| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

স্মরণ : অন্য চোখে দেখা

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

একজন সংগঠক,অভিভাবকক কিংবা খ্যাতির আড়ালে কেমন ছিলেন নবনীতা দেবসেন? তাঁর করা সংগঠন ‘সই’ করতে গিয়ে কেমন দেখেছেন তাঁকে ইরাবতীর পাঠকদের জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ


কিংবদন্তী কাছে এলে চুপ হও একা একা। তার আগে বেশ কয়েক বছর থেকে ফেসবুক বন্ধু, চিরকালীন স্বভাব আমার সেলেব থেকে দূরে থাকা , সাধারণ মানুষের সিম্পটম পাছে লোকে ভাবে বিচ্ছুরিত আভায় উদ্ভাসিত হবার চেষ্টা। তাই ঐ জন্মদিনে শুভেচ্ছা বার্তাটুকু পাঠিয়েই ক্ষান্ত। নো ইনবক্স। এমনই চলছিলো ।একদিন হঠাৎ হাতে এল ঠিকানা। আমার পেন ফ্রেন্ড ছিল কত স্কুল জীবনে। প্রচুর চিঠি লিখতাম। আত্মীয় বন্ধু অবন্ধু ভালোলাগা মানুষদের। কেউ উত্তর দিত কেউ সময় পেত না। চিঠি পাওয়া মাত্র ওনার ফোন। ভাবিও নি। প্রথমবার শুনে ভাবলাম ভুল শুনেছি। আবার জানতে চাওয়া , পারডন। নির্ভুল সেই স্বর। স্লাইট হাস্কি। তুমুল অথরেটিটিভ। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে দুজনেরই সেদিন মন খারাপ। বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তী সিনারিও কি হয় কি হয় আবহ পরিবর্তন অভিঘাত টালমাটাল স্বপ্নভঙ্গ পরপর ঘটে চলেছে তার ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে তামাম হোদবোধ , চিন্তা উদ্বেগ ভাগাভাগি হয়ে গেল প্রথম সাক্ষাতেই। মেসেজে টুকটাক বিনিময় , সাক্ষাৎ। প্রথম যেদিন মুখোমুখি হওয়া সেদিনই মনে হল প্রথম লাইনটি। তারপর আরো জানা বোঝা গল্প মিথ পেরিয়ে রক্তমাংসের নবনীতা কখন যে পরাণের সই।
তিনি শুধুই উচ্ছল প্রাণবন্ত মজারু সুন্দরী বুদ্ধিমান মানুষ নন তারও এক স্বাভাবিক মানবিক মুখ স্নেহ ভালোবাসা ক্রোধ শোক অভিমান থাকতে পারে তা তো সাহচর্য না পেলে পুরোপুরি বোঝা যায় না। গ্ল্যামারাস উপস্হিতি ভুবন ভোলানো হাসি অগাধ জ্ঞান অপরিসীম অভিজ্ঞতা চূড়ান্ত রসবোধ জীবন সম্পর্কে মাই ডিয়ার ক্যাজুয়াল দৃষ্টিভঙ্গী সর্বজনীন দিদিত্ব এই তার ইউ এস পি। প্রচুর স্মৃতিচারণের ভিড়ে সামান্য মানুষের অসামান্য স্মৃতিমেদুর সঞ্চয়টুকু গরীবের বিস্কুট খাওয়ার মত একটু একটু ভেঙে খরচ করাই তবে ভবিতব্য।বাড়ির টবের ফুল গাছ পোষা মুরগী মোরগ কুকুর বেড়াল পথের কল পুরনো পাড়া মানুষ বন্ধু স্মৃতি মা বাবার আদুরে কন্যার দুষ্টুমি ভাই বোন কানাই আতিথেয়তা বৌমা সবাইকে নিয়ে জড়িয়ে মরিয়ে মায়ার সংসার তার ব্যক্তিগতকে রসিকতায় মুড়িয়ে অপূর্ব গদ্যভাষা মায়াবী পদ্য সাবজেক্টিভ অবজেক্টিভ সমাজ পরিবেশ মিলে মিশে এক সচেতন ভোকাল মানুষ কোন অন্যায়ের বিরূদ্ধে বলতে তার গলা কখনো কাঁপে না চোখ মন মস্তিষ্ক কখনও ঘুমোয় না কখনো নড়ে যায় না মতবাদ তিনি চির বিশ্ব মানব ( মোটেই খিল্লি করে বলা নয় ) প্রতিবাদী যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনই হোক বা মানবতার উপর আঘাতই হোক , মেয়েদের সমস্যাই হোক বা লিঙ্গবৈষম্যই হোক , পুরানের চরিত্রকে গবেষণার নব আলোকে নির্মাণই হোক তার প্রেজেন্টেশান তার মরমীয়়া মন তার সাবলীল নিরহংকার আভিজাত্যকে কখনো আড়াল করে না। কোন নীচতা গ্রাস করে না তাকে। জীবন যন্ত্রণা শেষ করতে পারে না তাকে। বর্ণহীন করতে পারে না তাকে , কোন লড়াই দমাতে পারে না তার জীবনবোধ।তিনি স্বাভাবিক ভাবেই রোল মডেল হয়ে ওঠেন কয়েক প্রজন্মের। অজান্তেই অনুপ্রাণিত করে অদম্য প্রাণবন্ত পজিটিভিটি সংস্কার মুক্ত উদার আলোকিত মনন অফুরান প্রাণ।
রোগ শয্যা বলে তেমন কিছু ছিলনা তার অথচ সারা জীবন কেটেছে রোগ কবলিত। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া খ্যাতি ভাঙিয়ে জীবন কাটে নি তাঁর তিনি র্নিমাণ করেছেন আরো আরো নতুন মিনার। বলতে গেলে ফুরোয় না , তিনি অনির্বান , সময়কে চ্যালেঞ্জ করেছেন জীবনকে চেলেছেন অপার দানে। অসংখ্য সৃষ্টিশীল কাজের পাশাপাশি তাঁর ‘সই’ পরিচালনা , নতুন অভিজ্ঞ সম্মিলনে একাত্ম আপন করে নেওয়া প্রচুর প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া পরের প্রজন্মকে তুলে ধরা প্রকাশ হবার সুযোগ দেওয়া তাঁর অধ্যাপিকা সুলভ ধারার মধ্যেই পড়ে। তিনি নিজেই একটি যুগ , অনন্ত বিস্ময় ।
একাশি বছরের বেশিরভাগটাই অতি অর্থবহ ভাবে দিয়ে গেলেন সভ্যতাকে , আজ সময় ফিরিয়ে দেওয়া ভালোবাসাকে ভালোবাসা | বিন্দুতে কি আর সিন্ধু ধরে। লোক হাসিয়ে সে চেষ্টা না করাই ভালো। শুধু বলি এই অস্হির পাপবৃত্তে তাঁর মত দু একটি মহীরুহ এখনো বাতাস নির্মল করার জন্য অনলস দিয়ে যান বলেই জেগে ওঠে আশা ভরসা নামের দ্বীপ। খুব ভাবতেন , কি হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের , খুব চিন্তায় ছিলেন হিংসা উন্মত্ত পৃথিবী নিয়ে। আমাদের সামান্যতম ট্রিবিউট হবে আজ সেগুলো তুলে এনে আলোচনা করা , তাঁর দেখানো পথে ভাবা প্র্যাকটিস করা। পারলে আওয়াজ তোলা পারলে উদ্বুদ্ধ করা এক অসম লড়াইয়ে , হার হতে পারে , হতেই পারে , তিনিই তো শেখালেন ‘দুবেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।’

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত