Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,shahaduzzaman-short-story-book-reviewed-by-nibedita-aich

মামলার সাক্ষী ময়না পাখি অনুভূতির গল্পমালা । নিবেদিতা আইচ

Reading Time: 3 minutes

এই অবরুদ্ধ সময়ে পড়ছি কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান রচিত ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ গল্পগ্রন্থটি। মোট এগারোটি সমকালীন গল্প নিয়ে গ্রন্থটি সংকলিত হয়েছে। প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন 

শুরুতেই ‘জনৈক স্তন্যপায়ী প্রাণী, যিনি গল্প লেখেন’ গল্পটি পড়তে হয়েছে কয়েকবার আর পাঠ শেষে ভাবতে হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। এই গল্পে মতিন কায়সার একজন লেখক যে একটা হয়ে-ওঠা গল্প লিখতে চায়। আর সে জানে ঠিক সে-রকম একটা গল্প লেখার সংগ্রামে সে আছে। সংগ্রামটা তার নিজের সঙ্গেই৷ গল্প লিখবে বলে সবকিছুর দিকে সে এমনভাবে তাকায় যেন প্রথমবার আর শেষবার দেখছে। তারপর মতিন একদিন খুঁজে পায় সেই গল্পকারকে, যে এই মৃত্যুচিহ্নিত পৃথিবীর নিরেট দেয়ালে অলীক ছবি এঁকে এঁকে সবার বাঁচার আশাকে জাগরূক রেখে নিজে হারিয়ে গেছে। গল্পটি পাঠককে ধোঁয়াটে ভাবনার জালে আবদ্ধ করে রাখে পাঠ শেষেও।

‘তোমার সন্তানেরা তোমার নয়। জীবনের ভেতর গুঁজে-থাকা যে তৃষ্ণা, তারা বস্তুত তারই সন্তান। তারা তোমাদের মাধ্যমে সংসারে আসে শুধু কিন্তু তোমাদের থেকে নয়।’ ‘অপস্রিয়মাণ তির’ গল্পের এই কথাগুলো ভীষণ সত্য বলে মনে হয়েছে। সত্যিই তো নিজেকে ভালোবাসি বলে আমরা সন্তানকে ভালোবাসি, যত্ন নিই, দুর্ভাবনায় আক্রান্ত হই আর প্রাণপণে চাই ওরা আমাদের বলে-দেওয়া পথেই হেঁটে যাক, আমাদের ইশারায় চলুক পুরোটা জীবন৷ ওদের ভালো চাই কারণ ওরা ভালো থাকলে আমরা ভালো থাকি।

এই বইতে আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প ‘টুকরো রোদের মতো খাম’। এই গল্পটা আন্দালীবের, শাহীনের কিংবা রীনারও। ‘আন্দালীব দেখে মুহূর্তে কোন অতল থেকে তার দুই চোখে ফুটে উঠছে অশ্রু। গুনে গুনে দুই ফোঁটা। ওজোনস্তর ভেদ করে কোনো আদিম গ্লেসিয়ারের বরফে প্রথম সূর্যতাপ পড়বার পর তা কি এমনই একাধারে মৃদু এবং তীব্রভাবে গলতে শুরু করেছিল?’ সেই কান্নার আড়ালে যে গল্পটা রয়ে গেছে, যার শুধু আভাস রেখে গেছেন গল্পকার, সমাপ্তিতে এসে সেটাই যেন পাঠককে আরো বেশি ভাবায়। গল্পের ভেতর গল্প গুঁজে দেয়ার অদ্ভুত শৈলীর কারণে এই আখ্যানটি মনে রাখবার মতন।

সমাজে যত ত্রুটিবিচ্যুতি থাকুক না কেন কলঙ্কের দায় দেবার বেলায় যুগ যুগ ধরে শুধুমাত্র নারীকে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়েছে। ‘উবার’ গল্পে শেষ লাইনটিই গল্পের সারকথা। বোরকা-পরিহিতা নারীটিকে নিয়ে হোটেলে যে ঘটনার অবতারণা হয় সেটার সমাধান হলেও আমরা দেখতে পাই গল্পের শেষে উবারড্রাইভারের চোখেও নারীটি প্রচ্ছন্নভাবে অভিযুক্ত থেকে যায়। তাই শেষলাইনে গানটা যথার্থ হয়ে ওঠে — জলেতে যাইও না তুমি কলঙ্কিনী রাধা।

‘পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার’ আরেকটা অন্যরকম গল্প। বৃষ্টি এলে রুমা যখন বলে শেডের নিচে দাঁড়াতে তখন মাসুদের বুকের মধ্যে এ-কথাটাও বাজে — ইন আদার ওয়ার্ডস আই লাভ ইউ! তারপর কায়সারের এক্সপ্লেনেশন না শুনে চলে আসা মাসুদ শেডের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। রাতে রুমার সাথে কথা হলে খবরের কাগজের সেই লজ্জাবতী লেমুরের বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয়। একটা ট্র‍্যাপড-হয়ে-যাওয়া আইডেন্টিটির মধ্যে থেকেও মাসুদ বুঝতে পারে রুমা তার কাছে আসবে, একটা শালিকের মতো তার বুকের ওপর গিয়ে বসবে। গল্পটি পড়ার সময় বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছি কোথায় গিয়ে থামতে হবে আর পাঠকের ভাবনাটা জমাট বাঁধতে শুরু করবে গল্পকার সে-কৌশলটি কী দারুণভাবেই-না প্রয়োগ করতে জানেন!

‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’ আরেকটি প্রিয় গল্প। আইসিইউতে অচেতন বাবার টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো মনে করে গল্পকথক জীবন আর মৃত্যু নিয়ে দোলাচলে ভোগে। ডাক্তারকে বারবার প্রশ্ন করে জেনে নেয় বেঁচে থাকবার সম্ভাব্যতা কতটুকু। তারপর দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু সম্পর্কে নিজের অবস্থানটা পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছে। মৃত্যু কিংবা জীবন বিষয়ক এই গল্পটি আমাকে বিষণ্ণ করেছে খুব।

‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ এবং ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’ বই দুটোর মাধ্যমে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের লেখার সাথে আমার পরিচয় ঘটে। মনে আছে ‘আন্না কারেনিনার জনৈকা পাঠিকা’ গল্পটি পড়ে সে-সময় ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। তারপর পড়া হলো ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপন্যাসটি, যা আমার মতে বাংলা সাহিত্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন। তবে পাঠক হিসেবে গল্পকার শাহাদুজ্জামানই আমার বেশি প্রিয়।


গল্পসংকলন : মামলার সাক্ষী ময়না পাখি
লেখক : শাহাদুজ্জামান
প্রকাশক : প্রথমা
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>