শক্তি চট্টোপাধ্যায়( জন্ম : নভেম্বর ২৫, ১৯৩৩ ও মৃত্যু : মার্চ ২৩, ১৯৯৫) জীবনানন্দ-উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে বিবেচিত। বাংলা ভাষায় হাতেগোনা গ্রান্ডকবিদের একজন হচ্ছেন তিনি। তিনি শক্তি নামেই অধিক পরিচিত। ১৯৭৫ তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৩ সালে ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো(১৯৮২)’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। ‘অবনী বাড়ি আছে’র মতো অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতা আছে তার।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় চল্লিশটির বেশি ভ্রমণ, প্রবন্ধ, উপন্যাস, অনূদিত, শিশুতোষ ও কবিতার বই লিখেছেন। ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য(১৯৬১)’ শক্তির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। দ্বৈতসত্তায় বেশিরভাগ বাঙালি বিশ্বাসী। এদের নিয়েই লিখলেন (দ্বিতীয়) ‘ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো’র মতো কাব্যগ্রন্থ। ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি,অন্ধকারে(১৯৬৬)’, ‘সোনার মাছি খুন করেছি(১৯৬৭)’, ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে(১৯৭৮)’, ‘আমি চলে যেতে পারি(১৯৮০)’, ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো(১৯৮২)’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
তিরিশের কবিদের কবিতায় ইংরেজি কবিতার চিত্রকল্পের ছোঁয়া পাওয়া যায়। শব্দ গঠনরীতিতে মৌখিক ভঙ্গির প্রবণতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় সার্থক রূপকার। এক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব একটা জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ‘গড়িয়ে পড়ছে উস্কোখুস্কো ভেড়ার পাল’র মতো অলংকারে ইউরোপের মেষের গন্ধ পাই। ইউরোপীয় স্টাইলে ঋদ্ধ হলেও বঙ্গজ উপাদানে সেগুলো রঙিন করেছেন। কবিতায় নতুন এক ভুবন তৈরি করেছেন। শক্তির অনুধাবন ক্ষমতা চমৎকার। উপমা-অলংকারে কবিতায় বিমূর্ত রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। অনেক সমালোচক কবিতায় ‘কংক্রিট’ রূপ দেওয়ার উপর কবিতার মান নির্ভরশীল বলে মনে করেন। বিভিন্ন ও নিয়ন্ত্রিত অলংকার প্রয়োগ করে পাঠককে ঈপ্সিত লক্ষ্য নিয়ে যেতে সক্ষম।
শক্তির কবিতায় উচ্চারণ রক্তজবার মতো উজ্জ্বল, ঝরঝরে। তেজস্বী কবিতায় স্পষ্টতা পাঠককে মুগ্ধ করে। এরিস্টটল বলেন, স্পষ্টতার উপরেই নির্ভর করে সাহিত্যের গুণ। এক্ষেত্রে শক্তির কবিতায় স্পষ্টতা লক্ষ্যণীয়। ‘যদি পারো দুঃখ দাও, আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি/ দাও দুঃখ, দুঃখ দাও – আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি।/ তুমি সুখ নিয়ে থাকো, সুখে থাকো, দরজা হাট-খোলা(যদি পারো দুঃখ দাও)’, ‘ঝড় মানে ঝোড়ো হাওয়া, বাদলা হাওয়া নয়/ক্রন্দন রঙের মত নয় ফুলগুলি/ চন্দ্রমল্লিকার(দিন যায়)’, ‘ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই/ আমার পুবের হাওয়া।/ কিন্তু এখন যাবার কথায়/ কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়(ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ)’ ইত্যাদির মতো সরল ও স্পষ্ট উচ্চারণের পঙ্ক্তি পাঠককে কাছে টানতে সক্ষম হয়েছে। প্রেমের কবিতা বলি কিংবা দেশপ্রেমের কবিতা বা মানবতার কবিতা–সর্বত্র তার স্পষ্ট ও কঠিন উচ্চারণ।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে নতুন এক স্বর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এখানে শক্তির বিরাট সফলতা। সম্ভবত এ কারণেই বিপুল এক পাঠকসমাজ গড়ে তুলতে পেরেছেন। রবার্ট ফ্রস্টের মতে, কবিতা আনন্দ দিয়ে শুরু কিন্তু শেষে পাঠক জ্ঞানার্জন করতে সক্ষম হন। শক্তির কবিতাগুলো আমাদেরকে একইসঙ্গে আনন্দ ও জ্ঞান বিতরণ করে। শক্তির কবিতা পাঠ করে আমরা প্রজ্ঞাবান হতে পারি। আনন্দ দেওয়া এবং জ্ঞান বিতরণ–দ্বিমুখী এ অবস্থান ধরে রাখতে পারা কঠিন। তবে শক্তি ঠিকই কবিতায় পাঠককে উল্লেখিত দুটি বিষয় বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। লঙ্গিনাস ও অনেকের মতে, কাব্য হচ্ছে আবেগের প্রকাশ। কিন্তু আবেগ হতে হবে নিয়ন্ত্রিত। শক্তির কবিতায় আমরা নিয়ন্ত্রিত আবেগই দেখতে পাই। ঠুনকো বিষয়ের ওপর আবেগ বাড়িয়ে কবিতার উৎকর্ষতা নষ্ট হতে দেননি।
‘ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।/ এতো কালো মেখেছি দু হাতে/ এতোকাল ধরে!/ কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।/…যাবো/কিন্তু, এখনি যাবো না/ তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো/ একাকী যাবো না, অসময়ে(যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?)’। মানবতা আধুনিক কবিতার বড় একটি নিয়ামক। কবিতা বা সাহিত্যে এ গুণটি না-থাকলে সাহিত্য অমরতা লাভ করতে ব্যর্থ হবে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আসলে কেউ বড়ো হয় না, বড়োর মত দেখায়,/ নকলে আর আসলে তাকে বড়োর মত দেখায়/গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াও, দেখবে কত ছোটো(আসলে কেউ বড়ো হয় না, বড়োর মত দেখায়)’ অথবা ‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও,/ মানুষই ফাঁদ পাতছে,/ তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও,/মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও(দাঁড়াও)’ ইত্যাদি পঙ্ক্তিগুলোতে মানবতার জয়গান গাওয়া হয়েছে। এরকম অসংখ্য ছত্র রয়েছে শক্তির।
বাংলা ভাষায় হাংরি আন্দোলন অন্যতম(সত্যিকারের ধরলে একমাত্র)। ১৯৬১ সালের নভেম্বর পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে ‘হাংরি আন্দোলন’র সূত্রপাত হয়েছিল। প্রথমকার চারজন সদস্যের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম সদস্য। এছাড়া সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, এবং দেবী রায় ছিলের আন্দোলনের অন্য তিনজন। হাংরি আন্দোলনকারীরা মনে করতেন দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে এবং বাঙালির সত্যিকারের আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন হিসাবে বিবেচনা করতেন। কিছু-কিছু কার্যকলাপের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষার্ধে হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয়। অবশ্য শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরে এ আন্দোলন থেকে সরে আসেন এবং সুনীল গঙ্গোপাদ্যায়ের সঙ্গে ‘কৃত্তিবাস’ ধারায় যোগ দেন। এখানে তিনি সফলও হন।
কবির ভাবনা ও পাঠকের অনুধাবনের মধ্যে পার্থক্য নেই বললেই চলে। জোরালো উপস্থাপনা শক্তির কবিতার বড় এক গুণ। এ গুণের কারণেই কবিতা-শক্তির বৃদ্ধি/হ্রাস পেতে পারে। শক্তির সজ্জা/অলংকার বক্তব্যকে ধারালো ও বীর্যবান করেছে। শক্তির কবিতায় আদিখ্যেতা ও খামখেয়ালিপনা নেই বলতে গেলেই চলে। কবিতার ভাষায় দ্বর্থহীনতা শক্তিকে গ্রান্ডকবি করতে সক্ষম হয়েছে।

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট