Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,Shakti Chattopadhyay poet

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য । বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর শেষ দিনটি

Reading Time: 2 minutes

আমি কখনো কোনো শোক মিছিলে যাই না। শুধু, সুধীন্দ্রনাথ মারা গেলে তাঁর শবের অনুগামী হয়েছিলুম। তাঁর ছাত্র ছিলুম তথন, যাদবপুরে। বুদ্ধদেব আমাদের বিভাগের প্রধান ছিলেন তখন। তারপর অনেকেই গেলেন- প্রায় সকলেই অপ্রত্যাশিতভাবে গেলেন। নারায়ণবাবু চলে গেলেন, শান্তিদা- শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন হঠাৎ, নরেনদা গেলেন। তার কিছুকাল আগেই গেছেন বুদ্ধদেব। শেষ গেলেন অচিন্ত্যকুমার আর ঋত্বিক। এঁরা আমার চেনাশুনো, আপনার জন। আপনার জনের এই হঠাৎ-যাওয়া আমি সহ্য করতে পারি না। কিন্তু, সহ্য করতেই হয়। আমি শুধু যা পারি, তা এই শবানুগমনে না থাকা। শ্রাদ্ধশান্তিতে যোগ না দেওয়া। পালিয়ে-যাওয়া মানুষের সঙ্গে কোনো সংশ্রব না থাকুক- এই চাই।

বুদ্ধদেব নেই- আকাশবানী থেকে প্রচারিত সংবাদটুকু শুনে বালিশে মুখ গুজেঁ শুয়ে পড়েছি- তখন সকাল। জানালা-দরোজা বন্ধ করে অন্ধকার বানিয়েছি। শুয়েই ছিলাম, আমার বন্ধুরা এসে জোর করে নিয়ে গেল। যামিনী রায়ের পুত্র মণিদা ছিলেন, গাড়ি নিয়ে। তাঁর সংগে আমি আর নিখিল নাকতলা যাই। সেখানে পৌছেঁই সব মানুষের অবনত মাথা আর ফুলগন্ধ আমাকে ভীষণ জব্দ করে। তখনো তাঁর ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখিনি। সেখানে স্তব্ধতা আর মানুষের অসহনীয় ভীড়। কারুকে কাঁদতে দেখলেই আমার চোখে জল এসে পড়ে। বুকের ভেতরটা কেমন খালি-খালি লাগে। যেখানে সবার চোখে জল, মুখ বিষাদ-থমথমে, আমি সেখানে দাঁড়াতে পারি না। কেন এলুম? নিজেকে ভর্ৎসনা করতে থাকি, মনে মনে। অনহ্য এক বেদনার নীলরঙ আমার মুখে চোখে জুড়ে বসে। আমরা এক ঝলক তাঁকে দেখে, পাশে, দেবব্রতর ফ্লাটে চলে যাই। সেখানে গিয়ে অবিরাম সীধুপান চলে। গান হয়, চোখ জলে ভাসে- ওঁর সম্পর্কে কথা একেবারেই হয় না। যেন এক সমূহ দৃশ্য থেকে উদ্ধার পেতে, স্মৃতি থেকে পার- আমরা গলাধঃকরণ করতে থাকি অগ্নি। যা তাকেঁও, কিছুকাল বাদে, বৃত্তাকারে ঘিরে ধরবে। অনুমান করি।

কিছুক্ষণ বাদে স্টেসম্যান কাগজের অরণি আসেন, নরেশ গুহ তাকেঁ বুদ্ধদেব সম্পর্কে রচনা তৈরি করতে সাহায্য করেন। আমরা মাঝে মধ্যে শুনি। অরণির হাতের কাগজ পুড়ে যায় অকস্মাৎ। আমাদের মনে হয়, তিনি তাঁর সম্পর্কে কোনোরকম রচনাই চান না। আমরা ঐ ঘটনার পর, কেমন অন্যরকম হয়ে যাই। অরণি আবার শুরু করেন। নরেশদাকে বলিঃ এমন কোনো কথা বলবেন না যাতে ওঁকে আবার কাগজ পুড়িয়ে দিতে হয়!

সারাদিন আমরা আর ঐ খুপরি থেকে বেরুই না। কেউ কেউ বেরোয়। আমি, নিখিল আর মণিদা ঠায় বসে থাকি। সন্ধে নাগাদ ওরা কেওড়াতলা যায়, আমাকেও যেতে হয়। না যাওয়াই ভালো ছিল। সেখানে আমি, পরে শুনেছি, প্রচণ্ড গোলযোগ করেছি- যাতে কিছুতেই অগ্নি তাকেঁ স্পর্শ না করে- আমি এমন দাবী করেছিলুম পাগলের মতো। বলেছিলুম, ওঁর দেহ আমাদের দিয়ে দেওয়া হোক, আমরা কাছে রাখব।
পাগলের কথা কেউ শোনেনি। প্রতিবাদে সমস্ত পাগল স্থানত্যাগ করে সেদিন।

বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমাদের যোগাযাগ প্রায় বিশ বছরের। বিশ বছরের স্মৃতি একটা সার্থক পাহাড়। এখানে সেই শেষ দিনটির সামান্য চিত্র তুলে ধরা হল।

(শব্দমন্ত্র, বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা,১৯৭৪)

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>