সকাল সাড়ে ১০টা আন্দাজ; কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। শান্তিনিকেতনের বাড়িতে আমি তখন কাগজ-কলম খুলে বসেছি, দোতলার ঘরে। কেউ দেখা করতে এলে একতলা থেকে ডাকে কিংবা খবর পাঠায়। এই ডাক দ্বিতীয়বার শুনেই চিনতে পেরেছি- শক্তির কণ্ঠস্বর, সে সরাসরি ওপরে উঠে আসছে। ঘরে ঢুকে শক্তি বলল, এ কী! আজই লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছ?
কলম বন্ধ করতে করতে আমি বললাম, কী করি বলো, যাবজ্জীবন দণ্ডিত আসামির মতন অবস্থা যে!
শুক্রবার ছিল দোল-উৎসব; শনিবারেও অনেক অতিথি ও বন্ধুসমাগম ছিল; লেখাপড়া করার সময় পাইনি। কিন্তু আমার ধারাবাহিক উপন্যাসের কিস্তি লেখার চাপ, নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে একটি পরিচ্ছেদ জমা দিতে হবেই। সুতরাং যদিও রবিবার আমার না-লেখার দিন, তবু জোর করেই নিজেকে বসাতে হয়েছিল লেখার টেবিলে।
শক্তি এসে পড়লে আর লেখালেখির কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
শক্তি বলল, চলো চলো, উঠে পড়ো, আজ তোমার এখানে কেউ নেই দেখছি। নিরিবিলিতে পাওয়া গেছে, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, কাজের কথা।
আমাদের এখানে সপুত্র মুনমুন-সৌমিত্র মিত্র অতিথি ছিল, তারা কলকাতায় ফিরে গেছে গতকাল। প্রতিবেশী গীতা-পার্থসারথি চৌধুরীরাও চলে গেছে ভোরবেলা। বসন্ত উৎসবে যোগ দিতে যারা এসেছিল, তারা অনেকেই ফিরেছে। আজ সকালে আমার বাড়িতে কেউ আসেনি, কারও আসার কথাও নয়।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শক্তি বলল, কাল সন্ধেবেলা বাড়ি ছিলে? কাল খুব তোমার এখানে আসার ইচ্ছে ছিল, শর্বরীর বাড়িতে একটা গানের অনুষ্ঠান ছিল। সেখান থেকে টুক করে চলে আসব ভেবেছিলাম, কিন্তু গান অনেকক্ষণ চলল। এত দেরি হয়ে গেল, মীনাক্ষী আসতে চাইল না। আজ ভোরবেলা মীনাক্ষী ফিরে গেল কলকাতায়। তারপর দু-চারটে ছেলেমেয়ে এসেছিল কথা বলতে। এক সময় ওদের থামিয়ে আমি একটা সাইকেল রিকশা নিয়ে-
একতলার বারান্দাটাই আড্ডার পক্ষে প্রশস্ত। কিছু সবুজ গাছগাছালি দেখা যায়। ডানপাশটায় দিগন্ত পর্যন্ত উন্মুক্ত, একটা ছোট পুকুরে হাঁসেরা প্যাঁক প্যাঁক করছে। শীত চলে গেলেও হু-হু বাতাসে তেমন আঁচ নেই। পাশাপাশি দুটি বেতের চেয়ারে বসা গেল। শক্তি একটা নস্যি রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছে, আমার গায়ে শুধু গেঞ্জি।
শক্তি বেশ উৎফুল্লভাবে বলল, এত নিরিবিলিতে তোমাকে আর স্বাতীকে পাব ভাবিইনি। এ রকম তো পাওয়াই যায় না।
এই ক’দিনে শক্তির সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে, ইন্দ্রনাথের বইয়ের দোকানে, রাস্তায়, দোলের উৎসবে; কিন্তু ঠিক আড্ডা হয়নি। এর মধ্যে এক রাতে যোগেন চৌধুরী ও অন্য রাতে সুবোধ রায়ের বাড়িতে গান ও কবিতা পাঠের আসর জমেছিল। সেসব জায়গাতেও আমরা কাছাকাছি বসেছি বটে, কিন্তু ওসবের মধ্যে তো আড্ডা চলে না। তা ছাড়া ওই দু’রাতেই শক্তি মীনাক্ষীর সঙ্গে তাড়াতাড়ি গেস্ট হাউসে ফিরে গিয়েছিল।
শক্তি চেঁচিয়ে ডাকল- স্বাতী, ও স্বাতী, এখানে এসে বসো-
স্বাতী এসে বলল, চা খাবেন?
শক্তি বলল, না, না। চা-টা নয়, সকালের সব চায়ের কোটা শেষ করে ফেলেছি। স্বাতী বলল, অন্য কিছু কিন্তু দেওয়া হবে না। মীনাক্ষী চলে গেছে, এখন আমি আপনাকে শাসন করব।
শক্তি বলল, আরে না না; তুমি বসো না! আজ কাজের কথা বলতে এসেছি। সিরিয়াস কথা।
স্বাতী হেসে ফেলল। শক্তির মুখে কাজের কথায় কেউ তেমন গুরুত্ব দেয় না। স্বাতী জিজ্ঞেস করল, আপনি তো এখানকার অধ্যাপক। কেমন লাগছে?
শক্তি জোর দিয়ে বলল, ভালো লাগছে; খুবই ভালো লাগছে। ছেলেমেয়েরা এত ভালো। আমি এখানে বেশ ফুর্তিতে আছি।
আমি বললাম, শুনেছি, তুমি এখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের কবিতা লেখা শেখাচ্ছ। আরও কিছু পড়াতে হচ্ছে নাকি?
শক্তি বলল, ধেৎ! আবার কী পড়াব? কবিতা পড়া, কবিতা নিয়ে দু’চারটে কথা বলা, এতেই বেশ জমে যায়। তার বেশি কিছু না। আমি কি খুব সিরিয়াস হতে পারি নাকি? হ্যাঁ, সিরিয়াস হচ্ছে শরৎ। সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম ঠিক করে এসেছে, বইপত্তর, রোজ সকালে উঠেই কাজে বসে যায়। জানো স্বাতী, শরৎ আর আমি তো পাশাপাশি ঘরে থাকি, তুমি গিয়ে দেখে এসো, শরতের ঘর কেমন সুন্দর গোছানো। সবকিছু ঠিকঠাক, আর আমার ঘর, এলোমেলা, মীনাক্ষী অনেক চেষ্টা করেও গোছাতে পারেনি, কোথায় যে কী থাকে!
স্বাতী বলল, আমি এখানে আসার দিনই পূর্বপল্লী গেস্ট হাউসে আপনার আর শরৎবাবুর খোঁজ করতে গিয়েছিলাম। দু’জনেই ছিলেন না।
শক্তি বলল, হ্যাঁ শুনেছি, পরে খবর পেয়েছি।
আমার দিকে ফিরে বলল, শরৎ খুব বদলে গেছে!
আমি বললাম, আমরা সবাই তো বদলে গেছি। বদলাইনি?
শক্তি বলল, একটু-আধটু, হ্যাঁ, তা তো হবেই। কিন্তু শরৎ যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। অনেক দূরে সরে গেছে।
আমি বললাম, একেকজন একেকদিকে বদলাবে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
শক্তি বলল, শরৎ আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এক সময় কত আমোদ-আহদ্মাদ হয়েছে, কত জমিয়ে রাখত! ওকে এখনও, মাঝে মাঝে অন্তত, সেইভাবে পেতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু শরৎ এখন আড্ডা-হইচইয়ের মধ্যে থাকেই না, এড়িয়ে যায়।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, তুমি কী কাজের কথা বলবে, বলছিলে?
শক্তি বলল, আরে স্বাতীটা আবার হুট করে কোথায় উঠে চলে গেল? ও মেয়েটা এমন ছটফটে, কোথাও সুস্থির হয়ে বসতে পারে না। স্বাতী শুনবে না?
আমি বললাম, স্বাতী পরে শুনবে।
শক্তি বলল, আমি ক’দিন ধরেই ভাবছি, ‘কৃত্তিবাস’ আবার বার করলে কেমন হয়? বেশ বড় করে, দামামা-জয়ঢাক বাজিয়ে যদি কৃত্তিবাস আবার বেরোয়? শুধু কবিতার কাগজ। তুমি মাঝখানে যে পাঁচমিশেলি মাসিক কৃত্তিবাস করেছিলে, সে রকম না, আগেকার মতন। তুমি আর আমি দু’জনে সম্পাদক, আমি সব ব্যবস্থা করব।
আমি বললাম, ‘কৃত্তিবাস’ যদি আবার বেরোয়, ভালোই তো হয়। তবে তুমি একা সম্পাদক হও, আমি না, আমার সম্পাদক হবার শখ মিটে গেছে, শক্তি। অনেক বছর তো-
শক্তি বলল, না না, তোমাকেও থাকতে হবে। শক্তি-সুনীল, সুনীল-শক্তি। আমাদের দু’জনের নাম একসঙ্গে থাকলে হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে টানা যাবে। কবিতা নিয়ে আবার একটা উদ্দাম নেত্য শুরু করে দেব।
আমি বললাম, ধেৎ, ওরকম যমজপনার কোনো দরকার নেই। তুমি একাই যথেষ্ট। তুষার কী লিখেছিল, মনে আছে? শক্তি হা-হা করে হেসে উঠল।
অকাল-প্রয়াত কবি তুষার রায়, সরল ও কল্পনা-নিবাসী, ধীমান ও উদাসীন, মৃত্যু-বিলাসী ও রসিকতা-প্রিয় তুষার ছিল আমাদের দু’জনেরই বিশেষ স্নেহভাজন। ছোট্টখাট্টো চেহারা, তুষারকে মনে হতো আমাদের চেয়ে অন্তত বছর দশেকের ছোট। যদিও মৃত্যুর পর জানা গিয়েছিল তুষার ছিল ঠিক আমার সমবয়সী। তুষার মুখে মুখে তাৎক্ষণিক ছড়া বানিয়ে মুগ্ধ করত আমাদের। ময়দানের মুক্ত মেলায় এক পুলিশের প্রতি তুষারের সেই বিখ্যাত উক্তি- পুলিশ, কবিকে দেখে টুপিটা তুই খুলিস।
শক্তি আর আমার কবিতা একসঙ্গে মিলিয়ে যখন ‘যুগলবন্দী’ নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়, তখন তুষার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে বসে ছড়া বানিয়েছিল, সুনীল-শক্তি যুগলবন্দী/পয়সা লোটার নতুন ফন্দি। সে ছড়া শুনে আমরা দু’জনেই হেসেছিলাম খুব। সেই ‘যুগলবন্দী’র জন্য আমরা দু’পাঁচ টাকাও পেয়েছিলাম কিনা সন্দেহ!
শক্তি বলল, ঠিক আছে, তুমি যদি আমার ওপর পুরো ভারটা দিতে চাও-
আমি বললাম, তুমি শরৎকে সঙ্গে নিতে পারো। আমি যখন বিদেশে ছিলাম, তখন শরৎ কিছুদিন ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদনা করেছে, তা ছাড়া প্রায় আগাগোড়াই ‘কৃত্তিবাস’ পরিচালনার ব্যাপারে শরৎ অনেকখানি যুক্ত ছিল, ওর অনেক অভিজ্ঞতা আছে-
সিগারেট ধরাবার জন্য একটুখানি সময় নিয়ে শক্তি বলল, শরৎ বোধ হয় আমার সঙ্গে মিলেমিশে কিছু করতে চাইবে না। বুঝলে না, ঠিক টেম্পারামেন্টের মিল হবে না। শরৎ এমনিতে খুবই ভালো, ও লিখবে, আমি বললে নিশ্চিত সবাই লিখবে, আমি একাই দায়িত্ব নিতে পারব। আমি বিজ্ঞাপন চাইলে কেউ না বলে না! আমি তো বিজ্ঞাপন লাইনের প্রায় সবাইকে চিনি।
শুধু বিজ্ঞাপন লাইন কেন, শক্তির চেনাশোনার পরিধি বিস্ময়কর। আমি সকলের সঙ্গে সহজ খোলামেলাভাবে মিশতে পারি না, ছেলেবেলার লাজুকতা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি, কারও সঙ্গে নতুন পরিচয়ের পর আড়ষ্টতা কাটাতে আমার অনেক সময় লাগে, এটা আমার দোষ, আমি জানি। শক্তি ঠিক এর বিপরীত। পাঁচ-দশ মিনিট আলাপের পরই সে যে কাউকে বলতে পারে, তোর বাড়িতে আজকে আমি ভাত খাব! অল্প সময়ের মধ্যে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার অসাধারণ গুণ আছে ওর চরিত্রে। আর কত লোকের যে নাম মনে রাখতে পারে! আনন্দবাজারে যোগ দেওয়ার পরে বেশ কয়েক বছর আমি সেখানকার কোনো টেলিফোন অপারেটরের নাম জানতাম না। কারণ তাদের কখনও চোখে দেখিনি, শুধু গলার আওয়াজ শুনেছি। আর শক্তি ফোন তুলে নম্বর চাইবার আগে অপারেটরের গলা শুনেই বলত, কে, অমুক? কেমন আছ? তোমার ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়েছে? আর তোমার মেয়ের জন্ডিস হয়েছিল, এখন ভালো আছে? অর্থাৎ অপারেটরের শুধু নাম নয়, তাদের পারিবারিক, এমনকি হাঁড়ির খবর পর্যন্ত শক্তি জানে। সকলের সঙ্গে এমন আপন-আপন ব্যবহারের জন্য শক্তি কবিতার সঙ্গে সম্পর্কহীন বহু মানুষের প্রিয়। এমনকি যাদের বাড়িতে অসময়ে উপস্থিত হয়ে শক্তি অনেক উৎপাত করেছে, তারাও শক্তিকে ভালোবাসত।
আমি বললাম, বিজ্ঞাপন লাইনে, পুলিশ লাইনে, ট্যাক্সি ড্রাইভারদের লাইনে তোমাকে কে না চেনে!
শক্তি বলল, আমার হাজার পাঁচেক টাকা মাসে মাসে অন্তত দরকার। রিটায়ার করেছি, বাড়ির খরচ চলে যাবে। কিন্তু আমার নিজস্ব হাতখরচ, এটা-সেটা চাই। সৌমিত্রদের ‘বিনোদন’ নতুন কাগজ, ওদের কাছে তো টাকা চাইতে পারি না। ‘কৃত্তিবাস’-এর জন্য ভালো বিজ্ঞাপন জোগাড় করে, সব খরচ মিটিয়ে আমার নিজেরটাও চলে যাবে, কী বলো?
আমি বললাম, তা যেতে পারে, অসম্ভব কিছু নয়।
শক্তি বলল, অন্য বন্ধুরা, যারা রিটায়ার করেছে, তারা খবরের কাগজে টুকিটাকি গদ্য লিখে কিছু রোজগার করে। সন্দীপন ব্যাটা আগে লিখতেই চাইত না, এখন প্রায়ই তো ওর লেখা দেখি। আমার গদ্য লিখতে ইচ্ছে করে না।
আমি বললাম, আগে তো অনেক লিখেছ। উপন্যাসও কয়েকটা।
শক্তি বলল, হ্যাঁ লিখেছি। এখন আর একদম ইচ্ছে করে না।
শক্তি আনন্দবাজার ও দেশ পুজো সংখ্যায় উপন্যাস লিখেছে, ‘অবনী বাড়ি আছে’। আর দাঁড়াবার জায়গা। সবসুদ্ধ ওর উপন্যাসের সংখ্যা আট। তার মধ্যে ‘হাই সোসাইটি’ নামে একটা উপন্যাসের বীভৎস মলাট দেখে আমি পড়িনি। ওটা বোধ হয় ওর এক সময়কার চরম অর্থাভাবে কমার্শিয়াল উপন্যাস লেখার ব্যর্থ চেষ্টা। ওর প্রথম উপন্যাস কুয়োতই আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল। অল্প বয়সে পড়ার সেই মুগ্ধতার স্মৃতি আছে। পরে সমালোচকের দৃষ্টি নিয়ে দ্বিতীয়বার পড়া হয়নি। ওই উপন্যাসে শক্তি একেবারে দেশি, গ্রাম্য শব্দ চমৎকার ব্যবহার করেছিল, একটা নতুন গদ্য ভাষা হতে পারত, কিন্তু সেদিকে আর গেল না। মাসিক কৃত্তিবাস প্রকাশের সময় একবার শক্তি নিজেই বলেছিল, শারদীয় সংখ্যায় কবিতার বদলে উপন্যাস লিখবে। আধখানা লেখার পর বলেছিল, আর লিখতে ভালো লাগছে না। সেটা সেই রকম অসমাপ্ত অবস্থাতেই ছাপা হয়েছিল।
আজ রাতে বুলবুলের বাড়িতে চাঁদের আলোয় পিকনিক, সেখানে আমাদের দু’জনেরই নেমন্তন্ন আছে। সমরেশ বসুর বড় মেয়ে বুলবুলকে চিনি প্রায় বাচ্চা বয়স থেকে, বড্ড ভালো গান গায়। বুলবুল আজ তার বাড়িতে ছাত্রছাত্রীদের নাচ-গানের আয়োজন করেছে, সেই সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া।
গাড়িতে উঠে, পূর্বপল্লী ছাড়ার পর শক্তি বলল, বাতাসে একটা ফুলের গন্ধ। পাচ্ছ? কী ফুল বলো তো?
একটা ফুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ঠিক চেনা যাচ্ছে না। এই সময় শিমুল আর পলাশই বেশি ফোটে। গাঢ় লাল রঙের ফুলে গন্ধ থাকে না। একটা বাড়িতে বাতাবি লেবু গাছে ফুল ফুটতে দেখেছি, বেশ মিষ্টি গন্ধ। বললাম, বাতাবি ফুল?
শক্তি ঘাড় নেড়ে বলল, নাঃ নাঃ। মহুয়া ফুলের মতন মনে হচ্ছে।
আমি বললাম, শান্তিনিকেতনে মহুয়া ফুল কোথায় পাবে? এখানে আমি মহুয়া গাছ দেখিনি। অন্য কোনো ফুল হবে।
শক্তি বলল, ক’দিন আগে রামপুরহাট গিয়েছিলাম, বুঝলে! গাড়িতে করে ফেরার সময় রাস্তায় এক জায়গায় মহুয়া ফুলের গন্ধ পেতেই আমি চেঁচিয়ে অর্ডার দিলাম, থামো, থামো, এখানে থামো। ঠিক মহুয়া ফুলের গাছ আছে; কাছেই একটা মহুয়ার দোকান। ফার্স্ট ক্লাস মহুয়া খেলাম। তুমি কতদিন মহুয়া খাওনি?
আমি বললাম, তা অনেক দিন খাইনি বটে। অন্তত বছর পাঁচেক তো হবেই। শেষবার সেই ঝাড়গ্রামে।
শক্তি বলল, মনে আছে, হেসাডিতে, ও, মহুয়ার শ্রাদ্ধ করেছি-
কিছুক্ষণ চলল হেসাডির গল্প ও সন্দীপনের নানান বীরত্ব কাহিনী।
বুলবুলের বাড়ির কাছে গাড়ি থেকে নামবার পর ড্রাইভারটি বিনীতভাবে বললেন, স্যার, উনি ঠিকই বলেছেন, গাড়ির মধ্যে কিছু মহুয়ার ফুল রেখেছি। উনি সেই গন্ধ পেয়েছেন।
আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম, শান্তিনিকেতনে মহুয়া গাছ আছে নাকি?
ড্রাইভার বললেন, হ্যাঁ, আছে কয়েকটা।
শক্তি সগর্বে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলে, দেখলে, আমার ভুল হয় না। তুমি কি গন্ধ চেনো না? কোথায় বাতাবির ফুল, কোথায় মহুয়া!
বুলবুলের বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল, তখনও কিছু শুরু হয়নি, উদ্যোগ-আয়োজন কিছু বাকি আছে। বুলবুল বলল, আপনারা বরং বুলাদার বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ বসুন। আমি ডেকে পাঠাব।
গাড়িটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে; হেঁটে যেতে হবে। অবশ্য বুলাদার বাড়ি বেশি দূর নয়; একটি ছেলেকে পথপ্রদর্শক হিসেবে সঙ্গে নেওয়া হলো।
একটুখানি গিয়েই শক্তি বলল, ধোৎ! আজকাল আর হাঁটতে একদম ভালো লাগে না।
দোতলার ওপর অপেক্ষা করছিলেন বুলাদা আর মন্টুদা। এই দু’জনকেই ডাকনামে সবাই চেনে। পোশাকি নাম অনেকে জানেই না। বুলাদার গায়ের রঙ ফরসা, মাথার চুল সাদা। দেখলে মনে হয় টুকটুকে পাকা ফলের মতন বুড়ো। আসলে অত্যন্ত তারুণ্যময় মানুষ। আর মন্টুদার বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও শান্তিনিকেতনের সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ। দু’জনেই ভালো গান গাইতে পারেন; যে কোনো আড্ডার আসর জমিয়ে দেন।
দোতলায় উঠে এসে শক্তি বলল, এইটুকু হেঁটেই হাঁপিয়ে গেলাম কেন? বুকে যেন চাপ লাগছে।
বুলাদা বললেন, গ্যাস হয়েছে নাকি? এন্টাসিড খাবে?
শক্তি বলল, না, আমার ওসব কিছু হয় না। হার্ট-ফার্ট সব ভালো আছে। এখন ঠিক হয়ে গেছি।
বুলাদা তবু কয়েকটা অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট এনে দিলেন, শক্তি খেল না। পকেটে রেখে দিল।
বুলাদা এবং মন্টুদা দু’জনেই শক্তিকে খুব ভালোবাসেন। মন্টুদা বললেন, শক্তি একটা টিভি টিম তোমাকে নিয়ে শুটিং করবে নাকি, শুনলুম। তুমি শান্তিনিকেতনে যতদিন থাকবে, আমাকে তোমার লোকাল গার্জেন করে দাও। টাকা-পয়সার ব্যাপার-স্যাপার সব আমি সামলাব। তুমি তো আপনভোলা, ওসব পারবে না।
বুলাদা বললেন, আমি হবো মন্টুর অ্যাসিস্ট্যান্ট-
শক্তি খুব হাসতে লাগল। একটু পরে বারান্দার সেই আড্ডায় এসে যোগ দিলেন বুলাদার স্ত্রী এবং স্বাতী। মাঝে মাঝে গান ও হাস্য-পরিহাস। বুলবুলের দূত এসে বারবার তাড়া দিচ্ছে, তবু আমাদের আড্ডা ভাঙে না।
বুলবুলের বাড়িতে যখন ফিরে এলাম, তখন ছাত্রছাত্রীদের নাচগানের অনুষ্ঠান শেষ পর্যায়ে। সামনে শতরঞ্চি পাতা, পেছনে আমাদের জন্য চেয়ার দেওয়া হয়েছে। আকাশে বসন্তের চাঁদ ঠিকঠাক আলো দিচ্ছে। এই সময়কার বাতাস বড় মধুময়।
শক্তি চেয়ারে বসল না। ও নাচ-টাচ বিশেষ পছন্দ করে না কোনোদিনই। ওর নেশা রবীন্দ্রসঙ্গীতে। সুকণ্ঠের রবীন্দ্রসঙ্গীত ও মন্ত্রমুগ্ধের মতন শোনে। বাঙালিদের নাচে আমারও অবশ্য আগ্রহ নেই, এবং ইদানীং বহুশ্রুত রবীন্দ্রসঙ্গীতেও আর রস পাই না। যেসব গান খুব কম গাওয়া হয় কিংবা রাগনির্ভর, বরং সেগুলো ভালো লাগে। তবে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যা-ই করুক, তাদের মুখে যে তীব্রতা ফুটে ওঠে, সেটা দেখে মুগ্ধ হই।
একটি অচেনা যুবকের সঙ্গে শক্তি কথা বলে চলেছে, এক সময় ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে? শক্তি বলল, এই ছেলেটি ডাক্তার। দারুণ ছেলে, ওর সঙ্গে আলোচনা করছি, ভাবছি এখানে থাকতে থাকতে। একবার সব চেক-আপ করিয়ে নেব। এখানে তো অনেক সময় পাওয়া যাবে। বুলবুল কখন গাইবে?
বুলবুলের একটা বড় গুণ, আজ গাইতে পারব না, গলা ভালো নেই- এ ধরনের কথা কখনও বলে না। আমরা অনুরোধ করলেই গায়। আরও গান হলো, তারপর খোলা আকাশের নিচে পাত পেড়ে খেতে বসা হলো। এক-একদিন শক্তি রাত্তিরের দিকে কিছু খেতে চায় না; এক-একদিন বেশ চেটেপুটে খায়। আজ ছাত্রছাত্রীদের রান্নায় বেশ ভালো স্বাদ হয়েছে। শক্তি বেশ মন দিয়ে খেল সব পদ।।
রাত হয়েছে বেশ, ছেলেমেয়েরা বিদায় নিচ্ছে দ্রুত।
বুলাদার বাড়ি কাছেই, মন্টুদার সাইকেল আছে। স্বাতী একটি চেনা রিকশাওয়ালাকে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, আমরা সেটাতেই ফিরব। শক্তি যাবে কী করে? এখান থেকে পূর্বপল্লী যথেষ্ট দূর। এ সময় রিকশা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ঠিক হলো যে, আমাদের রিকশা শক্তিকে পৌঁছে দিয়ে আসবে, ততক্ষণ আমরা এখানে অপেক্ষা করব।
এই সময় একজন ভদ্রমহিলা, এখানকার কোনো ছাত্রীর মা, আমাকে এসে বললেন, আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে, আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি।
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, বাঃ, এ তো খুব ভালো প্রস্তাব। আমাদের পৌঁছে দিতে হবে না, আমাদের সঙ্গে রিকশা আছে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে পূর্বপল্লীতে নামিয়ে দেবেন একটু?
তিনি বললেন, নিশ্চয়ই। আমরা ওইদিকেই যাব।
শক্তি আমার দিকে ফিরে বলল, আজ দেখা যাচ্ছে আমার গাড়ির ভাগ্য খুব ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি আর স্বাতী কাল সকালেই ফিরে যাবে?
আমি বললাম, ফিরতেই হবে, উপায় নেই।
শক্তি বলল, দিন সাতেক বাদে আমিও একবার কলকাতায় যাচ্ছি। তখন কৃত্তিবাসের ব্যাপারটা একেবারে পাকাপাকি করে ফেলতে হবে। সময় নষ্ট করে লাভ নেই, এই পঁচিশে বৈশাখ থেকেই। সুনীল, দেখো, আমি এমন কাগজ করব যে, আবার একটা তুলকালাম শুরু হয়ে যাবে।
মারুতি ভ্যানে উঠে শক্তি জানলা দিয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়ল।
শক্তির সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।
এর পর চতুর্থ দিন সকাল ছ’টার একটু পরে, তখনও আমার ঘুম ভাঙেনি, স্বাতীই টেলিফোনের শব্দে জেগে উঠে দুঃসংবাদটি আগে শোনে। স্বাতীর অবিশ্বাস ও প্রায় দমবন্ধ করা গলার আওয়াজ শুনে আমি ধড়মড় করে উঠে বসি।
আমার ধারণা, আমি কঠিন ধরনের মানুষ। সব রকম অবস্থার সম্মুখীন হয়ে সবকিছু সহ্য করতে পারি। কিন্তু শক্তি আর নেই- শুনেই আমার মাথাটা ঘুরতে থাকে। হয় তো একটুক্ষণের জন্য আমার চেতনা লোপ পেয়েছিল।
সে যাই হোক। অনেক দিন পর ওই উনিশে মার্চ শক্তির সঙ্গে আমি প্রায় সারাদিন কাটিয়েছি। সেই স্মৃতিটাই আমি হুবহু রেখে দিতে চাই।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘আমার জীবনানন্দ আবিস্কার ও অন্যান্য’ গ্রন্থ [১৯৯৯] থেকে
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪, ২১ ভাদ্র, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ – ২৩ অক্টোবর ২০১২ বিংশ শতকের শেষার্ধের এক জন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিস্টোব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপক ভাবে পরিচিত ছিলেন। এই সাহিত্যিক একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক। তাঁর কবিতার বহু পংক্তি সাধারণ মানুষের মুখস্থ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “নীললোহিত”, “সনাতন পাঠক” ও “নীল উপাধ্যায়” ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টোব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ এবং ১৯৬৬ খ্রিস্টোব্দে প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে তিনি “কাকাবাবু-সন্তু” নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
নীললোহিত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। নীললোহিতের মাধ্যমে সুনীল নিজের একটি পৃথক সত্বা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। নীললোহিতের সব কাহিনিতেই নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই কাহিনিটি বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে। সব কাহিনিতেই নীললোহিতের বয়স সাতাশ। সাতাশের বেশি তাঁর বয়স বাড়ে না। বিভিন্ন কাহিনিতে দেখা যায় নীললোহিত চিরবেকার। চাকরিতে ঢুকলেও সে বেশি দিন টেঁকে না। তাঁর বাড়িতে মা এবং দাদা বৌদি রয়েছেন। নীললোহিতের বহু কাহিনিতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায়। যেখানে বহু শিক্ষিত সফল মানুষ কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিষ্পৃহ একাকী জীবন যাপন করেন।
২০০২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ২৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ৪ এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করে যান। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে তাঁর দেহ দাহ করা হয়।