Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,shakti-thakur-indian-actor-playback-singer

স্মৃতিচারণ: আমার বন্ধু  শক্তি ঠাকুর  ।  দিলীপ মজুমদার

Reading Time: 3 minutes

শক্তি ঠাকুর ছিল আমার সহকর্মী, বন্ধু। গান ও অভিনয়ের জগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল তাকে। তাই অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না তার সঙ্গে  । একদিন তাকে টিভির কোন রিয়েলিটি শোতে দেখলাম। তার মেয়ে তাকে নিয়ে এসেছে । গায়িকা হিসেবে তার মেয়েও নাম করেছে। সেই রিয়েলিটি শোতে সেলিব্রিটিদের মা-বাবারা  অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু শক্তিকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। জীর্ণ শীর্ণ। কথা বলতে পারছে না ভালো করে। শুনলাম তার  হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। প্রাণচঞ্চল শক্তির এই পরিণতি দেখে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপরে টিভিতেই তার মৃত্যুর খবর শুনলাম গত বছর।

গত শতকের সত্তরের দশকে  টালিগঞ্জের নেতাজিনগর বিদ্যামন্দিরে যুক্ত  হই আমি। শক্তি সেখানকার কেমিস্ট্রির শিক্ষক। বেঁটে খাটো ,সুস্বাস্থ্যের অধিকারী শক্তি ছিল প্রাণচঞ্চল, রসিক মানুষ। কথা বলার সময়ে একটু তোতলামি করত। খুব জনপ্রিয় শিক্ষক ছিল সে। প্রচুর টিউশন করত। চেহেরা ছোটখাটো হলেও দাপট ছিল তার। ইলেভেন-টুয়েল্ভের তাগড়াই চেহেরার ছেলেরাও তাকে ভয় পেত। লাফিয়ে চড় কষিয়ে দিত ছেলেদের। পরীক্ষার সময়ে যে ঘরে সে গার্ড দিত, সেখানকার ছেলেরা তটস্থ হয়ে থাকত।

শুনেছিলাম শক্তি  অবসর সময়ে গান নিয়ে থাকে। তার শ্বশুরমশায়  ক্ল্যাসিকাল গানের চর্চা করতেন। শক্তি অবশ্য দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদের গান গাইত। আমাদের বাড়িতে এসে সে অনেকবার সেসব গান শুনিয়েছে। তখন তার নাম হয় নি। তাই বাড়ির আশপাশে লোক জমে যাওয়ার প্রশ্ন ছিল না।  স্কুল ছুটির পরে সে প্রায়ই আমার সঙ্গে বেরোত। কোথায় যাবে জানতে চাইলে কখনও বলত, আকাশবাণী যাবে, কখনও বলত ইন্দ্রপুরী স্টুডিও যাবে। কি করতে যাবে সেসব জায়গায়? শক্তি বলত, বুঝলি না, নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে…।  প্রথমে বুঝতে পারি নি ব্যপারটা। শক্তি আমাকে বুঝিয়ে দেয়। এখনকার মতো তখন আগে থেকে রেকর্ড করে রাখার চল ছিল না। যে শিল্পীকে গান করার  জন্য ডাকা হয়েছে, তিনি কোন কারণবশত না  এলে তার জায়গায় শক্তি ঢুকে যেতে পারে।

শক্তি ছিল স্মার্ট, ড্যাশিপুশি। যা চাইত তা স্পষ্ট করে বলতে পারত।  কোন দ্বিধা-সংকোচ ছিল না। যার কাছে চাইত, তিনি যত বড় হোন না কেন,  শক্তির জিভে জড়তা দেখা যেত না। এই সাহসটাই তার সাফল্যের চাবিকাঠি। এক শনিবার সে আমাকে বলল, তুই কাল সকাল আটটায় বসুশ্রী সিনেমার সামনে থাকবি, এক জায়গায় নিয়ে যাব।

ঠিক সময়ে শক্তি একটা ট্যাক্সি নিয়ে হাজির। তার নির্দেশে উঠে পড়লাম ট্যাক্সিতে। যাব কোথায়? শক্তি চুপ। লেকের পাশ দিয়ে ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল  হেমন্ত মুখার্জির বাড়ির সামনে। শক্তির নির্দেশে নেমে পড়লাম। সে দরজার বেল টিপল। ভাবলাম সে হয়তো আগে থেকে যোগাযোগ করে এসেছে। ভালোই হল। আমার প্রিয় মানুষটিকে সামনা সামনি দেখতে পাব। কথা বলতে পারব। হেমন্ত মুখার্জীকে দেখেছিলাম আমাদের রবীন্দ্রভারতীর সমাবর্তনে। সেবার তাঁকে ডি লিট উপাধি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তখন কথা বলার সুযোগ ছিল না।

একটু বাদে হেমন্ত মুখার্জী এলেন। শক্তি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,  আগে থেকে না জানিয়ে চলে এলাম, ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে কয়েকটা গান শোনাতে চাই। আর আমার এই বন্ধু চায় আপনার জীবনী লিখতে।

তার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। প্রতিবাদ করতে যেতেই শক্তি টেবিলের তলায় তার পা দিয়ে আমার পা চেপে ধরল। আমাকে চুপ করে যেতে হল। হেমন্তবাবু  বললেন, ভাই আজ তো পারব না, আমাকে একটু পরে বেরিয়ে যেতে হবে, রেকর্ডিং আছে।

শক্তির মুখে শুনেছিলাম, পরে সে হেমন্তবাবুকে গান শুনিয়েছিল, খুশি হয়েছিলেন তিনি। হয়তো বা তাঁর সুপারিশে শক্তি আকাশবাণীতে একটা জায়গা করে নিতে পেরেছিল।

রসিকতা আর দুষ্টুমি সহজাত ছিল শক্তির। আমাদের পণ্ডিতমশায় ছিলেন কালীপ্রসাদ ভট্টাচার্য। একটু বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন তিনি। বিয়ের দিন দুই আগে আমি ,শক্তি, বিশ্বজিৎ আর পণ্ডিতমশায় ছুটির পরে বেরোচ্ছি। পণ্ডিত আমাদের কয়েক পা আগে। শক্তি লেঙ্গি মেরে দিল। পণ্ডিত পড়লেন মুখ থুবড়ে। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ইস কি কাণ্ড, বেশি আঘাত লাগলে বিয়ের আসরে যেতে পারতাম না।

সঙ্গে সঙ্গে শক্তি বলে,  বিয়ে বন্ধ থাকত না, আমি প্রক্সি দিয়ে চালিয়ে নিতাম।

স্কুলের বাৎসরিক উৎসব। ছাত্রদের  আবদার পণ্ডিতকে মূকাভিনয় করতে হবে। মূকাভিনয় জানেন না তিনি, কিন্তু ছাত্রদের আবদার রক্ষা করতে হবে। সে অনুষ্ঠানে যতীনদার লেখা একটা নাটক আছে, যার নায়ক শক্তি। পণ্ডিতের অনুরোধে আমি ধারাভাষ্য বলে যাচ্ছি, মঞ্চে পণ্ডিত যেমন খুশি হাত-পা নেড়ে যাচ্ছেন। মিনিট পনেরো কাটল। উইংসের পাশ থেকে শক্তি আমাকে মূকাভিনয় শেষ করার ইঙ্গিত করছে। আমিও সে দিকে এগোতে যেতে মঞ্চ থেকে পণ্ডিত প্রবল বেগে হাত নেড়ে শেষ না করার বার্তা দিলেন। তা দেখে শক্তি স্থানকাল ভুলে বলে উঠল, অ্যাই পণ্ডিতের বাচ্চা, বন্ধ কর, বন্ধ কর। মাইক্রোফোন খোলা ছিল। শক্তির কথা শুনতে পেল দর্শক।  তারা ভাবল এটাও মূকাভিনয়ের  অঙ্গ। হাসির হল্লা উঠল বাইরে।

দেখতে পাচ্ছিলাম  আস্তে আস্তে নাম হচ্ছে শক্তির। প্লে ব্যাক করছে, নানা অনুষ্ঠানে গান গাইছে পেশাদার শিল্পীর মত। একদিন আমার ছাত্রস্থানীয় অমরনাথ করণ বলল শক্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে। অমর ভালো  তবলা বাজায়। শিখেছে রাধাকান্ত নন্দীর কাছে। শক্তির তবলচি তার শ্যালক বাবলা। কিন্তু সব দিন সে যেতে পারে না। তাই আমার কথায় শক্তি অমরনাথকে তবলচি হিসেবে গ্রহণ করল। তবলা বাজিয়ে কিছু রোজগারও করেছে  অমর। তারপরে সে একটা স্কুলে চাকরি পেয়ে যায়।

একদিন শক্তি বলল সে সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছে। সম্ভবত তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’তে শক্তি প্রথম অভিনয় করে তাপস পালের বন্ধু হিসেবে। তারপরে আরও অভিনয় সে করেছে। তাকে একদিন বলেছিলাম, এটা তোর সঠিক সিদ্ধান্ত নয়, নায়ক হবার চেহেরা তোর নেই, ভাঁড়ামির অভিনয়ে তোর গায়ক সত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আমার কথা শোনে নি শক্তি। শোনার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তখন তার নাম ও টাকা দুটোই হচ্ছিল প্রচুর। বহু স্তাবক জুটেছিল। নিয়মিত স্কুলে আসতে পারত না সে। স্কুল কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে সম্পাদক তার উপর চটছিলেন। তাঁরাই তাকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করলেন।  স্কুল থেকে চলে গেল সে। তারপরে লোকমুখে শুনতাম তার কথা। বুঝতে পারছিলাম আমার রসিক, প্রাণচঞ্চল বন্ধুটি ধীরে ধীরে কর্মাশিয়াল হবে যাচ্ছে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>