আনুমানিক পঠনকাল: 20 মিনিট
ভূতের গলির লোকেরা বানর নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তারা দেয়ালের ওপর অথবা দূরে ছাতের কার্নিশে লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকা এই খয়েরি রঙের জানোয়ারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে, বান্দর বান্দর, ওই যে বান্দর!
তখন হয়তো কখনো ভূতের গলির লোকেরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, হয়তো প্রসন্ন হয়ে বলে, হয়তো জটিল সময়ের ভেতর কাহিল হয়ে বিরক্তির সঙ্গে বলে।
একাত্তর সনের ঘটনা ২ মার্চের পর থেকে যখন দেশে ঘটতে থাকে, যখন রাতে ঢাকা শহরে কার্ফু জারি করা হয়, টিপু সুলতান রোড দিয়ে ছুটে যাওয়া ভারি মিলিটারি গাড়ির চাকার গোঙানি এবং গুলির ফট ফট আওয়াজ নীরবতাকে বিদীর্ণ করে, এবং যখন ২৫ তারিখের রাতে নয়াবাজারের কাঠের গোলা পুড়তে শুরু করে তখন ভূতের গলি তার বাইরে থাকে না; ভূতের গলিতেও অবধারিতরূপে একাত্তর সন নেমে আসে এবং তখন আব্দুল হালিম এই সময়ের পাকচক্রে ধরা পড়ে;আহারে আব্দুল হালিম, আহারে আমার পোলা, বলে তার মা হয়তো কাঁদে, নীরবে বিলাপ করে, মহল্লার লোকেরা হয়তো এই কান্নার শব্দ শুনতে পায় অথবা পায় না। অথবা হয়তো তার মা আর কাঁদে না, হয়তো এতদিন পর ভূতের গলির লোকেরাও আব্দুল হালিমের কথা ভুলে যায় অথবা হয়তো তারা একেবারে ভুলে যায় না, হয়তো তাদের আব্দুল হালিমের যুদ্ধ যাত্রার স্মৃতি স্মরণে আসে। মহল্লার ওপর দিয়ে দীর্ঘ সময়ের স্রোত বয়ে যায় এবং এবং কাছেই যেমন বুড়িগঙ্গা দিয়ে যায় পানি, তবু, কখন কখন মহল্লার লোকদের হয়তো আব্দুল হালিমের কথা মনে পড়ে,এবং তখন তারা বলে, হালায় পাগল আছিল এউকগা; ভূতের গলির লোকেরা সকলকেই, হালা এবং পাগল বলে,এবং পরিবর্তিত সময়ের ভেতর অর্থহীন কলরব করে; তারা লেদ মেশিন চালায় অথবা দোলাইখালের রাস্তায় পুরানো মটর গাড়ির পার্টসের দোকানদারি করে, বিকাল বেলা হয়তো বুড়া বিহারির দোকানে বসে চা খায় এবং কথা বলে,এই হালায় মান্দার পোলা ..!
মহল্লার লোকেরা বলে যে, ভূতের গলিতে আগেও বানর ছিল। যারা মহল্লার পুরাতন বাসিন্দা তারা মনে করতে পারে যে, একসময় তারা মহল্লায় অনেক বানর দেখেছে, ছাতের ওপর থেকে এই লাল টকটকে পশ্চাৎদেশওয়ালা জানোয়ারেরা দেয়াল বেয়ে নেমে এসে অরক্ষিত কোন রান্নাঘর থেকে হরলিক্সের বোতল বগলদাবা করে নিয়ে যেত। তখন মহল্লার ছোট ছেলেমেয়েরা বানরের পিছনে ছুটতো, দূরে কোন বাড়ির ছাতের কার্নিশের ওপর বসে থাকা বানরের দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভেংচি দিত, ছড়া কাটতো, বান্দর বান্দর ভেংচি, তর লাল পুটকি দেখচি! তবে কালক্রমে ভূতের গলি থেকে বানর অবলুপ্ত হয়ে যায়, কেন হয় তা গলির লোকেরা জানে না; পরে তারা বলে, তারা বস্তুত বুঝতেই পারে নাই যে মহল্লায় বান্দর নাই, এবং তারা বহুদিন বান্দর দেখে না। এভাবে বহুদিন কাটানোর পর মহল্লায় প্রথম বানর ফিরে আসে, এবং মহল্লার লোকেরা সচেতন হয়, তারা যখন বুঝতে পারে যে, সত্যি একটি অথবা একাধিক বানরের আগমন ঘটেছে, তারা ভেবে পায় না এই বানর কোথেকে এল; এই হালার বান্দরেরা আইলো কইত্থন, তখন তারা বলে। তারপর তাদের মনে হয় যে, বানর হয়তো দয়াগঞ্জ থেকে এসেছে, হয়তো গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডের গলি থেকে এসেছে; তবে মহল্লায় এতদিনের বানরহীনতায় অভ্যস্ততার কারণে তারা এদের আগমনের বিষয়টি প্রথমে বুঝেও মনে হয় যেন না বুঝে থাকে। তখন কোন একদিন চন্দ্রকান্তদের পাশের বাড়ির ভাড়াটে নূরুল হকের যুবতী স্ত্রী শিশু পুত্রের কান্না শুনে রান্না ঘরে চুলার ওপর তরকারির হাঁড়ি ফেলে ঘরে আসে, তারপর কান্না থামিয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে সে যখন পুনরায় রান্নাঘরে ফিরে যায় সে ভালমত খেয়াল করে না, তরকারি রেঁধে নামায়, ডাল রাধেঁ, তারপর কুয়া থেকে দড়ি বাঁধা বালতিতে করে পানি তুলে গোসল করে ঘরে ফিরে অপেক্ষা করে। তখন সূর্য ঠিক মাথার উপরে উঠলে পোস্তগোলার ফুড ডিপার্টমেন্টের অফিস থেকে তার স্বামী আসে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। ঘরের ভেতর চৌকির ওপর মাদুর পেতে সে খাওয়ার আয়োজন করে, রান্না ঘর থেকে বাটিতে করে তরকারি আনে, ডাল আনে, তারপর যখন গামলায় ভাত বাড়ার জন্য ভাতের হাঁড়ি নামাতে দেয়ালের তাকের কাছে যায় সে দেখে যে, তাক খালি, ভাতের হাঁড়ি নাই । তখন, ভাতের হাঁড়ি গেল কোনে, ভাতের হাঁড়ি গেল কোনে, বলে সে ভাতের হাঁড়ি খোঁজে। সেদিন দুপুরে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে রান্না ঘরের আনাচকানাচ, কুয়াতলা, ঘরের পাশের গলি সব তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে, কোথাও কিছু নাই; ভাতও নাই, এলুমিনিয়ামের হাঁড়িও নাই। প্রথমে তখন তাদের কাছে ব্যাপারটা ভৌতিক বলে মনে হয়, তারপর তাদের মনে হয় যে, রুনু যখন ছেলের কান্না থামানোর জন্য রান্নাঘর ফেলে ঘরে গিয়েছিল তখন কোন তস্কর ফকির অথবা ফকিরনি গলি দিয়ে ভিতর বাড়িতে ঢুকে দেয়ালের তাক থেকে দ্রুত ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে নিয়ে গেছে। নূরুল হক যখন সব বুঝতে পারে সে তার স্ত্রীর অসতর্কতার জন্য গালমন্দ করে, বলে, ব্যাক্কেল, এবং তখন রুনু ভাত রাধার জন্য পুনরায় চুলায় হাঁড়ি চাপায় ।
মহল্লার পশ্চিম দিকের আকাশ যেদিন রাতে নয়াবাজারের আগুনের লাল ভৌতিক আলোয় ভরে যায় এবং মহল্লার লোকেরা ভয় এবং বিহ্বলতার ভেতর শেষ রাতের ঘুম থেকে জেগে ওঠে, বন্দুক ও মেশিন গানের গুলির শব্দ এবং দূরবর্তী বিপদাপন্ন মানুষের চিৎকার শোনে, তারা তখন বুঝে উঠতে পারে না তারা কি করবে। তারা কার্ফুর ভেতরে মহল্লার রাস্তার ওপর বের হয়ে আসে এবং একে-ওপরকে জিজ্ঞেস করে, এ্যালা কি অইবো? তাদের এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত কউকে পাওয়া যায়না, মনে হয় যেন তারা উত্তর পাওয়ার জন্যও এই প্রশ্ন করে না, তারা এমনি ঘটনার ভয়াবহতার উপলব্ধির কারণে বিচলিত হয়ে পড়ায় এভাবে কথা বলে। তখন মহল্লার লোকেরা আব্দুল হালিমকে তাদের বাড়ির গেটের সামনে গলির রাস্তার ওপর দেখে, তারা বলে, কি মিঞা লাঠি লয়া কুজকাওয়াজ করলা এতদিন অখনে কি করবা, অখনে তো মাইরা শ্যাষ কইরা ফালাইবো! আব্দুল হালিম তাদের কথা শুনে চুপ করে থাকে, হয়তো দূরবর্তী লেলিহান আগুনের প্রবল ক্রুদ্ধ লাল আভা দেখে সে ভয় পায়, হয়তো তার এমনিতেই কিছু বলার থাকে না। সলিমুল্লাহ কলেজের সহপাঠীদের সঙ্গে লুঙ্গি মালকোচা মেরে কাঁধের ওপর রাইফেলের মত বাঁশের টুকরো নিয়ে লেফট-রাইট করায় এক ধরনের মজা ছিল, হয়তো এক ধরনের বিদ্রোহের প্রকাশও ছিল, এখন মহল্লার লোকদের এই প্রশ্নের সামনে সে চুপ করে থাকে। সেদিন রাতে মহল্লার লোকেরা পুনরায় যার যার বাসায় ফিরে যায়, এবং শেষ রাতের দিকে হয়তো আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর সকালে যখন তাদের ঘুম ভাঙে তারা বুঝতে পারে যে, তাদের ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেছে, কারণ মহল্লার মসজিদের মুয়াজ্জিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভয়ে মাইকে শব্দ করে আজান দেয় না এবং মসজিদের ইমাম মওলানা নুরুজ্জামান কেবলমাত্র মুয়াজ্জিনকে সঙ্গে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়া শেষ করে। লোকেরা যখন এই কথা শোনে তাঁরা জুমা ঘরের পিছনে নুরুজ্জামান মওলানার বাসায় যায় এবং বলে, হুজুর আপনেও এমুন করলেন, আপনেও ডরাইলেন! তখন মওলানা নূরুজ্জামানের চেহারা বিষণ্ন হয়ে ওঠে, সে বলে যে, আসলে তারও ভয় হয়েছিল, কারণ সেও মানুষই, তার মনে হয়েছিল যে, উত্তেজিত এবং ক্রুদ্ধ এই জন্তুদের সামনে নীরবতা হয়তো মঙ্গলকর হবে। মহল্লার লোকদের ভেতর যারা তখন অলিগলির মধ্য দিয়ে লুকিয়ে লালচান মকিম লেনের সামনে নবাবপুর রোডের
ওপর গিয়ে ওঠে তারা দেখে যে, কার্ফুর ভেতরই ঢাকার মানুষের ঢল বুড়িগঙ্গার দিকে যায়। দুই দিনের ভেতরে ভূতের গলির লোকও প্রায় সাফ হয়ে আসে এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে, আব্দুল হালিম এই সময় কোন একদিন হাসিনা আকতার ঝর্ণার দিকে তাকায়।
এই সময় মহল্লার লোকেরা প্রথমে নেপাল চন্দ্রের ভাড়াটে নূরুল হকের রান্না ঘর থেকে ভাতের হাঁড়ি হারিয়ে যাওয়ার কথা শোনে, এবং তাদেরও মনে হয় যে, এটা কোন ফকির কিংবা ফকিরনিরই কাজ, বেকুব বৌটার বেখেয়ালের কারণে ফাকাঁ রান্নাঘরে কেউ ঢুকে হাঁড়িটা নিয়ে দ্রুত গলি দিয়ে বের হয়ে গেছে। কিন্তু তখন বাঘওয়ালা বাড়িতে চুরি হয়, এই বাড়ির মালিক আব্দুর রহিম মিঞা কোন একদিন দুপুরে অথবা বিকেলে যুগিনগরে তার রহিম এন্ড কোং প্লাস্টিক ইন্ডাঃ লিঃ’ থেকে ফিরে কলতলায় মুখ ধুতে যায়, সে কলের পাশে একটি নিচু দেয়ালের ওপর তার হাতের সিটিজেন অটোমেটিক কোয়ার্জ ঘড়িটা খুলে রেখে প্রক্ষালণ কর্ম সম্পন্ন করে ঘরে ফিরে আসে, কিন্তু সে তার ঘড়িটার কথা ভুলে যায়। বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর তার ঘড়ির কথা মনে পড়ে, তখন তার স্ত্রী পারভিন কলতলায় গিয়ে দেয়ালের ওপর ঘড়ি দেখতে পায় না, সে চিৎকার করে, দেখি নাতো কুনো ঘড়িউড়ি, নাইতো এইখানে কিছু; তখন আব্দুর রহিম ঘর থেকে বের হয়ে আসে। তারপর সারা প্রাঙ্গণ, ঘরের ভেতর, সার্ট-প্যান্টের পকেট, টেবিল আলমারির দেরাজ, সর্বত্র, সবখানে সকলে মিলে তারা খুঁজে দেখে; আব্দুর রহিম এবং পারভিনের সঙ্গে তাদের তরুণ ভৃত্য আকবরও আঁতিপাঁতি করে খোঁজে। তারপর যখন বোঝা যায় যে, ঘড়িটা বাড়ির কোথাও নাই এবং যখন আব্দুর রহিম তার স্ত্রীকে এটা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করাতে পারে যে, ঘড়িটা সে অন্য কোথাও হারায় নাই, তখন যে প্রশ্ন দেখা দেয়, তা হচ্ছে, এটা তাহলে গেল কোথায়? আব্দুর রহিম বলে, বাড়ির ভিতর থেইকা জিনিছ উইড়া গেছে নিহিঃ এবং তখন তাদের সন্দেহ পড়ে আকবর এবং কাজের মেয়ে বসনার মায়ের ওপর। বাসনার মা অভিযোগ শুনেই কেঁদে ফেলে, আমি নেই নাই, আমি যুদি নিকি নিয়া থাকি আল্লায় আমার বিচার করবো, কুষ্ঠ হয়া আমার আত খয়া পড়বো। কিন্তু পারভিন এসব কথায় ভোলে না, সে বলে, এইসব কতা হুনায়ো না, আর কেউ বাড়ির ভিতরে আহে নাইকা, তুমি লইছ, না হয় আকবইরা লইছে, তুমরাই লইছ, তুমরাই বাইর কররা যুদি নিকি ভালা চাও। কিন্তু আকবর এসব কথায় একদম পাত্তা দেয় না,সে বলে, দুইশ/চাইরশ টাকা দামের এইসব ঘড়ি আমি চুরি করি না,এবং তার এই কথায় আব্দুর রহিম চেতে আগুন হয়, সে চিৎকার করে, হারামযাদা শুয়ারের জানা রোয়াব দেখাচ, তুই চুরি করচ নাই তর বাপে চুরি করছে, এই ঘড়ি বাইর কইরা দিবি! মহল্লার লোকেরা যখন আব্দুর রহিম মিঞার ঘড়ি হারানোর খবর শোনে তাদের মনে হয় যে, মহল্লায় কি চুরিদারি বেড়ে গেল, তারপর তাদের মনে হয় যে, হয়তো এটা আকবরেরই কাজ,হয়তো বাসনার মায়ের;তারা বলে,মাইর দিলেই বাপ বাপ কইরা বাইর কইরা দিবনে।
কিন্তু নয়াবাজারের কাঠের গোলা সারা রাত ধরে পোড়ার দুই দিন পর ভূতের গলির সব লোক মিলিটারি আসার ভয়ে মহল্লা ছেড়ে নদী পার হয়ে জিঞ্জিরা এবং নবাবগঞ্জের দিকে চলে যায়। আব্দুল হালিম তার মা এবং ছোট দুই বোনকে নিয়ে আরও একদিন মহল্লায় থাকে, কিন্তু তারপর তার মা, আমেনা, নীরব নিঝুম হয়ে আসা মহল্লায় আর থাকতে চায় না, বলে, খুব ডর লাগতাছে। তখন আব্দুল হালিম তার মা এবং দুই বোন রেনু আর বেনুকে জিঞ্জিরায় চরাইল গ্রামে তার ছোট খালার বাড়িতে নিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে যায় তাদের গলির একদম শেষ মাথার ৩৪ নম্বর বাড়ির আবু হায়দারের পরিবার। আবু হায়দারের স্ত্রী আগের দিন আব্দুল হালিমদের বাসায় আসে, তার সঙ্গে আসে তাদের বড় মেয়ে, ক্লাশ টেনের ছাত্রী ঝর্ণা; আব্দুল হালিম তাদের বাসার বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে থেকে দেখে মায়ের সঙ্গে কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলের পাটকেল রঙের মলিন কামিজ পরা মেয়েটি বিকেলের ঘনিয়ে আসা ছায়ার ভিতর তাদের কামিনি গাছ তলা দিয়ে কেমন কেঁপে কেপে হেঁটে আসে। তখন আব্দুল হালিম ছায়ায় জড়ান ঝর্ণার ভীত মুখ এবং চোখের দিকে তাকায়, এবং তার মনে হয় যে, মহল্লার এই মেয়েটিকে সে কি
আগে কখন দেখে নাই! বাসার ভিতরে ঢুকে কর্ণার মা যখন আমেনাকে বলে, হনলাম আফা আপনেরাও যাইতাছেন গা, আমিতো ডরে বাঁচি না, আমরা যে কই যাই, তখন আব্দুল হালিম বলে, আপনেরা আমাগো লগে চলেন, কুনো অসুবিদা অইবো না, আমাগো খালার বাইতে অনেক জায়গা আছে থাকনের কুনো ঝামেলা অইবো না, আপনেরা হগ্গলে আমাগো লগে চলেন। ভূতের গলির লোকেরা পরে বলে যে, আসলে কামিনি গাছ তলায় ঝর্ণার বিপর্যস্ত চেহারা দেখার পরেই আব্দুল হালিমের মনে হয়েছিল, সে জানে সে ঝর্ণাদেরকে তাদের সঙ্গে জিঞ্জিরা যেতে বলবে, এবং তার ফলেই হয়তো পরিণতিতে আবু হায়দারের পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে; অথবা হয়তো তা নয়, কারণ, এটা ছিল এমন এক সময় যখন কেউ জানতো না কার কখন কোথায় কি হবে।
তারপর মহল্লার লোকেরা যখন শোনে যে, আব্দুর রহিমের হারানো হাতঘড়ি আর পাওয়া যায় নাই, বাসনার মাকে ছোটখাটো চড়থাপ্পড় লাগানো এবং আকবরকে চাকুরিচ্যুত করার গুরুতর হুমকি দেয়ার পরেও তাদের কাছ থেকে ঘড়ি বের করা যায় নাই, তারা খুব হতাশ হয়; কারণ, তাদের মনে হয় যে, এরাই কেউ ঘড়িটা চুরি করেছে । তারপর, তখন, তারা মহল্লায় চুরি বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে পুনরায় বিচলিত বোধ করে এবং তারপর যখন এর কোন সমাধান বের করতে পারে না তখন তারা তাদের পুরানো কথায় ফিরে যায়, তারা বলে যে, আব্দুর রহিম যদি সত্য কথা বলে থাকে, কল তলায় হাতমুখ ধোয়ার সময় সে যদি সত্যি ঘড়ি খুলে দেয়ালের ওপর রেখে থাকে তাহলে এই ঘড়ি অবশ্যই বাসনার মা নিয়েছে, অথবা নিয়েছে আকবর। তারা বলে, ভালা কইরা একটা মাইর দিলেই বাইরইবো; কিন্তু মহল্লার লোকের এসব কথায় তেমন কোন কাজ হয় না, পারভিন সুলতানা বাসনার মাকে পুনরায় ডাল ঘুটনি দিয়ে একদিন মারে। মার খেয়ে বাসনার মা পুনরায় হাউমাউ করে, আল্লাহকে সাক্ষী মানে, বলে, যুদি আমি নিয়া থাকি তাইলে আমি মুখে রক্ত উইঠা মরুম, আমার আতে কুষ্ট অইবো, আর যুদি না নিয়া থাকি তাইলে, আপনে আমারে মারছেন, আপনের প্যাডে কুত্তার ছাও অইবো, আপনের আত লুলা হয়া যাইব, আল্লায় আপনের বিচার করব, আমি আল্লার কাছে বিচার দিছি! এই হুমকিতে আব্দুর রহিমের স্ত্রী হয়তো ভয় পায়, মহল্লার লোকেরা এইসব ঘটনার কথা শোনে কিন্তু তারা আর আব্দুর রহিমের এই পারিবারিক সমস্যায় জড়াতে চায় না। পরে মহল্লার লোকেরা বলে যে, তারা আসলে বোকা ছিল, তাদের এই বোকামির কারণ, তারা মহল্লায় বহুদিন বানর দেখে নাই, এবং বানরের কথা ভুলে যাওয়ার ফলে তাদের জীবনে এই বিভ্রান্তি আসে।
মহল্লার লোকদের এই বিভ্রান্তি সারা জীবন থেকে যায়, তারা জানতে পারে না জিঞ্জিরায় ঝর্ণার আসলে কি হয়েছিল । এপ্রিল মাসের প্রথম শুক্রবার জিঞ্জিরায় মিলিটারি অপারেশনের মধ্যে ভূতের গলির যারা পড়েছিল তারাই এ ব্যাপারে সবচাইতে বেশি অনিশ্চিত ছিল, কারণ, তারা সবকিছু সামনে থেকে দেখেছিল এবং জেনেছিল যে, যে-কারো যে কোন কিছু ঘটতে পারতো, বন্দুক বাগিয়ে ধরা পাকিস্তানি মিলিটারিদের চক্রব্যুহের ভেতর আটকা পড়া কোন মানুষ গুলি কিংবা সঙ্গিনের খোঁচা খেয়ে মরতে পারতো, সেই মানুষ নারী হলে সে ধর্ষিত হতে পারতো, ধর্ষণের পর সে নিহতও হতে পারতো। ঝর্ণার কি হয়েছিল বা হয় নাই মহল্লার লোকেরা জানতে পারে নাই, আবু হায়দার এবং তার পরিবারের কেউ এ নিয়ে কথা বলে নাই, হয়তো আব্দুল হালিম বিশদ জানতো, কিন্তু সেও কিছু বলে নাই, এবং তরপর সে মরেও যায়। হয়তো চরাইল গ্রামে কোথাও মিলিটারির তাড়া খেয়ে ছুটতে ছুটতে ঝর্ণা অন্যদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, হয়তো তখন আব্দুল হালিম তার সঙ্গে ছিল এবং তখন কোন বাড়ির আঙিনায় অথবা কোনো মাঠের মধ্যে তারা দুই জন দেখেছিল তাদের সামনে মিলিটারি; এবং তখন, মহল্লার লোকেরা ভেবে পায় না, আব্দুল হালিম কি করে বাঁচলো! ভূতের গলির লোকদের মনে হয় যে, হয়তো ঝর্ণা সব বুঝতে পেরেছিল, হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে, তার বাঁচার কোন উপায় নাই , তখন কোন ছলে সে আব্দুল হালিমকে বাঁচায়; হয়তো আব্দুল হালিম গুলি খাওয়ার ভান করে মাটিতে মটকা মেরে পড়ে থাকে এবং ঝর্ণা তাকে জড়িয়ে ধরে মিছামিছি কাঁদে, এবং তখন তাদের চারদিক থেকে একটি বৃত্ত রচনা করে মিলিটারিরা এগিয়ে আসে। তারপর মিলিটারিরা কি করে? মহল্লার লোকদের জানা হয় না, তবে তারা জানে যে, ঝর্ণাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলে কিন্তু আব্দুল হালিম বেঁচে যায়। তখন হয়তো আব্দুল হালিম চরাইল গ্রামের কোন এক মাঠের ভেতর মৃত বালিকার পাশে শুয়ে নীরবে কাঁদে, তারপর সেদিন দুপুরের পর যখন মিলিটারি অপারেশন শেষ করে নদী পার হয়ে ঢাকা ফিরে যায় তখন সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার পর আব্দুল হালিম এবং ঝর্ণার পরিবারের লোকেরা দেখে যে, তারা দুই জন নিখোঁজ। তাদের খোঁজে আব্দুল হালিমের খালাতো ভাইয়েরা এবং আবু হায়দার বের হয় এবং অনেক খোঁজার পর তাদেরকে মাঠের মধ্যে পায়; তখন হয়তো আব্দুল হালিম ঝর্ণর রক্তাক্ত দেহ নিজের কোলের ভেতর নিয়ে বসে ছিল, হয়তো সে ঝর্ণার দেহের পাশে ভয় এবং শোকের প্রবল তাড়নায় বিপর্যস্ত হয়ে মাটিতে পড়ে ছিল। হয়তো আব্দুল হালিমই একমাত্র ঝর্ণার কি হয়েছিল তার সাক্ষী ছিল; কিন্তু সে মহল্লার লোকদের কিছু বলে না, আবু হায়দারও চুপ করে থাকে। জিঞ্জিরায় মিলিটারি অপারেশনের পরদিন আবু হায়দার পরিবার নিয়ে মহল্লায় ফিরে আসে এবং দেখে যে, আরও অনেকে তার আগেই মহল্লায় ফিরেছে। তখন মহল্লার যারা আবু হায়দারকে দেখে তারা পরে বলে যে, তারা দুই দিনের ব্যবধানে যেন আবু হায়দারকে চিনতে পারে না, তার চেহারা নয়াবাজারের ভস্মীভূত কাঠের গোলার ভাপ ওঠা গরম ছাইয়ের মত কালো এবং আগ্নেয় লাগে; তারা বলে, হায়দর মিঞা কি অইচে আপনের? তখন মহল্লার এই লোকদের দিকে তাকিয়ে সে শুধু বলে, মাইয়াটারে রাইখা আইলাম জিঞ্জিরায় । মহল্লার লোকেরা মনে হয় যেন তার কথা তবু বুঝতে পারে না, তখন আবু হায়দার আবার বলে, ঝর্ণারে জিঞ্জিরার কব্বরে রাইখা আইলাম!
তবে ভূতের গলির লোকদের কাছে এক সময় সব কিছু পরিষ্কার হয়ে আসে, এবং তারা বলে যে, তারা কেন যে ব্যাপারটা বুঝতে পারে নাই! আব্দুর রহিম মিঞার হারানো ঘড়ি যখন আর সত্যি পাওয়া যায় না এবং মহল্লার লোকেরা যখন ছিঁচকে চোরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার কথা ভাবে তখন আলি রেজা ব্যাপারির মেজ ছেলে মেজর মুজিবর রহমানের স্ত্রী, রহিমা বেগম রিতা, তার দুই ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকা বেড়াতে আসে। তখন একদিন রান্না ঘরে বাচ্চাদের জন্য হরলিক্স তৈরি করার পর কাজের মেয়ে টেবিলের ওপর বয়ামটা রেখে আসে তারপর ফিরে গিয়ে দেখে কাচের বয়ামটা নাই; কিশোরী মেয়েটা অবাক হয়, সে বলে, আরে বোতলটা গেল কই, এবং সে রান্না ঘরে খোঁজে, ঘরের ভেতরে গিয়ে খোঁজে, ভাবে, হয়তো ভুল করে হাতে করে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও রেখেছে; কিন্তু কোথাও হবলিক্সের ভরা বয়ামটা পাওয়া যায় না; তারপর তারা পরিবারের সকলে মিলে খোঁজে, কোথাও নাই বয়াম! মহল্লার লোকেরা বলে যে, তারা আসলে বুদ্ধু ছিল, তারা মহল্লায় বানরের আগমনের কথা বুঝতে দেরি করে ফেলে, কারণ, তারা এজন্য তৈরি ছিল না; তখন তারা জানতে পারে যে, আলি রেজা ব্যাপারির বাড়িতে খোঁজাখুঁজির পর যখন হরলিক্সের বোতল পাওয়া যায় না তখন আলি রেজার বৃদ্ধা বিধবা স্ত্রী জরিনা বলে, বান্দরে নেয় নাইতো? জরিনা খাতুনের কথা শুনে তার বাড়ির লোকেরা অবাক হয়, তারা বলে যে, বান্দর কোথায়, বান্দর কেমন করে কাচের এত বড় বয়াম নিয়ে যাবে। কিন্তু ভূতের গলির লোকেরা যখন এই কথা শোনে, তাদের ভেতর যারা প্রবীণ অথবা বৃদ্ধ তারা বলে যে, তাদের কেন ব্যাপারটা আগে মনে হয় নাই তা তারা বুঝতে পারে না, কারণ, ঘরের ভেতর থেকে হরলিক্সের বোতল বানরেরাই নেয়; এই বানরটা হয়তো তক্কেতক্কে ছিল, সুযোগ পাওয়া মাত্র ঘরে ঢুকে বয়ামটা বগলদাবা করে নিয়ে গেছে। তখন মহল্লার লোকেরা বুঝতে পারে যে, ভূতের গলিতে বহুদিন পর হয়তো বানর আবার ফিরে এসেছে এবং তারা মহল্লায় গোপনে আগমনকারী এই বানরদের দেখা পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করে, তারা বলে, বান্দর কি হাচাই আইছে, হালাগো দেখি না ক্যালা? তারপর মহল্লার লোকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু সহসা বানরের দেখা পাওয়া যায় না। তখন একদিন রুনুর ভাতের হাঁড়ির খোঁজ পাওয়া যায়, চন্দ্রকান্তের ছোটভাই চন্দ্রশিব একদিন লাটাই এবং লাল ও সবুজ রঙের একটা ঘুড়ি নিয়ে তাদের বাড়ির ছাতে ওঠে ওড়ানোর জন্য, তখন সে পাশের বাড়ির ছাতের ওপর এলুমিনিয়ামের হাঁড়িটা পড়ে থাকতে দেখে; তারপর ভূতের গলির লোকেরা মহল্লায় বানরের উপস্থিতির বিষয়ে নিশ্চিত হয়, তারা বোঝে এবার বানরের দেখা পাওয়া যাবে।
মহল্লার লোকেরা তখন আব্দুল হালিমকে দেখতে পায়; জোড়পুল লেনের বিহারিদের দ্বারা হিন্দুদের ফেলে যাওয়া খালি বাড়ি তালা ভেঙে লুঠ করার খবর পাওয়ার পর, বাসা লুঠ হওয়ার ভয়ে আব্দুল হালিম তার মা এবং দুই বোনকে জিঞ্জিরায় রেখে মহল্লায় ফিরে আসে। সে যেদিন ফিরে আসে সেদিন অথবা পরদিন রাতে তাদের দরজায় সে ঠকঠক করে আঘাতের শব্দ শোনে, তার প্রথমে ভয় লাগে, সে সাড়া না দিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকে। তখন দরজার বাইরে থেকে আবু হায়দার তাকে ডাকে, আব্দুল হালিম আমি ঝর্ণার বাপ, এবং তখন আব্দুল হালিম দরজা খুলে বের হয়। আবু হায়দার সে রাতে আব্দুল হালিমকে তার বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়, সে তাকে বলে যে, এ সময় রাতের বেলা বাসায় এরকম একা থাকা নিরাপদ নয়; এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে, প্রথম রাতেই সে আবু হায়দারের বাসায় চুরি করে! মহল্লার লোকেরা বলে যে, এই ঘটনার কথা হয়তো কেউ জানতে পারতো না, কিন্তু তারা বলে যে, ঘটনা জানার জন্যই ঘটে, যেভাবেই হোক তা জানাজানি হয়ে যায়, কারণ, জানা না গেলে কোন ঘটনা আর ঘটনাই থাকে না। সে জন্যই দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর, কত বছর পর মহল্লার লোকেরা বলতে পারে না, তখন কোন একদিন গলির আবর্জনা বয়ে নিয়ে বড় রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলার জন্য নিয়োজিত ঝাড়ুদারনি নিমফল দাসী আব্দুল হালিমদের বাসার সামনে দেয়ালের পাশে ফেলা জঞ্জাল পরিষ্কার করতে থাকে, সে সময় সঙ্গে আসা তার ছোট বালিকা মেয়ে, জবাকুসুম দাসীকে আমেনা বেগম তাদের বাসার ভেতর ডেকে নিয়ে যায় এবং এভাবেই আব্দুল হালিমের চুরির বিষয়টি প্রকাশিত হয়।
বানরের আগমনের বিষয়ে ভূতের গলির লোকেরা নিশ্চিত হয়, কিন্তু তারা তাদের দেখা পায় না; তখন বানরের দেখা পাওয়ার জন্য মহল্লার লোকেরা ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
যেদিন জবাকুসুমকে আমেনা বেগম তাদের বাড়ির ভেতর ডেকে নিয়ে যায়, সেদিন রাতে অথবা অন্য কখনো মহল্লার লোকেরা এই ঘটনার কথা জানতে পারে; জবাকুসুমকে নিমফল কাজের সময় প্রতিদিনই সঙ্গে করে নিয়ে আসে, সে কাজ করে আর জবাকুসুম তার পিছনে ঘুরঘুর করে, অথবা কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে থেকে হাতের নখ খায়। এরকমভাবেই সে সেদিন আব্দুল হালিমদের বাইরের গেটের কাছে হয়তো দাঁড়িয়ে ছিল, হয়তো, এ মাঈ এ মাঈ, বলে নিমফল দাসীকে বিরক্ত করছিল; তখন বৃদ্ধা আমেনা বেগম বের হয়ে এসে জবাকুসুমকে ভেতরে নিয়ে যায়। তারপর জবাকুসুম যখন পুনরায় রাস্তায় ফিরে আসে তখন তার মা দেখে যে, তার মেয়ের চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, পিছনে ঝুটি করা চুলে লাল সাটিনের একটি ফিতা ফুলের মত করে বাঁধা। মহল্লার লোকেরা বলে যে, সুদীর্ঘ সময় ধরে আমেনা বেগম এই চুলের ফিতাটা সংরক্ষণ করেছিল এবং এই ফিতাটা আসলে ছিল আবু হায়দার মিঞার মেয়ে ঝর্ণার, আব্দুল হালিম এটা চুরি করে এনে তার নিজের ঘরে রেখে দিয়েছিল!
মহল্লার লোকেরা যখন শোনে যে, নেপাল চন্দ্রের ভাড়াটের হারানো ভাতের হাঁড়ি ছাতের ওপর পাওয়া গেছে, তারা বুঝতে পারে, আব্দুর রহিমের খোয়া যাওয়া সিটিজেন হাত ঘড়িও নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, এবং এই খবর শোনার জন্য তারা প্রতীক্ষা করে; তবে তার চাইতেও বেশি আগ্রহের সঙ্গে তারা অপেক্ষা করে মহল্লার বাড়িঘরের ছাতে, কোন কার্নিশ অথবা দেয়ালের ওপর বানর দেখার জন্য। তারা বুঝতে পারে না এই বানর ভাত খেয়ে যায়, খুলে রাখা ঘড়ি নিয়ে পালায়, হরলিক্সের বোতল লোপাট করে, কিন্তু দেখা দেয় না কেন। তারা বানর দেখতে পাওয়ার খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করে, তারা জানে এ খবর তারা পাবেই।
নিমফল দাসীর মেয়ের চুলে আমেনা বেগম লাল ফিতা বেঁধে দিলে, মহল্লার লোকেরা এই খবর পায় এবং তারা বলে যে, এই ফিতা ঝর্ণারই, আবু হায়দারের বাসা থেকে আব্দুল হালিম চুরি করেছিল। জিঞ্জিরায় ঝর্ণার মৃত্যুর পর মহল্লায় ফিরে আব্দুল হালিমকে একদিন রাতে আবু হায়দার তাদের বাসায় ডেকে নিয়ে যায়, বলে, রাইতের বেলা আমাগো বাসায় আয়া থাক। কিন্তু আবু হায়দারের বাসায় আব্দুল হালিমকে থাকতে দেয়ার জন্য খাট কিংবা চৌকিতে জায়গা হয় না; বাইরের ঘরের একমাত্র চৌকিতে আবু হায়দারের ছোট দুই ছেলে শোয়, তখন আব্দুল হালিমের জন্য মেঝেতে ঢালা বিছানা পাতা হয়, আব্দুল হালিম বলে, কুনো অসুবিদা নাই। তারপর মশারি টাঙানোর আয়োজন করা হয় এবং তখন হয়তো ইলেক্ট্রিক চলে যায় অথবা বাতি হয়তো মিলিটারির ভয়ে আগে থেকেই নেভানো ছিল; এই অন্ধকার অথবা আধোঅন্ধকারের ভেতর মশারি টাঙাতে গিয়ে দেখা যায় এক কোনার রশি নাই, তখন মশারি বাঁধার জন্য দড়ি অথবা দড়ি জাতীয় কিছু খোঁজা শুরু হয়। ঘরের ভেতর আবু হায়দার, তার ছেলেরা এবং আব্দুল হালিম খোঁজে, কিন্তু পছন্দ মত কিছু পায় না। তখন কোন একসময় আব্দুল হালিম কোন টেবিলের ওপর অথবা চৌকির তোশকের নিচে ঝর্ণার চুলের ফিতাটা পায়, সামান্য একটু নাড়াচাড়া করেই বুঝতে পারে এটা একটা চুলের ফিতা, এবং এই বাসায় এ ধরনের ফিতা পরার আর কেউ না থাকায় সে নিশ্চিত হয়, এটা ঝর্ণার, এবং ভূতের গলির লোকেরা বলে যে, সে তখনই অথবা পরে রাতে অন্ধকারের ভেতর শুয়ে শুয়ে ঠিক করে, এটা সে নিয়ে যাবে। সে রাতে, তখন আবু হায়দার যখন বুঝতে পারে যে, আব্দুল হালিম কিছু একটা পেয়েছে, সে বলে, দেখি কি, দ্যাও দেখি; কিন্তু ঝর্ণার চুলের ফিতা দিয়ে মশারি বাঁধার ইচ্ছা হয়তো আব্দুল হালিমের হয় না, অথবা হয়তো যেহেতু সে ঠিক করে যে, সে সেটা চুরি করবে, সে তখন বলে, এইটা দিয়া অইবো না। সকালে নিজেদের বাসায় ফেরার সময় সে চুলের ফিতাটা লুকিয়ে নিয়ে আসে এবং কাগজে মুড়ে নিজের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে অথবা চৌকির তোশকের তলায় রেখে দেয়। সে হয়তো ঝর্ণার এই ব্যক্তিগত জিনিসটা স্মৃতি হিসাবে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু সে নিজেই আর বেশি দিন বাঁচে নাই।
ভূতের গলির লোকেরা অনেকদিন থেকে ভাবে যে, মহল্লায় বানর আছে, কিন্তু ‘তারা যখন তা দেখতে পায় না, তখন প্রতীক্ষার ভেতর তারা পুনরায় বিভ্রান্ত হতে থাকে, তাহলে কি আসলে বানর নয়, অন্য কিছু, অন্য কেউ? কিন্তু তাদের এই বিভ্রান্তি এবং আপেক্ষার কাল এবার দ্রুতই শেষ হয় এবং তারা বানর দেখতে পাওয়ার খবর পায়।
আব্দুল হালিমের কথা যখন ভূতের গলির লোকেরা শোনে তখন তাদের মন বিষণ্নতায় ভরে যায়, কারণ, মহল্লায় এখন যারা প্রবীণ তারা বলে যে, সে সময় তাদের বয়স কম ছিল, এবং তখন জিঞ্জিরা থেকে ফিরে আসার পর তারা মহল্লার ভেতর ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে বাস করছিল। আব্দুল হালিম কয়েকদিন পর জিঞ্জিরা গিয়ে তার মা এবং ছোট দুই বোনকে ভূতের গলিতে নিয়ে আসে এবং তখন কিছুদিন পর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মহল্লায় শোনা যেতে থাকে। ভূতের গলির লোকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকম কীর্তির কথা শোনে এবং তখন আব্দুল হালিমের সঙ্গে দেখা হলে তারা ভাবে যে, আব্দুল হালিম হয়তো মুক্তিযুদ্ধে যাবে, হয়তো তারা তাকে বলে, কি মিঞা যুদ্দে যাইবা নিহি, খালি বাঁশের লাডি লয়া লেপ্ট রাইট করলা! কিন্তু আব্দুল হালিমের যুদ্ধে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না, তবে, তারপর অবশেষে একদিন আষাঢ় মাসের কোন এক রাতে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সে বাসা ছেড়ে যায়; এবং মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, আব্দুল হালিমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে নিখোঁজ হয়েছে, তার মায়ের জন্য রেখে গেছে ছোট একটা চিরকুট। ভূতের গলির লোকেরা এই খবর যখন পায় এবং তারপর তারা যখন গোপনে রাতের বেলা বিবিসি এবং স্বাধীন বাংলা বেতারে যুদ্ধের খবর শোনে, তাদের মনে হয় যে, হয়তো আব্দুল হালিম কোথাও কোন সেক্টরে কোন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তখন একদিন তারা তার মৃত্যুর খবর শোনে, এবং তারা বলে, আহারে আব্দুল হালিম! মায়ের জন্য টেবিলের ওপর চিরকুট রেখে যাওয়ার মাস দুয়েক পর ভাদ্র মাসের ১৬ তারিখ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার সময় এক অপরিচিত যুবক আসে মহল্লায়, সে দ্রুত হেঁটে গিয়ে আব্দুল হালিমদের বাসার সম্মুখ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে তারপর আমেনা বেগমের সঙ্গে কথা বলে পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়; এই যুবক আব্দুল হালিমের মৃত্যুর খবর নিয়ে আসে। মহল্লার লোকেরা জানতে পরে যে, আব্দুল হালিম আষাঢ় মাসের ২৩ তারিখ বুধবার দিন শেষ রাতে বাসা থেকে বের হয়ে অলিগলির ভেতর দিয়ে হাজারিবাগে একটা বাসায় যায়, সেখান থেকে তারা মোট চারজন, যাদের ভেতর এই সংবাদ বাহক যুবকও ছিল, কামরাঙ্গির চরের ভেতর দিয়ে বুড়িগঙ্গার কূলে গিয়ে পৌঁছায় । নদীর কিনারায় তখন একটা মাঝারি আকারের ছৈ তোলা পানসি নৌকা বাঁধা ছিল, নৌকায় নিকষ অন্ধকারের ভিতর আরো অনেক লোক আব্দুল হালিমদের এই দলের জন্য অপেক্ষা করে বসে ছিল। সেদিন, আগন্তক এই যুবক আব্দুল হালিমের মায়ের বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলে যে, তারা যখন এই নৌকায় উঠছিল আব্দুল হালিম পা পিছলে নিচে পানিতে পড়ে যায়। তখন প্রবল বর্ষণ, হাওয়ার ঝাপটা আর ঢেউয়ের ঘূর্ণি ছিল, এবং আব্দুল হালিম সাঁতারও জানতো না, সে সেই অন্ধকারের ভেতর নদী বক্ষে হারিয়ে যায় এবং অন্যদের পক্ষে তখন তাকে খোঁজার জন্য বেশি অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ভূতের গলির লোকেরা বলে যে, সেদিন তারা আব্দুল হালিমের মার কান্নার কোন শব্দ পেয়েছিল কিনা তা তাদের মনে নাই।
তারপর খুব শীঘ্রই মহল্লার লোকেরা বানরের সাক্ষাৎ পায়। প্রথম দিন হাজি আব্দুর রাজ্জাকের লেবেষ্ণুশের কারখানার শ্রমিকেরা পিছনের আঙিনায় দুটো বানরকে বড় কড়াইয়ে রাখা পানি খেতে দেখে এবং মহল্লার লোকেরা এই খবর জানতে পারে। এরপর ক্রমাগত এই বানরদের দেখা যেতে থাকে। কিছুদিন পর মহল্লার লোকেরা নিশ্চিত হয় যে, ভূতের গলিতে তারা বিভিন্ন জায়গায়, ছাতে, দেয়ালের ওপর অথবা কোন কার্নিশে যে দুটি বানরকে দেখে, সেগুলো আসলে একই বার, এবং তারা আরো নিশ্চিত হয় যে, বানর দুটির একটা, যেটা আকারে বড়, সেটা মর্দা বানর, অন্যটা মাদি । তখন ভূতের গলিতে বান্দর নিয়ে সব ঘটনা ঘটতে থাকে, এবং মহল্লার লোকেরা বিহারির দোকানে বসে আলুপুরি এবং চা খায় আর বানরের গল্প করে। তখন একদিন এরশাদ সাহেবের বাসায় রাতে ডাকাত পড়ে, ডাকাতেরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সোনাদানা টাকাপয়সা সব নিয়ে যায়, যাওয়ার সময় এরশাদ সাহেবের স্ত্রী চিৎকার করলে তার পেটে চাকু বসিয়ে দিয়ে, রাস্তার ওপর হাত বোমা ফাটিয়ে মাইক্রো বাসে করে চলে যায়। পরদিন পুলিশ এসে তদন্ত করে সব বিবরণ টুকে নিয়ে যায়; ভূতের গলির লোকেরা মহল্লায় ডাকাতির কথা শোনে, বিচলিত হয়, এবং তারা বলে, এই বান্দর দুইটা থাকে কই, গাছে, না কুনো বাড়ির ছাদে? তাদের কাছে এই বিষয়টিও অনেক দিন ধরে রহস্য হয়ে থাকে। বানর দুটো, একটার পিছনে অন্যটা, দেয়ালের ওপর দিয়ে হেলেদুলে হেঁটে যায়, কোন এক বাড়ির ছাতের ওপর থেকে অন্য বাড়ির ছাতের ওপর লাফিয়ে পড়ে অথবা দুপুর বেলা কোন কার্নিশের ওপর লেজ ঝুলিয়ে শুয়ে থাকে। মহলার নারী পুরুষ, শিশু কিশোর এবং বৃদ্ধ, সকলে, যখন যার হাতে সময় থাকে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বানর দেখে, বানরের সব কিছুই তাদের কাছে খেলা মনে হয়; কিন্তু তারা এই বানরদের আস্তানার হদিস জানতে পারে না।
আব্দুল হালিম তার মার জন্য চিরকুট লিখে চলে যাওয়ার পর একদিন আমেনা বেগম সাটিনের লাল চুলের ফিতাটির সন্ধান পায়। কোন একদিন ঘর গোছাতে গিয়ে আব্দুল হালিমের টেবিলের ড্রয়ারে অথবা বিছানার তোশকের নিচে সে কাগজে জড়ানো ফিতাটা দেখে প্রথমে ভাবে এটা রেনু কিংবা বেনুর কিনা; তার এই বিষয়টি ভেবে হয়তো অবাক লাগে যে, তার মেয়েদের চুলের ফিতা এমন পরিপাটি করে ভাঁজ করে কে কাগজে মুড়ে রেখেছে। তবে তার এরকম সন্দেহ হয় যে, ফিতাটা আসলে হয়তো রেণু/বেনুর নয়, অন্য কারো। তখন আমেনা বেগম ফিতাটা নাকের কাছে নিয়ে শুকে দেখে বিষয়টা নিশ্চিত হয়, কারণ, এই সাটিনের ফিতা থেকে কদুর তেলের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, এবং এক মুহুর্তে সে বুঝতে পারে যে, এটা ঝর্ণার; ঝর্ণা হয়তো সুগন্ধি তেল দিত মাথায়। মহল্লার লোকেরা বলে, জবাকুসুমদাসীকে আব্দুল হালিমের মা ফিতাটা দিয়ে দেয়ার পরই কেবল তারা এই ফিতার কথা শোনে এবং জানতে পারে যে, আব্দুল হালিম এটা চুরি করেছিল, তারা বলে যে, এই ফিতার দিকে তাকিয়ে আমেনা বেগমের মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়, হয়তো মৃত বালিকা ঝর্ণার জন্য, হয়তো তার পাগল ছেলের জন্য। তারপর, সেদিন সে ফিতাটা একই কাগজে জড়ানো অবস্থায় তার বেতের ব্যক্তিগত তোরঙ্গের ভেতর সংরক্ষণ করে রেখে দেয় এই আশায় যে, একদিন আব্দুল হালিম যখন মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরবে তখন সে বুঝতে পারার আগেই আমেনা বেগম ফিতাটা ঠিক আগের জায়গায় রেখে দেবে; এবং তখন আব্দুল হালিমের যখন ফিতাটার কথা মনে পড়বে সে বিছানার তোশক উল্টে দেখতে পাবে যে, আরে আশ্চর্য, ফিতাটা একই অবস্থায় রয়ে গেছে এবং তখন হয়তো তার ঝর্ণার কথা মনে হবে এবং চোখ বাষ্পচ্ছন্ন হয়ে আসবে। মৃত ঝর্ণার কথা ভেবে ছেলের চোখে পানি দেখা দেয়ার সম্ভাবনায় তখন আমেনা বেগমের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে; সে তোরঙ্গের ভেতর ফিতাটা রেখে দিয়ে দিন গনে।
ভূতের গলিতে বানরের গল্প শোনা যায়, মহল্লার লোকেরা বলে, হালা বান্দরের কথা হুনচোস, হালারা বহুত বিটলা কইলাম; এবং তারা এই গল্পের ভেতর নিমজ্জিত হয়ে থাকে। তখন একদিন আব্দুর রহিমের হারানো হাতঘড়িটা পাওয়া যায় এবং আব্দুর রহিম মিঞার প্লাস্টিকের কারখার কর্মচারি এবং একই সঙ্গে তার গৃহভৃত্য আকবর বানরের আস্তানা খুঁজে বের করে। মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, আসলামদের চালতা গাছে একদিন আসলাম চালতা পাড়তে উঠলে গাছের কোটরের ভেতর ঘড়িটা পায় পিটিয়ে ভাঙা অবস্থায়, এবং সে দেখেই বুঝতে পারে যে, এটা আব্দুর রহিমের খোয়া যাওয়া ঘড়ি। তখন আসলাম ভাঙা ঘড়িটা আব্দুর রহিমের বাড়িতে গিয়ে দিয়ে আসে। পরে দুপুর বেলা ভাত খেতে এসে আব্দুর রহিম এবং আকবর ঘড়িটা দেখে, পারভিন দেখায়, বলে, বান্দরে লয়া গেছিল গা, কেমুন পিটায়া ভাঙচে! তখন পারভিনের কথা শুনে আকবর রাগে ফেটে পড়ে, বলে, আপনেগো ঘড়ি ইন্দুরে লয়া যায় বান্দরে লয়া যায়, আপনেগো কুনো তাল নাইকা, আর আপনেরা আমাগো চোর বানান, গাইল পাড়েন! তখন এক কথায় দুই কথায় কথা বাড়তে থাকে এবং এক সময় আব্দুর রহিম রেগে গিয়ে পায়ের স্যান্ডেল খুলে আকবরকে পেটয়; স্যান্ডেলের বাড়ি খেয়ে আকবর আরো ক্ষেপে যায়, এবং সে লাঠি নিয়ে বানরের খোঁজে বের হয়। তারপর যখন সে ফখরুলদের বাড়ির দোতলার সিঁড়ি ঘরের ছাতের ওপর বানর দুটোকে পায়, তার মনে হয় যে, এটাই এদের স্থায়ী থাকার জায়গা; কিন্তু পরিণতিতে সেদিন এই বানরেরা আকবরের পশ্চাৎদেশে কামড়ে দেয়। সেদিন প্রথমে মহল্লার বাড়িঘরের ছাতের ওপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে আকবর বানর খোঁজে, তারপর বিকাল বেলা এখলাসউদ্দিনের চারতলা বাড়ির ছাতে উঠে যখন দূরে তাকায় সে ফখরুলদের সিড়ি ঘরের ওপরে পানির ট্যাঙ্কের তলায় বানর দুটোকে শুয়ে থাকতে দেখে। এই জায়গার চারপাশে টিনের কৌটা, কাচের শিশি বোতল, দলা পাকানো কোঁচকানো কাপড়ের টুকরা পড়ে থাকতে দেখা যায়; এসব দেখে আকবর বুঝতে পারে, এটাই বান্দরের বাসা এবং তখন সে এমন কাজ করে যে, বানর তাকে কামড়ে দেয়। মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, আকবর দূর থেকে বানরের আস্তানার স্থান নির্ণয় করার পর ফখরুলদের বাসায় যায় এবং বাসার লোকদের কিছু না বলে দোতলার ছাতে ওঠে, সেখান থেকে সে লাঠিটা মুখে কামড়ে ধরে পানির পাইপ বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে। তখন পানির লোহার পাইপ বেয়ে ওঠার সময় হয়তো শব্দ হয়েছিল, ফলে বানরেরা তৈরি ছিল, আকবরের মাথা সিঁড়ি ঘরের ছাতের ওপর থেকে দেখা যাওয়া মাত্র বানর দুটো দাঁত খিঁচিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আকবর তার লাঠি ব্যবহার করার কোন সুযোগই পায় না, বানরের হামলার মুখে সে হাত ছেড়ে দিয়ে দোতলার হাতের ওপর পড়ে যায়, তার মুখের লাঠি কোন দিকে যায় তার ঠিক থাকে না। কিন্তু বানরেরা তবু তাকে ছাড়ে না, লাফিয়ে নেমে তেড়ে আসে, আকবর মরিয়া হয়ে তখন সিঁড়ির দরজার দিকে দৌঁড় দেয়, এবং সে যখন দরজা পেরিয়ে প্রায় ভেতরে চলে যাচ্ছিল তখন পুরুষ বানরটা এসে পেছন থেকে তার কোমরের নিচে প্যান্টের ওপর কামড় বসায়। তবে সুতি মোটা কাপড়ের প্যান্ট হওয়ায় সে বেঁচে যায়, দাঁত তার গায়ে ফোটে না। কিন্তু মহল্লার লোকেরা যখন এই খবর পায়, তারা বিশ্বাস করতে পারে না যে, অত বড় একটা জানোয়ার ক্ষেপে গিয়ে কামড়ে দেয়ার পরও গায়ে দাঁত বসবে না; তারা তখন আকবরকে বিরক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বলে, হাচাই তর হোগার কুনো ক্ষতি হয় নাইকা, ভালা কইরা দেখ কামড় লাগছে নিহি, বাসনার মায়েরে দিয়া দেখা! কিন্তু আকবর তাদের পাত্তা দিতে চায় না, সে বলে, আপনেগো এত খাওজানি অইতাছে ক্যালা; তারপর মহল্লার লোকদের সে বলে যে, তার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু ভূতের গলির লোকেরা এত সহজে তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয় না, তারা বিহারির দোকানে বসে যখন আকবরকে দেখে তাকে চিৎকার করে ডাকে, অই আকবর, অই হালারপোত এদিকে আয়, এবং তারপর তাকে ভয় দেখায়। তারা বলে যে, কুকুর কামড়ালে যেমন মানুষের পেটে কুকুরের বাচ্চা হয় এবং মানুষ পাটের দড়ির মত মোচড় খেয়ে মুখে ফেনা তুলে মরে যায়, সে রকম হয় বানর কামড়ালেও; তারপর তারা বলে, তরে বন্দরে কামড়াইছে, নিজে নিজে মাদবরি না কইরা ডাক্তারের কাছে যা, যায়া হোগা দেখায়া সুই ল গা, না হইলে তুই মরবি; কিন্তু আকবর মুখ ব্যাদান করে, তাদের কথা শোনে না। তখন আব্দুর রহিম বিষয়টা জানতে পারে এবং বিকাল বেলা সে তাকে জোড়পুল লেনে ওয়াজেদ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ওয়াজেদ ডাক্তার জিজ্ঞাসাবাদ করে সবকিছু জেনে নেয়, তবু তার মনে হয় যে, ব্যাপারটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য একবার দেখা প্রয়োজন; এবং তখন আব্দুর রহিমকে চেম্বার থেকে বের করে দিয়ে সে যখন বলে, একটু দেখা দরকার, তখন আকবর প্যান্ট খুলে নিচে নামিয়ে তার পশ্চাৎদেশ ওয়াজেদ ডাক্তারের স্পট লাইটের আলোর সামনে উচু করে ধরে। ওয়াজেদ ডাক্তার ভাল করে দেখে আকবরের বুকে বানরের দাঁতের কামড়ের কোন ক্ষত হয়েছে কিনা, তারপর মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে, কিছু হয় নাই তোমার। তখন আকবরের সঙ্গে ভূতের গলির লোকদের দেখা হয়, তারা বলে, ডাক্তাররে হোগার কাপড় খুইলা দেখায়া আইলি!
আমেনা বেগম যেদিন তার ছেলের মৃত্যুর খবর পায়, তারপর কোন একদিন হয়তো বেতের তোরঙ্গের ভেতর রাখা লাল ফিতাটার কথা তার মনে পড়ে, এবং ভূতের গলির লোকেরা বলে যে, এই বস্ত্রখণ্ড তার ছেলের স্মৃতির তাবৎ স্মারকের চাইতে বড় হয়ে ওঠে। এবং তারপর পুনরায় তোরঙ্গের ভেতর ফিতাটা দীর্ঘদিন পড়ে থাকে, রেনু এবং বেনুর বিয়ে হয়ে যায়, তাদের বাচ্চা হয়, এই বাচ্চারা বড় হতে থাকে, এবং আমেনা বেগমের শরীর জীর্ণ মলিন হয়ে আসে। এই সময় হয়তো সুগন্ধি ফিতাটার কথা ভেবে সে বিচলিত হয়ে পড়ে এবং একদিন বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিমফল দাসীর মেয়েটিকে দেখে; এবং তারপর সেদিন মহল্লায়। • লাল চুলের ফিতার ইতিহাস প্রকাশিত হয়।
তখন বানরেরা একদিন অন্য এক কাণ্ড করে, তারা একটা আস্ত পিস্তল চুরি করে আনে; কেউ কেউ বানরদেরকে এই অস্ত্র নিয়ে খেলা করতে দেখে, এবং মহল্লার লোকেরা যখন এই খবর পায় তারা ভাবে যে, এটা হয়তো আসল না, খেলনা পিস্তল। তারপর তাদের মনে হয় যে, এটা হয়তো আসলই, তবে তারা বুঝতে পারে না এই অস্ত্রটা কার, এবং তারা বলে, অইবো কারু, কত মাইনষের কত রকমের পিস্তল আছে মহল্লায়। তারপর তারা ভাবে যে, পিস্তলওয়ালা নিশ্চয়ই তার এই অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করবে এবং তারা তখন জানতে পারবে পিস্তলের মালিক কে; কিন্তু পিস্তল উদ্ধার করার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না, অথবা হয়তো আসে এবং গোপনে সেটা উদ্ধার করে নিয়ে যায়, মহল্লার লোকেরা জানতে পারে; মহল্লার লোকেরা শুধু জানতে পারে যে, দুই দিন ধরে দখলে রাখার পর বানরেরা অস্ত্রটা কোথাও ফেলে দেয়। তখন মহল্লার ছাতের ওপর দিয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বানরদের ঘুরে বেড়ানোর খবর হয়তো সূত্রাপুর থানার পুলিশদের কানে যায়, কারণ, সহসা একদিন তারা মহল্লায় এসে হাজির হয় এবং মহল্লার লোকদের পিস্তলের কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু মহল্লার যারা পুলিশের সাথে কথা বলে তারা ঝামেলায় জড়াতে চায় না, প্রথমে চুপ করে থাকে, তারপর বলে, পিস্তলের খবর আমরা কি জানি, আমরা কুনো পিস্তলউস্তল দেখি নাইকা ; এবং তখন তারা আকবরকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে। ভূতের গলির লোকদের আব্দুর রহিমের এই ভৃত্য আকবরের প্রতি বানরের আস্তানা খুঁজে বের করার জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ হয়, কিন্তু তাকে দেখলে তাদের পরিহাস করার ইচ্ছা জেগে ওঠে, তারা তার দিকে তাকিয়ে হাসে এবং বলে, কিরে আকবইরা, বান্দরের লগে পারছ না, হোগায় কামড়ায় দিল! তখন এতদিন পর মনে হয় যেন আকবরের মন মেজাজ প্রসন্ন হয়ে আসে সে মহল্লার লোকদের কথায় চেতে না, বরং হাসে এবং বলে, খাড়ান না ক্যালা, দেখেন না, আপনেগো হোগায়ও কুন দিন আয় কামড়ায়!
তখন ভূতের গলির লোকদের আব্দুল হালিমের কথা মনে পড়ে, তাদের মনে হয় যে, অনেক দিন তারা আমেনা বেগমকে ঠিকমত দেখে নাই । এই দীর্ঘ সময়ে আমেনা বেগমের জীবন হয়তো নিঃশেষ হয়ে আসে, হয়তো শীতের পূর্বেকার অশ্বত্থের পাতার মত বিবর্ণ হয়ে ওঠে এবং ঝরে পড়ার প্রান্তে উপনীত হয়ে হিমেল হাওয়ায় ঝির ঝির করে কাঁপে।
মহল্লার লোকেরা কেউ কেউ কখনো বানর দেখার জন্য এখলাসউদ্দিনের বাসায় যায়, চার তলার ছাতে উঠে দূরে ফখরুলদের সিঁড়ি ঘরের ওপর বানর দুটোকে দাপাদাপি করতে দেখে; তাদের তখন খুব আমোদ হয়। এখলাসউদ্দিনের বড় ছেলের স্ত্রী মনোয়ারা, মেয়েটি ভাল, সুন্দর, গোলগাল এবং নরম স্বভাবের সে স্বামীর সঙ্গে বাসার চার তলায় থাকে, কখনো তার স্বামী কোন কারণে অথবা কারণ ছাড়াই তাকে গালমন্দ করলে তার খুব মন খারাপ হয়, তখন সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দূরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ রকম একদিন মনোয়ারাকে তার স্বামী আব্দুল কুদুস কোন কারণে অথবা অকারণেই বকাঝকা করে, মাগি বলে গাল দেয়, তাতে মনোয়ারার খুব মন খারাপ লাগে এবং সে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়; তখন সে ফখরুলদের সিড়ি ঘরের ছাতের ওপর বানর দুটোকে হুটোপুটি করতে দেখে। তার মনে হয় যে, প্রাণী দুটোর কোন ক্লান্তি নাই, তারা ক্রমাগত লাফায়, জড়াজড়ি করে, একজন আরেকজনকে কামড়ায়; তখন, তারপর, মনোয়ারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একদম হঠাৎ, মেয়ে বানরটা ছাতের ওপর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং পুরুষটি পিছন থেকে উপগত হয়, মহল্লায় নেমে আসা বিকালের নরম আলোর ভেতর প্রবলভাবে কটি সঞ্চালন করে সঙ্গম করে। মনোয়ারা ভাবে যে, সরে যাওয়া উচিত, কিন্তু সে সরে না, দেখে আরো দূরে মহল্লায় সূর্য ডুবে যায়।
ঔপন্যাসিক, গল্পকার। তিনি ১৯৫৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার নারিন্দার ৩৬ ভূতের গলিতে (ভজহরি সাহা স্ট্রিট) জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তার নাম ছিল মোহাম্মদ শহীদুল হক। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার স্বাতন্ত্র্য চর্চার জন্য তিনি পরিচিত। তিনি চারটি উপন্যাস এবং তিনটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের একটি, যেটির জন্য ২০১০ সালে তিনি মরণোত্তর প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১৫ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮), সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (১৯৯৫), ও মুখের দিকে দেখি (২০০৬) উপন্যাসগুলোকে বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন বলে বিবেচিত হয়। পারাপার (১৯৮৫), ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প (২০০০), এবং ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪) তার রচিত উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ।