| 28 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত কবিতা

অনুবাদ কবিতা: শ্যারন ওল্ডসের পাঁচটি কবিতা । সায়মা মনি

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

শ্যারন ওল্ডস একজন মার্কিন কবি যিনি ১৯৮০ সালে প্রথম স্যানফ্রান্সিসকো পুরষ্কারে ভূষিত হন। তিনিই প্রথম মার্কিন নারী কবি যিনি টি.এস.এলিয়েট পুরষ্কারেও পুরষ্কৃত হন তার কবিতার জন্য। এরপরে ২০১৩ সালে পুলিৎজার পুরষ্কার পেয়ে সবার নজরে আসেন। তবে তার কবিতার বিষয়বস্তু আর তার সাবলীল উপস্থাপনা এসব পুরষ্কার ছাড়াও নজরে নিয়ে আসার যোগ্যতা রাখে। ছোটবেলা থেকেই নানান ধরনের পারিবারিক অত্যাচারের স্বীকার হন মদ্যপ পিতার কারনে। তার কবিতায় তার ব্যক্তিগত জীবন যেভাবে উঠে আসে তা আমাদের জীবনকে সহজেই ছুঁয়ে যায়। পি এইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি সিদ্বান্ত নেন কবিতায় তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে নিয়ে আসার। পাঠক কিভাবে বিষয়টিকে নেবেন সেটা না ভেবেই।তার ফলেই আমরা তার কাছ থেকে এমন অসাধারন কিছু কবিতা পাই যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তিনি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সৃজনশীল লেখা বিষয়ে শিক্ষকতার সাথে জড়িত থাকেন। বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কে লুকোনো দিক, যৌনতা, নারীর প্রতি বৈষম্য প্রভৃতিই তার কবিতার মূল উপজীব্য।


 

আমার মায়ের জন্য
 
তুমিই আমার প্রথম সন্তান ছিলে সত্যিই।
যখন আমার বোনকে অতিথি কক্ষে নেয়া হলো
তুমি রাতে আমার কাছে আসতে শুরু করলে
যেন একটা শিশু
যে মায়ের বিছানায় আসা ছাড়া
রাতে ঘুমাতে পারে না
সুতরাং সেই সাত বছর বয়সেই আমি মা হয়ে উঠলাম।
একজন নার্স নবজাতককে তার মায়ের কোলে দিয়ে গেলে যেমন হয়।
মাঝে মাঝে তুমি এসে নিজেকে যেন আমার কোলে শুইয়ে দিতে।
তুমি একদম স্পঞ্জের মতো ছিলে যেন মনে হতো কোনো হাড়ই নেই
কোনো কিছুর থলি মনে হতো
ভেজা পালক তোমার চোখে কোথা থেকে এলো
শিশুর মতো ভালোবাসা।
কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই তোমাকে আমার কোলে তুলে নিলাম
আর নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম।
তোমার গাল আমার শক্ত ফিতার ন্যায় বুকে লেপ্টে
আছে।
এই সমতল স্তনবৃন্তে যেন তা রঙের একটা পোচ
একটা দাগ, যেখানে কিছু দেবতা তাদের বুড়ো আঙুলের ছাপ দিয়েছেন আলগোছে।
আমি অধৈর্য্য ছিলাম না।
তুমি ওর বিছানা থেকে যে সেদ্ধ ডিমের গন্ধ বয়ে নিয়ে আসতে, তাতে আমি বিরূপ হতাম না।
যা আমি চাইতাম তা হলো তোমাকে কেবল শক্তি ভরে দিতে
যেন তাপ বা কোনো রঙ তোমার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিতে
জীবনীশক্তি ভরে দিতে তোমার জীবনে
আমি কোথা থেকে এটা শিখলাম?
এটা আমি তোমার কাছেই শিখেছি
মাসের পর মাস তুমি যে আমাকে তোমার বুকের কাছে ধরে রাখতে আর আমাকে উষ্ণ করে রাখতে
প্রচুর পরিমানে দুগ্ধপান করাতে
মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে আমি কিছুই ভুলে যাইনি।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
নোংরার স্তুতিকাব্য
 
প্রিয় নোংরা, আমি দুঃখিত যে আমি তোমাকে সামান্য ভেবেছিলাম
আমি ভেবেছিলাম যে তুমি মুখ্য চরিত্রের পটভূমি মাত্র
বৃক্ষের, প্রানীর আর মানবপ্রানীর।
এটা যেন আকাশকে বাদ দিয়ে তারাদের ভালোবাসার মতো
যখন কিনা আকাশই তাদের জ্বলে ওঠার স্থান দিয়েছে।
সুক্ষ্ণ ও বৈচিত্রময় আর সংবেদনশীল,
তুমিই আমাদের ভূখন্ডের ত্বকের ন্যায়
তুমি আমাদের গণতন্ত্র।
যখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমি কখনোই তোমাকে সমানভাবে অস্তিত্বশীল বলে স্বীকৃতি দিইনি
আমি নিজেকে নিয়ে লজ্জা অনুভব করেছি।
যেন আমি আমার মতো নয় বলে একটি অস্তিত্বকে
স্বীকার করে নিইনি।
একটি অস্তিত্ব যা আমার থেকে একদমই আলাদা দেখতে,
কিন্তু আমি এখন আমাদের সবাইকে দেখতে পাই, একই মৌলিক উপাদানেই যে আমরা তৈরি।
সেই শুন্য থেকে প্রথম বিষ্ফোরনেরই জ্ঞাতিভাইয়ের মতো
আমাদের সকলের সমন্বিত জটিলতায় তা সমানভাবে বিরাজমান।
ও নোংরা, তোমার অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার পথ খুঁজে পেতে আমাদেরকে সাহায্য করো।
তুমিই সে, যে কিনা আমাদেরকে সামনে এগিয়ে দিয়েছো
আর আমাদেরকে খাইয়েছো
আর তুমিই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে তোমার অন্তর্ভুক্ত করে নিবে
আর আমাদের সাথেই আবর্তিতও হবে
আর আমাদের সাথেই চুর্ণ-বিচুর্ণও হবে
আবার বিবর্তিত হবে।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
পরিকল্পিত সন্তান
 
যেভাবে তারা আমাকে নিয়ে পরিকল্পনা করেছেন
তা আমি সবসময় ঘৃণা করতাম।
তিনি (স্ত্রী) তার (পুরুষ) জামা থেকে একটা পিচবোর্ড নিলেন
যেন তার (পুরুষ) মেরুদন্ডটা শরীর থেকে তুলে তাতে একটা মাস তালিকা তৈরি করলেন।
আর তাতে তার (স্ত্রী) তাপমাত্রা টুকে রাখেন।
উত্থান আর পতন
আমাকে তৈরি করার উপযুক্ত সময় জানতে।
আমি সবসময় উষ্ণতায় ধারিত হতে চেয়েছি
উদ্দামতায় আর ভুলে
ভালোবাসায় আর যৌনতায়
পিচবোর্ডে নয়।
এই উত্থিত সারিতে ছোট্ট এক্স
কখনোই আর পড়ে যায়নি
 
কিন্তু তখন তুমি মদ ঢালছো
যেন লাল আর শক্ত কাদামাটির দানা
অথবা রক্ত
ছোট ছোট জমাট বাঁধা রক্ত কনিকা
যা আমাদেরকে এই জীবনে উপনীত করেছে
আর তুমি বলো যে তুমি আমাকে কাঙ্খিত শিশু বলেই বলতে চাইতে
আমি আমার গালে মদ ঢালি যেন তা আমার মায়ের রক্ত
যেন আমার ঠোঁট দুটোতে চাপ দেয়ার মতো
তার (স্ত্রী) শরীরের সেই ভালভে চাপ দিয়ে
আমাকে আনা হয়েছে আলোতে
তিনি প্রসব বেদনা পাচ্ছিলেন আর মুখোশের ভেতর নিশ্বাস নিচ্ছিলেন
আবার প্রসবের চেষ্টা করছেন আর আমাকে চাপ দিচ্ছিলেন পৃথিবীতে আনার জন্য
কেননা তার পৃথিবী আমাকে ছাড়া অসম্পুর্ন ছিলো
চাঁদ নয়, সূর্য নয়, তারা নয়
কালপুরুষের দু’চাকার গাড়ি চালিয়ে সহজেই অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া
পৃথিবী নয়, সমুদ্র নয়
এর কোনোকিছুই তার জন্য যথেষ্ট ছিলো না
আমাকে ছাড়া।
 
 
 
 
 
 
 
অব্যক্ত
 
এখন আমি ভালোবাসাকে এক নতুন রূপে দেখতে পাই
এখন আমি জানি, আমি এর আলোতে দাঁড়িয়ে নেই।
আমি আমার প্রায় প্রাক্তন স্বামীকে না ভালোবাসা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে চাই
কিন্তু সে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি নয়
সে এই শেষ পর্যায়ে একটা স্থিরতা আশা করে
আর মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ইতিমধ্যেই আমি এখানে নেই- তার ত্রিশ বছরের দৃষ্টি আর ভালোবাসার দৃষ্টির সামনে।
আমি এক ধরনের অদৃশ্যমানতা অনুভব করি
যেন কনা শনাক্তকারী ফানেলে একটি নিউট্রন সমাহিত
এক মাইল দীর্ঘ বেগবর্ধক যন্ত্রের মাঝে
যেখানে অদৃশ্যকনাকে দৃশ্যমান কনার সাহায্যে অনুমান করা হয়।
নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পরে
আমি তাকে ডাকলাম
আমার হাত যেন শিল্পীর মতো
যে তার সাথে গান গায়
যেন তার মাংস পেশী গান গাইছে তার স্বরে
সুউচ্চ, অবিচ্ছিন্ন, ভরাট পুরুষ কন্ঠে
গুরুগম্ভীর বাদ্যযন্ত্রের ন্যায়।
আমি তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম
আমাকে ভালোবাসার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিলো
যখন তুমি আমার দিকে তাকাতে
তুমি কি দেখতে পেতে?
যখন সে (পুরুষ) আমাকে ভালোবাসতো
আমি পার্থিব কোনো কিছুর দিকে গুরুত্বহীনভাবে তাকাতাম যেন আমি এক গভীরতার বাসিন্দা খুব ভেতর থেকেই
যেন একটি খাদ বা অথবা একটি কুয়া
আমি উপরের দিকে তাকাতাম, দুপুরে আর কালপুরুষ দেখি জ্বলজ্বল করছে
যখন আমি ভাবি সে আমাকে ভালোবাসে
যখন আমি ভাবতাম আমরা শুধু দম নেয়ার জন্য সম্পর্কে ছিলাম না
বরং সুদূরপ্রসারী হবে ভেবেই ছিলাম
কঠিন আর সুন্দর আবরন, শক্ত ধারক আর পাথরের ন্যায় আর দ্রুততার সাথে
সে (পুরুষ) কোনো রাগ দেখালোনা
আমি কোনো রাগ দেখালাম না শুধু এক ঝলক কৌতুক করা ছাড়া।
সবটুকুই ভদ্রতার আর ভয়ের
আর প্রথম মিনিটের পর, যখন আমি বলি
এসব কি তার (স্ত্রী) সম্পর্কে?
সে(পুরুষ) বলে, না
এসব তোমার সম্পর্কে, আমরা তার (স্ত্রী) সম্পর্কে কথা বলি না।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
সীমানা
 
সে আমার ভেতরে অন্য এক পৃথিবী থেকে এসেছে, যদি বলি
তা সঠিক নয়।
এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে কিছুই আসে না
কিছু যায়ও না।
আমার মা অর্থাৎ আমার মেয়ে আমার ভেতরে প্রবেশ করেনি
সে আমার ভেতরে অস্তিত্বশীল হতে শুরু করেছে
সে আমার ভেতরে বিদ্যমান।
আর আমার মা আমার ভেতরে প্রবেশ করেনি
যখন তিনি শুয়ে থাকতেন
আর আমার জন্য প্রার্থনা করতেন
তিনি সব সময় ভয়ংকর রকমের নরম
আর ধর্মান্ধ, পিউরিটান ধর্মান্ধ হয়ে থাকতেন।
আমার ত্বকের সীমানা তাতে বাধা হতে পারতোনা
দেহের সীমানাও ব্যর্থ হতো, আমার স্পৃহার বাধাও।
তিনি আমাকে জাগিয়ে রাখতেন
আর আমাকে আকৃষ্ট করতেন
আমি যথাসাধ্য তাকে খুশি রাখতে চাইতাম
তিনি যা শুনতে পছন্দ করতেন, আমি তাকে তাই শোনাতাম
যেন আমি তারই ছিলাম
আমি স্বেচ্ছায় তার সেবায় নিয়োজিত ছিলাম।
আর তারপর আমি অনেকটা তার মতো হয়ে গেলাম।
আর তারপর আমি আমার জন্য মারাত্মক হয়ে উঠলাম।
যখন আমার মেয়ে আমার মধ্যে ছিলো,
আমি অনুভব করি, আমার ভেতরে একটি আত্মা আছে
তবে আত্মাটা তার ভেতরে জন্মেছে।
তারপর যখন সে কেঁদে উঠলো, এক রাতে
এত শুদ্ধ কান্না!
আমি বলে উঠি, আমি তার যত্ন করবো।
আমি তোমার বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দিবো
ওকে আমি তেমন করে কখনো বড় করবো না
যেমন ভাবে তিনি আমাকে করেছেন।
আমি তোমার মাঝে কখনো তেমনভাবে বিচরন করবো না
যেভাবে আমার মা আমার ভেতরে করেছেন
আর আমি নিজে আমার ভেতরে যেভাবে গ্রাস হয়ে গিয়েছি।
আমি আর কারো সাথে তেমন করে কোনো সম্পর্ক চাই না
যেমনটা আমার মায়ের সাথে আমার ছিলো
তেমন সম্পর্কের সুযোগ আর নেই।
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

One thought on “অনুবাদ কবিতা: শ্যারন ওল্ডসের পাঁচটি কবিতা । সায়মা মনি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত