| 29 মার্চ 2024
Categories
ইতিহাস জীবন যাপন নারী

শাড়ি কথন

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে শাড়ি পরার ধরন। ১৯২৮ সালে শিল্পী এম.ভি ধুরন্ধরের জলরংয়ে আঁকা ছবি।

 

‘‘বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।’’- (শাড়ি,সুবোধ সরকার)

গুপ্ত যুগের (আনুমানিক ৩০০থেকে ৫০০ সাল পর্যন্ত) বিখ্যাত কবি কালীদাসের ‘কুমারসম্ভব’-এ শাড়ির কথা উল্লেখ আছে। গুপ্ত আমলের ইলোরা অজন্তা গুহার প্রাচীন চিত্রাবলি বলে দেয়, খ্রিস্টাব্দ শুরুর সময়ে শাড়ির অস্তিত্ব ছিল। ইলোরা অজন্তার মতো পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলক থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, হাজার বছর আগে এই পূর্ববঙ্গে শাড়ির প্রচলন ছিল।

“শাড়ি” বাঙালির পরিচয়ের সাথে মিশে আছে বাংলার অহংকার হয়ে। সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীনতম পরিধেয় বস্ত্র এই শাড়ি, যার ব্যবহার এবং জনপ্রিয়তা আজো আকাশ ছোঁয়া। কখন কীভাবে শাড়ি উদ্ভূত হয়েছিল সে ইতিহাস খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবে আবহমান বাংলার ইতিহাসে শাড়ির স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে বদলেছে শাড়ির পাড়-আঁচল, পরার ধরন আর বুনন কৌশল।  “শাড়ি” শব্দের উৎস সংস্কৃত “শাটী” শব্দ থেকে। ‘শাটী’ অর্থ পরিধেয় বস্ত্র। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রাচীন ভারতের পোশাক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে তখন মেয়েরা আংটি, দুল, হার এসবের সঙ্গে পায়ের গোছা পর্যন্ত শাড়ি পরিধান করত, উপরে জড়ানো থাকত আধনা (আধখানা)। পাহাড়পুরের পাল আমলের কিছু ভাস্কর্য দেখেই তা অনুমান করা যায়। এই তথ্য অনুযায়ী বলা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি ছিল প্রচলিত পোশাক। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার রেওয়াজ আদিম কালে ছিল না। এই সেলাই বিহীন অখন্ড বস্ত্র পুরুষের ক্ষেত্রে “ধুতি” এবং মেয়েদের বেলায় “শাড়ি” নামে অভিহিত হয়। বয়ন শিল্পের উৎপত্তির সঙ্গে শাড়ির সংযোগ রয়েছে। তখন যেহেতু সেলাই করার কৌশল জানা ছিল না তাই সেলাই ছাড়া টুকরা কাপড় পরাই ছিল শাস্ত্রীয় বিধান।


১৯৩৪ সালে ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছবি। এতে নারীদের পরিধেয় শাড়ি লক্ষনীয়।

দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের নারীরা শাড়িকেই নিজেদের পরিধানের প্রধান বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে। মোগলদের মধ্যে সম্রাট আকবরই ভারতবর্ষের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতায় শাড়িতেও মোগলাই আভিজাত্যের সংযোজন। মোগলদের আগ্রহের জন্য মসলিনের শাড়ির উপস্থিতিও থাকত জেনানা মহলে। মোগলদের জন্য মসলিন কাপড় সংগ্রহের জন্য সরকারি লোক নিয়োগ দেওয়া হত। আর সম্ভবত মোগল আমলে শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরিধানের রীতি চালু হয়। তবে সেসময় শাড়ি পড়া হত এক প্যাঁচে।


বা দিক থেকে মীরা, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিমা ও বেলা, ১৯১০ সাল। এই সময়ের শাড়িগুলোতে খেয়াল করলে দেখা যাবে তাতে কোনো কুচি নেই।

উনিশ শতকের চল্লিশ দশক থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে বলা হয়ে থাকে ‘ভিক্টোরিয়ান যুগ’। এ যুগে ফ্যাশনের মূল কথাই ছিল কাপড়ে সারা শরীর ঢাকা থাকতে হবে। ব্রিটিশদের সংস্পর্শে থাকা জমিদার ও স্থানীয় ধনীদের পোশাক-পরিচ্ছেদেও ভিক্টোরিয়ান ফ্যাশনের স্টাইল যোগ হয়। এ সময়ে শাড়ির সঙ্গে ফুলহাতা ব্লাউজ এবং পেটিকোট পরার চল শুরু হয়। এই রীতিতে শাড়ি পরাটা বাঙালি নারীর চিরায়ত এক প্যাঁচে শাড়ি পরার ধারণাকে সম্পূর্ণ পালটে দেয়।
ভারত বিভাগের পূর্বে এদেশে নারীরা আধুনিক শাড়ি পরার চলন-বলন শিখেছেন মূলত ঠাকুর বাড়ির কল্যাণে৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর অবদানের কথা এক্ষেত্রে স্মরণ করতে হয়৷ স্বামীর কর্মস্থল বোম্বাই থাকাকালে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শাড়ি ও জামার নমুনার নানা রকম পরিবর্তন করেন।

গুজরাটি মেয়েরা যেভাবে শাড়ি পরে তার কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে ডান কাঁধের বদলে বাম কাঁধে আঁচল নিয়ে শাড়ি পরার প্রচলিত সে রূপটি আমরা আজকের দিনে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান মেয়েদের দেখি তা জ্ঞানদানন্দিনীরই আবিষ্কার। শাড়ির নিচে সায়া, সেমিজ, জামা ব্লাউজ পরার চলটি জ্ঞানদানন্দিনীই অবিভক্ত বাংলায় প্রবর্তন করেছেন।

শাড়ির স্টাইলিস রূপটি আমরা দেখতে পাই ৬০’এর দশকে৷ কারণ ফ্যাশন বা লুক যাই বলি না কেন সাজ-পোশাক নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট এ দশকেই দেখা যায়৷ সুচিত্রা সেন অথবা শর্মিলা ঠাকুরের শাড়ি পরার স্টাইল আজও বাঙালি হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়।

আজকাল শাড়ির জায়গায় পাশ্চাত্য পোশাকে নারীকে বেশি দেখা যাচ্ছে, এ প্রসঙ্গে একজন নারী বলেন, ‘মেয়েরা আজ আর ঘরে বন্দী থাকে না। তারা আজ পুরুষের পাশাপাশি বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে ড্রাইভিং পর্যন্ত করছে। তাতে শাড়ি তো সমস্যা বরং জিনস আর টি শার্টই কাজের ক্ষেত্রে সহায়ক।’ ২০০০ সালে এসে নতুন সহস্রাব্দ আমাদেরকে ব্যাপকভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় বিশ্বায়নের সঙ্গে। এই বিশ্বায়নই আমাদেরকে একে অপরের কাছে নিয়ে আসে। কাছে নিয়ে আসে সংস্কৃতি এবং মানুষদেরকে,  যা কিনা এর আগে কল্পনাও করা যায়নি। উন্নত প্রযুক্তির কল্যাণে আজকের ফ্যাশন হচ্ছে বিভিন্ন উপাদানে প্রস্তুত এক নতুন ধারা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পোশাক নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে; এবং ভবিষ্যতেও হতে থাকবে। বলা যেতে পারে-শাড়ির কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, তা বলা যাবে না। ভারতবর্ষের নারী তথা বাংলার নারীরা যুগ যুগ ধরে শাড়িকে তার প্রধান পরিধেয় বস্ত্র হিসেবে আঁকড়ে রেখেছে।

 

 

ছবি ও তথ্য সূত্রঃ ইন্টারনেট

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত