| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সম্পাদকের পছন্দ সাহিত্য

মনোজগতের কাঁটা

আনুমানিক পঠনকাল: 23 মিনিট

ভূতের গলির লোকদের জীবন দীর্ঘদিন যাবৎ একটি সঙ্কটের ভেতর দিয়ে পার হয় বলে জানা যায়; বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৮০’র দশকে দ্বিতীয় সামরিক শাসনের কাল শুরু হয়, এই সময় ভূতের গলির পশ্চিম প্রান্তে রাস্তা যেখানে তিনভাগে হয়ে জোড়পুল, পদ্মনিধি লেন এবং র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিটের দিকে গেছে, সেখানে আব্দুল আলি যখন একদিন তার পুরনো চুলকাটার সেলুনঘর ভেঙে নতুন এবং আধুনিক করে তৈরি করে এর নাম দেয় ‘ইয়োর চয়েস’ সেলুন, তখন র‌্যাঙ্কিন স্ট্রিট এবং বনগ্রাম থেকে, জোড়পুল এবং পদ্মনিধি লেন থেকে, শাহসাহেব লেন এবং নারিন্দা থেকে লোকেরা আব্দুল আলির নতুন সেলুনে চুল কাটতে আসে, এবং তখন তারা ভূতের গলির লোকদের এই সমস্যার কথা জানতে পারে। পরবর্তী সময়ে এইসব মহল্লার লোকেরা বলে যে, ভজহরি সাহা স্ট্রিট, ভূতের গলির লোকেরা এরকম সন্দেহ করে যে, তারা সময়ের একটি চক্রাবর্তের ভেতর আটকা পড়ে গেছে। কোনো একদিন, তখন, কোদাল হাতে মাটি কেটে আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির ভেতরের পাতকুয়ো বন্ধ করতে গেলে তারা দেখতে পায় যে, তাদের জীবনে সময়ের কাঠামোটি ভেঙে পড়েছে, বর্তমান অতীতের ভেতর প্রবিষ্ট হয়ে গেছে অথবা অতীত, ভবিষ্যৎ বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই বিভ্রান্তির ভেতর তারা সেদিন মাটি কেটে কুয়ো ভরাট করার কাজ করে, কারণ, তা না করলে, তাদের এরকম ধারণা হয় যে, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির নূতন ভাড়াটে সুবোধচন্দ্র অতীতে, বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে এই কুয়োর ভেতর পড়ে যাবে। সুবোধচন্দ্রকে নিয়ে ভূতের গলির লোকদের এই সঙ্কটের কথা আশপাশের মহল্লার লোকেরা ‘ইয়োর চয়েস’ সেলুনে চুল/দাড়ি কাটার সময় জানতে পারে, তারা বলে যে, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে যেদিন ভাড়াটে আসে ভূতের গলির লোকেরা তা শুনতে পায় এবং তারপর তারা যখন এই বিষয়ে অবহিত হয় যে, ভাড়াটে লোকটির নাম সুবোধচন্দ্র দাস এবং তার স্ত্রীর নাম স্বপ্না। তখন তারা বলে যে, তাদের এটা আগেই জানা ছিল; কারণ, তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে যে, সুবোধচন্দ্রদের স্ত্রীদের নাম স্বপ্নাই হয়। ২০ শতকের ৮০-এর দশকের শেষ দিকে ভজহরি সাহা স্ট্রিট, ভূতের গলিতে মানুষ খরা এবং মরে পচে যাওয়া পশুপাখির দুর্গন্ধে বড় পীড়িত হয়েছিল, তখন মহল্লায় সুবোধ এবং স্বপ্নার আগমনের খবরে তারা বিচলিত বোধ করে; তাদের খুব বিরক্তিও হয়, কারণ, সুবোধ ও স্বপ্নার আগমনে তাদের ব্যস্ত বিপর্যস্ত জীবনের ভেতর এক ধরনের অসহায়তা এবং অপরাধবোধ জেগে ওঠে। তারা গরম এবং পচা গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে থুতু ফেলে বলে, এই হালায় ঘুইরা ঘুইরা কইত্থন আহে!

মহল্লার লোকেরা তখন এরকম আশা করতে থাকে যে, এ হয়তো অন্য কোনো সুবোধ, অন্য কোনো স্বপ্না, কিন্তু তাদের এই আশা নির্বাপিত হয়। তারা জানতে পারে যে, মহল্লায় যারা সুবোধ এবং স্বপ্নাকে দেখতে যায় তাদেরকে ঠিক চিনতে পারে না, কিন্তু তখন তারা স্বস্তিবোধ করলেও মনের গভীরে আসল বিষয়টি যেন তাদের জানা থাকে; তারা স্বপ্না রানির বানানো চা খেয়ে সুবোধচন্দ্রের মুখের দিকে তাকায় এবং বলে, আপনে এই বাইতে ভাড়া আইলেন ক্যালা? ভূতের গলির লোকেরা বলে যে, এই কথা শুনে কালো এবং শীর্ণ চেহারার সুবোধচন্দ্র নীরব হয়ে থাকে এবং তার স্ত্রীর উজ্জ্বল শ্যামলা মুখটি মলিন হয়ে আসে, তাদের বোধহয় এরকম মনে হয় যে, মহল্লার লোকেরা তাদেরকে পছন্দ করে নাই। তখন তাদের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে মহল্লার সেইসব লোক নীরব হয়ে যায়, তারপর বলে, পরান আপনের ভাই না? তাদের এই কথা শুনে আজিজ ব্যাপারির নূতন ভাড়াটে সুবোধচন্দ্রের বিস্ময় হয় এবং সে বিভ্রান্ত বোধ করে; মৃদুভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে সে যখন স্বীকার করে যে, পরান নামে তার একটি ছোট ভাই আছে, সে সিরাজগঞ্জে গ্রামে বাস করে, তখন তার সামনে চা-র কাপ হাতে বসে থাকা লোকদের মনে হয় যেন অবাক লাগে না; এবং মহল্লায় যারা মাঝবয়স্ক অথা প্রবীণ তারা যখন এই কথা শোনে, তারা বলে যে, তাদের এই ব্যাপারটি জানা ছিল, কারণ, সুবোধের ছোট ভাইয়ের নামও সবসময় পরানই হয়। মহল্লার লোকেরা যখন এইসব কথা শোনে, তাদের এক ধরনের দুশ্চিন্তা দেখা দেয় এবং তাদের যখন মনে পড়ে যে, মহল্লায় কলের পানি আসার পরও আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির ভেতরের পাতকুয়োটি আগের মতোই রয়ে গেছে, তখন তাদের দুশ্চিন্তা ভয়ে রূপান্তরিত হয় এবং তারা কয়েকজন একদিন আজিজ ব্যাপারিকে বলে, আপনের বাইতে আবার সুবোধচন্দ্র আইলো ভাড়াইট্টা হয়া!

আইলে কী করুম!

এই হালার বৌয়ের নামবি হালায় স্বপ্না।

হ।

অর ছুটো ভাইয়ের নাম জানেন?

না।

পরান।

তাই নিহি!

আপনের কুয়া তো অখনো রয়া গেছে গা, এই হালায় আবার না কুয়ায় পড়ে!

আরে না।

আজিজ ব্যাপারির এই কথায় মহল্লার লোকেরা আশ্বস্ত বোধ করতে পারে না, কারণ, তারা এই কথাটি ভুলতে পারে না যে, আজিজ ব্যাপারির এরকম কথায় ভুলে অনেক বছর পূর্বে তাদের জীবনের লজ্জা এবং কলঙ্কের ঘটনাটি ঘটায়। তারা এখন পরিষ্কার মনে করতে পারে না এটা কোন বছর ছিল, যখন তারা একদিন জানতে পারে যে, আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাসায় নূতন ভাড়াটে এসেছে এবং এই ভাড়াটের নাম সুবোধচন্দ্র, তার সঙ্গে আছে তার স্ত্রী, স্বপ্না। তাই বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য যারা আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে যায় মহল্লার সেইসব লোক স্বপ্নার বানানো চা এবং নিমকপারা খায় এবং দেখতে পায় যে, আজিজ ব্যাপারির বাড়ির ভিতরের দেয়ালের কাছে, একটু দূরে বিচ্ছিন্ন জায়গায়, একটি তুলসীগাছের চারা লাগানো হয়েছে; এবং তারা বুঝতে পারে যে, এটা সুবোধচন্দ্রের স্ত্রীর কাজ। তখন, সেদিন, এই তুলসীগাছের চারার দিকে তাকিয়ে মহল্লার লোকেরা খুবই বিচলিত বোধ করে, এবং তারা যখন আজিজ ব্যাপারিকে বলে যে, সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী আবার কুয়োর ভেতর পড়ে না যায়, তখন আজিজ ব্যাপারি বলে, আরে না, এবং তার এই কথায় মহল্লার লোকেরা প্রতারিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে তারা বলে যে, এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের জীবনের সেই ঘটনাটি ঘটে। মহল্লার লোকদের মনে পড়ে যে, একাত্তর সালের মার্চ মাসে যখন দেশের অবস্থা ঘোরালো হয়ে ওঠে, তখন তাদের ভেতর আজিজ ব্যাপারির ভাড়াটে সুবোধচন্দ্র সবচাইতে বেশি বিচলিত হয়ে পড়ে এবং সে যখন তার স্ত্রীকে তার দেশের বাড়ি সাতক্ষীরায় পাঠিয়ে দিতে চায়, মহল্লার লোকেরা সুবোধচন্দ্রের আশঙ্কার বিষয়টি বুঝতে পারে; কিন্তু তখন একইসঙ্গে তাদের কালো সুহাসিনী স্বপ্নার বানানো নিমকপারা এবং চা-র কথা মনে পড়ে, তারা এইসব খাওয়ার কথা ভুলে যেতে পারে না, ফলে তারা তাদেরকে আশ্বস্ত করতে চায় এবং বলে, আরে আমরা আছি না, আমরা মইরা গেছি নিহি। কিন্তু পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গোলাগুলির ভেতর নিদ্রাহীন কাটানোর পরদিন শুক্রবার সকালে যখন নয়াবাজারের আগুনের শিখায় পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে ওঠে তখন ভূতের গলির লোকেরা বুঝতে পারে না এই অবস্থায় তাদের নিজেদেরই বেঁচে থাকার উপায় আছে কি না! তবু, এই অবস্থার ভেতরও, পরবর্তী সময়ে তারা মনে করতে পারে যে, সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রীর কথা তাদের মনে পড়ে, এবং দুদিন পর আজিজ ব্যাপারিসহ মহল্লার অনেকে যখন জিঞ্জিরায় পালায় তখন তারা সঙ্গে করে সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে যায়, তারপর জিঞ্জিরায় মিলিটারির উল্টো তাড়া খেয়ে তারা যখন মহল্লায় ফিরে আসে তখন সুবোধ এবং স্বপ্নাও তাদের সঙ্গে ফেরে। তখন সুবোধচন্দ্র বাধ্য হয়ে এই মহল্লায় থেকে যায়, কারণ তার তখন পালিয়ে যাওয়ার মতো জায়গা এবং সময় ছিল না, তার গ্রামের বাড়ি ছিল অনেক দূর এবং ভূতের গলির লোকদের বরাভয়ে সে আশ্বস্ত হয়েছিল; বস্তুত মহল্লার লোকদের মতো সে-ও বিভ্রান্ত হয়েছিল এবং বুঝতে পারে নাই যে, একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চের পরে মহল্লার মুসলমানদেরই নিজেদের রক্ষা করতে পারার কোনো নিশ্চিত উপায় ছিল না। জিঞ্জিরা থেকে ফিরে আসার পর মহল্লার লোকদের যখন সুবোধচন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয় তখন তারা, নিজেদের প্রবল নিরাপত্তাহীনতার ভেতরেও, তার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ভালো আছেন? কিন্তু তখন মহল্লার কেউ-ই ভালো ছিল না, সুবোধচন্দ্র তাদের প্রশ্ন শুনে যখন ম্লানভাবে হাসে, তখন মহল্লার লোকেরা তাদের ভুল বুঝতে পারে, তারা বলে, ডরান ক্যালা, আমাগো যা হইব, আপনেরও হইব; আমরা বাঁচলে আপনেও বাঁচবেন। সেই সময়, কতদিন পর মহল্লার লোকদের তা মনে নাই, এই আতঙ্কের ভেতর ক্রমাগতভাবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পরই কেবলমাত্র তারা বুঝতে পারে যে, তারা সেই সময় কতটা দিশেহারা ছিল; কারণ, তখন কোনো এক সময় তাদেরকে তাদের স্ত্রীরা এই কথা বলে যে, সুবোধচন্দ্রের স্ত্রী তার কপালের সিঁদুর মুছে, হাতের শাঁখা খুলে রেখে দিয়েছে, এবং তারা দুজনে কলেমা মুখস্থ করছে; তখন এই কথা শুনে তাদের মনে হয় যেন সম্বিৎ ফিরে আসে এবং তারা স্মরণ করতে পারে যে, সাতাশ তারিখে তারা যখন কার্ফুর ভেতর অলিগলির মধ্য দিয়ে সোয়ারিঘাটে পৌঁছে নদী পার হয়েছিল তখন তাদের সঙ্গে একমাত্র হিন্দু ছিল সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী, স্বপ্না। এবং তাদের স্মরণ হয় যে, তখন স্বপ্নার কপালে সীমন্তে সিঁদুর এবং হাতে শাঁখা ছিল না, কিন্তু সেই মুহূর্তে তারা মনে হয় যেন তা দেখে নাই; পরে তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে এই কথা শোনার পর তাদের তা পুনরায় মনে পড়ে, তখন তাদের এক ধরনের লজ্জা হয় এবং তারা বিষণ্ণবোধ করে। তখন, তারা যখন নিজেদের নিরাপত্তা বিধানেই সক্ষম ছিল না, তারা আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে সুবোধচন্দ্রের ঘরে যায় এবং স্বপ্নার মুখের দিকে তাকিয়ে নীরব হয়ে থাকে, তারপর তৃতীয়বারের মতো বলে, ডরায়েন না, ডরায়া লাভ কী, আমরা তো আছি! কিন্তু মহল্লার লোকেরা পরে দেখেছিল যে, তারা তখন সব ভুল বলেছিল। পরবর্তীকালে মহল্লার লোকদের এইসব কথা ক্রমাগতভাবে মনে পড়ে এবং তাদের অন্তর গ্লানিতে আকীর্ণ হয়, কারণ, তারা এই কথা ভুলতে পারে না যে, এত আশ্বাসের পরেও তারা যে শুধু সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারে নাই তা-ই নয়, সত্যিকার অর্থে তাদেরকে তারা বিসর্জন দেয়। মহল্লার লোকদের মনে পড়ে যে, এই চ‚ড়ান্ত ঘটনা ঘটার আগে পর্যন্ত তারা সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রীকে ক্রমাগতভাবে সাহস দিয়ে যায়, মহল্লার লোকেরা পুনরায় মনে করতে ব্যর্থ হয় কবে, তাদের মনে পড়ে যে, তাদের পাশের মহল্লার আবুবকর মওলানার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়া এবং মহল্লায় রাজাকর আসার পর অবস্থা যখন আরও জটিল এবং বেঁচে থাকা আরও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, তারা সুবোধচন্দ্র এবং স্বপ্নারানির কলেমা পাঠের বিষয়টি তাদের স্ত্রীদের মুখে পুনরায় শুনতে পায় এবং তখন পুনরায় আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্নার ঘরে গিয়ে হাজির হয়। মহল্লার লোকেরা পরে বলে যে, সেদিন ঘরে প্রবেশ করে তারা সুবোধচন্দ্রকে চৌকির উপর চিৎ হয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দেখে, এবং তখন তারা দেখে যে, তার স্ত্রী স্বপ্নারানি দাস চৌকির কাছে একটি বেতের নিচু মোড়ার উপর ঈষৎ কুঁজো হয়ে বসে একটা বই পড়ে। মহল্লার লোকদের দেখে সুবোধচন্দ্র উঠে বসে এবং স্বপ্না বইটা বন্ধ করে রাখে, তখন ‘সহজ নামাজ শিক্ষা’ বইটা দেখে মহল্লার লোকদের মনে হয় যে, তাদের স্ত্রীরা ভুল বলে নাই; তারা তখন নীরব স্বামী-স্ত্রীর দিকে তাকায় এবং তাদের চেহারায় বিমর্ষতা দেখতে পায়, তারা বুঝতে পারে না তারা কীভাবে কথা শুরু করবে; তারা তখন সুবোধচন্দ্র এবং স্বপ্নার বিমর্ষতার ভেতর নিজেরাও কিছুক্ষণ চুপ করে ডুবে থাকে, তারপর বলে, আপনেগো কী হইছে?

না, কী হইব!

এই বই কিনছেন ক্যালা?

এমনি দেইখা রাখতাছি।

কলেমা মুখস্থ করছেন নিহি?

হেঁ।

কলেমা কয়টা কন দেহি।

চাইর।

কলেমা তৈয়েবা মুখস্ত কন দেহি।

মহল্লার লোকদের এই কথা শুনে সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী মনে হয় যেন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তারা এই ছোট্ট ঘরের ভেতরের অস্পষ্ট আলোয় বিষণ্ণ চেহারা তুলে ভূতের গলির এই লোকদের দিকে নীরবে তাকায়, তখন মহল্লার লোকেরা তাদের ভুল বুঝতে পারে এং বিচলিত হয়; তাদের তখন মনে হয় যে, আমরা তো আছি, তারা আর এই কথা বলতে পারে না; এই অবস্থায় তারা বলে, আল্লাহ ভরসা। মহল্লার লোকেরা সেই সময় দেখতে পায় যে, সুবোধচন্দ্রের কলেমা শেখায় কাজ হতে গিয়েও তা ব্যর্থ হয়, মহল্লায় একদিন মিলিটারি আসে এবং সেদিন মহল্লাজুড়ে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তির ভেতর সুবোধচন্দ্র ও তার স্ত্রী স্বপ্না নিহত হয়। মহল্লার লোকেরা এই ঘটনার গ্লানি ভুলতে পারে না; এবং মুক্তিযুদ্ধের পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে আবুবকর মওলানা এবং তার রাজাকার শিষ্যরা এই এলাকায় ফিরে আসে এবং ভূতের গলির লোকেরা জানতে পারে, আবুবকর মওলানা এই কথা বলে যে, একাত্তর সালে ভূতের গলির লোকদের অপ্রয়োজনীয় আতঙ্ক এবং মূর্খতার কারণে সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী মারা পড়ে। আবুবকর মওলানা বলে যে, ঢাকার মহল্লাগুলো থেকে বাড়িঘর ছেড়ে সব হিন্দু পালিয়ে যাওয়ার পর পত্রিকায় ছবি ছাপানোর জন্য পাকিস্তানি মিলিটারি একজন হিন্দুর সন্ধান করছিল, কিন্তু পাচ্ছিল না; তখন তা জানতে পারে এবং তার মনে পড়ে যায় যে, সে শুনেছে ভূতের গলিতে একটি হিন্দু পরিবার আছে। সে বলে যে, সুবোধচন্দ্রকে এই কারণে খোঁজার জন্য ভূতের গলিতে দু’বার মিলিটারি আসে, কিন্তু ভূতের গলির মূর্খ লোকেরা প্রথমবার সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রীকে লুকিয়ে রাখে, পরের বার কুয়োর ভেতর ফেলে দিয়ে মেরে ফেলে। ভূতের গলির লোকেরা নীরবে আবুবকর মওলানার কথা শোনে, এবং সে কেন এইসব কথা বলে তা অনুধাবন করতে তাদের খুব বেশি অসুবিধা হয় না; তারা বলে যে, একাত্তর সালের কথা তারা কেউ ভুলে যায় নাই, আবুবকর মওলানা ভোলে নাই মহল্লার লোকের কথা, যেমন আবুবকর মওলানার বিশদ আচরণের কথা ভোলে নাই মহল্লার লোক। মহল্লার লোকেরা বলে, হালারপোত মিছা কতা কয়, কিন্তু একইসঙ্গে সুবোধচন্দ্রকে কুয়োর ভেতর ফেলে দেয়ার ঘটনার কথা তারা ভুলতে পারে না। পরবর্তী সময়ে, তাদের পরিষ্কার মনে পড়ে না, তবে তারা বলে যে, ভুতের গলিতে প্রথম মিলিটারি আসে মে অথবা জুন মাসে, এবং তাদের যেহেতু জানা ছিল যে, মহল্লায় যে কোনো দিন যে কোনো মুহূর্তে মিলিটারি আসতে পারে, তারা সেজন্য প্রস্তুত ছিল। সেদিন মিলিটারি আসার খবর শুনে ছাতে চাঁদতারাখচিত সবুজ এবং সাদা রঙের পতাকা উড়িয়ে তারা অপেক্ষা করে এবং সে সময় বড় রাস্তার ধারে যাদের বাড়ি তারা ভারি বুটের আওয়াজ শুনতে পায় এবং তাদের ভেতর যারা উঁকি দেয় তারা চাইনিজ রাইফেল কাঁধে খাকি পোশাক পরা পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে দক্ষিণ মৈশন্দির, লম্বা জোব্বাপরা আবুবকর মওলানাকে দেখতে পায়। মহল্লার ভেতর দিয়ে সেদিন মিলিটারি চুপচাপ হেঁটে যায়, কাউকে কিছু না বলে; এবং পরে মহল্লার লোকেরা বলে যে, এই মিলিটারির সঙ্গে ছিল একজন তরুণ পাঠান লেফটেন্যান্ট, সে মহল্লায় ঢুকে সব বাড়ির ছাতে সবুজ রঙের পতাকা উড়তে দেখে খুব আনন্দিত হয়ে পড়ে এবং জোব্বা পরা আবুবকর মওলানাকে বলে, ইয়ে লোগত সাব পাকিস্তানি হায়। পাকিস্তানি এই সেনা কর্মকর্তার কথা যে ঠিক নয়, তা আবুবকর মওলানার জানা ছিল কিন্তু ভাষাগত সমস্যার কারণে, ভ‚তের গলির লোকেরা পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানোর পরও কেন পাকিস্তানি নয়, সেই জটিল বিষয়টি পাঠান লেফটেন্যান্টকে বোঝানো তার পক্ষে সম্ভব হয় না, সে নীরব হতাশার সঙ্গে পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে হেঁটে যায়। মহল্লার লোকেরা বলে যে, তখন আবুবকর মওলানা তাকে বোঝায় যে, এই লোকগুলো সব হিন্দু, সে বলে ইয়ে সব হিন্দু, তখন তার কথা শুনে পাঠান লেফটেন্যান্টের হুঁম হয় এবং পাকিস্তানি মিলিটারির ৬৪ নম্বর বাড়ির দরজায় গিয়ে ঘা দেয়। দরজায় মিলিটারির পায়ের শব্দ এবং করাঘাত শুনে বাড়ির মালিক হাজি মোহাম্মদ আব্দুল করিম দরজা খুলে দাঁড়ায়, এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে, আবুবকর মওলানার তখন আরেক ধরনে সঙ্কট হয়, কারণ, সাদা পাঞ্জাবি ও টুপি পরা হাজি করিমের শুভ্র দাড়ির দিকে তাকিয়ে পাকিস্তানি লেফটেন্যান্ট পুনরায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সে বলে, ইয়ে আদমি হিন্দু হায়? মওলানা আবুবকর তখন তার ভাঙা বাংলা এবং উর্দুতে তাকে এই বিষয়টি বোঝাতে পারে যে, এরা সব হিন্দু না, কিন্তু এই মহল্লায় হিন্দু আছে বলে সে জানে। তারপর, সেদিন মহল্লার লোকদের তাদের ধর্মপরিচয়ের বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়, মিলিটারিরা ভূতের গলির ৪১ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে বড় রাস্তার উপর এনে লাইন করে দাঁড় করায় এবং দেখে যে, তারা সকলে মাথায় টুপি পরে আছে; পরে মহল্লার লোকেরা বলে যে, এই লাইনে সাদা কিস্তি টুপি পরা সুবোধচন্দ্রও ছিল এবং এইদিন তার কলেমা মুখস্থ করা বিদ্যা কাজে লাগে। পাকিস্তানি মিলিটারি একজন একজন করে কলেমা পড়ায় এবং ছেড়ে দেয়, সুবোধচন্দ্র সেদিন সাফল্যের সঙ্গে উতরে যায় এবং বাসায় অপেক্ষমাণ তার নীরব এবং ভীত স্ত্রীর কাছে ফিরে আসে, এবং তারপর রাস্তায় যখন আর একজনও অবশিষ্ট থাকে না, তখন পাঠান লেফটেন্যান্ট ক্রুদ্ধ হয় এবং আবুবকর মওলানা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, কারণ, সে জেনেছিল যে, এই মহল্লায় একজন হিন্দু রয়েছে, সে ক্রুদ্ধ লেফটেন্যান্টের মুখের দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকে, তারপর পাকিস্তানি মিলিটারি সেদিন মহল্লা ত্যাগ করে যায়। মহল্লার লোকেরা পরে বলে যে, প্রথমবার মিলিটারি ফিরে যাওয়ার পর তারা ভাবে যে, বাঁচা গেছে, কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল ছিল, কারণ, পরে তারা দেখেছিল যে, একাত্তর সালে এদেশে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না, এবং তখন মহল্লায় পুনরায় যখন মিলিটারি আসে সুবোধচন্দ্রকে তারা কুয়োর ভেতর ফেলে দেয়, কিন্তু নিজেদেরকেও রক্ষা করতে পারে না এবং এই গ্লানি তাদের আজীবন থেকে যায়। মহল্লার লোকেরা বলে যে, কলেমা পড়ে শুনিয়ে পাকিস্তানি লেফটেন্যান্টকে বিভ্রান্ত করা গেলেও আবুবকর মওলানার মন থেকে সন্দেহ যায় নাই এবং ভূতের গলির একটি পরিবারকে অন্যদের ভেতর থেকে খুঁজে বের করতে না পারায় তার মনে এক ধরনের অশান্তি এবং ভূতের গলির লোকদের ওপর ক্ষোভ থেকে যায়। কিন্তু দেশের অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকায় আবুবকর মওলানার জন্য পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে যায়, তখন মহল্লার লোকেরা প্রথম মুক্তিবাহিনীর নাম শুনতে পায় এবং জানতে পারে যে, মহল্লা থেকে পাঁচটি ছেলে মুক্তিবাহিনীতে গেছে। আবুবকর মওলানার কানে যখন এই কথা পৌঁছায় সে তখন একজন হিন্দু লোককে খুঁজে বের করার কথা ভুলে যায়, সে বরং তার রাজাকারদের পাঠায় সেই পাঁচটি পরিবারকে খুঁজে বের করার জন্য, যে পরিবারের ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। তখন, এক বৃহস্পতিবার বিকেলবেলায় কাপড়ের জুতা এবং খাকি পোশাক পরা চারজন রাজাকার লেফট রাইট করে ভূতের গলির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে, এই রাজাকাররা বুঝে উঠতে পারে না শত্রুবেষ্টিত এই দেশে তারা কী করে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর বের করবে। মহল্লার ভেতর ক্রমাগত পায়চারি করার পর তারা তিনটি বাড়ির দরজায় ঘা দেয় এবং বাড়ির লোকেরা দরজা খুলে দাঁড়ালে পরে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের কথা জানতে চায়, বাড়ির লোকেরা যখন বলে যে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানে না তখন এই রাজাকাররা বড় বিমর্ষ হয়ে পড়ে এবং শুকনো মুখে আবুবকর মওলানার সামনে গিয়ে হাজির হয়। সেদিন আবুবকর মওলানা তার প্রাঙ্গণে নীরবে অপেক্ষমাণ রাজাকারদের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারে এবং ক্রুদ্ধ চাপা স্বরে বলে, বিচরায়া পাওনিকা? এবং তার কথা শুনে উঠোনে দাঁড়ানো রাজাকাররা ঘাড় নাড়ে।

কারে জিগাইছিলা?

তিনটা বাইতে যায়া জিগাইলাম।

কী জিগাইলা? মুক্তিযোদ্ধাগো চিনে নিহি?

রাজাকাররা তখন চুপ করে থাকলে আবুবকর মওলানা গাল দিয়ে ওঠে, ভোদাই, এ্যামনে মাইনষে খবর বাইর করে? ছাগল, এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে, সেদিন রাতে তারা জানতে পারে মুক্তিযোদ্ধা খোঁজার জন্য মহল্লায় রাজাকাররা এসেছিল এবং এ ঘটনায় তারা খুব বিচলিত হয়ে পড়ে। তারা বলে যে, পরদিন রাজাকারদের পুনরায় লাঠি হাতে লেফট রাইট করে যেতে দেখে তারা তাদের বাসার বাইরের গেট লাগিয়ে চুপচাপ বসে থাকে; কিন্তু, তারা বলে যে, এদিন রাজাকাররা অন্য এক ফাঁদে পড়ে। আবুবকর মওলানার কাছে ধমক খাওয়ার কারণে রাজাকাররা এদিন কারও বাড়ির দরজায় টোকা না দিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করে এবং যে দু-একজন রাস্তায় বের হয় তাদেরকে লক্ষ করে মহল্লার লোকেরা পরে বলে যে, এদিন রাজাকাররা বেশি বুদ্ধি দেখাতে গিয়ে নতুন ভুলের কবলে পড়ে, তারা সেদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকদের ঝানু গোয়েন্দার মতো নিরীক্ষণ করে কিন্তু পছন্দসই কাউকে খুঁজে পায় না, তখন, এসময়, ৩৮ নম্বর বাড়ির ভেতর থেকে তরুণী কাজের মেয়ে কুলসুম বের হয়ে মুদিদোকানে যায়। সে মুদিদোকান থেকে সওদা নিয়ে ফেরার সময় মহল্লার মসজিদের কাছে এসে রাজাকারদের হেঁটে যেতে দেখে এবং রাজাকাররাও দেখে তাকে; মহল্লার লোকেরা বলে যে, এই সাক্ষাতেই বিপত্তি ঘটে। তারা বলে যে, কাজের মেয়ে হওয়ার কারণে কুলসুম ছিল প্রায় স্বাধীন নারী এবং তার বয়স ছিল চলতে-ফিরতে ছলকানোর মতো, ফলে সে মানুষের অথবা রাজাকারদের ভেতরকার সাপের প্রবৃত্তি চিনতে ব্যর্থ হয় এবং এই রাজাকারদের নিয়ে খেলা শুরু করে, পরিণতিতে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভূতের গলিতে প্রথম নিহত হয় ৩৮ নম্বর বাড়ির আলি আকবর মিয়ার উচ্ছ্বসিত যৌবনা এবং কলহাস্যপ্রিয় পরিচারিকা কুলসুম। মহল্লার লোকেরা বলে যে, সেদিন মসজিদের কাছে রাজাকারদের একদম সামনে এসে কুলসুম কোমরে একটি হাত রেখে দাঁড়ায় এবং হৈচৈ করে বলে, এত লেফটরাইট করেন ক্যালা, হয়রান লাগে না আপনেগো? এই কথা শুনে রাজাকাররা থামে, কুলসুমের নবীন দেহের চাইতেও তার কণ্ঠের তারল্যের ভেতরকার উষ্ণতা তাদেরকে চমকিত করে ফেলে এবং কাঁধের ওপর থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ওজন নিয়ে তাদের কমান্ডার আব্দুল জব্বারের মনে হয় যে, অবশেষে বুদ্ধিবর্জিত এই মহল্লায় আসল লোকটিকে তারা খুঁজে পেয়েছে, তখন তারা কুলসুমকে ঘিরে ধরে এবং বলে, তুমার নাম কী?

কুলসুম।

তখন রাজাকাররা কুলসুমকে মসজিদের পাশে একটু আড়ালে ছায়ায় ডেকে আনে এবং জিজ্ঞেস করে, কই কাম করো তুমি?

এই তো আলি আকবরের বাইতে, ক্যালা?

মহল্লার লোকেরা বলে যে, রাজাকারদের সঙ্গে কথোপকথনের এই পর্যন্ত অকারণ হাসি সত্ত্বেও কুলসুম স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু এর পরেই সে ভুল পথে যায়, ঘাড়ের উপর বন্দুক থাকা সত্ত্বেও সে বিস্মিত হয় যে, এই লোকগুলো শুধু পুরুষমানুষই নয়, তারা রাজাকারও বটে এবং পুরুষমানুষ নিয়ে খেলা করা গেলেও রাজাকারদের নিয়ে খেলা করা বিপজ্জনক। মহল্লার লোকেরা, যারা পরে এইসব কথা শুনতে পায়, বলে যে, কুলসুমের হাসি থেমে এলে পরে আব্দুল জব্বার তার কণ্ঠে গম্ভীর অথচ নরম করে নিচু স্বরে বলে, তুমি মুক্তিবাহিনীরে চিনো?

তখন, এই কথা শুনে অশিক্ষিত এবং অপরিণতবয়স্ক এই প্রায় স্বাধীন নারীর মাথায় শয়তানি খেলা করে, সে তার তরলভাব দূর করে মুখটা গম্ভীর করে তাকায় এবং বলে, নাম হুনচি!

এই মহল্লায় কয়জন আছে?

দুইজনের নাম জানি।

ক্যাডা ক্যাডা।

মহল্লার লোকেরা বলে যে, কুলসুমের চেহারায় তখন তল চাপা হাসি পুনরায় ফুটে ওঠে, সে দাঁতে আঁচল কেটে বলে, সাতভাইগো বাড়ির পরের বাড়ির পরের বাড়ির রহিম বক্সের পোলা ছোরাব মুক্তিবাহিনীতে গেছে হুনচি, আর মন্দিরের পিছনের গল্লির জহিরউদ্দিনের পোলা আজমল গেছে। মহল্লার লোকেরা বলে যে, কুলসুমকে ছেড়ে দেয়ার পর রাজাকাররা সেদিন দ্রæত আবুবকর মওলানার নিকট ফিরে যায় এবং সবকিছু বিশদ শোনার পর আবুবক মওলানার মুখে মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ে, সে শূন্যের ভেতর ডান হাতটা ঈষৎ চালনা করে নিজে নিজে নিচু স্বরে বলে, এ্যালা ঘুগু! তারপর সেদিন জুম্মা নামাজের পর দুপুরবেলা সে রাজাকারদের পাঠায় জহিরউদ্দিন ও রহিম বক্সকে ডেকে আনার জন্য। মহল্লার লোকেরা পরে সব জানতে পারে এবং তারা বলে যে, মন্দিরের পিছনে পঁচিশ নম্বর বাড়ির ভেতর ঢুকে রাজাকাররা যখন জহিরউদ্দিনের খোঁজ করে, বাড়ির লোকেরা বলে, অয় তো বাইতে নাইকা, কই যিনি গেছে। এই কথা শুনে রাজাকাররা চুপ করে থাকে, তারপর সে বাড়ি ফিরলে আবুবকর মওলানার সঙ্গে দেখা করতে বলে বের হয়ে রহিম বক্সের বাড়িতে যায়। মহল্লার লোকেরা বলে যে, রহিম বক্স যখন দরজা খুলে সামনে দাঁড়ায় তখন তার মাথার কাঁচাপাকা চুল এবং ঝুলে পড়া ভুঁড়ির দিকে তাকিয়ে রাজাকারদের মনে হয় যে, তারা ঠিক লোককে ধরতে পেরেছে, তারা তখন বলে, আবুবকর মওলানা আপনেরে ডাকছে।

ক্যালা?

কয়া পারুম না ক্যালা। এমনেই ডাকছে!

রহিম বক্স যখন আবুবকর মওলানার বাড়িতে আসে সে তখন বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে অপেক্ষায় ছিল, রাজাকারদের সঙ্গে রহিম বক্সকে প্রবেশ করতে দেখে সে উঠে দাঁড়ায় এবং তার প্রাঙ্গণে রাজাকারদের বৃত্তের ভেতর দাঁড়ানো রহিম বক্সকে বলে আপনের নাম যিনি কী?

রহিম বকসো। আপনে আমারে ডাকছেন?

মহল্লার লোকেরা বলে যে, আবুবকর মওলানা বিষয়টি বেশ উপভোগ করতে শুরু করে, সে রহিম বক্সের প্রশ্ন শুনে সরাসরি উত্তর না দিয়ে, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মাছ ধরার মতো করে তাকে ধরার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু প্রথমেই সে ধরাশায়ী হয়, কারণ, সে যখন বলে আপনের পোলামাইয়া কয়টা, তখন রহিম বক্স বলে, আল্লায় দেয়নিকা।

আপনে কী কইলেন বুজা পারলাম না!

আমার পোলাপাইন নাই, আল্লায় দেয় নাইক্যা, ক্যালা?

মহল্লার লোকেরা বলে যে, আবুবকর মওলানা এবং তার রাজাকাররা রহিম বক্সের উত্তরে খুব বিব্রত হয়ে পড়ে, তা সত্তে¡ও তারা নারী কুলসুমের ইয়ার্কির সমগ্র প্রকৃতিটা বুঝতে পারে না, যতক্ষণ-না তারা জহিরউদ্দিনের দেখা পায়। রহিম বক্সকে আরও কিছুক্ষণ জেরা করে আবুবকর মওলানা তাকে ছেড়ে দেয় এবং তার বাড়ির উঠোনে ¤øান মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রাজাকারদের দিকে তাকিয়ে রাগ সংবরণ করে নিচু কণ্ঠে বলে, ছাগল ভোদাই! রাজাকাররা অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে যখন এরকম ভাবে যে, রহিম বক্স নামের এই বয়স্ক লোকটিই ষোলকলা পূর্ণ হয়, কারণ তখন আবুবকর মওলানার বাড়ির ভেতর একটি কিশোরকে তারা প্রবেশ করতে দেখে। এই বালকটি বারান্দায় দাঁড়ানো আবুবকর মওলানার সামনে গিয়ে বলে, আপনে বলে আমারে ডাকছেন?

মহল্লার লোকেরা বলে যে, আবুবকর মওলানা এবার প্রথমেই ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারে, সে কালো রঙের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে, তর নাম কী?

জহিরউদ্দিন।

এই অবস্থায় উপনীত হওয়ার পর আবুবকর মওলানা সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভেতরকার রসিকতাটি বুঝতে পারে। সে জহির উদ্দিনকে বলে, আজমল ক্যাডা?

কয়া পারুম না, আমি চিনি না।

তুই যা।

জহিরউদ্দিন চলে যাওয়ার পর আবুবকর মওলানা প্রাঙ্গণে নীরবে দন্ডায়মান রাজাকারদের দিকে তাকায় এবং ক্রোধ ও উত্তেজনা ধরে রেখে বলে, ছাগল, কানে ধর। এক প্রবল বিভ্রান্তির মধ্যে অবস্থানকারী রাজাকারদের তখন মনে হয় যেন তারা আবুবকর মওলানার কথার অর্থ বুঝতে পারে না, তারা শুকনো মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে, আবুবকর মওলানার সামনে, ভূতের গলির লোকদের ইয়ার্কি মারার প্রবণতার পাশাপাশি রাজাকারদের তার নিয়ন্ত্রণ না মানার সঙ্কট দেখা দেয়। মহল্লার লোকেরা বলে যে, তখন যারা আবুবকর মওলানার বাড়ির ভেতর উঁকি দেয় তারা রাজাকারদের মুখোমুখি অবস্থায় বারান্দার উপর আবুবকর মওলানাকে দাঁড়ানো দেখতে পায়, তারা দেখে যে, কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকার পর সে তার ডান হাত বাতাসের ভেতর প্রবলভাবে আন্দোলিত করে চিৎকার করে ওঠে, কানে ধর, কানে ধর, এবং তার এই অকস্মাৎ ফেটে পড়া দেখে উঠোনে দাঁড়ানো রাজাকাররা ভয় পেয়ে এবং তারা এক মুহূর্তের জন্য একটু নড়ে ওঠে তারপর হাতের লাঠি মাটিতে রেখে দুহাতে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মহল্লার লোকেরা বলে যে, রাজাকারদের কান ধরে দাঁড়াতে দেখে আবুবকর মওলানার স্বস্তি ফিরে আসে এবং সে তাদেরকে এই অবস্থায় রেখে বাড়ির ভেতর গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তারপর বিকেলে ঘুম থেকে ওঠার পর বাইরে বেরিয়ে সে রাজাকারদের তখনও কানধরা অবস্থায় প্রাঙ্গণে দাঁড়াতে দেখতে পায়। মহল্লার লোকেরা বলে যে, রাজাকারদের ওপর তার কথার এরকম প্রভাব দেখে ব্যাপারটায় আবুবকর মওলানার নেশা ধরে যায়, সে তারপরও রাজাকারদের ছেড়ে দেয় না। ব্যাপারটা সে উপভোগ করতে থাকে, কানে ধরা রাজাকারদের সামনে বারান্দায় বসে সে আয়েশ করে চা খায় এবং বিকেল গড়িয়ে যেতে দেয়, তারপর সন্ধে হয়ে এলে যখন মাগরিবের আজান শোনা যায় তখন সে বলে, যাও এ্যালা যায়া নামাজ পড়। রাজাকাররা সেই সন্ধ্যায় কান ছেড়ে দিয়ে মসজিদে যাওয়ার বদলে আলি আকবরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় এবং বাইরের দরজায় ঘা দিয়ে অপেক্ষা করে। তখন ভেতর থেকে দরজা খোলা হলে তারা খুব ভদ্র ব্যবহার করে এবং কুলসুম কোথায় জানতে চায়। বাড়ির লোকেরা যখন বলে যে, কুলসুমকে দিয়ে তাদের কী দরকার, তখন তারা কিছু একটা বলে এবং এই সময় বাড়ির ভেতর কুলসুম রাজাকারদের আগমনের কথা জানতে পারে; তখন সে দাঁতের ফাঁকে আঁচল চেপে ধরে হাসে এবং তার ছলাকলার ইচ্ছে জেগে ওঠে, সে বলে, বলদেরা আবার মুক্তিযোদ্ধা বিচরাইবার আইছে নিহি, এবং এই কথা বলে সে কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে দরজার সামনে এসে যখন দাঁড়ায় এবং সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারের ভেতর তির্যকভাবে হেসে বলে, কুলসুম কুলসুম করেন ক্যালা, তখন একটিও কথা না বলে রাজাকার কমান্ডার আব্দুল জব্বার বন্দুক উঁচু করে তিন হাত দূর থেকে কুলসুমের বুকে গুলি করে, এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে, সেদিন যখন আলি আকবরের বাড়ির দরজার কাছ থেকে কুলসুমের মৃতদেহ ওঠানো হয় তার ঠোঁটে তখনও কৌতুকের হাসিটি লেগে ছিল। মহল্লার লোকেরা বলে যে, পাকিস্তানি মিলিটারি এবং রাজাকারদের সম্পর্কে তাদের মনে যে অস্পষ্ট ভয় ছিল তা কুলসুমের হত্যাকাণ্ডের পর স্পষ্ট ও মূর্ত হয়ে ওঠে, তারা নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার ভেতরও ক্রমাগতভাবে সুবোধচন্দ্র ও তার স্ত্রীর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, তাদের মনের ভেতর এই কথাটি জানা থাকে যে, কলেমা পড়ে প্রথম দিন ঠকালেও আবুবকর মওলানা সুযোগমতো আবার নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে। কুলসুমের মৃত্যুর পর আবুবকর মওলানার জন্য মুক্তিযোদ্ধা ধরা বেশি জরুরি হয়ে ওঠে, কিন্তু মহল্লার লোকেরা বলে যে, কপাল এমনই খারাপ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ার বদলে সুবোধচন্দ্রের ধরা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় এবং তার পরিণতিতে মহল্লার লোকের জীবনে লজ্জার ঘটনাটি ঘটে। তারা বলে যে, সেদিনও সম্ভভত কোনো এক শুক্রবার ছিল, কারণ, ঘটনাটা ঘটার সময় তাদের সকলের মাথায় টুপি ছিল; এদিন জুম্মা নামাজের পর এগারোজন লোক আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে সুবোধচন্দ্রের ঘরে যায়, তারা আজিজ ব্যাপারির বাড়ির ভেতরের একটি ঘরে বসে সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রীকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়া যায় কি না সে বিষয়ে কথা বলে এবং সেইদিন, তখন আবুবকর মওলানা মহল্লায় মিলিটারি নিয়ে আসে। পাকিস্তানি মিলিটারি মহল্লার রাস্তা ঘেরাও করে রাখে, কিন্তু তল্লাশি করে কোনো বাড়ি থেকে কে মুক্তিযুদ্ধে গেছে তা বের করতে পারে না। আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে জড়ো হওয়া লোকেরা মিলিটারি আসার খবর শুনে প্রথমে পালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু তারা যখন দেখতে পায় যে, রাস্তার উপর বন্দুক তাক করে ধরে মিলিটারি দাঁড়ানো, তারা আব্দুল আজিজের ঘরে ফিরে গিয়ে মিলাদ শরিফ পড়তে শুরু করে দেয় এবং একটি টুপি মাথায় দিয়ে এসে সুবোধচন্দ্র এই দলের সঙ্গে যুক্ত হয়। পাকিস্তানি মিলিটারি যখন আবুবকর মওলানার সঙ্গে আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে আসে তখন তারা আজিজ ব্যাপারির বাড়ির ভেতরের এই বড় ঘরটিতে একদল লোককে মিলাদ পড়তে দেখে। টুপিমাথায় দাঁড়ানো লোকগুলো ক্রমাগতভাবে ইয়া নবি সালামালাইকা পড়ে এবং আধঘণ্টা বন্দুক হাতে অপেক্ষা করার পরও এই লোকগুলো যখন থামে না তখন পাকিস্তানি মিলিটারি তাদের ধমক দিয়ে থামায়। আবুবকর মওলানা ততক্ষণে বুঝতে পেরেছিল যে, মুক্তিযোদ্ধার খবর এভাবে বের করা যাবে না, তার তখন পুরনো একটি প্রসঙ্গ মনে পড়ে, কারণ, আজিজ ব্যাপারির বাসায় প্রবেশ করে তার সন্ধানী চোখ দেয়ালের কাছে তুলসীগাছটি দেখতে পায় এবং তার মনে হয় যে, এই বাড়িতে সেই লোকটি থাকে, ফলে টুপিমাথায় চুপ করে দাঁড়ানো লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে সে বলে, আপনেগো এইখানে একজন হিন্দু আছে! মহল্লার লোকেরা বলে যে, তারা আবুবকর মওলানার কথা প্রথমে স্বীকার করতে চায় না, তারা বলে, কী কন আপনে, হিন্দুরা মিলাদ পড়ে নিহি, কিন্তু তখন আবুবকর মওলানা যখন জানতে চায়, তুলসীগাছ কে পূজা করে, তাদের সুবোধচন্দ্রের স্ত্রী স্বপ্নার লাগানো তুলসীগাছটির কথা মনে পড়ে, তারা বুঝতে পারে যে, হাতের শাঁখা ভেঙে সিঁদুর মুছে ফেলার পর তারা হয়তো এই গাছটির কথা ভুলে যায়; কিন্তু তবু, তখন মহল্লার এই লোকেরা শেষ চেষ্টা করে, তারা বলে যে, তুলসী গাছ হয়তো এমনি এমনি হয়েছে, কিন্তু আবুবকর মওলানা এ কথা বিশ্বাস করে না। সেদিন সুবোধচন্দ্রকে যখন মহল্লার অন্য লোকের ভেতর থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, তখন পাকিস্তানি মিলিটারি সুবোধচন্দ্রসহ বারোজন লোককে আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে ভেতরের প্রাঙ্গণে কুয়োর পাশে লাইন করে দাঁড় করায়, এবং পরবর্তী সময়ে মহল্লার লোকেরা এই কথা বলে যে, কপাল এমনই খারাপ ছিল যে, এই লাইনের একেবারে শেষে কুয়োর পাড় ঘেঁষে দাঁড়ায় সুবোধচন্দ্র। তারপর পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন যখন বলে, কলেমা বোলো, তখন একে-একে সকলে কলেমা তৈয়বা পড়ে শোনায় কিন্তু এইদিন আবুবকর মওলানা বিষয়টি শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিয় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, সে পাকিস্তানি মিলিটারির ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলার পর বন্দুক বাগিয়ে ধরে দুজন সিপাই এগিয়ে এসে লাইনের প্রথম ব্যক্তিকে বলে, লুঙ্গি উঠাও, এবং তখন লাইনে দাঁড়ানো মহল্লার অন্য লোকেরা দেখে, আঠারো নম্বর বাড়ির পাকা দাড়িওয়ালা ইদ্রিস মিয়া কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর লুঙ্গি উঁচু করে ধরে দিনের উজ্জ্বল আলোর ভেতর খাতনা করানো শিশ্ন উন্মুক্ত করে তার পরিচয় প্রমাণ করে এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে, তখন তারা ইদ্রিস মিয়ার চোখ থেকে শুভ্র দাড়ি বেয়ে অশ্রু নেমে আসতে দেখে। তারপর সেদিন লাইনে দাঁড়ানো লোকেরা একে-একে লুঙ্গি উঠিয়ে দেখায় এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে, এই প্রক্রিয়া যখন চালু ছিল তখনই তাদের মনের ভেতর এই আশঙ্কা ছিল যে, সুবোধচন্দ্রকে এবার ধরা পড়তে হবে, সে ধরা পড়বে এবং ধরা পড়বে তারাও। সে সময়, লাইনের কতজন লুঙ্গি তোলার পর তা মহল্লার লোকেরা বলতে পারে না, লাইনের কেউ একজন সম্ভবত সুবোধচন্দ্রের সঙ্গে যে দাঁড়িয়েছিল সে, তাকে জাপটে ধরে কুয়োর নিচু পাড়ের উপর দিয়ে ঠেলে ভেতরে ফেলে দেয়। এই সময় ঘটনার আকস্মিকতায় এক মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ার পর বন্দুক বাগানো সিপাই দুজন অনেকটা ঘাবড়ে গিয়ে গুলি ছোড়ে, সেদিন আজিজ ব্যাপারির কুয়োতলায় তিনজন গুলি খেয়ে মরে এবং কুয়োর ভেতর পড়ে মরে সুবোধচন্দ্র। ভূতের গলির লোকেরা এই কথাটা ভুলতে পারে না যে, একাত্তর সালে সুবোধচন্দ্রকে তারাই কুয়োর ভেতর ফেলে দেয়। মহল্লার লোকেরা সেদিন বিহ্বল হয়ে পড়ে, তারা তিনটি লাশ নিয়ে আজিজ ব্যাপারির বাড়ি ত্যাগ করে যায়, তখন তাদের শোক এবং বিভ্রান্তি হয়তো-বা এত প্রবল হয় যে, তারা কুয়োর ভেতর পড়ে যাওয়া সুবোধচন্দ্রের কথা ভুলে যায়, এবং তারা পরবর্তী সময়ে বলে যে, এটা একটা মারাত্মক ভুল ছিল। তারা সেদিন বিকেলে মৃত ব্যক্তিদের গোসল করিয়ে এবং জানাজা পড়ে আজিমপুর গোরস্থানে নিয়ে গিয়ে দাফন করে এবং যার যার বাড়ি ফিরে যায়, তখন মহল্লার লোকদের মনে পড়ে যে, সুবোধচন্দ্রের লাশ কুয়োর ভেতর রয়ে গেছে, তারা তখন পুনরায় দ্রæত আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে যায় এবং তারা দেখে যে, স্বপ্নার ঘরে স্বপ্না নাই, তার বিছানার উপর, এতদিন লুকিয়ে রাখা, সাদা শাঁখা খণ্ডিত অবস্থায় পড়ে আছে এবং তার উপর সিঁদুরের খোলা কোটা ওলটানো; মহল্লার লোকেরা তখন বিচলিত হয়ে পড়ে এবং কুয়োর ভেতর দড়ি বেঁধে হুক নামানো হলে তার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর জোড়া লাশ উঠে আসে। এই জোড়া লাশ নিয়ে মহল্লার লোকেরা সেদিন বিমর্ষ, বিচলিত এবং বিপর্যস্ত বোধ করে, তারপর সুবোধচন্দ্রের কথা মহল্লার লোকেরা নানারকম ঝামেলার ভেতর ভুলে থাকে যতদিন পর্যন্ত না সাতক্ষীরা থেকে তাকে খুঁজতে লোক আসে। মহল্লার লোকেরা বলে যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার এক মাস অথবা দুই মাস পর কোনো এক মঙ্গলবার অথবা বুধবারে একজন লোক ভূতের গলিতে এসে আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন আজিজ ব্যাপারি দরজা খুলে অপেক্ষমাণ লোকটিকে দেখে এবং মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, সুবোধচন্দ্রের খোঁজে একজন লোক এসেছে, তখন তাদের সুবোধচন্দ্র এবং স্বপ্না রানির কথা স্মরণ হয় এবং অস্পষ্ট গ্লানিবোধ ফিরে আসে; তখন তাদের ভেতর যারা আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে যায়, তারা বাড়ির ভেতরের সেই কক্ষটিতে, যে কক্ষে বসে ইতিপূর্বে নিমকপারা খাওয়ার স্মৃতি তাদের স্মরণ হয়, আজিজ ব্যাপারির মুখোমুখি এক তরুণকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে; তার সম্মুখে বিছানার উপর ছিল একটি ভাঁজ করা চাদর এবং এই চাদরের উপর সিঁদুর মাখানো শাঁখার খণ্ডিত টুকরো। মহল্লার লোকেরা বলে যে, লোকটা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শাঁখার টুকরোগুলো ডান হাতের তালুর উপর রেখে নাড়াচাড়া করে, মনে হয় যেন সে সেগুলো পরখ করে অথবা হয়তো সে সেগুলো এমনি খোঁটে, তারপর রুমাল বের করে তাতে জড়িয়ে শার্টের পকেটে রেখে দেয়; তখন সেখানে দাঁড়ানো মহল্লার লোকেরা চুপ করে থাকে এবং অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে, আপনের নাম কী? মহল্লার লোকেরা পরে বলে যে, এই প্রশ্নের উত্তর শোনার পর তাদের মনে হয়েছিল যে, এই উত্তর আসলে তাদের জানাই ছিল; তারা বলে যে, তাদের কথা শুনে লোকটা তাদের দিকে তাকায় এবং তারা তখন সে চোখে কী দেখে তা তারা বুঝতে পারে না; সেই চোখের দৃষ্টিতে কোনো অনুভ‚তিই হয়তো তারা দেখে নাই, এবং তারা বলে যে, তার এই নির্লিপ্ততায় তাদের ভেতরকার গ্লানি ফিরে আসতে থাকলে তারা যখন প্রায় অসহায় হয়ে ওঠে তখন লোকটি বলে যে, তার নাম পরানচন্দ্র দাস।

ভূতের গলির বয়স্ক এবং প্রবীণ লোকেরা স্মরণ করতে পারে যে, সাত বছর আগে সুবোধচন্দ্র আরেকবার কুয়োর ভেতর পড়ে এবং তার কারণ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পারে না। সে সময় ঢাকা শহরের কোনো কোনো এলাকায় দাঙ্গা হওয়ার পর খবর পাওয়া যায় এবং মহল্লার লোকেরা একদিন জানতে পারে যে, ছত্রিশ নম্বর বাড়ির আজিজ ব্যাপারির ভাড়াটে সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী স্বপ্না কুয়োর ভেতর পড়ে মারা গেছে, এবং তারা বলে যে, তারা প্রথমে ভেবেছিল যে, সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী হয়তো খুন হয়েছে; কিন্তু পরে তারা মহল্লায় এই কথা শুনতে পায় যে, ওটা ছিল একটা দুর্ঘটনা, সুবোধচন্দ্র এবং তার কালো তরুণী স্ত্রী কুয়োর পানিতে ভেসে ওঠা পূর্ণিমার চাঁদ ধরতে গিয়ে পানিতে পড়ে যায়। তারা এই কথা শুনতে পায় যে, বর্ষার দিনে কোনো এক রাতে ঘুম না আসায় সুবোধচন্দ্রের স্ত্রী ঘর থেকে বের হয়ে কুয়োপাড়ে মুক্ত বাতাসে গিয়ে দাঁড়ায়; তখন ক্রমাগত বৃষ্টির কারণে কুয়োর পানি খুব উপরে উঠে এসেছিল এবং সে রাতে আকাশে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। মহল্লার লোকেরা এই কথা শুনতে পায় যে, সেদিন রাতে কোনো এক সময় কুয়োতলায় সুবোধচন্দ্র তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগ দেয় এবং তারা কুয়োর শান-বাঁধানো পাড়ের উপর বসে গল্প করে; তখন তাদের তরুণ বয়স এবং প্রকৃতির আনন্দময় উন্মোচনের কারণে হয়তো-বা তাদের উচ্ছ্বাস হয়। সে সময় তাদের প্রায় নাগালের ভেতর কুয়োর পানির দিকে তাকিয়ে স্বপ্না একটি গোল সোনার থালার মতো চাঁদকে পানির ভেতর ডুবে থাকতে দেখে। মহল্লার লোকেরা বলে যে, কুয়োর ভেতরের এই চাঁদের দিকে তাকিয়ে স্বপ্না যখন বলে, ধরি তখন সুবোধচন্দ্র বলে, ধর এবং তারা জানতে পারে যে, তারপরেই এই ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা কত রাতে ঘটে এবং এটা ঘটতে কে দেখে বা সুবোধচন্দ্র এবং স্বপ্নার এইসব কথা কে শুনতে পায়, সে সম্পর্কে মহল্লার লোকেরা জানতে পারে না, তবে তারা জানতে পারে যে, সেদিন সুবোধচন্দ্রের স্ত্রী কুয়োর পাড়ের উপর বসে পানি যত কাছে ভেবেছিল তা বস্তুত তত কাছে ছিল না; সে উপুড় হয়ে কুয়োর ভেতর হাত বাড়িয়ে দিয়ে পানি ছুঁতে চেষ্টা করলে তার হাত পানির নাগাল না পেয়ে শূন্য বাতাসের ভেতর অবলম্বনহীন হয়ে পড়ে এবং সে ভারসাম্য হারিয়ে মাথা নিচের দিকে করে পানির ভেতর পড়ে যায়। সুবোধচন্দ্র তখন কাছে থাকলেও ঘটনার আকস্মিকতার কারণে সে তার স্ত্রীর পতন ঠেকাতে পারে নাই, কিন্তু তারপর তার সম্বিৎ ফিরে আসে এবং সে লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে কুয়োর পানিতে লাফিয়ে পড়ে স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য, এর পরিণতিতে স্ত্রীর সঙ্গে সে-ও মারা যায়। মহল্লার লোকেরা বলে যে, সুবোধচন্দ্রের স্ত্রী সম্ভবত সাঁতার জানত না, ফলে পানিতে পড়ে সে ডুবে যায় এবং সুবোধচন্দ্র যখন পানিতে নেমে তার কাছে পৌঁছায় সে তাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে যে, সুবোধচন্দ্রেরও ডুবে না মরে উপায় থাকে না; পরদিন সকালবেলা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রাখা সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রীর লাশ বাসার লোকেরা কুয়োর পানিতে ভেসে থাকতে দেখে। সেদিন প্রথম মহল্লার লোকেরা কুয়োর পানি থেকে জোড়া লাশ উদ্ধার করে বারান্দায় চৌকির উপর রাখে এবং নারায়ণগঞ্জে সুবোধচন্দ্রের বাড়িতে খবর পাঠায় এবং সেদিনই বিকেলে ট্রেনে করে সুবোধচন্দ্রের ভাই এবং অন্য দুজন লোক এসে পৌঁছায়, তখন এই লোকদের সঙ্গে কথা বলে মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, সুবোধচন্দ্রের ভাইয়ের নাম, পরানচন্দ্র। সেদিন পরানচন্দ্র এবং তার সঙ্গীরা একটি ট্রাক ভাড়া করে যখন লাশ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রওনা হয়, তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে জড়ো হওয়া মহল্লার লোকেরা বাইরের উঠোনে দেয়ালের ধার ঘেঁষে স্বপ্নার লাগানো তুলসীগাছটি দেখতে পায়; তারা দেখে যে, গাছটির গোড়ায় কোনো বেদি না থাকলেও, গোড়ার মাটি একটি বৃত্তের মতো করে নিকানো। সে সময় সুবোধচন্দ্র এবং স্বপ্নার লাশ নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যাওয়ার পর মহল্লার লোকেরা তাদের কথা ভুলে যায় এবং দেয়ালের পাশের তুলসীগাছ কোনো এক সময় মরে যায়।

মহল্লার লোকেরা বলে যে, প্রায় সাত বছর পর আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে সুবোধচন্দ্র এবং তার কালো তরুণী স্ত্রী স্বপ্না যখন ভাড়াটে হয়ে আসে, তখন তারা এই বিষয়টি দীর্ঘদিন খেয়াল করতে ব্যর্থ হয় যে, স্বপ্না ঠিক আগের জায়গায় একটি তুলসীগাছ লাগায় এবং এর গোড়ায় মাটি লেপে বৃত্তের মতো গোল করে রাখে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো এক মঙ্গলবার অথবা বুধবার পরানচন্দ্র সাতক্ষীরা থেকে আসে এবং স্বপ্নারানির ভাঙা শাঁখার টুকরো তার বুকপকেটে রেখে সুবোধচন্দ্রের জিনিসপত্র বেঁধে কমলাপুর স্টেমনে রওনা হয়ে যায় এবং তারপর মহল্লার লোকেরা সুবোধচন্দ্র, স্বপ্না এবং দেয়ালের পাশের তুলসীগাছটির কথা পুনরায় ভুলে যায়।

তারপর ‘ইয়োর চয়েস’ সেলুনে বসে চুল কাটার সময় মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসেছে এবং তাদের নাম সুবোধ এবং স্বপ্না, তখন তারা তাদের দেখতে যায় এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে। ‘ইয়োর চয়েস’ সেলুনে বসে মহল্লার লোকেরা এই গল্প করে; তারা বলে যে, বাবুল মিয়া একদিন তাদেরকে দেখতে পায় এবং সুবোধচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করে, আপনের নাম কী? সে উত্তর দেয়, সুবোধচন্দ্র এবং তখন বাবুল মিয়া বলে যে, এটা তার জানা ছিল!

তাই নাকি! কেমন কইর‌্যা?

আপনের ইস্ত্রির নাম স্বপ্না?

 হেঁ, কেমন কইর‌্যা জাইনলেন!

আপনের একটা বাই আছে না দ্যাছে?

 হেঁ আছে।

নাম পরান না?

 হেঁ, এত কথা ক্যামন কইর‌্যা জানেন?

বাবুল মিয়া তখন বলে যে, এইসব কথা মহল্লার সকলেই জানে এবং সে সুবোধচন্দ্রকে এই বলে সাবধান করে, এই বাড়ির ভিতরে একটা কুয়া আছে, এই কুয়া থেইকা সাবধান! ‘ইয়োর চয়েস’ সেলুনে বসে মহল্লার লোকেরা এইসব কথা শোনে এবং তারা খুব বিচলিত বোধ করে, তারা তখন আব্দুল আজিজ ব্যাপারির কাছে যায় কুয়োর ভেতর সুবোধচন্দ্র এবং স্বপ্নার পুনরায় পড়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের আশঙ্কার কথা বলে, কিন্তু আজিজ ব্যাপারি তাদের কথায় গুরুত্ব দেয় না, সে বলে, আরে না, বারে বারে কুয়ার ভিতরে মানুষ পড়ে নিহি; তখন মহল্লার লোকদের কিছু করার থাকে না, তারা ফিরে আসে, তারপর তারা স্বপ্নার বানানো নিমকপারা এবং চা খায় এবং সুবোধচন্দ্রের কাছে যমুনা নদীর ভাঙনের গল্প শোনে, এবং তখন দেয়ালের পাশের তুলসীগাছটাকে তারা আবার দেখতে পায়, তারা লক্ষ করে যে, গাছটার গোড়ার মাটি একটি ছোট বৃত্তের আকারে নিকানো এবং এই মাটিতে ছিটানো রয়েছে সিঁদুরের গুঁড়ো। ভ‚তের গলির লোকেরা বলে যে, তখন, কবে তাদের তা মনে নাই, তবে তারা বলে যে, সেটা ছিল নিঃসন্তান রংবাজ জেনারেলের শাসনকালের শেষদিকে, মহাবন্যার পরের কোনো এক সময়, মহল্লায় প্রবল খরা দেখা দেয় এবং গরমে ভেন্টিলেটারের ভেতর থেকে চড়–ইপাখি মরে পড়তে থাকে, সেই সময় তারা একদিন প্রথম অযোধ্যায় মসজিদ ভেঙে ফেলার কথা শুনতে পায় এবং খুব বিচলিত হয়ে পড়ে, কিন্তু তারা দেখতে পায় যে, এই খবরে তাদের চাইতে বেশি বিচলিত হয় সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী : পরবর্তী সময়ে মহল্লার লোকদের এই কথা মনে পড়ে যে, তারা সুবোধচন্দ্রকে বারে বারে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু কোনোবারই তা রক্ষা করে নাই। তখন একদিন তারা জানতে পারে যে, মসজিদটি আসলে ভেঙে ফেলা হয় নাই, এবং ‘ইয়োর চয়েস’ সেলুনে বসে একদিন চুল কাটার সময় সুবোধচন্দ্র ম্লান মুখে বলে, এইগুলা কোনো কাম না, মসজিদ ভাঙলেই কি ধর্ম হয়? মহল্লার লোকেরা বলে যে, তখন সেলুনে চুল কাটতে আসা অন্যান্য লোক সামনের বড় আয়নায় গলা পর্যন্ত সাদা চাদরে মোড়ানো সুবোধচন্দ্রের মলিন এবং ম্লানমিয়মাণ মুখ দেখতে পায় এবং তারা এই খরা এবং দুর্গন্ধের ভেতরেও তার বিষণ্ণতার কারণ বুঝতে পারে এবং তারা বলে, আপনে ডরান নিহি?

না, ডরামু ক্যা।

ডরায়েন না, আপনে তো কিছু করেন নাইকা।

কিন্তু পরবর্তীকালে মহল্লার লোকেরা এক ধরনের বিভ্রান্তি, বিষণ্ণতা এবং গ্লানির সঙ্গে এইসব ঘটনা স্মরণ করে এবং এই সত্য উদ্ঘাটন করে যে, সুবোধচন্দ্রের ব্যাপারে তারা হয়তো ঠিক কথা বলে নাই এমন কোনো কারণে তা তারা বুঝতে পারে নাই, কারণ সুবোধচন্দ্র এবং স্বপ্না পুনরায় কুয়োর ভেতর পড়ে। মসজিদ ভেঙে ফেলার এইসব গুজব ক্রমাগতভাবে চলতে থাকে এবং তা একদিন সত্যি সত্যি ভাঙা হয়; এবং এই জীর্ণ পুরনো মসজিদটি দীর্ঘ প্রচারণা চালিয়ে ভেঙে ফেলার দিন সুবোধচন্দ্র এমন একটি কাজ করে যার ব্যাখ্যা তারা করতে পারে না এবং তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মসজিদটি সত্যি ভেঙে ফেলার খবর যেদিন মহল্লার লোকেরা পায়, তারা খুব বিমর্ষ হয়ে থাকে এবং দুদিন পর সংবাদপত্রে যখন মসজিদের এই ধ্বংসস্ত‚পের উপর বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাত উপরের দিকে ওঠানো, মাথায় পাগড়ি জড়ানো মৌলবাদীর ছবি ছাপা হয়, তারা অসহায় বোধ করে এবং তখন, সেদিন সুবোধচন্দ্রের এই কাজের বিষয়টি মহল্লায় উদ্ঘাটিত হয়। এই খবরটি মহল্লায় দ্রুত প্রচারিত হয়ে পড়ে যে, যেদিন অযোধ্যার মসজিদ ভাঙার খবর পাওয়া যায় সুবোধচন্দ্র সেদিন নবাবপুর গিয়ে মরণচাঁদের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে আনে এবং স্বামী-স্ত্রী মিলে তা খায়। এই মিষ্টি খাওয়ার ঘটনা কে দেখে কিংবা এই ঘটনার কথা কার কাছ থেকে জানা যায় তা মহল্লার লোকেরা বলতে পারে না; তারা পরে বলে যে, এই খবরের উৎস হয়তো ছিল আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির চাকর অথবা চাকরানি অথা অন্য কেউ সেদিন বিকেলের ভেতর এই খবর পুরো ভূতের গলি এবং আশপাশের মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে, এবং এক প্রবল বিভ্রান্তির ভেতর উত্তেজিত মানুষের এক বিরাট দল আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। সেদিন ভূতের গলির লোকেরা সুবোধচন্দ্র এবং স্ত্রী স্বপ্নার খাওয়ানো নিমকপারার কথা ভুলে যায় এবং এই জনতা যখন আজিজ ব্যাপারির বাসা ত্যাগ করে যায়, তখন সুবোধচন্দ্র এবং স্বপ্নাকে কুয়োর ভেতর পাওয়া যায় মৃত; কিন্তু এবার পরানচন্দ্র আসে না, কারণ, খবর পেয়ে পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়। জোড়পুল এবং পদ্মনিধি লেনের লোকেরা, নারিন্দা এবং গৌড়ের মঠ এলাকার লোকেরা, যারা ‘ইয়োর চয়েস’ সেলুনে চুল কাটতে অথবা দাড়ি কামাতে আসে তারা বলে যে, এরপর কোনো এক সময় ভূতের গলির লোকেরা সময়ের এক নিমকপারা গোলকধাঁধার ভেতর প্রবেশ করে, কারণ, দেখা যায় যে, তারা স্বপ্নার বানানো নিমকপারা খাওয়ার কথা ভুলে যেতে পারে না  এবং তাদের এই কথাটি সর্বদা মনে পড়ে যে, সুবোধচন্দ্রকে তারা ক্রমাগতভাবে বলেছিল, ডরায়েন না, কিন্তু সুবোধচন্দ্র এবং তার স্ত্রী ক্রমাগতভাবে মহল্লার কুয়োর মধ্যে পতিত হয় অথবা তারাই তাদেরকে ফেলে দেয়; তখন মহল্লার লোকদের পুনরায় বিষণ্ণ লাগে এবং গ্লানিবোধ হয় এবং তখন কোনো একদিন মহল্লার একদল লোক কোদাল হাতে আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় এবং তাদের জীবনের সবচাইতে বড় বিভ্রান্তির ভেতর প্রবেশ করে এবং তাদের মনে হয় যে, তাদের জীবনে সময়ের কাঠামোটি ভেঙে পড়েছে।

সেদিন ভূতের গলির এই লোকেরা  কোদাল হাতে আজিজ ব্যাপারির বাসায় গিয়ে হাজির হয় এবং বাড়িতে ট্যাপের পানি আসার পরও কুয়ো বুজিয়ে না দেয়ার জন্য তাকে দোষারোপ করে এবং বলে যে, তারা মাটি কেটে এই কুয়ো বন্ধ করে দেবে। তখন তাদের কথা শুনে আজিজ ব্যাপারি বিস্মিত হয়, সে বলে, সুবোধচন্দ্র ক্যাঠা? কলের পানি কই পাইলা? নিযামের মা’র ঠিল্লার পানি খায়া বাঁইচা আছো! তখন মহল্লার এই সব লোকের সামনে দিয়ে নিযামের মা কলসিতে করে রাস্তার কল থেকে আজিজ ব্যাপারির বাসার বিকেলের খাওয়ার পানি নিয়ে আসে। মহল্লার এই লোকেরা ঠিলাওয়ালি নিযামের মা’র শারীরিক উপস্থিতির এই বাস্তবতা উপেক্ষা করতে পারে না এবং তখন তারা বুঝতে পারে যে, তখনও পর্যন্ত মহল্লায় হয়তো সুবোধচন্দ্র আসে নাই, দেশ স্বাধীন হয় নাই এবং অযোধ্যায় মসজিদও ভাঙা হয় নাই; কিন্তু তখন, একইসঙ্গে সুবোধচন্দ্রের ক্রমাগতভাবে কুয়োর ভেতর পড়ে যাওয়ার ঘটনার কথা মনে করতে পারে এবং তারা খুবই বিচলিত এবং গ্লানিবোধ করে এবং তারা বিভ্রান্ত হয়। তারা সময়ের কোন তলে আছে তা তারা বুঝতে পারে না, কিন্তু যে নিমকপারা তারা খেয়েছিল অথবা খাবে তার স্বাদের কথা তারা ভুলতে পারে না, এবং ভয় না পাওয়ার যে কথা তারা সুবোধচন্দ্রকে বলেছিল অথবা বলবে, তার ব্যর্থতার স্মৃতি তাদেরকে এমনভাবে পীড়ন করে যে, তারা আব্দুল আজিজ ব্যাপারিকে বলে, আপনরে এই কুয়া আমরা বুজায়া ফালামু, এবং তারা বাধা উপেক্ষা করে তার চোখের সামনে মাটি কেটে কুয়ো বুজিয়ে ফেলে, তারপর, সন্ধ্যার পর তাদের কেউ কেউ রথখোলার মোড় থেকে ইপিআরটিসির দুই দরজাওয়ালা লম্বা সবুজ রঙের বাসে চড়ে সদরঘাট যায়। কিন্তু মহল্লার লোকেরা বলে যে, এই লোকেরা বাস সদরঘাট পৌঁছার আগেই বিচলিত হয়ে পড়ে, কারণ, তাদের স্বপ্না এবং সুবোধচন্দ্রের কথা মনে হয়; তখন তাদের মনে হয় যে, কুয়ো বুজিয়ে ফেললে সুবোধচন্দ্রের কুয়োয় পড়ার কথা নয়, এবং ফলে, তাদের ইপিআরটিসির এই নতুন বাসে চড়ার আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। মহল্লার লোকেরা বলে যে, এই বিভ্রান্তির ভেতর তাদের এরকম মনে হয় যে, তারা হয়তো কোনো এক জায়গায় কোনো এক স্বপ্নের ভেতর আটকা পড়ে আছে এবং এই স্বপ্নের ভেতর তারা অতীত থেকে ভবিষ্যতে অথবা ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে; এবং তাদের মনে হয় যে, সুবোধ ও স্বপ্নার বিষয়টি হয়তো সত্য নয়, স্বপ্ন; কিন্তু তখন তাদের আব্দুল আজিজ ব্যাপারির বাড়ির প্রাঙ্গণে লাগানো স্বপ্নার তুলসীগাছটির কথা মনে পড়ে, তারা আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে যায় এবং দেয়ালের কিনারায় মৃদু বাতাসের ভেতর তুলসীগাছটিকে দেখে; এবং তখন তাদের কুয়োটির কথা মনে পড়ে। 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত