শামসুর রাহমান সময়ের পরিক্রমায় বাংলা কবিতার পরিসরে তৈরি করে নিয়েছেন একটি নিজস্ব ভাষাভঙ্গি। জীবন ও মানুষকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন নিবিড়ভাবে। কবিতাচর্চার প্রথম দিকে প্রেম, প্রকৃতি ও মৃত্যুবোধ দ্বারা প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে সংগ্রহ করেছেন কবিতার উপাদান। ক্রমান্বয়ে তার কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে বৈরীসমাজ, ব্যর্থপ্রেম, জড়বাদে অনুরাগ, মৃত্যুর পটভূমিতে জীবনের নশ্বরতা, নৈঃসঙ্গ্যস্পৃহা এবং শূন্যতাবোধ। ভাষা-আন্দোলন এবং পাকিস্তানি সামরিক শাসন তাঁর কাব্যযাত্রার প্রারম্ভকালকে প্রভাবিত করেছিল। সঙ্গে ছিল জীবনানন্দের প্রকৃতিলগ্নতা ও জীবন-উপলব্ধির প্রেরণা আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘নির্বাক নীল নির্মম মহাকাশ’। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মা-মাটি-মানুষ তার কবিতার মূল সুর হয়ে ওঠে।
যিশু রুটিকে মনে করতেন তার চেতনার, উচ্চারণের প্রতীক। শামসুর রাহমানের কবিতায়ও যেন আমরা পাই তেমন স্বাদ। আর তিনি তার প্রথম কবিতার বই প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, (প্রকাশকাল : ১৯৬০)-এর নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘রুপালি স্নান’। সে অভিপ্রায় প্রকাশের অল্পকাল পরে অবশ্য বলেছিলেন বইটির নাম হবে ‘রুটি ও গোলাপ’। ‘রুটি’ শব্দটি সে সময় শামসুর রাহমানের চেতনায় গভীর রেখাপাত করেছিল। তার সে উপলব্ধির গাঢ়তার প্রকাশ দেখি ‘রুপালি স্নান’ কবিতায় : ‘শুধু দু’টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ/ অথবা প্রখর ধু-ধু পিপাসার আঁজলা ভরানো পানীয়ের খোঁজ/ শান্ত সোনালি আল্পনাময় অপরাহ্নের কাছে এসে রোজ/ চাইনিতো আমি। দৈনন্দিন পৃথিবীর কাছে চাইনি শুধুই/ শুকনো রুটির টক স্বাদ আর তৃষ্ণার জল।…’
সাম্প্রদায়িকতা-স্বৈরাচারবিরোধী নাগরিক-আন্দোলন গড়ার প্রত্যয় আছে তার কবিতায়। আন্দোলনকারী মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, আনন্দ-বেদনাকে তিনি ঘাতকদের জন্য অভিশাপবাণীতে পরিণত করেছেন। মায়ের সম্ভ্রম, নিজের ভাষার, দেশের বহুদিনের লালিত ঐতিহ্য আর অর্জিত ইতিহাসের আলোকসভায় তিনি তৈরি করতে চান সৃজনশীলতার বাতায়ন। প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে উপলব্ধি করেছেন সে অনুভবের যাতনা। মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি, মৌলিক অধিকার আর সহজভাবে চলতে থাকা জীবনে আছড়ে-পড়া অনাকাক্সিক্ষত অভিঘাত ঘা দিয়েছে কবির হৃদয়ে; ‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বল তবে, কী থাকে আমার?/ উনিশ শো’ বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/ বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।/ সে-ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে/ কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।/ এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষ মাস!/ তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’ (বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা)
শামসুর রাহমানের কবিতায় জাতির আত্ম-জিজ্ঞাসার ভাষা নির্মিতি লাভ করেছে। যোগ্যতা অনুযায়ী মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার। আলোকিত মানবসভ্যতা বিনির্মাণ আর আধুনিকতার প্রলেপে শিল্পচর্চার বিষয়টি লালন করেছেন তিনি। স্বাধীনতার জন্য আকুল অপেক্ষা, প্রজন্মপ্রহর আর অর্থনৈতিক স্থিতি-অস্থিতির কালযাপনের ক্লান্তি শামসুর রাহমান অনুভব করেন ‘শূন্য থালা হাতে’ ‘পথের ধারে’ বসে-থাকা ‘হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী’র উপলব্ধির গাঢ়তায়। কবি বাঙালি জাতির মনন-চেতনকে আঁকছেন এভাবে: ‘তোমার জন্যে,/ সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,/ কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,/ মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,/ গাজী গাজী ব’লে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে/ রুস্তম শেখ, ঢাকার রিক্শাওয়ালা, যার ফুসফুস/ এখন পোকার দখলে/ আর রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো/ সেই তেজী তরুণ যার পদভারে/ একটি নতুন পৃথিবী জন্ম হ’তে চলেছে-/ সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।’ (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা)
প্রকৃতির নির্মলতা-স্বাভাবিকতা, পরিবার ও সমাজের নীতিপ্রীতি-ধর্মযাপন, মায়ের আনন্দ, বোনের খুশী, সাফল্যের পথে বন্ধুর এগিয়ে চলা- সবকিছুর ভেতরে লুকিয়ে থাকে ঝিনুকের মোড়কে থাকা মুক্তার মতো সম্ভাবনা। শামসুর রাহমান মায়ের শুকাতে-দেওয়া শাড়ি আর বোনের মেহেদীরাঙা হাতের আহ্বানে দেখেছেন শান্তিনিবিড় মাতৃভূমির ছবি। বাবার প্রার্থনারত হাতের তালুতে ঝুলতে থাকা থোকা থোকা স্বপ্ন বুনতে চেয়েছেন তিনি স্বাধীন দেশের উর্বর মাটিতে। আর ভেবেছেন- ঘরে ঘরে নির্মিত হচ্ছে অফুরন্ত শান্তির সুবাতাস : ‘স্বাধীনতা তুমি/ গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,/ হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।/ স্বাধীনতা তুমি/ খোকার গায়ে রঙিন কোর্তা,/ খুকীর অমন তুলতুলে গালে/ রৌদ্রের খেলা।’ (স্বাধীনতা তুমি)
নিজের ভাবনাবলয়কে অতিক্রম করার পাশাপাশি প্রচুর কবিতায় কেবল নিজেকেই প্রদক্ষিণ করেছেন শামসুর রাহমান; তবে আত্ম-অনুকরণ ও আত্ম-বিবরণে আগ্রহী এ কবিতা-কারিগর বেশ কিছু অসামান্য কবিতা সৃষ্টি করে আমাদের তৃপ্তি দান করেছেন। প্রায় দুই দশক কবিতায় প্রবল প্রতিবাদ-ঝড়-উন্মাদনা জন্ম দেয়ার পর চলার স্রোতে খানিকটা ধীরতায় নেমেছেন তিনি। বিশেষ করে, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, ইকারুসের আকাশ, মাতাল ঋত্বিক ও উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ পর্বে (প্রথমটি ১৯৭৮, পরের তিনটি কাব্যগ্রন্থ ১৯৮২তে প্রকাশিত) তার এই সৌম্যকান্তি স্বভাব প্রকাশ পায়; যেন তিনি প্রবল বাতাসে বহুকাল নৌকা চালিয়ে মোহনায় কিংবা চরের সামান্য বাধায় বিশ্রাম নিচ্ছেন খানিকটা। তখন, এই আপাত বিশ্রামের কালে কবি মিথ এবং কিংবদন্তি প্রয়োগের দিকে মনোযোগী হলেন। মিথ বা পুরাণের পাশাপাশি তার কবিতার এ পর্বে প্রবেশ করেছে দুঃসময়ে কবির ব্যক্তিগত অস্থিরতা এবং প্রেমনির্ভরতা।
মানুষের মনের অজান্তেই কেমন করে যেন মোহন বাগান কাঁটাবন হয়ে যায়! অতিথিরা কেবল হয়ে পড়ে মৃত অথবা শত্র“! ভাঙা আয়নায় নিজের মুখও পরিষ্কার দেখা যায় না। আস্থা আর নির্ভরতার জায়গা কমছে পৃথিবীজুড়ে। মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের মতো ব্যানারে ব্যানারে, কিংবা পোস্টারে, ফেস্টুনে লেখা কথাগুলো বাতাসে মেলাচ্ছে তাদের করুণ-ব্যর্থ সুর। মিথ্যার ডালিতে ভরে উঠছে পৃথিবী; বেঁচে থাকতেও যেন এক ধরনের ঘৃণা ধরেছে সজাগ মানুষের মনে! কেবল বমি বমি লাগে- ঘেন্নায়। জীবনানন্দের মতো, চারপাশের অশুভ নৃত্যপরতা দেখতে দেখতে, শামসুর রাহমানও গভীর গভীরতর এক অজানা অসুখে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছিলেন। জাতির বিপর্যয়, অনাকাক্সিক্ষত দুঃশাসন, অবরুদ্ধ জীবনের যন্ত্রণা শামসুর রাহমানের বোধ আর দায় গ্রহণের মানসিক শীতল-উর্বর ভূমিতে গড়েছে কবিতাসৃজনের শান্ত পরিসর। তিনি মানুষের কল্যাণ আর সুস্থির অবস্থান ভাবনার কবি; শান্তি আর স্বস্তি নির্মাণের নিবিড় ভাষ্যকার। কবিতাযাত্রায় তার কোনো ক্লান্তি নেই, আছে সুখলাগা-দোললাগা উপলব্ধির আভাস; আর ওই অনুভব কবিতা পাঠকের হৃদয়-দরোজায় পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা-শিহরণ।
সময়ের অস্তিত্বচেতনা প্রকাশে কবি শামসুর রাহমান রোমান্টিক কবিগোষ্ঠীর সারিতে হয়তো বিবেচ্য হবেন। আর শব্দ, ভাষা, চিত্রকল্প ও উপমা-রূপকে তিনি অনেক বেশি আবেগঘন। দীর্ঘসূত্রিতা ও বিবরণধর্মিতার দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে না পড়ে তার কবিতায় প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে ইন্দ্রিয়ঘনত্ব ও প্রকরণনিষ্ঠা। শামসুর রাহমান মূলত স্বাধীনতা ও অবাধ প্রকরণের কবি।