| 29 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

স্মরণ: তুমি যে ছিলে সেটা অভাবনীয় । পৃথ্বী বসু

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট
 
 
কয়েক বছর আগের একটা রবিবার। যাদবপুর থেকে তিন বন্ধু গেছি শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে। কারণ কী? ‘ডি লা গ্রান্ডি’ নামে একটা পত্রিকার জন্য লেখা চাইতে। কিন্তু লেখা তো নেই! কী হবে? ‘তাহলে যদি আপনি একটা শুভেচ্ছাবার্তা লিখে দেন…’। তাতে অবশ্য আপত্তি নেই ওঁর। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা খাম চলে এল আমাদের হাতে। আর আনন্দে লাফাতে থাকলাম আমরা।
 
ভেবেছিলাম ওই শুরু, ওই শেষ। কিন্তু না। এরপর নানা কারণে ওঁর কাছে যেতে হয়েছে। কখনো দরকারে, কখনো অদরকারে। কিন্তু যতবারই গেছি, অদ্ভুত একটা ভালোবাসা পেয়েছি। প্রশ্রয় পেয়েছি। উৎসাহ দিয়েছেন নানান সময়ে, নানান কাজে। আর ওঁর রসিকতা! একবার একজন প্রশ্ন করেছে, ‘স্যার, অল্পবয়সে লিখে যে আনন্দ পেতেন, এখনও কি তেমন পান?’ তৎক্ষণাৎ স্যারের উত্তর, ‘আমি যে অল্পবয়সে লিখে আনন্দ পেতাম, তোমাকে কে বলল!’ আরও মনে পড়ছে, একবার যাদবপুর থেকে অনেকজন মিলে যাওয়াতে পকোড়া গোছের কিছু খেতে দেওয়া হয় আমাদের। সেগুলো সংখ্যায় যতগুলো ছিল, তাতে সবার একটা করে হয়ে কিছু পড়ে থাকবে। খেতে খেতে যখন একটা পড়ে রয়েছে, দেখা যাচ্ছে কেউ আর খাচ্ছে না। স্যার তখন বললেন, ‘তোমাদের একটা গল্প বলি। ফ্রান্সে একবার এক মহিলা বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেছিলেন ফিশফ্রাই খাওয়াতে। শেষে যখন ঠিক এরকমই একটা পড়ে, কেউ আর হাত বাড়ায় না। তখন মহিলা বললেন, তোমরা লজ্জা পাচ্ছ বুঝেছি। আমি পাশের ঘরে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিচ্ছি, তোমরা তখন কেউ একটা খেয়ে নিও। কিন্তু আলো নেভাবার পরেই একটা তীব্র চিৎকার শোনা যায়। মহিলা আলো জ্বালিয়ে দেখেন, সবাই কাঁটা চামচগুলো ফিশফ্রাইতে গেঁথেছে, কেবল একটা চামচ একজনের হাতের ওপরে পড়ে গেছে।’ গল্প এখানেই শেষ। খানিক থেমে বললেন, ‘আমাকেও কি উঠে গিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিতে হবে?’ আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম।
কত মানুষকে যে কতভাবে সাহায্য করতেন! শুধু মুখ ফুটে বলার অপেক্ষা। আমি এতটাই লজ্জা পেতাম ওঁকে, নিজে মুখে কিছু না বললেও উনি জানতে পারলেই সাহায্য করতেন। একবার আমার দরকার পড়ল, ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার কিছু সংখ্যা দেখার। একমাত্র শঙ্খবাবুর কাছেই সেসব সংখ্যা আছে। কী করা যায়, সন্দীপন চক্রবর্তীকে দিয়ে বলালাম। উনি শুনলেন। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমিও যেতে পারিনি। সে-বছর পয়লা বৈশাখে, কলেজ স্ট্রিটে হাঁটছি। দূর থেকে দেখি উনি আসছেন। আমার তো কাছে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। হাতে সিগারেট। কিন্তু উনি যত এগিয়ে আসছেন, দেখছি গতি কমছে। কিছুক্ষণ পরে থেমে গেলেন আমার দিকে তাকিয়ে। বাধ্য হয়ে গেলাম। দু-চার কথার পর আমায় বললেন, ‘তোমার ফোন নম্বর ছিল না, তাই জানাতে পারিনি। কৃত্তিবাসের সংখ্যাগুলো আনিয়ে রেখেছি। সময় করে দেখে এসো একদিন’। অবাক হয়ে গেছিলাম ওঁর আন্তরিকতায়!
 
 
একইরকম সাহায্য করেছিলেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্তকে নিয়ে অনুষ্ঠান করার সময়ে। খুব খুশি হয়েছিলেন। প্রণবেন্দুর সমস্ত বই প্রয়োজন পড়ল আমাদের। শুধু ফোন করে জানানো হল একবার। ব্যস। পরের দিন সকালে গিয়ে দেখি, ব্যাগে করে গুছিয়ে রাখা আছে। শরীর তখন খুবই অসুস্থ। আমরা চেয়েছিলাম স্যার যদি ‘গদ্যসংগ্রহ’ বইটা উদ্বোধন করেন। উনি কার্ডে নাম ছাপাতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন দুপুরে সন্দীপনদার ফোন, ‘স্যার বলেছেন বিকেলে আসবেন। তোকে গেটে বলে রাখতে বলেছেন’। এত আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন, বলে বোঝাবার নয়।
 
মৃদু রাগও কি করেননি কখনও? যদিও ওঁর স্বভাবধর্ম তা নয়। তবু মনে পড়ছে, দুটো ঘটনার কথা। শঙ্খ ঘোষকে লেখা নির্মল হালদারের ২১/২২টা চিঠি ছেপেছিলাম একবার আমার পত্রিকায়। উনি বারবার বলে দিয়েছিলেন, চিঠির বানান ভুল হলেও যেন এক থাকে। কিন্তু যাকে কম্পোজ করতে দিই, বারবার বলা সত্ত্ব্বেও সে সমস্ত বানান ঠিক করে দেয়। এদিকে স্যারের নির্দেশ, প্রুফ উনি দেখবেন। ফলে আমি সরাসরি স্যারকেই দিয়ে আসি। এর পর যখন একদিন আনতে যাই, দেখি ওঁর মুখ একদম থমথমে। আমি আড়ষ্ট হয়ে যাই। প্রথমেই উনি জিগ্যেস করেন, ‘কাকে দিয়ে কম্পোজ করাও তুমি?’ আমি বলি। তারপর বলেন, ‘সমস্ত বানান ঠিক করা হয়েছে, কার ইচ্ছায়?’ আমার আর কথা বেরোয় না। প্রুফ হাতে নিয়ে দেখি, পাতার পর পাতা, পেনসিল দিয়ে শুধু জিজ্ঞাসাচিহ্ন! কিন্তু পরেরবার যখন আবার প্রুফ দেখাতে যাই (মাঝে নিজে তিনবার প্রুফ দেখে), তখন সেই শিশুর মতন হাসি, ‘সেকেন্ড প্রুফে একটাও ভুল নেই, এ আমি ভাবতেই পারি না’।
 
আরও একবার ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম। সাংঘাতিক। প্রশান্ত মাজী এলগিন রোডের স্টোরি-তে বইপ্রকাশের একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। সেখানে স্যারের যাওয়ার কথা। অনুষ্ঠানের আগের দিন রাতে প্রশান্তদা ফোন করে বললেন, ‘তুমি কি স্যারকে একটু নিয়ে যেতে পারবে? উনি জায়গাটা ঠিক চেনেন না। আমি তোমার কথা বলে রাখছি তাহলে।’ না করি কী করে! কিন্তু এদিকে আমিও তো জায়গাটা চিনি না। ঠিক করলাম, সকালে গিয়ে জায়গাটা দেখে আসব। বিকেলে স্যারকে নিয়ে যাব। এদিকে গাড়িতে উঠে রুট-ম্যাপটা বলতেই, উনি বললেন, ‘ওদিক দিয়ে গাড়ি ঢুকতে দেবে?’, বলি কী করে যে, সকালে গিয়ে আমি দেখে এসেছি! কিন্তু জোর দিয়ে হ্যাঁ বলতে থাকায় উনি কীরকম যেন চিন্তিত হয়ে পড়েন। এদিকে আমার স্মৃতিতে তো সকালের দৃশ্য পরিষ্কার। কিন্তু যথারীতি দেখা গেল, আমার বলে দেওয়া রাস্তায় একসময়ে গাড়ি আর ঢুকতে দিচ্ছে না। ওদিক দিয়ে গাড়ি বেরোচ্ছে তখন। হা ঈশ্বর! স্যার এক্কেবারে চুপ। আমি বললাম, ‘গাড়ি ঘুরিয়ে আনি, স্যার?’, সোজা উত্তর, ‘কোনও প্রয়োজন নেই। হেঁটেই যাব’। হাঁটবেন মানে কী? একে অতটা পথ, তার ওপর হু হু করে গাড়ি যাচ্ছে। আর ওঁর তখন অত বয়স! কিন্ত ওঁকে আটকাবে কার সাধ্য? ব্যস্ত রাস্তায় তখন বেপরোয়া শঙ্খ ঘোষ আর মরিয়া আমি! লজ্জায় মাথা হেঁট। অনুষ্ঠান শেষে লিফটে নামছি একসঙ্গে। হঠাৎ দেখি পিঠে একটা হাত। স্যার। মুখে হাসি। বললেন, ‘একটা কথা প্রমাণিত হল তো পৃথ্বী?’, ‘কী স্যার?’, ‘এখনও কলকাতাটা আমিই ভালো চিনি!’ দুজনেই হেসে উঠলাম।
 
আরও নানান ঘটনা মাথার ভেতরে ভিড় করে আসছে। কিন্তু সারা জীবন আমার এই একটা ঘটনার কথাই ঘুরে ফিরে মনে পড়বে জানি। যাদবপুরের বাংলা বিভাগের ৩৩তম পুনর্মিলন উৎসব। সেবারে আমাদের দায়িত্বে পুরোটাই। একদিন সকালবেলায় যথারীতি আমি আর আমার বন্ধু বিতান হাজির হয়েছি ওঁর বাড়িতে, আমন্ত্রণপত্র আর লেখার অনুরোধ নিয়ে। স্যার লেখা দেবেন এ তো নতুন কিছু নয়, তবু ওই আর কি! কিন্তু সেবার ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল একটু জটিল। সেবারে দিন গড়াতে গড়াতেই খানিক দেরি হয়েছিল। আর যে-সময়ে আমাদের লেখা পাওয়ার কথা, স্যার তখন থাকবেন না। কী করা যায়? পাতা তো ফাঁকা রেখে দিয়েছি। স্যারকে জানানো হল। বললেন, দেখছি। এবারে যদি না পারি খুব কি অসুবিধে হবে?… না, মানে স্যার… আপনি সময় নিন। আমাদের অমুক তারিখের মধ্যে পেলেই হবে।… এদিকে হল যেটা, সেই দিনও চলে এল। প্রেস থেকে ফোন আসছে। অমুকদিন কিছুতেই বের করা যাবে না এবারে না দিলে। কিন্তু শঙ্খবাবুর লেখা পাওয়াই যাবে না? সুতরাং শেষবার ফোন। স্বরে বেদনা। নির্দেশ : অমুকদিন দুপুর বারোটায় আসতে পারবে?
 
ঘরে দুজন মানুষ বসে রয়েছেন। এসেছেন, দিল্লি থেকে। আমিও বসে আছি চুপ করে। স্যার লেখার ব্যাপারে কিছুই বলছেন না। তাঁরা যখন উঠলেন তখন প্রায় দেড়টা। এরপর হঠাৎ দেখি স্যারের হাতে একটা সাদা কাগজ, আমার দিকে বাড়িয়ে বলছেন, লেখো ‘চিরহরিৎ ঘুম’… হা ঈশ্বর! পরক্ষণেই বললেন, কী হবে জানি না। তবু শেষ চেষ্টা করছি।… একটা একটা করে লাইন এরপর আসছে… কখনো চুপ করে তাকিয়ে থাকছেন… পায়চারি করছেন… আবার ওই এল আরেকটা লাইন… তারপর একসময় শেষ। ঘড়িতে সোয়া দুটো। জিজ্ঞেস করলেন, পুরোটা একবার পড়বে? পড়লাম :
‘চিরহরিৎ ঘুম
সেইখানে সে দাঁড়িয়ে আছে প্রতীক্ষার আলোর পাশে
একলা আজও।
দূরের থেকে দেখছি আমি ঘাসের জাজিম পাতা
পথের মৃদু দিশা।
হঠাৎ কোথায় বেজে উঠল হাজারকণ্ঠী শাঁখ।
জাগল চরাচর।
আমার হাতে বাংলাদেশের ভিসা।’
— লেখাটার নাম দাও ‘ভিসা’। তবে কী হল, সত্যিই জানি না।… বেরোবার সময় বললাম, স্যার খুব খারাপ লাগছে আমার। আপনার এতটা সময় নষ্ট হল!… মুখে সেই হাসি, ‘আর তোমারও যে হল!’…
কদিন ধরে কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে। এই কলকাতা শহরে এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর কাছে যেকোনও সময়, যেকোনও দরকারে পৌঁছে যাওয়া যেত। কত কী জানা যেত! কোনও জটিল প্রশ্নের সহজ সমাধান পাওয়া যেত। আর পাওয়া যেত অফুরন্ত প্রশ্রয়। স্নেহ। ভালোবাসা। আমাদের সেই জায়গাটা আর রইল না।
 
 
 
 
 
 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত