| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোট গল্প: প্রতীক্ষা । সৈয়দা শর্মিলী জাহান

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট
” ও বিজুর মা , বাসায় আছো নাকি?”
ঘরের ভেতর বসে ছোট কন্যার চুলে বিনুনি কাটছিলো বিজুর মা। কপালে তিন কুঞ্চন ফেলে বিরক্তি সহকারে জবাব দিলো “জে আছি।” জায়গা থেকে একচুল নড়লো না সে। বসে বসে গজগজ করে কি বললো তা ঘরের অন্য কেউ বুঝলো না। 
ওদিকে বৃদ্ধ সৈয়দ নূরুল হক ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘরের বাইরে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে রইলেন বিজুর মা’র অপেক্ষায়। ১৫/১৬ মিনিট পর ঘরের বাইরে এসে কপালে সেই তিন কুঞ্চন নিয়েই জিজ্ঞেস করলো বিজুর মা “কন চাচা কির লিগা আইচেন।”
“কইচিলাম যে, আমার পুলা-মেয়ারা আইবো ডাকা থিকা। তুমি, তুমি কি ইকটু রান্দা পারবা অগো জন্যে? জানোই ত আমি একলা মানুষ…”
“না চাচা, আমি পারুম না। আপনের পুলা-মেয়ারা আমারে পছন করে না। আপনে অন্য কেউরে কয়া দেহেন।”
বিজুর মা’র কথা সত্যি; কিন্তু ও রাজি না হলে কাকে বলবে এখন এ কথা? বাজারের শেষ মাথায় সড়কের এক ধারে বড়ো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি হওয়াতে পাড়ায় কাজের লোক পাওয়া এখন দায় হয়েছে। রহিম নামের একটি ছেলে দেখভাল করে তাকে,  প্রতিদিন রাঁধে তার জন্য, সে রান্না কোনোমতে গিলে নেয় বৃদ্ধ; কিন্তু ছেলে-মেয়েরা রহিমের রান্না খেয়ে হৈ চৈ শুরু করে দেবে। চিন্তিত মনে মৃদুপায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকেন তিনি কাকে বলা যায়? তার স্ত্রী গত হয়েছেন আজ দুই বছর।
ছেলে-মেয়েরা সব ঢাকায় কর্মজীবন আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সে-ই যে সবাই একসাথে দু’বছর আগে এসেছিলো মা’র মৃত্যুর সময় এরপর আর একত্রে আসেনি কেউ। মাঝেসাঝে ফোন করে খবর নেয় বৃদ্ধ পিতার। সৈয়দ সাহেবের এতো বড়ো ঘর-বাড়ি খাঁ খাঁ করে মানব শূন্যতায়। ঐ রহিমটা ছিলো বলেই দম বন্ধ হয়ে মরে যাননি এখনো তিনি। সম-সাময়িক বন্ধু-বান্ধবেরা কেউ গত হয়েছেন, কেউ ঢাকায় ছেলে-মেয়েদের সাথে থাকতে চলে গেছেন, কেউ অসুস্থতা জনিত কারণে বিছানায়! তাই অবসরে জামিলের টং দোকানের সামনে ধূমায়িত চা খেতে খেতে আগের সেই মনখুশি করা আড্ডাটা আর জমে না।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন জামিলের  টং দোকানের  কাছাকাছি এসে পড়লেন টের পেলেন না তিনি। সেখানে বহুদিন পর একসময়ের আড্ডার সঙ্গী আবু বকরের দেখা পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে প্রশ্ন করলেন “আরে আবু ভাই যে! কবে আইলেন ঢাকাত থিকা?” 
“হ আইলাম তো! বাকি সাবরা কনে সবাই? কেউরেই তো দেখতাছি না।”
“সবারই এহন এক অবস্থা। আল্লারে ডাকন ছাড়া আর কুনো কাজ নাই। তা ঢাকায় আপনার পুলা-মেয়ারা সবাই আছে তো বালো?”
“হঅ জমি-জমা ভাগ কইরা দিছি সব, এহন তারা বালো আছে। হায়রে যন্ত্রণা গেছে কয় বচ্চর এই জমি ভাগ নিয়া।”
“হ আমিও জ্বলতাছি ঐ একই জ্বালায়; কিন্তু জমি আমি ভাগ কইরা দিমু না। জমি ভাগ করামাত্র তারা বাপ-দাদার জমিন বেইচ্চা ঢাকায় যে শিকড় গাইরা বইবো তো বইবোই, এইদিকে আর আইবো না। তারপর আমারে ঢাকায় নিয়া চাইর ভাই-বইনে করবো কামড়াকামড়ি। কয়দিন থাকন লাগবো এর ঘরে কয়দিন তার ঘরে। আমি হেই সুযুগ দিমু না। তারচেয়ে বাপ-দাদার স্মৃতি নিয়া একলা নিজের ঘরে পইড়া আছি তাই বালো। আমি মরার পরে তারা যা করে করুগ গ্যা।”
“কথা মন্দ কন নাই। তয় আপনে শক্ত মনের মানুষ তাই পারছেন। আমার এতো ব্যাজাল বাল্লাগে না। দিছি জমিন ভাগ কইরা।  আমার দুই পুলার বউগুলা পাইছি বালো; তারা শ্বশুর শাশুড়িরে অমান্য করে না ।”
“আপনার কপালডা খুব বালো আবু ভাই।” বলে অশ্রুশূন্য বেদনে উঠে দাঁড়ান সৈয়দ নুরুল হক। দীর্ঘদিনের পুরোনো আড্ডাটা আর জমলো না। আবু বকরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলেন তিনি। 
বাড়ির আঙিনায় পা দিতেই কুয়ার পাড়ে পেঁপে গাছের দিকে নজর গেলো তার। “হায় হায় পাকা পেঁওপ্যা দুইডা নিলো ক্যারা? কতো পাহারা দিয়া দিয়া পাকাইলাম! ওই রহিম তুই কনে? দেহস নাই ক্যারা করলো এই আকাম? রহিম…ওই রহিম ! 
রান্নাঘরে লাকড়ি চুলায় কিছু রাঁধছিলো রহিম। কাঠপোড়া ধোঁয়া থেকে চোখ বাঁচাতে ব্যস্ত সে। সে অবস্থায়ই নাক-চোখ কুঁচকে জবাব দিলো  ” হায় হায় কি কন! আমি তো রান্ধন ঘরে আছিলাম! কেডায় করলো এই আকাম? আল্লার গজব পড়ুক তার উপ্রে।”
সৈয়দ সাহেব কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন কালিঝুলি মাখা রহিমের ময়লা গেঞ্জিটার দিকে। পাকা পেঁপের কমলা রঙের রসালো আঁশের গলিত ক্ষুদ্র একটি অংশ লেপ্টে আছে সেখানে। অন্য সময় হলে রেগে যেতেন এমন মিথ্যাচারে, কেন যেন আজ তার কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। বাড়ির চারপাশে নজর বুলালেন। বুনো বটগাছের চারা গজিয়ে শেকড় প্রশস্ত হচ্ছে বাড়ির এখানে সেখানে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট ছোট পদক্ষেপে ফলবাগানে এলেন তিনি। 
শেষ বিকেলের সোনারোদ এসে বিদায় জানাচ্ছে সৈয়দ বুড়োর ফলজ গাছ-গাছালীকে। বুড়ো বাগানময় হেঁটে হেঁটে হিসেব কষছেন কোন গাছের কতো ফল হলো। সারা বছরই ছেলে-মেয়ের জন্য কড়া পাহারা দিয়ে রাখেন মৌসুমী পাকা ফলমূলেগুলোকে; যাতে পাড়ার দুষ্ট ছেলে-মেয়ের দল ওগুলো নিতে না পারে। আগামীকাল ছেলে-মেয়েরা সবাই আসবে,  ছুটোছুটি করে গাছ থেকে ফল পেড়ে মজা করে খাবে ভেবে বুড়োর মুখে হাসি ফোটে। পরক্ষণেই ভাবলেন বাজার সদাই সবই করা আছে কিন্তু রান্না করাবেন কাকে দিয়ে? একে-তাকে আর অনুরোধ করতে ইচ্ছে হলো না। সিদ্ধান্ত নিলেন আগামীকালের জন্য তিনি নিজেই রাঁধবেন। যুবা বয়সে তার হাতের রান্নার সুনাম ছিলো বন্ধু মহলে। ঐ রহিমটা কুটনা-বাটনা করে এটা সেটা এগিয়ে দিলে কষ্ট হবে না তেমন। 
পরদিন ভোরে উঠেই রহিমকে ঘুম থেকে তুলে কোনো রকম নাস্তা সেরে রান্না-বান্নার কাজে নেমে পড়লেন তিনি। ধীরে ধীরে সৈয়দ বাড়ির হাওয়ায় মশলামিশ্রিত মাংস-পোলাওয়ের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।
“দাদাজান আপনের মুবাইলে দ্যাহেন কয়ডা মিসকল! আপনে মুবাইলডা কাছে নিয়া রানতে বইবেন না?”
“কাম সারছে! পুলা-মেয়ারা মনে অয় ফুন করছে। ধরবার পারি নাই। কামের ঠ্যালায় মনেই আছিলো না মুবাইলের কথা।” ফোন হাতে নিয়ে বড়ো ছেলের নাম্বারে ফোন করলেন তিনি। ওপাশ থেকে ফোন ধরতেই বলে উঠলেন
“কহন আইবি তরা? আর কতো দেরি অইবো?”
“আব্বা গতকাল কি বলছি মনে আছে তো? জমি-জমা ভাগ-বন্টনের বিষয়ে আলাপ করছেন তো সবার সাথে? আজ কিন্তু সবাই ঐ উদ্দেশেই যাবে।”
“হ হ মনে আছে। আয় তরা।”
ফোন রেখে রান্নার কাজ শেষ করে আড়মোরা ভেঙে উঠে দাঁড়ালেন বুড়ো। বেলা বেড়ে সূর্য ঠিক মাথার উপর এখন। চোখ পিটপিট করে আকাশে তাকাতেই ঝিকিয়ে উঠলো সূর্যটা। চোখ নামিয়ে কলপাড়ে গিয়ে গোছল সেরে বারান্দার চেয়ারে বসে ছেলে-মেয়েদের অপেক্ষায় রইলেন তিনি। কিছুক্ষণ পর পরই উঁকি মেরে রাস্তা পানে তাকাচ্ছেন। একটি পাতাঝরার শব্দেও চমকে উঠছেন । অবশেষে অপেক্ষার পালা ফুরালো। পিপ্ পিপ্ পিপ্ শব্দে তিনটি সাদা প্রাইভেট কার থামলো বাইর বাড়ির উঠোনে। বুড়োর চোখে রূপালি জলবিন্দু খেলা করতে লাগলো ।
গাড়ি থেকে নেমে একে একে ঘরে প্রবেশ করলো ছেলে-মেয়ে, ছেলের বউ, মেয়ে জামাই আর নাতি-নাতিনরা। রহিম একটি বড় কাচের জগে করে কাগজি লেবুর শরবত পরিবেশন করলো। কেউ তেমন একটা কথা বলছে না; অনেকটা থমথমে সবাই। কেবল সৈয়দ বুড়ো উচ্ছ্বসিত কন্ঠে নাতি-নাতনিদের সাথে খুনসুটি করছেন। বাচ্চাগুলোও নানা-দাদা ডেকে ডেকে চারপাশ ঘিরে আছে বুড়োর। ছোটো পুত্রের দেড় বছরের কন্যা মানহার হাতে একটি লাল টুকটুকে ঝুমঝুমি তুলে দিলেন বুড়ো। গেলো বৈশাখী মেলা থেকে কিনেছিলেন নাতির জন্য। ছেলে-মেয়েরা নিজেদের ভেতর ফিসফাস করে বলছিলো কিছু; সেই সাথে এর-তার মুখ চাওয়া-চাওয়ি। অবশেষে উচ্চস্বরে মুখ খুললো বুড়োর ডাক্তার বড়ো ছেলে “আব্বা বহুদিন পর সবাই একত্রিত হয়েছি। জমি-জমা সংক্রান্ত আলাপ সেরে ফেলতে চাচ্ছি। আপনাকে তো আগেই জানিয়েছিলাম এ বিষয়ে। কী সিদ্ধান্ত নিলেন? কাকে কোন অংশ দেবেন?”
বুড়ো জবাব দিলেন না; তিনি ছোট্ট মানহাকে নিয়ে ব্যস্ত। বড়ো ছেলে উচ্চস্বরে আবার জিজ্ঞেস করলো “আব্বা, জমি কাকে কোন অংশ দেবেন? আমরা জানতে চাই।”
“সব সময় এতো জমি জমি করস ক্যান রে তরা? কি করবি এতো ধন-সম্পদ দিয়া? তগো কি কম আছে ঢাকায়? বুড়া বাপটার কথা কি একবারও মনে অয় না। গত দুই বৎসর বাপটারে দ্যাখতে আসস নাই ঠিকমতো। ফুন করলেই খালি জমি জমি আর জমি। আমি কি জমি কবরে নিয়া যামু? এগুলা তো তগোই!” ফস করে মনের কথাগুলো বলে ফেললেন তিনি। 
চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো বড়ো ছেলে “কি বললেন এবারো জমির ফয়সালা করেন নাই? আমরা কি তবে ঘোড়ার ঘাস কাটতে আসছি! চল সবাই! আর এক সেকেন্ডও না এইখানে!” বলে ঘরের বাইরে বের হয়ে গেলো সে। তার পিছু পিছু বাদ বাকি সবাই বের হয়ে গেলো।
বুড়োর কোলে খেলছিলো ছোট্ট মানহা। অনেকটা ঈগলের মতো ছো মেরে মানহাকে নিয়ে বের হয়ে গেলো ছোটো ছেলের বউটা। মানহার হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেলো ঝুমঝুমিটা। আধো আধো বোলে বলতে লাগলো সে ও-ই, ও-ই ওতা দাও ।
সৈয়দ বুড়ো হকচকিয়ে গেলেন। এমন ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি; আকুল হয়ে ফেরাতে চেষ্টা করলেন ছেলে-মেয়েদের পিছু নিয়ে “বাবারা শুন আমার কথা। এমনে না খায়া যাইস না। আমি নিজ হাতে রানছি। ইট্টু খায়া যা। বাজান…খাড়া তরা…যাইস না! জমি তো তগোই । আমি কি সম্পদ কব্বরে নিয়া যামু? কতো দিন পরে আইলি তরা…আল্লার দোহাই যাইস না ” 
ছেলে-মেয়েদের ক্রোধান্বিত মন তাতে গললো না, আকুল হয়ে বলা কথাগুলো পৌঁছলোও না  ঠিকমতো তাদের কর্ণকুহরে! চারচাকার যানগুলো ধূলো উড়িয়ে পিপ্ পিপ্ শব্দ করে চলে গেলো। সৈয়দ বুড়ো তাড়াহুড়া করতে গিয়ে শুকনো ঝুরঝুরে বেলে মাটির উপর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। ভূপাতিত শরীরের আঘাতে চোখের সামনে ধূলো উড়ছে তার। চোখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেললেন তিনি; ধূলো উড়িয়ে আড়াল তুলে ছেলে-মেয়েদের এহেন অপমাণ প্রকৃতি যেন আড়াল করতে চাইছে । 
ধূলো-বালিময় মাটি থেকে উঠার কোনো চেষ্টা করলেন না সৈয়দ বুড়ো। ছোট্ট মানহার আদুরে হাসিখুশি মুখটি ভাসছে মানসপটে। অশ্রুশূন্য বেদনে অস্ফুটে বলতে লাগলেন “দাদুভাই আবার আইসো… আবার আইসো…” কম্পমান হাতে লাল টুকটুকে ঝুমঝুমিটা  বাজাতে লাগলেন তিনি ঝুমঝুম ঝুমঝুম ঝুমঝুম!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত