ছায়ার রাজনীতি বনাম বাঙালিত্বের রাজনীতি: প্রতীক আর চর্যাপদ
বাজনাব পাড়ী পঁউআ খাঁলে বাহিউ
অদব বঙ্গাল দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী,
নিঅ ঘরিণী চণ্ডালেঁ লেলী ।।”
আধুনিক বাংলায়ঃ “ বজ্ররূপ নৌকায় পাড়ি দিয়া পদ্মার খালে বাহিলাম। / অদ্বয়রূপ বাঙ্গালা দেশ লুঠ করিলাম। / হে ভুসুকু, আজি বাঙ্গালিনী জন্মিলেন। / চণ্ডালে (তোমার) নিজ গৃহিনীকে লইয়া গেল”।
অনেকে মনে করেন এখানে ভুসুকু পা নিজের ঘরণী এক চন্ডাল নিয়ে যাবার কারণে ব্যথিত হয়ে এই পদ রচনা করেন, চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয় বা চর্যাপদে। আসলেই কি তাই? কেননা পুর্বে এর অনুবাদ ছিল যে ভুসুকু নিজের ঘরণী এক চন্ডাল গ্রহণ করেন যার ফলে তিনি বাঙালি হন,
বাঙ্গালি বা বঙ্গাল এই শব্দটির মানে কি বা এর অর্থ কি সেটার আদি অর্থ আমাদের নিকট অনেকটাই অজানা ছিল। বাঙালি বলতে আমরা আজকে বুঝি বঙ্গভূমি এবং বঙ্গেয় ব-দ্বীপ এর অধিবাসী বা বাসিন্দা। তবে অতীতে বাঙালি সম্ভবত চৌরাশি সিদ্ধাগণের এক সাধন মার্গ ছিল, যারা প্রায় সকলেই নিজকে পতিত করে নিজের মাঝের অহংকার কে নাশ করে বাঙালি হতেন, বাঙালি সাধন মার্গ ছিল এর আরেকটি পরোক্ষ প্রমাণ হচ্ছে, সুলতানি আমলে বিভিন্ন সাধকগণকে বাঙালি নামে ডাকা, বহু সাধক এবং সুফি ছিলেন যাদের নামের শেষে থাকতো আল বাঙালি।
অর্থাৎ আমাদের এই বাঙালি নামটি তারাই ধারণ করতেন, যারা আল মালামাত বা নিজেকে পতিত করার মাধ্যমে সাধনা করে নিজের মাঝের ইবলিশ বা দম্ভকে ধ্বংস করে দিতেন।
সেই বাঙালি এক সময়ে আমাদের মাঝে হয়ে ওঠে বিপ্লবের প্রতীক বৈপ্লবিক পরিচয়,
পাকিস্তান সৃষ্টির সময়ে, এই বাঙালিত্ব আমাদেরকে সর্বপ্রথম বার দাড় করায় আত্নমর্যাদার প্রশ্নে, আমরা নিজেকে পতিত করে অহংকার বিনাশ করলেও, অপমানের ঋণ আমরা কখনই পরিশোধ না করে থাকিনি, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি হিসেবে পাকিস্তানের মাঝে আলাদা জাতিস্বত্ত্বা সৃষ্টির লড়াই, যাতে আমরা বিজয় লাভ করি, আবারও বাঙালি হই, নিজের বুকের রক্ত দিয়ে।
সেই সময়ে আমাদের এই ভাষা ছিল সেই চৌরাশি সিদ্ধাদের ন্যায়, টলটলে কোন প্রকার কলুষমুক্ত, হয়ত গালি দিতাম কিছু শব্দ দিয়ে, তবে সেটি ছিল একান্তই নিজের ব্যক্তিগত সার্বিক বিশ্বাস এর কারণে, এই ভাষা ছিল সত্যের ভাষা কেননা সত্য সবসময়ে থাকে মজলুমের সাথে।
আবারও আমরা মজলুম হই, ৭১ এ আবারও ভাষা আর শুধু ভাষা নয়, এবার জাতীয়তা, আর সাড়ে তিন হাজার বছরের ঐতিহ্য, আমরা বাঙালিরা চির সংগ্রামী, চির বিপ্লবী, বার বার মজলুম হয়ে ধংসের কাছাকছি গিয়েছি আর বার বার ফিরে এসেছি কিন্ত ৭১ এ সব কিছুই হুমকির মুখে পড়ে, তবে এবারও বাঙালির বুকের ইস্পাত আর সুদীর্ঘ সংগ্রামের ভাষা আমাদের আবারও বিজয়ী করে।
বাংলা এই সময়েও ছিল মজলুমের ভাষা, তবে এবার এই ভাষার মাঝে কিছু শব্দ এসে যায় যা আমাদের মাঝে সব সময়ে বিরমিষা তৈরি করত, যার মাঝে একটি ছিল ‘রাজাকার’
মূলত রাজাকার একটি ফারসি শব্দ যার অর্থ সাহায্যকারী বা অন্য কথাতে সেচ্ছাসেবক, তবে রাজাকার বাহিনীর মূল পরিচয় ছিল রাজাকার এ পাকিস্তান বা পাকিস্তানের মদদকারী বা সেচ্ছাসেবক ইংরেজিতে Volunteers of Pakistan army.
অর্থাৎ রাজাকার শব্দটি মূলত অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হত এর পুর্বে, তবে ঘৃণিত শব্দ হচ্ছে রাজাকার-ই-পাকিস্তান, বা পাকিস্তানি হানাদারদের সাহায্যকারী, তবে মূলত সামরিক ক্ষেত্রেই এটি ব্যবহৃত হত। পাকিস্তান বাদে স্বাধীন হায়দ্রাবাদের প্যরামিলিটারি বাহিনীর নাম ছিল রাজাকার, বাংলাদেশেও আনসার বাহিনীকে ভেঙ্গে পাকিস্তান রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল, আনসার এবং রাজাকার শুধু দুইটি ভাষার দুইটি শব্দ মাত্র যাদের অর্থ একই, সাহায্যকারী অর্থাৎ একজন আনসার যা একজন রাজাকারও তাই যদি তিনি হন বাংলাদেশের।
তবে আনসার-ই-পাকিস্তান নামটি যদি কাউকে বাংলাতে বলা হয়, বা যদি বলা হয় এই লোক পাকিস্তানের আনসার, তাহলে কি সেই একই ঘৃণা উৎপন্ন হবে? উত্তর হচ্ছে না। যদি বলা হয় এই লোক পাকিস্তানের ‘রাজাকার’ তাহলে?
কতখানি ঘৃণিত হবেন সেই ব্যক্তি? সেটি বলাই বাহুল্য, কিন্ত কি কারণে? একই লোক আনসার নামে ঘৃণিত না হলে রাজাকার নামে কেন হচ্ছেন?
মূল কথা হচ্ছে কর্ম, কাজ। ৭১ এর পাকিস্তানি রাজাকার গণ ছিলেন গণহত্যার দোষর, এই জন্য মূলত তারা এত ঘৃণিত, এর মানে তার গণহত্যার সাহায্যকারী, গণহত্যার ভলান্টিয়ার।
এর মানে কি সব স্বেচ্ছাসেবকই তাই? আজও ফারসিতে ভলান্টিয়ার কে রাজাকারই বলা হয়, তাই বলে কি ইরানি একজন স্বেচ্ছাসেবক? রাজাকার? তিনি কি পাকিস্তানে গণহত্যা করেছেন? অনেকে সিয়েটো সেন্টো টেনে আনতে পারেন তাই আরও একটি উদাহারণ দিলাম।
অথবা একজন ইন্দো-ইরানি বা ভারতে থাকা ইরানি, তিনিও কি রাজাকার? তিনিও গণহত্যাকারী?
উত্তর হচ্ছে না, এর অর্থ আমরা প্রত্যেকে যারা স্বেচ্ছাসেবায় অংশ নেই, তারা সবাই ফারসি ভাষাতে রাজাকার।
কিন্ত তাহলে এই রাজাকার আর ঐ রাজাকার এর মাঝে তফাৎ কি? সহজ ভাষাতে রাজাকার-ই-পাকিস্তান আর শুধু রাজাকার এর মাঝের তফাৎ,
আমাদের মাঝে যদি আমরা আগামবেন সহ অন্যান্য দার্শনিকদের লেখা পড়ি এবং প্রাচীন কিছু লিপি অধ্যয়ন করি, তবে আমরা জানতে পারবো, যে তারা সিজিল নামের এক জাতের জাদুবিদ্যা করতেন, যাদের কে করা হত কাগজের উপর লিখে বিভিন্ন লেখ্য শব্দের মাধ্যমে, মেসপটেমিয়াতে যারা লিখতে জানতেন বা স্ক্রাইব তাদের বলা হত ‘জাদুকর’ এমনকি আমাদের ইসলাম ধর্ম বা হিন্দু ধর্মের মাঝেও এটি আসে যে শব্দের এবং লিখনের মাধ্যমে জগৎ সৃষ্টি, অর্থাৎ সবথেকে বড় জাদু হচ্ছে শব্দ,
আর আমাদের মাঝে এই ‘রাজাকার’ শব্দটির প্রয়োগ এত বেশী হয়েছে, যে একে কেন্দ্র করে এর বিপরীতে রীতিমত একটি কাল্টের জন্ম হয়ে গেছে। এদের মাঝে কেউই পুর্ণ শব্দটি ব্যবহার করেনি সকল ক্ষেত্রে, এমনকি অনেকে যখন ভারতের আর পাকিস্তানের রাজাকার এর শব্দের রাজনীতি আনতে চেষ্টা করেছে, তখন তারা এই বলে নাকচ হয়েছে যে ‘রাজাকার’ শব্দটি পাকিস্তানের একক দায়।
এই কারণে একজন বাংলাদেশ আনসার যে মূলত রাজাকার-ই-বাংলাদেশ এর প্রতিশব্দ মাত্র, সেটি আমরা ভুলে গেছি। আর এই প্রতিশব্দ ভুলে যাবার কারণেই আমাদের কে রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার নাম দিয়ে ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে যুগের পর যুগ একাত্তর একটি যুদ্ধ থেকে হয়ে গেছে একটি গোষ্ঠীর কাছে ধর্ম। যার পিছনের কিছুই নেই আবার সামনেও কিছুই নেই।
যে রাজাকার এর ছায়া দেখিয়ে আমাদের ক্রমশ ভারতের পেটের মাঝে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল, প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর এর পুরনো শত্রু কে চিহ্নিত করা হচ্ছিল বন্ধু বলে, আর কিছু ভারতের বিপক্ষে বললেই সে পাকি, সে রাজাকার, এই ছিল সেই ছায়ার রাজনীতি, কেননা সবাই ভাবতো এই ব্যক্তির উপর পাকিস্তানের ছায়া আছে, ধীরে ধীরে সকল ইসলামিক চিহ্ন আমাদের দেশে রাজাকার শব্দ ব্যবহার করে করে দেওয়া হয় খন্ডিত, আর সব কিছুকেই যেন পাকিস্তানের ছায়া বানিয়ে দেওয়া হয়। পুরো বাঙালি মুসলিমকে করে দেওয়া হল পতিত, কিন্ত তারা এটি ভুলে গিয়েছিল যে পতিত করলেই বেরিয়ে আসবে আদি বাঙালির সেই ভয়াবহ শক্তি, সেই বাঙালিত্ব যা চন্ডাল কে ঘরণী করে, যা গোরক্ষনাথ নামের বাংলার প্রধান ধর্মগুরুকে করে গরুর রাখাল, আর চৌরাশি সিদ্ধাদের সকলকে করে লোকায়ত। তারা দেখতে পারছিল না সেই মহা অগ্নিকে যা আমাদের মাঝে আছে
সাথে সাথে আসল আমাদের আরেক মহা বিপ্লব চব্বিশের জুলাই বিপ্লব, যাতে একটি স্লোগান আগুন ধরিয়েছিল,
“আমি কে তুমি কে
রাজাকার রাজাকার,
কে বলেছে কে বলেছে,
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার;
চাইতে গেলাম অধিকার
হয়ে গেলাম রাজাকার।
মূলত এটি ছিল বাঙালিকে পতিত করার শেষ ধাপ, কেননা এতে কোটি কোটি ছাত্রছাত্রীদের পতিত করে দেওয়া হয়, রাজাকারের বাচ্চা বলে পতিত করা হয় তাদের অভিভাবক মানে বাঙালি জাতিকেই, এই কারণেই এখান হতেই আবারও মহাসিদ্ধাদের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করে আর তারা আগের মত আর একজন হয় না, বরঞ্চ বাঙালী জাতির প্রায় সকলেই হয়ে ওঠেন একেকজন সিদ্ধা, এখানে মতিয়া বা শেখ হাসিনা কেউই আমাদের কে রাজাকার-ই-বাংলাদেশ মনে করেন নাই, মনে করেছিলেন রাজাকার-ই-পাকিস্তান, সেই পুরনো অকেজো প্রতীক আমাদের উপরে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
করতে চেয়েছিলেন লজ্জ্বিত, কিন্ত আমরা সেটিকে আপন করে নেই, কি হিসেবে? পাকি হিসেবে? পাকিস্তানি রাজাকার হিসেবে? বা আমি যদি বলি আমরা সেটি আপন করেছিলাম “বাংলার রাজাকার হিসেবে”
যদি আমরা ভাবি যে এই বাংলার রাজাকার, এটি স্রেফ সেই সময়ের শব্দ সেই সময়ের প্রতীক, কিন্ত না, এই শব্দ এই প্রতীক ছিল সকল জুলুমের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান, সকল জুলুমের বিপক্ষে আমাদের মহা প্রতীক,এই আন্দোলন এর স্লোগান ছিল সেই সব আয়নাঘরের বন্দির প্রতিবাদ যারা বিনা অপরাধে রাজাকার হবার সাজা কাটছিল, এটি ছিল সেই আবরার ফাহাদের স্লোগান, যাকে রাজাকার সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এটি ছিল সেই সমস্ত বাঙালিদের স্লোগান যারা খা’লি বা অধিকারবিহীন, যারা নাগরিক হতে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল শুধু এই একটি শব্দের কারণে, যেখানে হয়ত তাদের মাঝে অনেকে কোনদিন পাকিস্তান দেখেইনি, যারা ৭১ এর মাঝের কাল্ট যেটি জন্ম নিচ্ছিল, আমাদের মহান বিজয়কে স্রেফ একদলের অবদান বলে যারা দখল করছিল, তাদের প্রতি যারাই প্রতিবাদ করেছে, তারাই হয়েছে এর শিকার। কেননা এই শব্দ তাদের কাছেও ছিল লজ্জার, কিন্ত এই প্রথমবারের মত জালিমের এই শব্দের অপবিত্রতা এবং পবিত্রতা আমরা উভয়েই ভেঙ্গে ফেলি এটি পরিনত হয় একটি সাধারণ শব্দতে যেটি যার যার কর্মের উপরে নির্ভর করবে, শব্দের বাহন হবে কর্ম। কর্মের বাহন কখনও শব্দ হবেনা, অর্থাৎ সে কি কাজ করেছে তার উপর ভিত্তি করে তাকে তার নাম বলা হবে, যেমন আজকে আওয়ামীলীগ কেও বলা হচ্ছে রাজাকার, কিন্ত কার রাজাকার? আওয়ামী দুঃশাসনের রাজাকার, ফ্যাসিবাদের রাজাকার, আবার শিক্ষার্থীরাও রাজাকার, কার রাজাকার? বাংলার রাজাকার, বাঙালীত্বের রাজাকার। একদল দুস্কর্মের ফলে রাজাকার, একদল সুকর্মের ফলে দেশের মানুষের সাহায্যকারী বা তারাও রাজাকার, তবে একটি বিষয় পরিস্কার, আর এই বাংলার মাটির মাঝে কখনও কারো রক্ত এই শব্দটির কারণে ঝরবে না যতক্ষণ এই স্লোগানটি আছে “ আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার”
কেননা এই স্লোগান ভারতপন্থা আর পাকিস্তানপন্থা উভয়কেই বিনষ্ট করে দেয় আমাদের রাজনীতিবিদদের জবান থেকে, জন্ম হয় বাংলাদেশ পন্থার।