| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

The Great Steppe: কাজাখ তৃণভূমির সুরভি ও কবিতা

আনুমানিক পঠনকাল: 25 মিনিট

ছেলেবেলায় মায়ের কাছ থেকে আমি পেয়েছিলাম ভূগোলের প্রাথমিক জ্ঞানটুকু, যাকে সারাজীবন আঁকড়ে ছিল মা। সর্বক্ষণ তার সাথী ছিল রঙিন মানচিত্রের বই। কোথায় কোন মহাদেশ, মহানদী আর মহাসিন্ধু। কোথায় আছে আধোজাগ্রত আগ্নেয়গিরি, গর্জনশীল চল্লিশা, মরুঝড় আর মেরুপ্রভা। কত রকমের বৃষ্টিবন, ম্যাংগ্রোভ অরণ্য, পত্রমোচীবন। আর কতসব মায়াময় বিস্তীর্ণ প্রান্তর, তৃণভূমি। স্টেপ, প্রেইরি, সাভানা, তাইগা, তুন্দ্রা। বালক বয়সে এইমতো নানান দেশে কল্পনায় ঘুরে বেড়িয়ে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি। যেমন আমাজন নদীর অববাহিকা, অথবা গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, বা মাদাগাস্কার, তেমনই সাইবেরিয়ার বরফে ঢাকা বিস্তীর্ণ তুন্দ্রা অঞ্চল আমার খুব প্রিয় ছিল। আর্কটিক সার্কেলের কাছাকাছি প্রবল হিম পাহাড়ি অঞ্চলগুলো, যেখানে গাছপালা নেই, আছে শুধু অন্ধকারে ঢাকা প্রবল শীতের কাল; আলাস্কা, স্ক্যান্ডিনোভিয়া, কানাডা, আর রাশিয়ার সাইবেরিয়া জুড়ে যে বিস্তীর্ণ তুন্দ্রা অঞ্চল। চারিদিকে ধু-ধু তুষারমরু, তারই মাঝে স্লেজগাড়ি নিয়ে ছুটে চলেছে কয়েকটা বল্গাহরিণ। এখান থেকে কিছুটা নীচে যে তুষারাবৃত অরণ্যভূমি, ভূ-প্রকৃতিতে তাকে বলে ‘তাইগা’। সেখান থেকে অক্ষাংশে আরও কিছুটা নীচে নেমে এলে, মধ্য আমেরিকা আর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে সাভানা অঞ্চল, যেখানে বৃষ্টিপাত কম, যেখানে হাল্কা বনাঞ্চল আর তৃণভূমি এসে মিশে গেছে। আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি এমনই এক সাভানা। আর আছে স্টেপ এবং প্রেইরি অঞ্চল, যা মূলতঃ বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, মাঝে মাঝে গুল্মলতা, অল্প কিছু গাছ, আর অজস্র ঘাসফুল। উত্তর আমেরিকায় এরই নাম- দা গ্রেট আমেরিকান প্রেইরি, আর মধ্য এশিয়ায় একেই বলে-দা গ্রেট স্টেপ (Steppe)। নীচে ছবিতে, সবুজ রঙে।



ইউরেশিয়ার ‘দা গ্রেট স্টেপ’ ছড়িয়ে আছে দৈর্ঘ্যে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার ; পূর্ব ইউরোপের ইউক্রেন থেকে শুরু করে কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও রাশিয়ার যে বিশাল তৃণভূমি। সাবেক রাশিয়া থেকে ভেঙে বেরিয়ে এসে, এখন এদের অনেকেই স্বাধীন রাষ্ট্র, পিপলস রিপাবলিক। যেমন কাজাখস্তান, যা স্বাধীন হয়েছে ১৯৯১ সালে। এখানে অনেক আদিবাসী ও এথনিক গ্রুপের বাসভূমি—রাশিয়ান, উজবেক, কাজাখ, তাতার, উইঘুর, জার্মান ও অন্যান্য। এদের মধ্যে আছে অনেক যাযাবর নোমাডিক গোষ্ঠীও। আদিতে তুর্কি ও ইরানী বংশোদ্ভূত,ধর্মেপ্রায় ৭০% ইসলাম, এবং বাকিটা খ্রিশ্চান। প্রধানতঃইসলাম হলেও কাজাখস্তান খুবই খোলামেলা, লিবারাল; মেয়েদের চালচলন, পোশাক বা প্রফেশান, কোথাও কোনওরকম নিষেধাজ্ঞা বা গোঁড়ামি নেই। খুবই মিশুকে, উচ্ছ্বল, বন্ধুবৎসল, শিক্ষিত, আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও উন্নয়নশীল এই দেশ।মৌলবাদ নেই, বোরখা-হিজাব নেই। বরং আছে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবহণ ব্যবস্থা, পানশালা, আনন্দ-হুল্লোড়, আতিথেয়তা।জিনিসপত্রের দাম, বা মধ্যবিত্ত মানুষের প্রাত্যহিক খরচ, আমাদের ভারতবর্ষের মতোই। ভারতীয় এক টাকার সমান ওদের পাঁচ টেঙ্গে (Tenge)। প্রধান সম্পদ পেট্রোলিয়াম তেল, গ্যাস, আকরিক লোহা, কয়লা। আর শহর থেকে কিছু দূরে, পাহাড়ের কোলে যোজন যোজন তৃণভূমি, দা গ্রেট স্টেপ। একসময় এঁরাই ছিলেন জারের শাসনে, এবং পরবর্তীকালে রাশিয়ার কম্যুনিস্ট ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে। এখন সেসব চাপ থেকে মুক্ত। তবে তৈরী হয়েছে এখনকার প্রেসিডেন্সিয়াল শাসনব্যবস্থার নানারকম রাজনৈতিক টানাপড়েন। প্রেসিডেন্টের হাতে  আছে সবকিছু ভাঙ্গা গড়ার অগাধ ক্ষমতা। প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন শ্রী নুরসুলতান নাজারবায়েভ। দেশপ্রেমী, দরদি, উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্রনেতা। পূর্বজ তুর্কি নেতা কামাল আতাতুর্ক-ই ওঁর পথপ্রদর্শক। (কাজী নজরুল তাঁর কবিতায় কামাল আতাতুর্ককে স্মরণ করেছেন। নজরুলের কবিতারও অনুবাদ হয়েছে কাজাখ ভাষায়।) ওঁরা চাইছেন বহির্বিশ্বের কাছে স্বাধীন কাজাখস্তানের কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকলা, সংস্কৃতি- সবই শ্রদ্ধা ও গর্বের সাথে উপস্থিত করতে। দা অরা (Aura) অফ কাজাখস্তান, যেন এক আধ্যাত্মিক নবজন্ম! এই মহৎ আবেগ ও উদ্যোগ আমার ভাল লেগেছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


এই পৃথিবীর সাভানা, প্রেইরি, তাইগা আর তুন্দ্রা অঞ্চলগুলোয় আমার যাওয়া হয়নি। কিন্তু এর নামগুলোই খুব প্রিয়। কখনও টিভিতে, ন্যাটজিও-র অনুষ্ঠানে, তাদের চিনেছি। তবে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা ও কেন্টাকি প্রদেশে, মাইল মাইল গাড়িতে যেতে যেতে দেখেছি বিস্তীর্ণ সমতল তৃণভূমি, মাঝে মাঝে শস্যখেত।

টাটা স্টীলের কর্ম জীবনে আমার সাথে পরিচয় হয়েছিল কয়েকজন উজ্জ্বল তরুণীর। তাদের মধ্যে ছিল অপরাজিতা, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ। আমার টিমে সে কাজ করেছে। পরে যোগ দিয়েছিল সল্টলেকের আইটি সেক্টরে, একটি নামী সংস্থায়। সেখানে প্রজেক্টের কাজে তাকে খুব দেশ-বিদেশ ঘুরতে হত। কখনও কায়রো, অথবা মিউনিখ। কখনও সেলন্ডনে; মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে পিকাসোর কাঁধে হাত রেখে ছবি পাঠিয়েছে আমায়। কিছুদিন পরে দেখি, চিঠি লিখেছে টোকিও থেকে! এইসব পারঙ্গম মেয়েরা আমাকে প্রকৃতই বিস্মিত করেছে। বয়স ২৫-৩০, অথবা ৩৫, প্রায় সকলেই অবিবাহিত। জিন্স, জ্যাকেট, পিঠে ব্যাকপ্যাক, পায়ে স্নিকার্স। ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক, চোখে নিপুণ আই-লাইনার, কিন্তু আই-শ্যাডো কদাপি নয়। একা একা পৃথিবী ঘুরে কাজ করছে। অনেক পরে এরকমই আরও দুজন, যাদের কাছ থেকে আমার আগ্রহ জন্মায় কাজাখস্তান দেশটা নিয়ে। একজন শোভনা, আর একজন প্রেরণা। দুই বোন। প্রেরণাকে আমি ‘প্রেইরি’ বলে ডাকি, সে এখন রয়েছে জোহানেসবার্গে, কোনও আইটি প্রজেক্টের কাজ নিয়ে, ওয়ার্ক ভিসায়। তার খুবই পছন্দের জিনিস হোল পারফিউম। শুধু পছন্দই নয়, এই বিষয়ে সে আমার পরামর্শদাতাও। বড় বোন শোভনা, আমার কাছে ‘সাভানা’ সে। ওদের দুজনেরই ছোটবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতায়। ব্যারনের ভাতের হোটেল, সাধনা ঔষধালয়, শ্যামপুকুর স্ট্রীট, পাঁচমাথার মোড়।

সাভানা রাশিয়ান ভাষায় বলতে লিখতে পারে। ওই ভাষায় আমার দৌড় শুধু ‘দা দা, নীয়ৎ নীয়ৎ’ এবং ‘দসবিদানিয়া’ অব্দি। সাভানার প্রিয় বিষয় কবিতা। প্রায় চার-পাঁচ বছর ধরে সে রয়েছে কাজাখস্তানে। দা ল্যান্ড অফ দা গ্রেট স্টেইপ, সাভানা যেমন বলে। সে-ই আমাকে প্রথম জানিয়েছে ওদেশের কবিতার কথা। এখন যেখানে আছে, সেই শহরের নাম ‘আস্তানা’ (Astana), ওদেশের রাজধানি। এখন নভেম্বরের শুরুতেই সেখানে দিনের তাপমাত্রা ৩-ডিগ্রি, রাতে মাইনাস -২ অব্দি নামছে। আগের রাজধানি ছিল ‘আলমাটি’-শহরে, চীন-সীমান্তের খুবই কাছে। ১৯৯৭ সালে, আলমাটি থেকে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার উত্তরে, আস্তানা শহরে সরিয়ে আনা হয় রাজধানী। গতবছর (২০১৯)তার নতুন নামকরণ হয়েছে-‘নুরসুলতান’, স্বাধীন কাজাখস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্টও মহান রাষ্ট্রনেতা নুরসুলতান নাজারবায়েভ-এর নামানুসারে। প্রশস্ত রাস্তা, হাইরাইজ বিল্ডিংস, ফ্লাই-ওভার, শপিং মল, ফুড প্লাজা, দ্রুতগামী গাড়ি। হ্যান্ডিক্র্যাফটের বড় দোকানগুলোয় আছে ওখানকার এমব্রয়ডারি করা দারুণ সব কার্পেট, চামড়ার কাজ, সুদৃশ্য পটারি, পাথরের ভাস্কর্য। আর শহর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেই, সেই মহান উন্মুক্ত স্টেইপ। মাইল মাইল শান্তিকল্যাণ।পাহাড়ি ঢাল, দোলায়িত তৃণভূমি ও অশ্বারোহী।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


তন্বী সাভানা কত জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, একা একা। কখনও তিন-চার দিনের ছুটিতে, শহর ছেড়ে দূরে কোনও গ্রামে, কাজাখ পরিবারে হোম-স্টে। দীর্ঘ শীতের রাত, তারায় ভরা আকাশ, শিশিরের শব্দ, এলোমেলো হাওয়া। সকালের প্রথম রোদে তৃণভুমির খুব মৃদু যৌনগন্ধ, ফুল ফোটার দিন। আমাকে সে লিখেছে কাজাখস্তানের প্রকৃতি আর পশুপ্রাণীর কথা। নেকড়ে, বাদামি ভালুক, দুই-কুঁজের ‘ব্যাকট্রিয়ান’ উট, পাহাড়ি ছাগল, অ্যান্টিলোপ, গেজেল, লাল হরিণ, সিল, সি-উলফ, স্টেপ পোলক্যাট। কত রকমের বেড়াল, বন্য কুকুর। আর ঘোড়া– কালো, পিঙ্গল, বাদামি। তৃণপ্রান্তরে, রুক্ষ লাল মাটিতে, নদী পারাপারে,সততই অশ্বারোহী। ঘোড়ার পিঠে কাজাখ যুবক। ঘোড়াই তার সঙ্গের সাথী, তার প্যাশান। তার মাংস, দুধ, খাদ্যপানীয়।

মনে পড়লো, সেই কবে আশির দশকে, আমি একবার কৌরবের শেষের মলাটে একপাল ঘোড়া চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম- ‘একপাল ঘোড়া চাই। বাদামী, সানট্যান্ড। কালো, পিঙ্গল, আটটা। পেতলের নাল ও স্টিরাপ।’ (কৌরবে আমি তখন একমাত্র অশ্বপ্রেমী। আমার ঠাকুরদা ছিলেন গ্রামের ডাক্তার, নিজস্ব ঘোড়া ছিল, সহিস ছিল)। সেই লেখা সাভানা পড়েছে অনেক পরে, বড় হয়ে, যখন সে প্রেসিডেন্সিতে ইংরিজি অনার্স। আমাকে চিঠিতে লিখেছিল, পুরোটাই নাকি তার মুখস্থ। …‘একটা খামার বাড়ি চাই। উইন্ডমিল। নিজস্ব ভূট্টা খেতের নৈঃশব্দ্য।… চুম্বন, আহাউহুর রাত, গায়ে গায়ে সিটি। শেষরাতে টাওয়ার থেকে নেমে বাঁধন খুলতেই আলগা একপাল জিনো।’-এর আগে জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সাভানা পড়েছিল প্রস্তরযুগের ঘোড়াদের কথা, যারা ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে। 

লোকে বলে, মেয়েরা প্রেমে পড়লে নাকি দেখে বোঝা যায়। আমি বলবো, মোটেই নয়। এটা বরং বেশি বোঝা যায় ছেলেদের বেলায়। তখন তাদের শব্দচয়ন, বাক্যগঠন, বেশ থতমত, উজবুক, অথবা লাউড। আমার মনে পড়ে গেল, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতায় সেই এক টেডি বালকের কথা, যে বালক ‘জামার পিঠে বুক-সাঁতারু বারুদ-নারীর ছবি পোষণ করে’। মেয়েরা সচরাচর তেমন নয়। অবশ্য সাভানার মতো মেয়েরা।প্রেম এলে, তাদের হৃদয়ের গভীরে কোথাও কিছু একটা থিরথির করে কাঁপে। এই কম্পনের কথাই হয়তো ফরাসি কবি য়্যুজিন গিলভিক লিখেছিলেন তাঁর কবিতায়। মেয়েরা এই কাঁপনকে অনুভব করে, আর গোপনও করে। ‘গভীর গোপন’ শব্দবন্ধটা মেয়েদের জন্যেই গঠিত হয়েছিল। -অথবা হয়তো সে নিজেও বোঝে না, ভয় পায়। সাভানার সেই কাঁপনের সামান্য টের পাই আমি। কোনও কাজাখ যুবকের জন্য আজ তার অন্তরে এই কাঁপন উঠছে কিনা জানি না।

হয়তো এই লেখার সাথে মেয়েরাইবেশি রিলেট করতে পারবে। যারা পুরুষ নয়, প্রকৃতি। যারা সাভানার মতো, যাদের ভেতরটা কাঁপে। সাভানার সেই কম্পিত গভীরে আছে, জানি আমি, হাল্কা ওক কাঠের একটা ছোট্ট কৌটো, যার ভেতরে রাখা আছে রূপোলি তবকের মতো ফিনফিনেএকটা পাতা। সেটাই আসলে কাঁপছে, সাভানার হৃদয়ের অনেক গভীরে। সেই ছোট্ট কৌটোকে আবৃত করে আছে তৃণভূমির সবুজ ঘাস, গুল্মলতা, লিলিয়াম লিলির শুকনো পাপড়ি। তার ওপরে ছড়ানো আছে পাখিদের পালক; যে পাখিরা সুরে ডাকে, শিস দেয়। এর ওপরে বিছানো আছে একটা হাল্কা বাসন্তী রঙের মলমল। হেমন্ত রাতে তার ওপরে শিশির জমে, পাতা ঝরে। -দা গ্রেট স্টেইপ!


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সেই তৃণভূমিতে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় কাজাখ যুবক। তার কাঁধের ওপরে একটা শিকারি পাখি। নদী পার হয়ে কতদূরে চলে যায় সে। তাদের পূর্বপুরুষ ছিল শিকারি ও যোদ্ধা। বাতাসে ঘোড়ার খুরের দূরগামী শব্দ। বাদামি চামড়ার ভারী স্টিরাপ। পেতলের নাল। গভীর রাতে স্বপ্নের খামারবাড়ি থেকে সেই শব্দ শুনে, সাভানা ঘুমের ভেতর ডাক পাড়ে—জিইইইইইইই… নোওওওওওওও!

কাজাখ দেশে যেমন মাইল মাইল তৃণভূমি, তেমনই আছে মরুভূমি, বরফে-ঢাকা পাহাড়চূড়া, ক্যাসপিয়ান সাগরের বালুতট। সাইবেরিয়ায় যেমন লেক বৈকাল, তেমনই কাজাখস্তানে আছে একটা বিশাল হ্রদ—লেক বলখাশ (Lake Balkhash)। কত রকমের পাখি আছে কাজাখস্তানে; ঈগল, হোয়াইট-হেডেড ডাক, ফ্লেমিঙ্গো, স্পুনবিল, সাইবেরিয়ান ক্রেন। কত প্রজাতির  হাঁস। আরও অনেক নাম, আমি তাদের চিনি না। ওদেশের জাতীয় প্রাণী হচ্ছে, সোনালী ঈগল। আর আছে পরিযায়ী বাজপাখি। আকারে অনেকটা পায়রার মতোই। তারা প্রতিবছর শীতের শুরুতে, উত্তর ও মধ্য এশিয়া থেকে উড়তে উড়তে চলে যায় ১৫,০০০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ আফ্রিকায়।শীতশেষে আবার ফিরে আসে নিজ বাসভূমে, জন্ম দেবে বলে। কলকাতা থেকে কাজাখাস্তানও অনেকটা পথ, আস্তানার দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার, ডাইরেক্ট ফ্লাইট নেই।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


*

দূর থেকে কোনও দেশকে বুঝতে গেলে,পড়তে হয় সেদেশের কবিতা। জানতে হয় সেইসব কবিদের, যাদের শিকড় আছে দেশের মাটিতে, যারা বিদেশি ভাষায় নয়, মাতৃভাষায় রচনা করেন তাদের সাহিত্য। সাভানা আমায় কাজাখ কবিদের কবিতা যোগাড় করে পাঠায়, ইংরিজি অনুবাদ সেসব। আমি বাংলায় তার কিছু অনুবাদ করছি। আমাকে মুগ্ধ করেছে যেসব কবিতা। রাষ্ট্রপতি শ্রী নাজারবায়েভের উদ্যোগে কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে কাজাখ কবিতার ইংরিজি অনুবাদের যে অ্যান্থোলজি বেরিয়েছে।  আর ইউরোপ থেকে তার বোন প্রেরণা, যাকে আমি প্রেইরি বলে ডাকি, সে আমাকে খবর পাঠায় পারফিউমের। কাজাখস্তানের নিজস্ব সুগন্ধি। কিভাবে নির্মিত হয়েছে সেই সুগন্ধির শরীর, তার আর্কিটেকচার, কী কী নোটস আছে তাতে, কোনটা তার বেশি পছন্দ, এইসব বৃত্তান্ত। প্রেইরিএখন জোহানেসবার্গে। ওখানে বসেই সে জানতে চায় এদেশের হাওয়া-বাতাস আর ঝড়-জলের কথা। কাশফুল ফুটেছে কিনা, পলাশ ফুটেছে কিনা, কোকিল কি ডাকতে শুরু করেছে?


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


গত বছর ‘দুনিয়াদারি’ ও ‘কৌরব’ পত্রিকায় ওয়াইন, পারফিউম ও কবিতার গঠন সম্পর্কিত যে গবেষণাপত্র আমি প্রকাশ করেছিলাম, প্রেইরি সেটা পড়ে একটা পারফিউম পাঠিয়েছিল আমায়, ফরাসি সুগন্ধি, সঙ্গে তার নিজস্ব বিশ্লেষণ। গিফট প্যাকে একটা গোলাপি কার্ডে লেখা ছিল- ‘মনের মাধুরী দিয়ে, আপনাকে’। আমার মনে পড়েছিল ‘সেন্ট অফ এ উওম্যান’ ছবিটার নাম। এখন আমি কাজাখ কবিতার অনুবাদ করছি শুনে, প্রেইরি এবার সেদেশের পারফিউমের সাথেও আমায় পরিচিত করিয়ে চলেছে। দা অরা অফ কাজাখস্তান। কাজাখস্তানের নিজস্ব সুরভি।

তো, এই আমার সাভানা আর প্রেইরি। দুই তরুণী বন্ধু, আমার অর্ধেক বয়স তাদের। একজন কবিতা, আর একজন সুগন্ধি। একঝাঁক পরিযায়ী বাজপাখি- তারা কাজাখস্তান থেকে সাভানার পাঠানো কবিতা নিয়ে আসে আমার কাছে, কলকাতায়। তারপর উড়তে উড়তে চলে যায় সুগন্ধির খবর আনতে প্রেইরির কাছে, আফ্রিকায়, সুদূর জোহানেসবার্গে। এরা পরিযায়ী পাখি। প্রতি বছর প্রায় ১৫,০০০ কিলোমিটার উড়তে উড়তে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যায়, আবার শীতের শেষে অতটা পথ ফিরে আসে। এরা ‘আমুর (Amur) বাজ’। মাঝপথে আমাদের অরুণাচল, বা মেঘালয়েও নাকি এরা থামে। আগামী বছর বেড়াতে গিয়ে পরিযায়ীআমুরের ছবি তুলে আনবে বলেছে আমার এক পাখি বিশারদ বন্ধু, ডাক্তার হৃষীকেশ। 

*

কাজাখ কবিদের মধ্য থেকে আমরা বেছে নিয়েছি কয়েকজন প্রবীণ ও তরুণ কবিকে, পুরুষ ও মহিলা। ইংরিজি থেকে যে সব কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছি, সবগুলোই আমার প্রিয়। রাশিয়ান অথবা, কাজাখ ভাষা আমি জানি না। সাভানা রাশিয়ান জানে, কিছুটা কাজাখ ভাষাও শিখছে। তার সাথে প্রথম পর্বে, এগারোজন কবির এইসব কবিতা নির্বাচন। এর ছয়জন পুরুষের মধ্যে আছেন- তুমান্‌বে মোলদাগালিয়েভ, কাদির মির্জা আলি, ওলঝাস সুলেইমেনভ, ইয়েসেঙ্গালি রাউশানভ,আর দুজন তরুণ কবি- আকবেরেন ইয়েলগেজেক ওইয়েরলান জুনিস। পাঁচজন মহিলার মধ্যে আছেন- মারফুগা আইটখোঝা, কুলাশ আখমেতোভা, ফরিজা ওঙ্গারসাইনোভা, টানাকজ টলকিনকিজি, এবং তরুণী কবি নাজিরা বারডালি।

এঁদের সবার কবিতায় যে মূল সুর, যা আমাকে স্পর্শ করেছে, তাতে আছে—পুরুষ ও নারীর প্রেমের বিরহ-মিলনের আর্তি, যা চিরকালের। আছে আদি কাজাখভূমির যাযাবর জীবনের প্রাচীন ইতিহাস ও শোর্য-বীর্যের প্রতি সম্মান। আর সবকিছুকে জড়িয়ে আছে, তাদের ওই দেবভূমি, মহান স্টেপ। প্রকৃতিতেযত রঙ রূপ শব্দ বর্ণ সুগন্ধ মায়া, যাকে কখনও ভোলা যায় না। ওই বিশাল তৃণ-প্রান্তরে কতরকমের ঘাস, গুল্মলতা, কত ফুল ফোটে, কত পাখি গায়।

কাজাখভাষায় টিয়ান-শান শব্দের অর্থ স্বর্গের পাহাড়। এই টিয়ান-শান পাহাড়েআছে অনেক বুনো আপেলের গাছ। এতবড় যে আলমাটি (Almaty) শহর, তার কাছেপিঠেও আছে অনেক। টিয়ান-শানের বুনো আপেলই নাকি বিশ্বের সমস্ত আপেলের পূর্বপুরুষ, এখান থেকেই ছড়িয়েছে সারা পৃথিবীতে। আপেলের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি জানিয়েছেন জিনোম-বিজ্ঞানীরা। তাহলে বাইবেলে কথিত আদম আর ইভ যে আপেল খেয়ে শাপগ্রস্ত হয়েছিলেন, সেকি কাজাখস্তানের এই টিয়ান-শান পাহাড়েরই বন্য আপেল, দারুণ নাকি যার স্বাদ ও গন্ধ?এই তবে সেই স্বর্গীয় উদ্যান! এই নিয়ে ছবিও এঁকেছেন চিত্রকর পিটার পল রুবেন্স—‘দা ফল অফ ম্যান’।

এইসব ফল-ফুলের মিলিত সুরভি ভেসে বেড়ায় প্রান্তরের বাতাসে। আমাকে প্রেইরি জানিয়েছে সেইসব ফুলের নাম। ছবি পাঠিয়েছে কত ফুলের, মশলার আর গাছের। সাইবেরিয়ান ফার, হোয়াইট সিডার, দাভানা, ভেটিভার, পচুলি, গোলাপ, গ্যালবানাম, লিলিয়াম লিলি, আপেল, ওয়ার্মউড, ভায়োলেট, জায়ফল, জাফরান। এছাড়াও নানা প্রজাতির কমলালেবুর ফুল, যেমন নেরোলি, ট্যাঞ্জারিন। -এইসব ফুল-পাতার নির্যাস অথবা, এসেন্সিয়াল অয়েল থেকেই তো তৈরি হয় কাজাখদেশের সুরভি। এর পাশাপাশি আছে তেলের খনির গন্ধ, ভার্নিশ আর ধুনোর গন্ধ, মশলার গন্ধ, ঘোড়ার জিনের পুরোনো চামড়া আর প্রাচীন টিম্বারের গন্ধ। এর সাথে যুক্ত হতে পারে রাম অথবা ওয়াইনের সম্ভ্রান্ত সুবাসও। কাজাখ কবি লিখেছেন, তৃণভূমির এইসব মধুরিমায় তুমি মেতে থাকতে পারো দীর্ঘকাল।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


কাজাখ কবিদের কবিতার অনুবাদ করতে বসে আমার প্রথমেই মনে পড়ছে সেই উক্তি, সম্ভবতঃ রবার্ট ফ্রস্ট বলেছিলেন।  কবিতার সংজ্ঞাই যেন সেটা– “Poetry is what gets lost in translation” অর্থাৎ, কবিতা সেটাই, যা অনুবাদ করলে হারিয়ে যায়। সমস্ত অনুবাদকই এটা অনুভব করেন। তবু আমি সাধ্যমত চেষ্টা করেছি, সবটাকে হারিয়ে যেতে দিইনি। লক্ষ্য করেছি, কাজাখ কবিদের অনেকেই তরুণ বয়সে ওদেশের বসন্ত ঋতু নিয়ে কবিতা লিখেছেন। বসন্তঋতুর নামে কাব্যগ্রন্থও আছে অনেকের। ওঁদের লিপি বা স্ক্রিপ্ট হচ্ছে সিরিলিক (Cyrillic), যা ব্যবহৃত হয় রাশিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, মঙ্গোলিয়া, সার্বিয়া ও মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশে। তবে কাজাখ সরকারের প্রকল্প অনুযায়ী আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে নাকি ওঁরা সিরিলিক হরফকে ছেড়ে কাজাখভাষার উপযোগী একটি ল্যাটিন লিপি তৈরি করে নেবেন।

তবে এবার পড়া যাক, কবি মোলদাগালিয়েভের একটা কবিতা। সঙ্গে রইল কবি পরিচিতি।

১ কবি তুমান্‌বে মোলদাগালিয়েভ (Tumanbay Moldagaliyev: 1935-2011)

তাঁর পড়াশোনা ছিল শব্দতত্ত্ব বা, ফিলোলজি নিয়ে। অনেক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রথম কবিতার বই ‘স্টুডেন্টস নোটবুক’ বেরিয়েছিল ১৯৫৭ সালে। তার পরে আরও প্রায় চল্লিশটা বই, যার মধ্যে আছেSpring Dawn (1961), Daughter of Alatau (1963), Time is Flying(1966), My Heart Has Taken a Trip (1966),Summer Calls (1970), The Heart IsAlways Lit (1972),Letters, Letters(1974), Farewell, Spring(1971)।

প্রধানতঃ প্রেমের কবিতার জন্যে তিনিবিখ্যাত। কাজাখভাষায় বায়রনের অনুবাদ করেছেন, লিখেছেন অজস্র জনপ্রিয় গান। ১৯৬৮ সালে পেয়েছেন জনগণের কবি (Peoples writer of Kazakhstan)পুরস্কার। আর ১৯৮২ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদয়ে অঙ্কিত লিপি’ বইয়ের জন্য তাঁকে রাষ্ট্রীয় কবির পুরস্কার দেওয়া হয়।

রাত্রি

লতাপাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে যায় জ্যোৎস্না
হাওয়ার শুশ্রূষায় জুড়িয়ে যায় প্রাণ
পেঁজা মেঘের দল ঘুরে বেড়ায় আলাতউ পাহাড়ের চূড়ায়
আর মলয় বাতাস বয় নদীতীর থেকে। 

এইসব মধুরিমায় তুমি মেতে থাকতে পারো দীর্ঘকাল। 
প্রতিদিন গাছে গাছে মর্মরধ্বনি ওঠে বাতাসে 
জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় তৃণভূমি, আর উর্ধাকাশে
ঝলমল করে নক্ষত্ররা। একটি বালিকার কন্ঠস্বর 

কেবলই প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরে। শোকাতুর রাতের
বাহুর আশ্রয়ে পাহাড় চূড়ায় বরফ জমেছে,
আর পাতারা কথা বলছে শান্ত ফিসফিস স্বরে,
যেন ঘুম ভেঙে জেগে না ওঠে কোনও ঘুমন্ত শিশু।

 

এর পরের কবিতা মির্জা আলি সাহেবের। বিষয় সেই মহান তৃণভূমি, দা গ্রেট স্টেপ। এর যা কিছু গোপন ও অপরূপ সম্ভার, তাই তিনি লিখে গেছেন কবিতায়। এই তৃণভূমিই তাঁর ঈশ্বর। কাজাখস্তানকে অনুভব করতে হলে, পড়তেই হবে এই কবিতা।

 

 

২. কবি কাদির মির্জা আলি (Kadyr Myrza Ali : 1935-2011)

কবিতা, রাজনীতি ও প্রকাশনা সংস্থার কাজে জীবন কেটেছে কবি মির্জা আলির। ভাষাতত্ত্ব বা ফিলোলজি নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পেয়েছেন আল-ফারাবি কাজাখ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বড় প্রকাশনা সংস্থা এবং রাইটার্স ইউনিয়নের তিনি ছিলেন প্রধান। এছাড়াও, কাজাখ প্রজাতন্ত্র সরকারের ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সুপ্রিম কাউন্সিলে ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন।  প্রথম কবিতার বই বসন্তঋতুবেরিয়েছিল ১৯৫৯ সালে। তার পরে আরও অনেক কাব্যগ্রন্থ। যার মধ্যে আছে- Spring(1959), The Wise Man(1961),Thoughts as Thick as Forests(1965),Face of the Earth(1966), ThePromised Land, 1976), Fate(2001), Heroes of the Past(2001) ওঁর গদ্যের বই Diamond Cannot Be Ignored(2004)। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন গল্প, নাটক, উপন্যাস। পেয়েছেন যুব পুরস্কার এবং অনেকগুলো রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও। 

তৃণভূমি (The Steppe)

ওগো কাজাখের অপরূপ তৃণভূমি!
তুমি আজ কোথায় নিয়ে চলেছ আমাকে?
এই তৃণপ্রান্তর আর সমাহিত ঈশ্বরের মাঝে
আমি কি কখনও পারি কোনও সীমারেখা টানতে? 

এই যে বিস্তীর্ণ বিপুল সঙ্গীতময় তৃণপ্রান্তর
এই সঙ্গীতের কাছেই আমি বশ্যতা মেনেছি
এর অফুরন্ত রূপ আর নিত্যনতুনের কাছে।
প্রিয় ভাই আমার, কখনও এইসব অবিনশ্বর
শব্দ বাক্য আর সুর ভুলে যেন বিপথে যেও না।

অসীম পরাক্রমী ও বিবশকারী
এই প্রান্তর ঘুমোয় একটা চিতাবাঘের মতো-
অর্ধেক জাগন্ত, এবং সর্বদা সজাগ
যেন অতি ক্ষীণ শব্দগুলোও সে শুনতে পায়। 
প্রান্তরে যে হাওয়া বয়, তা যেন হাওয়ারও অধিক,
এই যে তৃণভূমি, তা শুধুই তৃণ মাত্র নয়।
এরা যেন উভয়েই এক মায়াজাল। 

এই ভূখন্ডের যাকিছু গোপন সম্ভার
তার এক শতাংশের চেয়েও বেশি
জানি বলে হলপ করবে কি কেউ?
যদি করে তবে নির্লজ্জ সে।  

কখনও তোমার দৃষ্টিতে হয়তো
ধরা দিতেও পারে তার কোনও অনন্যতা। 
হয়তো কানে আসবে অস্ফুট কোনও স্বর, 
মায়াবী কোনও ঘ্রাণ ভেসে আসবে নাকে।   

এই তৃণপ্রান্তরে যদি চীৎকার করে কিছু বলার শক্তি ও সাহস আমি পেতাম, তাহলেও খুব চুপিচুপিই বলতাম, আমার গোপন কথাগুলো। 

হে আমার আদিভূমি, কতশতবার
আমি পেয়েছি তোমার বাতাসের সুরভি,
দাম দিয়ে কেনা সবকিছুর চেয়েও যে মিষ্টি সে। 
ওই আকাশ যখন মলমল কাপড়ে নিজেকে সাজায়
উঁচু জায়গায় উঠে তাকে দেখো,
অনুভব করো সেই সুন্দরকে। 

এখানে বসন্ত এসেছে যেন ছবিতে আঁকা,
তার সব রঙ যেন শুকোয়নি এখনও।
সুগন্ধি ঘাসফুল, ওয়ার্মউড, বাতাসেকাঁপছে
কত সুরভিত লতাগুল্ম, যেন সুদূরের মরীচিকা।
আকাশ পাখিরা আনন্দগান গাইছে,
আর বাসা বাঁধছে আমার মাথার ভেতরে। 

 

মির্জা আলির এই ‘তৃণভূমি’-কবিতার অনুবাদ পড়ে প্রেইরি আমাকে ওদেশের সুরভির সাথেও পরিচিত হতে বলে। আমাকে অনেকগুলো সুগন্ধীর ওপর নোটস পাঠিয়ে দেয়। অ্যানাটমি অফ পারফিউমস। আমি চমৎকৃত। কবিতা ও তার সহযোগী পারফিউম, এক অপূর্ব কম্বিনেশান! এভাবে আগে কেউ দেখেছে বলে জানি না। সাভানা আর প্রেইরি দেখেছে।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


 

 

সুরভি-১ :তৃণভূমির সমীরণ’( Wind of the Great Steppe)

এই পারফিউমটি বানিয়েছেন সারা ম্যাক্‌কার্টনি।

কাজাখস্তানের সমস্ত দেশপ্রেমিক নাগরিকের কাছে, অনন্ত তৃণপ্রান্তর জুড়ে বসন্ত প্রকৃতির মিশ্র সুরভিই যেন সূচিত করে জীবনের সকল সুখ ও স্বাধীনতা। ‘উইন্ড অফ দা গ্রেট স্টেইপ’ পারফিউমটি তাই তৈরি হয়েছে নানা ফুলের নির্যাস দিয়ে। দীর্ঘস্থায়ী বেস নোটে আছে লেদার, এবং সিডারের পুরুষালি ম্যাস্কুলিন গন্ধ। তার সাথে মিশেছে ভেটিভার এবং পাচুলির মিষ্টি স্পাইসি গন্ধ। ক্ষণস্থায়ী মিড নোট, বা হার্ট নোটে আছে ভায়োলেট ফুলের গন্ধ। আর ওপরের তাৎক্ষণিক, বা টপ নোটে মিশে আছে কত অবিস্মরণীয় সব ঘ্রাণ- দাভানা, ওয়ার্মউড, ভায়োলেট, জাফরান। এইসব নিয়ে একটা ওয়েল রাউন্ডেড নির্মাণ। হাল্কা পাখায় ভর করে সে ভেসে বেড়াবে, একটা আশ্চর্য দোলা লাগবে মনে। 

Wind of the Great Steppe

Perfumer: Sarah McCartney

Top notes: davana, wormwood, saffron, cumin, mint and herbs
Heart notes: violet and wild flowers
Base notes: leather, white cedar, vetiver, and patchouli

 

সুরভি-২ :টিউলিপ ফুলের দেশ’ (Land of Tulips)

এই পারফিউমটি বানিয়েছেন সেবাশ্চিয়ান মার্টিন।

স্টেপ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে বসন্ত আসে, যেন ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। দিকে দিকে টিউলিপের ফুল ফুটে আছে। টিউলিপ ফুলের মাতৃভূমি বুঝি টিয়ান-শান পর্বতের কোলে এই কাজাখস্তান। দিগন্ত অব্দি বিস্তৃত এক দারুণ কার্পেট যেন কেউ পেতে রেখেছে, তার গায়ে নানা বর্ণের ফুলের কোলাজ। সেইসব ফুলের সুগন্ধে বাতাস ভরে আছে। আর কত রকমের ঘাস। কোথা থেকে ডাক পেয়ে যেন সহসাই জেগে উঠেছে পৃথিবী। ‘ল্যান্ড অফ টিউলিপ্স’ পারফিউমের গভীরে আছে কস্তুরি আর কাঠের গন্ধ। আর ওপরের নোটগুলো প্রধানতঃ সবুজ গুল্মলতা, টিউলিপ, ফ্রিসিয়া, বার্গামট, ইত্যাদি রকমারি ফুলের মনমাতানো নীরব গন্ধ।

Land of Tulips

Perfumer: Sebastien Martin

Top notes: white freesia, bergamot, and cyclamen
Heart notes: tulip and green notes
Base notes: white musk and woody notes

*

কাজাখ কবিদের কবিতায়, আমি লক্ষ্য করছি, ১৯৯১ সালে তাদের স্বাধীনতা পাওয়ার পরে অথবা আগের পঞ্চাশ বছরেও, নেই কোনও উচ্চকিত স্বর, ধর্ম নিয়ে কোনও গোঁড়ামি, অবিবেচনা বা মৌলবাদ, বিপ্লব বা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কোনও আহ্বান। নেই কোনও তীব্র বিষাদ, ভয়, হতাশা, সামাজিক ভাঙন, এলিয়েনেশান, মূল্যবোধের অবক্ষয় জনিত ক্রোধ বা শ্লেষের কোনও বিশেষ উচ্চারণ। কোনোকালে ছিল কিনা জানি না। আজ যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তা আছে ত্বকের সামান্য নীচে, স্মৃতি চিহ্নের মতো। বরং আজকের সংকল নেয়া আছে, তা এক নতুন আলো; পৃথিবী, প্রকৃতি ও সময়ের প্রতি গভীর প্রেম, সহিষ্ণুতা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। সব মিলিয়ে কিছুটা ‘পোস্টহিউম্যান’ দৃষ্টিকোণ, যা আমার পছন্দ। শ্রীমতী মারফুগা তাঁর কবিতায় লিখেছেন, ‘জীবন আর কখনও বিষণ্ণ হবে না’। -সত্যিই?

৩.কবি শ্রীমতী মারফুগা আইটখোঝা (Marfuga Aitkhozha : Born 1936)

কাজাখ কবি মারফুগার জন্ম ১৯৩৬ সালে। সাংবাদিকতায় ১৯৬৫ সালের স্নাতক। পরে সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন মস্কোর ম্যাক্সিম গোর্কি ইন্সটিটিউট অফ লিটারেচার-এ। এর পরে সংবাদপত্রে চাকরি। তিরিশটিরও বেশি তাঁর কবিতার বই। তাঁর অনেক লেখাতেই আছে চীনদেশে ফেলে আসা তাঁর আদি বাসভূমির মন-কেমন-করা স্মৃতি। কয়েকটি বই- Youth (1962), Inscriptions at the Peak (1964), My Swan (1971), The Apple of My Eye (1975),My Sacred Cradle (1978), Shine,My Star (1980), Swan(2001), Blessing of (2005)।

দেশবিদেশের প্রায় চল্লিশটা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর লেখা। বহু দেশ থেকে সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি, আর কাজাখ ভাষায় অনুবাদ করেছেন রাশিয়ান, মঙ্গোলিয়ান, তাতার, কিরঘিজ, হাঙ্গেরিয়ান ও ইউক্রেনের অনেক কবির কবিতা।

 

হাঁসের হৃদয়

এত কষ্ট সহ্য করেছি আমি, তবু এক হাঁসের
হৃদয়ের রঙে রঙীন হয়েছে আমার কবিতা।
এবার যখন প্রভাত হবে 
আর আলোয় ভাসবে পাহাড়চূড়োগুলো
জীবন কখনওআর বিষণ্ণ হবে না।

একটি হাঁসের স্বপ্নও তার অনাবিল হৃদয়
আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে সইতে হয় শোক।
যখন পাহাড়ে পাহাড়ে মে-মাস এসে পড়ে,
আর আলাতউ পাহাড়ের শিখর স্পর্শ করে আকাশকে, 
আমার সকল আবেগ যেন নবজন্ম পায়, 
পুস্পিত হয় আমার নিঃষ্পাপ আশাগুলো!

সমস্ত হ্রদ জুড়ে হাঁসেদের কলধ্বনি ওঠে,
ফুলদল আবেগে বিহ্বল।
উত্তরণের গর্বিত পথে আলোড়িত কতযাত্রী,
ভাগ্যের ফের যাদের হতবাক করেছিল?

জীবনের দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে,
কত স্বপ্ন আবার বাসা বেঁধেছে এই হৃদয়ে।
পাহাড়ের নীল চূড়াগুলো থেকে নেমে আসছে সূর্য,
ভাবনায় রক্তিম, নেমে যাচ্ছে দিগন্তের নীচে।

আবার ভোর হচ্ছে, আর সেই জ্বলন্ত সূর্য
পুনরায় নামছে অস্তাচলে। 
কিন্তু কে-ই বা তার স্বপ্নকে খুঁজে পেয়েছে এখানে?
আমি শুধু চাই আমার কবিতারা 
ওই হাঁসদের মতোই পবিত্র হোক।

 

৪.  কবি ওলঝাস সুলেইমেনভ (Olzhas Suleimenov : Born 1936)

কবি সুলেইমেনভ একজন লেখক, সাহিত্যবিদ, রাজনীতিক, এবং পরমাণুশক্তি বিরোধী। ভূবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার পরে, মস্কোর গোর্কি ইন্সটিটিউট থেকে সাহিত্যের পাঠ নিয়েছেন। রাইটার্স ইউনিয়ন ও প্রাভদা সংবাদপত্রের সম্পাদক, এবং কাজাখফিল্ম স্টুডিয়োর প্রধান। এছাড়াও কিছুকাল (১৯৮১-৮৩) রাষ্ট্রীয় সিনেমাটোগ্রাফি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। রাজনীতির আঙিনায়, ১৯৯১ সালে তাঁর নেতৃত্বে পিপলস কংগ্রেস পার্টি গঠিত হয়। কাজাখ দেশের হয়ে তিনি ইউনেসকো এবং রোমে রাষ্ট্রদূত ছিলেন কিছুকাল (১৯৯৫-২০০১)। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৮ সালের মধ্যে। কয়েকটি বই-Stallions(1961), Earth, Bow Down before Man (1961), Sunlit Nights (1962), Monkey Year(1967), The Clay Book (1969), Language of Writing (1995), The Smile of God (1998)

তাঁর পাওয়া অনেক পুরস্কারের মধ্যে আছে ‘পিপলস রাইটার অফ কাজাখ’ (১৯৯০)এবং ‘হিরো অফ লেবার অফ কাজাখস্তান’ (২০১৬)।

 

শহরতলি

যখন উত্তাপের আয়োজন ছাড়াই
প্রকৃতি সামান্য উষ্ণ 
এবং রাস্তার বাতিগুলো নিজ ভারে নুয়ে পড়েছে, 
অন্ধকারকে মৃদু অমান্য ক’রে
সামান্য একটু আলো
যেন পরম নিষ্ঠায় ফুটিয়ে তুলেছে এশিয়ার রাত।      

রাস্তার বাতিগুলোকে ভাঙচুর করে গেছে খেয়ালি যুবকেরা,
আর তুষারের দিনগুলোকে পিছনে ফেলে রেখে এই মে-মাসে

আমি পথ চলেছি জ্বলন্ত সিগারেটের আলোয়।
জীবনের দাম এখানে এক কানাকড়িও নয়
তুমি যদি নিজে উদ্যোগী না হও। 

এখানে সুগন্ধ ভেসে আসে প্রাচীনকালের,
ঘোড়ার ওপরে বসিয়ে রাখা এক বালিকার কান্না যেন।
পূর্বজদের নিয়ে গর্বিত এক প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে
যেন ধীরে বাজছে ইউক্রেনের স্বাধীনতার গান। 

অন্ধকার নেমেছে। সাদা পোশাকের স্পষ্ট কিছু চলাফেরা,
বেঞ্চিতে বসে একটি ডাইনি যাদু করছে তার পুরুষকে –
একটানে ছিঁড়ে ফেলেছে শার্টের পিছনটা, ফুঁ দিচ্ছে কলারে–
এসো হে পরমাত্মীয়, হাতদুটোকে মেলে ধরো দেখি
শান্ত হাতে স্পর্শ করো ওই বাবলা গাছকে
আর ধীরে ধীরে আমার দিকে হেঁটে এসো। 

তোমার মুখমন্ডল যেন ছায়ায় ভাসছে,
ভাসছে যেন বজ্রবিদ্যুতের একটা গোলক।

আকাশে চাঁদ উঠেছে।
স্তব্ধতার মাঝে মৃদু গুঞ্জন উঠছে জলে।
ঘুমিয়ে আছে কুকুরটা। ঘুমোচ্ছে পাহারাদার তার ভোজালি নিয়ে।
একটা কোদালপড়ে আছে শহরতলির আপেল গাছটার নীচে,
আর সব্জির দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে
বরাবরের জন্য।

 

৫. কবি শ্রীমতী কুলাশ আখমেতোভা (Kulash Akhmetova : Born 1946)

কবি আখমেতোভা প্রথমতঃ চিকিৎসা বিদ্যায় স্নাতক (১৯৬৬)। এর পরে ১৯৭৩ সালে, আল-ফারাবি জাতীয় কাজাখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক হয়ে সংবাদপত্রে চাকরি শুরু। প্রায় কুড়িটা কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা তিনি। My White Flower (1975), You Are My Happiness (1977), Leaves Arethe Hearts of Summer(1979), Kindness (1981), Stars Reflected in a Spring (1982),The Green Riverbank (1984), ইত্যাদি। বহু পুরস্কৃত এই কবি কাজাখ ভাষায় অনুবাদ করেছেন অনেক বিদেশি কবিতা, তার মধ্যে আছে বাঙালি কবি কাজি নজরুল ইসলামের কবিতাও। নারীর মনোজগত, তার জীবনের জটিলতা ও দুর্ভাগ্যকে তিনি কবিতায় স্থান দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন।

মাতৃভাষা

অথবা ওরা যখন জিগ্যেস করে : ‘কতগুলো ভাষা বলতে পারেন আপনি?’

যখন প্রেরণা আসে আমার কাছে
এবং প্রত্যেকটি শব্দ যেন পুড়তে থাকে আগুনে,
সহসা আমি জেনে যাই সব শব্দগুলো, কথা বলি
তাদের ভাষায়, এমনকি পাখিদের সাথে- বরফের সাথেও বলি
দেখি এক লহমায় পেরিয়ে গেল একটা নীলাভ ছায়া।   

প্রিয় আমার, এখন আর তর্কে টেনো না আমাকে-
একটি স্ফুলিঙ্গ ওঠে প্রেরণার, আর ঝড়কে সংযত করি আমি। 
আমি বুঝতে পারি সব রকমের অনুভব-
পেত্রার্ক ক্রমশঃ ঝুঁকছেন লরার প্রতি, 
আর বাগিচায় মর্মর ধ্বনির মাঝে বায়রন।         

আমার কবিতারা জেগে ওঠে ফুলের সাথে,
রাশিয়ার ওক গাছের বিস্তীর্ণ অরণ্যের সুরে সুরে:
আকাশের পাখিদের থেকে শিখে
সুর সৃষ্টি করেন রোসিনি- 
আমি পারি সেই সুরের যাদুকে শব্দে নিয়ে আসতে। 

অনুবাদ করি আমি পৃথিবীর সব ভাষাতেই, 
পারি হৃদয় আর অন্তরাত্মাকে বুঝতে।
আমি আয়ত্ত্ করতে চাই অরণ্যের মর্মরধ্বনি,
ডালপালায় আগুন থেকে যে ধোঁয়া উড়ছে এলোমেলো-
সবই আমার মধ্যে পেয়ে যাবে তার জীবন্ত শব্দমালা।   

আমি ভাষা দেব অরণ্য আর পাহাড়ি উপত্যকাকে। 
শব্দের শক্তি দিয়ে আমি ভাঙতে পারি ধাতু,
রাত্রির মতো, উর্ধাকাশে দূর নক্ষত্রের গভীরের কোরকের মতো,
আমার কাছের কোনও মানুষের হৃদয়কেও বুঝি আমি,
এবং কোনও অপরিচিতের মনের উজ্জ্বলতাকেও।

পবিত্র নদীদের গতিপথ আমি বুঝি,
এবং বনাঞ্চলের আগুনও।
আমার হৃদয় আয়ত্ত করেছে পৃথিবীর সব ভাষাকেই,
কিন্তু আমি পৃথিবীর সাথে কথা বলি- শুধুই কাজাখ ভাষায়।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


*

এইসব কাজাখ কবিতা খুব শান্ত স্বরে ধীরে ধীরে পড়ার মতো, মনে হয়েছে আমার। বাংলা অনুবাদ পড়ে সাভানা বেশ  মুভড। ইংরিজি অনুবাদে নাকি কবিতার এই আমেজ সে ততটা পায়নি। আমি বললাম, যেকোনো মাতৃভাষাতেই এমনটা মনে হতে পারে। তবে কাজাখস্তানের ইতিহাস, ভূগোল ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় অনেকটা সাহায্য করবে পাঠককে। সাভানা এখন ভাঙা ভাঙা কাজাখ ভাষায় কথা বলতে পারে, বোঝেও কিছুটা। ওদেশে ইংরিজি বিশেষ কেউ বোঝে না। প্রধানত কাজাখ এবং রাশিয়ান ভাষাই সর্বত্র চলে। মূল আদিবাসী যাঁরা, তাঁরা প্রাচীন তাতার; তুর্কি ও ইরানিয়ান বংশোদ্ভূত যাযাবর গোষ্ঠী, নোমাডিক। তবে অনেককাল আগের কিছু জার্মানও আছেন এদেশে। ধর্ম প্রধানতঃ ইসলাম, অথবা ক্রিশ্চিয়ান। একা একা কীভাবে সময় কাটে সাভানার? সে খুব ভাবুক মেয়ে, অনুভবী। ‘মেঘের ছায়া ভাসে ঘন নীল জলে’—খুব ছেলেবেলায়, পুতুল খেলার বয়সে, এই লাইনটা পড়লে ওর নাকি খুব মন কেমন করত। কেন যে করত, তা আর বলতে পারে না। যখন নিরালায়, তখন ওর একক সঙ্গীটির নাম সঙ্গীত। শাস্ত্রীয় এবং রবীন্দ্র। সমর্পণের গান, সুফি গান, আবিদা পরভিনের গান, তার ভালো লাগে। তার প্রিয় রবীন্দ্রগান হল- ‘আমার প্রাণের ‘পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো’। এই একটা গান কখনও সে সারাদিন ধরে শোনে, ভোর থেকে সারা সকাল দুপুর পেরিয়ে, রাতেরও গভীরে। কখনও ছুটির দিনে বন্ধুদের ডেকে এনে রান্না করে। কাজাখ দেশের প্রিয় রান্না- চিকেন বা ভেড়ার মাংসের শাশলিক (Shashlik), অথবা ঘোড়ার মাংসের বেশ্‌বারমাক (Beshbarmak)। অনেকটা চর্বি, ব্রথ। মৃদু আঁচে ২-৩ ঘন্টা ধরে রাঁধতে হয়। রাশিয়ানরা বলে ‘বেভারমাক’। এর সাথে চলতে পারে পোর্ট ওয়াইন অথবা ভদকা।

সাভানা পড়েছে ফরিজা ওঙ্গারসাইনোভার কবিতা। তবে এখনও সে আরাল-কারাকুম (Aral-Karakum) মরুভূমি দেখেনি। দেখা হয়নি সেই বিশাল ‘লেক বলখাশ’হ্রদও। এই কাজাখস্তানেই আছে বিখ্যাত রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র ‘বাইকোনুর’ (Baikonur Cosmodrome), যেখান থেকে ১৯৬১ সালে পৃথিবীর প্রথম মহাকাশচারী রাশিয়ার ‘উরি গ্যাগারিন’ ভস্তক-যানে চড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন মহাকাশের কক্ষপথে। ফরিজার এই কবিতায় আছে কারাকুম মরুভূমি। 

৬. শ্রীমতী ফরিজা ওঙ্গারসাইনোভা (Fariza Ongarsynova : 1939-2014)

ফরিজা একজন কবি, প্রাবন্ধিক ও জনপ্রতিনিধি। কিছুদিন গ্রামীণ স্কুলে শিক্ষকতার পরে আঞ্চলিক সংবাদপত্রে সাংবাদিকের কাজ করেন। পরে রাজধানি আলমাটি-তে অনেক বড় পত্রিকা কাজাখস্তান পায়োনীয়ারের প্রধান সম্পাদক হয়েছিলেন। ২০০০ থেকে ২০০৪ সাল অব্দি ছিলেন পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষের সাংসদ। তাঁর বহু আলোচিত বইগুলি :Nightingale (1966), Monologues of Manghystau (1970), Uneasy Time (1972), Proud Generation (1973), My Pigeons (1974), July (1978), Diary of the Heart (1984) and Remedy (1985)। বহু পুরস্কৃত এই কবির কবিতা রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তিনি নিজে কাজাখ ভাষায় অনুবাদ করেছেন পাবলো নেরুদার কবিতা।    

কাগজের মেঘ, যেন আকাশ-মলমলের তুলো 

কাগজের মেঘ, যেন আকাশ-মলমলের তুলো 
ডালপালারাও যেন আকাশে ডানা মেলে উড়ে যেতে প্রস্তুত।
নতুন মদের কাছে বসন্তের ঘাস এক যাদুকরী,
শিশির এবার বিদায় জানাচ্ছে তার গান শুনিয়ে।
সমস্ত উপত্যকাজুড়ে যেন রঙিন ফুলের চাদর বিছানো
কত ফুল আর গুল্মলতার পাড় দিয়ে ঘেরা,
আদরে, চুম্বনে, আশ্লেষে তারা মেতে আছে-
বহুদুর থেকে উড়ে আসছে এক ঝাঁক পাখি
ঘরে ফেরার পথে তাদের কলরব।

পৃথিবীর স্তন বুঝি দুধে ভরে উঠেছে এখন,
আর মাঠের বৃষটির ছোট্ট শিঙের ওপরে
নরম হয়েছে রোদ।

সবাই উদযাপন করছে জীবনকে-
পৃথিবীজুড়ে বিচিত্র ছন্দে বর্ণে:
পথে, পর্বতে, উপত্যকায়, খাঁড়িতে, শাখায়।

এইবসন্তে সবকিছু, সমস্তই, ঢের বেশি চমকপ্রদ 
স্যাক্সল গাছের নীচে নির্জন বালুকা,
যেন ঘুম থেকে উঠে তারা অবশ, অপ্রস্তুত, লজ্জায় রাঙা,
শীতকালের কারাকুম মরুবালুর মতো
তারা কখনোই নয়।     

এবং সহসাই ওই রুক্ষ পাহাড়ের ওপারে 
আর সব চিহ্নদের মাঝে
একটা ডাক ওঠে একফালি তৃণভূমি থেকে  
আর দাপিয়েতোলপাড় করে ওঠেউট,

এভাবেই একদিন পৃথিবীতে জন্মেছিল বেঢপ প্রাণীটা,
ওই পাহাড়টা এক নীলাভ সাদা উট-ই যেন।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


৭. শ্রীমতী টানাকজ টলকিনকিজি (Tanakoz Tolkynkyzy : Born 1977)

শ্রীমতী টানাকজ কবি ও সাংবাদিক। সাহিত্যে স্নাতক, পরে জাতীয় বৃত্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে  স্নাতকোত্তর পড়াশোনা। বর্তমানে কাজাখস্তানের জাতীয় টিভি চ্যানেলে প্রযোজক। মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশ। খুবই আন্তরিকতা ও সাহসের সাথে নারীর মনের কামনা ও আর্তিকে তিনি প্রকাশ করেছেন কবিতায়, যা কাজাখ কবিতার মূলস্রোতে প্রথম। দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কারে সম্মানিত বইগুলি:  We Are from the Mountains (2001), I Miss You (2008), I Want to Say (2010), I Love (2014), ইত্যাদি। স্প্যানিশ ও আজারবাইজানি ভাষায় কাজাখ কবিতার সংকলন তিনি সম্পাদনা করেছেন।

আমরা চাইনা কোনও প্রদীপ অথবা আলো

কোনও প্রদীপ বা আলোর প্রয়োজন নেই আমাদের,
আর তুমি বসে আছো ওখানে,যেমন বরাবর, কত অমায়িক… 
আমার কবিতাগুলো তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি
তুমি তাকিয়ে আছ আমার দিকে, আর পড়তে চাইছ

আমার অন্তরাত্মাকে। আমার কবিতা লক্ষ মানুষের
অন্তরে দোলা দেয়, কিন্তু হায়
তোমার মনকে সে কখনোই স্পর্শ করে না। 

আমি যখন কফি আনতে বলছিলাম, আর যখন পান করছিলাম কফি,
আমার সারা শরীরটা তুমি জরীপ করছিলে, আর সবটাই
পান করে নিচ্ছিলে ভেতরে।  হুঁকোয় কেউ ধুমপান করে তামাক
আর আমি ধূমপান করি আমার শোক। কিন্তু পৃথিবী তো
পালটে যাবে না… তুমি যখন এসেছিলে
পথে পথে তখন কত হাল্কা ফুরফুরে ছিল পোশাক।

আমি চাই শরৎ ঋতু আসুক, আর নগ্ন করুক আমায়।
সেই একই দৃশ্য পুনরায়। রাস্তার বাঁ-হাতে সেই ক্যাফে।
বিদায় জানাও, কিন্তু
কোটটাপরিয়ে দাওদয়া করে।
আমি তো দায়ী নয়, তবু দেখ বসন্ত এসেছে।

এসো একবার ঠোঁট ছোঁয়াই তোমার গালে,
ধরো অসাবধানতাবশত ছুঁয়ে গেছি।

*

জোহানেসবার্গ থেকে প্রেইরি নাকি ফিরে আসবে কলকাতায়। এবার হয়তো কোনও আইটি প্রজেক্টের কাজে তাকে যেতে হবে প্যারিস, বেলজিয়াম কিংবা টোকিও। তার এখন মনে লেগে আছে কাজাখস্তান। খুব ইচ্ছে, একবার দিদির কাছ থেকে  ঘুরে আসে। প্রেইরি না হলে আমি জানতে পারতাম না, সুরভিত কাজাখস্তানের কথা— ‘দা অরা অফ কাজাখস্তান’। হয়তো শুধু কবিতা পড়েই ক্ষান্ত হতাম। তাতে কি আর এমনভাবে অনুভব করা যেত! এবারে সে আমায় পাঠিয়েছে আরও দুটো দারুণ ইউনিসেক্স পারফিউমের খবর। এই ২০২০ সালেই প্রকাশিত, দুটোই যেন সম্পূর্ণ দুটো কবিতা। (ঋণস্বীকারঃ ফ্র্যাগ্রান্টিকা ডট কম / www.fragrantica.com)।

সুরভি-৩: পর্বতের গান (Music of Mountains)

আলাতউ পাহাড়ের নীচে অরণ্য ভূমিতে ভোরের বাতাস ভরে থাকে সাইবেরিয়ান ফার, পিস্টিয়া, এশিয়ান স্প্রুস আর পাইন  গাছের বনজ গন্ধে। উঁচু উঁচু সেইসব গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা দেয় রোদের ঝিলিক। শীত চলে গিয়ে বসন্ত আসছে। প্রান্তর ভরে উঠেছে মরসুমের নতুন ঘাসে। কত গুল্মলতা, বুনো ফুল, মশলা ও মাশরুমের ঘ্রাণ। এসময় পাহাড়ি নদীর দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসে, আর দূরের হিমবাহ থেকে ভেসে আসে কুয়াশা ভেজা নানা ফুলের সতেজ গন্ধ। এইসব নিয়েই সেবাশ্চিয়ান মার্টিন বানিয়েছেন ‘মিউজিক অফ মাউনটেন্স’ নামের সুগন্ধি।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


Music of Mountains 

Perfumer: Sebastian Martin

Top notes: Cinnamon and nutmeg
Heart notes: pine, lavender, and labdanum
Base notes: white cedar, vetiver, sandalwood, and patchouli

সুরভি- : রেশম-পথের কাহিনী(Saga of the Silk Road)

দিগন্তহীন তৃণ প্রান্তর, স্টেইপ। পূর্ব দিক থেকে কতশত বছর ধরে এদিকে এসেছে বণিকেরা। প্রান্তরের ঢাল বেয়ে আঁকাবাঁকা পথে চলেছে তাদের ক্যারাভানের সারি। তারা চলেছে পশ্চিমে। সঙ্গে আছে নানান মশলা, সুগন্ধি আতর, মসৃণ সিল্ক, দামী কাঠ, চীনামাটির পাত্র, স্ফটিকের মূর্তি, নানা রত্ন অলংকার। বাতাসে শুকনো ঘাস আর ওয়ার্মউড ওষধি গাছের তিক্ত মেদুর গন্ধ। এইসব দিয়েই তৈরি হয়েছে ‘সাগা অফ দা সিল্ক রোড’ নামের কাজাখ পারফিউম। 

Saga of the Silk Road

Perfumer: Sarah McCartney

Top notes: incense, black pepper, myrrh, and wormwood
Heart notes: Spices, red wine and Oriental notes
Base notes: rosewood, grey amber, sandalwood, Tolu balm, and resins

রেশম-পথের এই পারফিউমটি বেশ জটিল। এর ওপরের দুটো নোটে যেমন গোলমরিচ ও প্রাচ্যের মশলার গন্ধ আছে, তেমনই তার সাথে মিশেছে রেড ওয়াইন এবং চন্দন। আর গভীরে আছে অ্যাম্বার ও রেজিনের গন্ধ, যা তার সামগ্রিক বোধকে স্থায়িত্ব দিয়েছে। কবি রাউশানভের লেখা ‘অগ্নিবর্ণা পরির প্রেমে’ কবিতাটিতে আছে তেমনই এক মিশ্র জটিলতা। গোধূলির আলো যেন কস্তুরির গন্ধ জড়ানো এক প্রাচীন মায়াবিনী, যার ধাতব নখাগ্র থেকে রক্তফোঁটা ঝরছে। রক্তে লাল দপদপ করছে দিগন্ত।        

৮.  কবি ইয়েসেঙ্গালি রাউশানভ (Yessengali Raushanov : Born 1957)

কবি রাউশানভ শিক্ষায় ও পেশায় একজন সাংবাদিক, বর্তমানে একটি প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক। আশির দশকের শেষে রাশিয়ার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজাখদের বিদ্রোহে তাঁর কবিতাই গান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর কবিতা প্রেরণা পেয়েছে কাজাখ দেশের লোককথা থেকে।  বহু পুরস্কৃত এবং সম্মানিত এই কবি ও প্রাবন্ধিকেরর প্রধান বইগুলো: Beginning (1980), Until Venus Rises (1986), The Cruel Baldicoot (1995), The Wormwood Grown in Dry Steppe (2006), and Angels and Birds (2006). তাঁর উপন্যাস: Born from Light (2002)। ইউরেশিয়ার প্রায় সমস্ত ভাষায় তাঁর কবিতার অনুবাদ হয়েছে।

এক অগ্নিবর্ণা পরির প্রেমে

আমি প্রেমে পড়েছি এক অগ্নিবর্ণা পরির,
যাকে লোকে গোধূলি-আলো বলে।
আনন্দ অথবা মৃত্যু যাই হোক, আমি নিয়েছি এই ঝুঁকি।
সে আমার পাশে বসে শান্ত হয়ে,
পোশাকের লম্বা হাতার ভেতরে পেতলের নখগুলোকে লুকিয়ে।   

পালক-ঘাসের সাগরের মাঝে আমি পড়ে আছি বিবর্ণ হয়ে। 
ধূসর আলোর ভেতরে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মায়াবিনী,
তার নখাগ্র থেকে রক্ত ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা
আমার চোখের সামনেই সে দুহাত দিয়ে আঁচড়াচ্ছে দিগন্তকে।

চারপাশের ঢালু জমিগুলো যেন জ্বলে উঠছে তৎক্ষণাৎ,
আর রক্তে লাল হয়ে দপদপ করছে ওই দিগন্ত।
যেন এই জীবনে যথেষ্ট শোক পাইনি আমি, 
হে ঈশ্বর, কী মানে হতে পারে এই রক্তের? সে করতে চায়টা কী? 

একটা গাঢ় ধূসর জোব্বায় পৃথিবী ঢেকেছে নিজেকে
দুরন্ত শিশুর মতো ছুটোছুটি করছে হাওয়া। 
কস্তুরীর গন্ধ জড়ানো সেই মায়াবিনী
কাছে এসে বলছে: শুধু আমিই যা হোক বুঝেছি তোমায়।

পৃথিবী এখন শান্ত, হ্রদের জলও রয়েছে স্বস্থানে,
আকাশেও কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই আর।
শুধু আমার হৃদয় এখনও কম্পিত– বিষণ্ণ এই পৃথিবী।
আমি ভালোবাসি এই পৃথিবীকে, তার সমস্ত ধাতব নখগুলো সমেত।
তাকে নিয়ে কী করতে পারি আমি?
বলো, কী করা উচিত হবে আমার?

৯. শ্রীমতী নাজিরা বারডালি (Nazira Berdaly: Born 1980)

নাজিরা কবি ও সাংবাদিক। আল-ফারাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০১ সালের স্নাতক। কাজাখ রেডিও এবং টিভি তে সঞ্চালক ছিলেন। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় আঞ্চলিক সংবাদপত্রে। তাঁর কবিতার বয়ের মধ্যে আছে- Rainy Night (2001),The Heart in Love (2009), এবং The Beautiful World (2014)। অনেক জনপ্রিয় গানেরও তিনি রচয়িতা। কাজাখস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতির প্রবর্তিত সাহিত্যবৃত্তি পেয়েছিলেন ২০১৪ সালে।

যখন একা থাকি, মিথ্যাচার করি নিজের সাথে

যখন একা থাকি, আমি মিথ্যাচার করি নিজের সাথে,
তখনও মিথ্যা বলি যখন অন্য কারও সাথে দেখা হয়…
দুঃখের সজোর আঘাত আমাকে ধরাশায়ী করেছে।
কাছে এসেও আমি ভালোবাসতে পারি না তোমায়,
তার চেয়েও খারাপ এই যে ঘৃণাও করতে পারি না।

এইসব অনুভবের জন্য আমি
হৃদয়কে দোষ দিই কি করে?     

দুঃখের এই কৃষ্ণসাগর পার হতে গিয়ে
আমি নগ্ন হয়েছি, কিন্তু নিজেকে সমর্পণ করিনি,
অথচ তুমি তো রয়ে গেলে সৈকতেই।

যদি আমার সকল খুশিকে তুমি বিষাদে ভরে দাও,
আমার দৃঢ়তাকে তুচ্ছ করো বালির মতো,
তবুও তোমাকে ক্ষমা করে দেব আমি,
তবুও আমি দেখতে চাইবো তোমায়,
চাইবো উষ্ণ ও আলোকিত এক নতুন দিনের ভোর।  

রাত্রির নীরবতাই যে জয়ী হবে আবার, আমি কখনও জানিনি
কারণ স্বপ্ন আমাকে ছলনা করেছে,
কারণ তুমি ছিলে অন্য সৈকতে-
আমি ভুলে যাব তোমায়।  

হে আমার মধুর বিষাদ! 
নিষ্ঠুর, অদ্ভুত …এবং পরিচিত সকল দুঃখরা! 
আমি বাতাসের মতো হাত বোলাবো না তোমার চুলে,
কোনও মিথ্যে আশাও তোমার বিরুদ্ধে পোষণ করবো না আমি,
একটু শান্তির খোঁজে তোমার মেজাজের সাথে লড়তেও যাবো না।

আমি চলে যাব, ওই সৈকতের পাথুরে রাস্তার ওপরে তুমি
খালি পায়ে একা দাঁড়িয়ে গান গাইবে শূন্যমনে।
আমি সাঁতার কেটে চলে যাচ্ছি বহুদূর।
তুমি আর আমাকেপাবে না।

*

সাভানা আর আমি যেমন কাজাখ কবিতা নিয়ে মেতেছি, প্রেইরি তেমনই মেতে আছে কাজাখস্তানের পারফিউম নিয়ে। এই সূত্রে সে আমাকে গ্রেট স্টেপ-এর মহান ইতিহাসের পাতা থেকে অনেক তথ্যও পাঠিয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ছয়শো বছর আগেকার কিংবদন্তি যোদ্ধা, রানি টমিরিস। এঁর কথা আজও কাজাখরা গর্বের সাথে, শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। কবিদের কবিতাতেও তাঁর উল্লেখ আছে। তাঁর বীরত্বের কাহিনী নিয়ে ছবি এঁকেছেন ইউরোপের চিত্রকর। রানির উল্লেখ আছে শেক্সপীয়ারের  (Henry VI) নাটকেও। আর সেই রানির স্মৃতিতে সুরভি-রচয়িতা অ্যাঞ্জেলা সিয়েমপ্যাগনা প্রস্তুত করেছেন এক দারুণ পারফিউম, নাম দিয়েছেন- ‘কিংবদন্তি টমিরিস’।

সুরভি- : কিংবদন্তি টমিরিস (The Legend of Tomiris)

দা গ্রেট স্টেইপ-এর মহান ইতিহাসে আছে ইউরেশিয়ার বিশাল অঞ্চল জুড়ে প্রাচীন সাইথিয়া সাম্রাজ্যের কথা। ইরানিয়ান বংশোদ্ভুত, মূলতঃ শান্তিপ্রিয় ও কর্মবীর যাযাবর মানুষের আদিভূমি। পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু করে কাস্পিয়ান সাগর পেরিয়ে, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান ছিল তার অন্তর্ভুক্ত। পার্সিয়ানরা সেই দেশকে বলতো মেসেজেতাই, গ্রীকরা বলতো সাইথিয়া (Massagetae/Scythia)। সেই রাজ্যের অসমসাহসী যোদ্ধাও শ্রদ্ধেয় রানি টমিরিসের বীরত্বের কথা আজও স্মরণ করেন কাজাখরা। আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও আগে, পার্সিয়ার রাজা সাইরাস যখন সাইথিয়াকে অতর্কিতে আক্রমণ করেন, তখন খ্রিস্টপুর্বসাড়ে পাঁচশো বছর। সে সময় খুব অপ্রস্তুত ও বেহিসাবি ছিল সাইথিয়ার সেনাবাহিনী। তাদের ভুল পথে এনে, মদ খাইয়ে বেহুঁশ করে ফেলে সাইরাসের চতুর সেনারা। রানি টমিরিসের ছেলে ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান। তিনি বন্দী হন, এবং বন্দী দশায় অত্যাচারিত হয়ে আত্মহত্যা করলে, যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন রানি টমিরিস স্বয়ং। বিপুল যুদ্ধে সাইরাস হার মানলে, তাকে বন্দী করে রানির কাছে এনে শিরশ্ছেদ করা হয়। শত্রুমুক্ত হয় রানির সাম্রাজ্য। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডোটাসের বিবরণে, এবং শেক্সপীয়ারের নাটকে এর উল্লেখ আছে। রানির দরবারে বন্দী সাইরাসের শিরশ্ছেদ নিয়ে সপ্তদশ শতাব্দীতে বিরাট ক্যানভাসে (দৈর্ঘ্যেপ্রায় ১২-ফুট) তৈলচিত্র এঁকেছেন বিখ্যাত চিত্রকর পিটার পল রুবেন্স (১৬২২)।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


সেই রানির স্মৃতিতেই আজ, আড়াই হাজার বছর পরে, তাঁর নামে তৈরি হয়েছে মহার্ঘ সুরভি ‘দা লেজেন্ড অফ টমিরিস’। কাজাখ কবিদের কবিতাতেও আছে এই রানির উল্লেখ।

The Legend of Tomiris

Perfumer: Angela Ciampagna

Top notes: neroli, tangerine, grass and white flowers
Heart notes: violet, rose, gurjan balsam,cove, white musk, nutmeg, calamus, and amyris
Base notes: patchouli, ebony, sandalwood, vetiver, guaiac, vanilla, papyrus, and copaiba balm.

কাজাখস্তানের এইসব পারফিউমের কথায়, আমার মনে হোল নিজের দেশের কথাও। আমরা কি শুধুই ফরাসি সুগন্ধি নিয়ে মেতে থাকবো? হয়তো এদেশেও কখনও তৈরি হবে কিংবদন্তি রানি ঝাঁসি, অথবা সম্রাট অশোক, বা নৃপতি বিম্বিসারের  স্মৃতিতে কোনও দেশীয় সুগন্ধি। অথবা, আমরা কি পারি না ‘উইন্ড অফ দা গ্রেট স্টেপ’-এর মতো কোনও নিজস্ব সুরভি বানাতে, যেভাবে আমাদের এই বঙ্গভূমির জল-মাটির ইতিহাস আর হাওয়া বা তাসের স্তরে স্তরে নানান সৌরভ মিশে থাকে? কবিতারই মতো। হয়তো একটা পারফিউমের নাম দেব আমি— ‘প্রান্তরের কুয়াশা’ অথবা ‘হাওয়ার রাত’। স্মৃতিতে ধরা থাকবে কতশীত আর শিশিরের জল! বাতাবি ফলের ঘ্রাণ! শিরিষের ফুল! -এই নিয়ে কত রকমের কম্পোজিশান তৈরি করা যায়, সুনির্বাচিত। চাই একজন ভালো পারফিউমার, আর স্টার্টআপ। পরে কোথাও সেসব নিয়ে আমি লিখতেও পারি।

*

কাজাখ কবিদের যে এগারোজনকে আমি এই পর্বে নির্বাচন করেছি, তাদের মধ্যে আছেন তরুণ কবি আকবেরেন ইয়েলগেজেক, জন্ম ১৯৮০ সাল। আর কনিষ্ঠতম হলেন তরুণ কবি ইয়েরলান জুনিস। জন্ম ১৯৮৪ সালে। সাভানা আর প্রেইরির প্রায় সমবয়সী। আমি দেখতে চেয়েছি, ১৯৩৫ সালে জন্মেছিলেন যেসব প্রবীণ কবি, যেমন মোলদাগালিয়েভ অথবা, মির্জা আলি, তাঁদের থেকে আজকের নব্য তরুণ কবিদেরসময়কাল,কবিতায় তাঁদের অনুভব, দৃষ্টিকোণ এবং প্রকাশ কতটা ভিন্ন। তরুণ ইয়েরলান কবিতায় লিখেছেন, ‘পৃথিবী কেমন আবেগপ্রবণ খেয়াল করেছ কি?’ মনে রাখতে হবে, রাশিয়া থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন কাজাখস্তানের জন্ম হয়েছে মাত্র ১৯৯১ সালে। কিন্তু তার পেছনে আছে কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস।

১০. কবি আকবেরেন ইয়েলগেজেক  (Akberen Yelgezek : Born 1980)

কবি, অনুবাদক, প্রশাসক ও জননেতা। ইতিহাসে স্নাতক হয়েছেন আল-ফারাবি কাজাখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আলমাটি শহরের নানা প্রশাসনিক পদে কাজ করেছেন। একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর কবিতায় আছে স্বপ্ন, সুররিয়ালিজম ও মগ্নচৈতন্যের গভীর থেকে তুলে আনা কিছু অপরিচিত দৃশ্যকল্পের উদ্ভাস। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই : The Whisper of Shadows (2009) এবং The Light Outside Infinity (2014)।তাঁর আত্মজৈবনিক বই- The Childhood that Never Happened (2014) খুবই প্রশংসিত। বহু পুরস্কৃত এই কবির কবিতা অনুদিত হয়েছে টার্কিশ, আজারবাইজানি ও স্প্যানিশ ভাষায়। কাজাখ ভাষায় তিনি নিজেও অনুবাদ করেছেন আইভান বুনিন, শালামভ, ভাইসোটস্কি ও গিয়োম অ্যাপোলিনেয়ারের কবিতা।   

একা

এই অনন্ত অসীম মহাবিশ্বে
পৃথিবী একটা ছোট্ট একাকী তারা
যার ভূপৃষ্ঠে তুমি একা রয়েছ, আমিও যেমন।

পৃথিবীটা তবে এরকম একলা কেন ?
তুমি তো বেশ সামাজিক, এবং আমিও তো।

একটা মাকড়শা তার জটিল জাল বোনে
কোনও নিরীহ পতঙ্গকে ফাঁদে ফেলবে বলে।

তামা যেমন একাকী, তেমনি সীসাও, 
তেমনই সমস্ত পরমাণু। 
পাখিরা একা, এবং সব কবিও।
হৃদয় যেমন একা, মস্তিষ্কও তো তেমনই।
একা একা পুড়তে থাকে সিগারেট,
একা চাঁদ নীচে তাকিয়ে দেখছে তোমার চতুর মুখ।
সকল বস্তুই নিজেদের মতো চলছে, এমনকি ঈশ্বরও।
মরণ এবং সম্মানও এমনই একাকী।
জীবনের অর্থ যেন অনেকটা
ওই মথ আরমাকড়শার মধ্যে লড়াই।

১১. কবি ইয়েরলান জুনিস  (Yerlan Junis : Born 1984)

ইয়েরলান তরুণ কবি ও অনুবাদক। পার্সিয়ান ভাষায় ২০০৭ সালের স্নাতক। কিছুদিন একটি সংবাদপত্রের সাহিত্যবিভাগে কাজ করেছেন, বর্তমানে একটি আঞ্চলিক টিভি চ্যানেলের সম্পাদক। প্রথম কবিতার বই: Verse-Child (2001) প্রকাশিত হয়েছিল স্কুলে থাকতেই। পরবর্তী বই: The Prayer of the Sacred Nights (2011), The Heavenly Spring (2014), Insight (2013) এবং Songs of Hope (2014)।

এই বয়সেই অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছেন। কাজাখ ভাষায় অনুবাদ করেছেন রাশিয়ান এবং পার্সিয়ান কবিতা।

পৃথিবী কেমন আবেগ প্রবণ, খেয়াল করেছ কি?    

তুমি কি খেয়াল করে দেখেছ, পৃথিবী কেমন আবেগ প্রবণ?
একটা কোমল ফুলের চারপাশের সবকিছুই কত কোমল,
চারপাশে ফুল ছাড়া আর কিছুই নেই–
অন্তত ফুলকে সেভাবেই ভাবতে দাও।
কার দোষে তার এই কোমল স্বভাব, বলো?
একটা পাথরচট্টান ভাবে সবকিছুই বুঝি পাথর দিয়ে গড়া,
এমনকী একটা পাকা জামও তার কাছে পাথর।

‘আমরা কেউ পাথর নয়!’– একথা বোঝাতে আমরা কঠিন সংগ্রাম
করেছি, যতক্ষণ না আমাদের তরুণ হৃদয় রক্তাক্ত হয়েছে।
এমনভাবে উঠে দাঁড়াও, যাতে অন্যরাও ওপরে উঠতে পারে।
এমনভাবে ভালোবাসো, যেন ভালোবাসতে পারে অন্যরাও।
সবচেয়ে শুভ্র যে ফুল, তার অশ্রুকে ধরে রাখতে
কখনও যেন পাথর কেটে কোনও পাত্র বানিয়ো না। 

 

অপেক্ষা

শরৎকালেই ফিরে আসবো- কথা দিয়েছিলাম তোমায়
আর বন্ধুদেরও, কিন্তু আমি কথা রাখতে পারিনি।
আমার মন চলে যাচ্ছে তোমার কাছে,
কিন্তু জীবন এক অন্যদিকে নিয়ে চলেছে আমায়।

শরতের অপেক্ষায় পুড়ে আংরা হয়ে গেছে তৃণভূমি।
হায়, এইসব পাকদন্ডি রাস্তাগুলো তোমার কাছে নিয়ে যায় না, 
সুদূর নির্জনে সেই বাড়িটার মাথায় এখনএকঝাঁক পাখি-
ওরা উড়ছে চক্রাকারে,কিন্তুছেড়ে যেতে পারছে না বাড়িটা। 

তোমার বৃষ্টিভরা চোখে হঠাৎই ঝিলিক দিয়ে উঠলো আকাশ,
তুমি আবার জানালায় এসে দাঁড়ালে,
আবারও চেয়ে রইলে পথের দিকে,
কিছুতেইপর্দাটা টেনে দিতে পারছো না…।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


*

একজন উৎকৃষ্ট পারফিউমার বা সুরভি রচয়িতাকে একজন উৎকৃষ্ট কবির সমতুল্য মনে করি আমি। একই রকম শ্রদ্ধেয়। কবির একটি গোটা কাব্যগ্রন্থের মতোই দীর্ঘকালের শ্রম, মেধা, সৃজনশীলতা, অন্বেষণ, বোধ এবং প্যাশান দিয়ে নির্মিত হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট বহুস্তরীয় পারফিউম।

প্রেইরি জোহানেসবার্গ থেকে দেশে ফিরে আসছে। খুবই খুশি সে। এতদিন রাত জেগে কাজ করে গেছে, ঘুম থেকে উঠেছে অনেক বেলায়। তার আর রান্নাবান্না কি- গ্রিলড স্যান্ডউইচ, কফি, আলুভাজা, ডিমভাজা, পাস্তা। বাকিটা ক্যান থেকে ঢেলে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নেওয়া। ঢিমে-আঁচে তিন ঘন্টা ধরে বেশবার্মাক বানানোর ধৈর্য তার কোনওদিন হবে না। দুটো বড় স্যুটকেশের মধ্যে এবার সে ভরে ফেলছে তার দেড় বছরের সংসার। টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আমাকে লিখেছে- সি ইউ সুন। আর আমি ভাবছি, আমুর বাজপাখিদের কথা। জোহানেসবার্গে তাদের ফেলে আসা ছোট্ট বাড়িটার মাথায় হয়তো পাখিরা ঘুরতে থাকবে। ছেড়ে যেতে পারবে কি সহজে? -ইয়েরলান জুনিসের কবিতায় যেমন!

তবে প্রেইরি যখন দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে দিদির কাছে যাবে, তখন সে আলমাটি বা আস্তানার মতো ঝকমকে শহরে থাকবে না। সাভানা হয়তো তাকে নিয়ে যাবে টিয়ান-শান পাহাড়ের কোলে সেই আপেল বনে, অথবা দূরের তৃণপ্রান্তরে কোনও বন্ধুর গ্রামের হোমস্টেতে, যেখানে জ্যোৎস্নায় বুনো ঘোড়ার পাল চরে বেড়ায় মাঠে। সেখানে সে পড়ে শোনাবে, কাজাখ কবিতার নির্বাচিত লাইনগুলো। কবিদের নাম হয়তো তার মনে থাকবে না, শুধু মনে পড়বে কবিতার কিছু বিচ্ছিন্ন লাইন:

“আমি চাই শরৎ ঋতু আসুক, আর নগ্ন করে দিক আমায়…যখন একা থাকি, আমি মিথ্যাচার করি নিজের সাথে… একটি স্ফুলিঙ্গ ওঠে প্রেরণার, আর ঝড়কে সংযত করি আমি…আমরা কেউ পাথর নয়!-একথা বোঝাতে আমরা কঠিন সংগ্রাম করেছি। …আমি নগ্ন হয়েছি, কিন্তু নিজেকে সমর্পণ করিনি।”


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


এইসব সাভানা, তুন্দ্রা, প্রেইরি, বৃষ্টিবন—সবই আজও ছড়িয়ে আছে পৃথিবী জুড়ে। এই প্রকৃতি, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের সব কিছু মিলিয়েই আমাদের অস্তিত্ব। আমাদের প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আমাদের বিপন্নতা। গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে জেগে উঠে জীবনানন্দ চেয়েছিলেন, আবার ঘুমোতে। যখন তাঁর সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়-আক্রোশে ভরে গিয়েছে।…সব পথে এই সব শান্তি আছে: ঘাস-চোখ-শাদা হাত-স্তন। তবু, যে জীবন দোয়েলের কোকিলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা। এই উপলব্ধি বিনয় মজুমদারেও আছে। “মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।” মানুষের যা কিছু অধরা, যা কিছু হতাশা, যা বাঙালি কবির মনে অবসাদ আনে, কাজাখের কবিতায় তার বিশেষ চিহ্ন নেই। প্রায় তিন হাজার বছরের ইতিহাস পেরিয়ে, আজ তাঁদের এক নব জাগরণ যেন। রক্তাক্ত স্মৃতি থেকে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা। কাজাখের কবিরা লিখছেন:

“আমার সকল আবেগ যেন নবজন্ম পায়…আমি শুধু চাই আমার কবিতারা ওই হাঁসদের মতোই পবিত্র হোক।… পাখিরা একা, এবং সব কবিও।… আমি ভালোবাসি এই পৃথিবীকে, তার সমস্ত ধাতব নখগুলো সমেত।… পৃথিবী এখন শান্ত, আকাশেও কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই আর।… এখানে সুগন্ধ ভেসে আসে প্রাচীনকালের, ঘোড়ার ওপরে বসিয়ে রাখা এক বালিকার কান্না যেন”। 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত