবে এ-কথা সত্যের চেয়েও বেশি দূরে নয়, কান্নার কারণে রক্তাধিক্যের ফলে একটু অসুস্থ অনুভব করছে। ‘আমি সারাদিন বিছানায় শুয়ে আছি।’
‘তোমার গলার স্বর কেমন যেন হয়েছে’, একটু থামল দেব, ‘তোমার কিছু প্রয়োজন হবে?’
‘আমার সব আছে।’
‘প্রচুর তরল জিনিস খাও।’
‘দেব?’
‘বলো মিরান্ডা।’
‘আমরা যেদিন ম্যাপারিয়ামে গিয়েছিলাম সেদিনের কথা তোমার মনে আছে?’
‘অবশ্যই।’
‘আমরা কীভাবে কানে কানে কথা বলেছি সেটা মনে আছে?
‘আমার মনে পড়ছে’, দেব আনন্দের সঙ্গে ফিসফিস করে বলে ওঠে।
‘তুমি কি বলেছিলে মনে আছে?’
একটু বিরতি এলো। ‘চলো, তোমার জায়গায় ফিরে যাই’, দেব দ্রম্নত হেসে ওঠে, ‘পরের রোববার, কী বলো?’
আগের দিন যখন তার কান্না পাচ্ছিল, মিরান্ডার মনে এ-বিশ্বাস জন্মাল যে, সে কখনো কিছু ভোলে না – এমনকি বাংলায় তার নাম দেখতে কেমন সেটাও না। সে রোহিনের পাশে শুয়ে পড়ল। যখন তার ঘুম ভাঙে, তখন রোহিন বিছানার নিচে লুকানো ইকোনমিস্ট পত্রিকার কপি থেকে একটা উড়োজাহাজ অাঁকছিল। ‘দেবজিৎ মিত্র’ কে? একটা ঠিকানা-অাঁটা কাগজ দেখে সে প্রশ্ন করে।
মিরান্ডা দেবের ছবি মনে মনে অাঁকতে থাকে। সে তখন তুলার পাজামা আর টেনিস খেলার জুতো পরে হেসে হেসে ফোনে কথা বলবে। অল্পক্ষণের মধ্যে নিচে স্ত্রীর সঙ্গে যোগ দেবে, তাকে বলবে, আজ সে জগিংয়ে যাবে না। সে বলবে, শরীরের প্রসারণ ঘটাতে গিয়ে মাংসপেশিতে টান পড়েছে; তাই পত্রিকা পড়ার দিকেই মনোযোগ দিতে হচ্ছে। দেবের জন্য মিরান্ডার মনটা পড়ে আছে। সে ভাবে, আর একটা কিংবা দুটো রোববার সে দেবের সঙ্গে দেখা করবে। তখন সে ওকে বলবে একদিন কী কী জেনেছে। বলবে এসব তার নিজের কিংবা ওর স্ত্রীর জন্য যথাযথ হবে না, বলবে তাদের দুজনের আরো ভালো থাকার কথা ছিল; বলবে সেখানে এমন কোনো বিষয় নেই, যা আলোচনায় টেনে আনা যাবে না।
পরের রোববার এত প্রবল তুষারপাত হলো যে, দেব তার স্ত্রীকে বলতে পারল না চার্লসের ওপর দিয়ে সে দৌড়াবে। তার পরের রোববার বরফ গলে গেছে, কিন্তু মিরান্ডা লক্ষ্মীর সঙ্গে সিনেমা দেখার পরিকল্পনা করেছে। যখন দেবকে সে-বিষয়টি জানাল, সে তাকে তা বাতিল করতে বলতে পারল না। তৃতীয় রোববার মিরান্ডা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরিয়ে গেল। আবহাওয়া ঠান্ডা হলেও দিনটা রৌদ্রময় আর তাই কমনওয়েলথ ডাউন পর্যন্ত পুরো পথ সে হেঁটে গেল। রেসেত্মারাঁগুলো পার হয়ে এলো যেখানে দেব তাকে চুমু খেত তারপর সে ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স সেন্টার পর্যন্ত সারাপথ হেঁটে এলো। ম্যাপারিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে, কাছাকাছি স্থান থেকে এক কাপ কফি কিনে গির্জার বাইরে পস্নাজার একটি বেঞ্চের ওপর সে বসে পড়ে, গির্জার বিশাল বিশাল থাম আর প্রকা- গম্বুজ আর শহরের ওপর স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
[লেখক পরিচিতি : বাঙালি মেয়ে ঝুম্পা লাহিড়ির জন্ম ১৯৬৭ সালের ১১ জুলাই লন্ডনে। আমেরিকার রোড আইল্যান্ডে তিনি বড় হয়েছেন। রেনেসাঁস সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করে ডক্টরেট পেয়েছেন ঝুম্পা। তাঁর গল্পগ্রন্থ ইন্টারপ্রেটর অব ম্যালাডিজের জন্য ২০০০ সালে পুলিৎজার পুরস্কার পান। তাঁর গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অতি ধীরে ধীরে সামান্যের উন্মোচন, যার তলায় থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খতা। ২০০৩ সালে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস দ্য নেমসেকে বর্ণনারীতির এক অত্যাশ্চর্য আধুনিকীকরণ ঘটিয়েছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য রচনা – Unaccustomed Earth (২০০৯), The Lowland (২০১৩)। ‘সেক্সি’ গল্পটি ইন্টারপ্রেটর অব ম্যালাডিজ গল্পগ্রন্থের ‘Sexy’ গল্পটির অনুবাদ।]