অনুবাদ কবিতা: শ্যারন ওল্ডসের পাঁচটি কবিতা । সায়মা মনি
শ্যারন ওল্ডস একজন মার্কিন কবি যিনি ১৯৮০ সালে প্রথম স্যানফ্রান্সিসকো পুরষ্কারে ভূষিত হন। তিনিই প্রথম মার্কিন নারী কবি যিনি টি.এস.এলিয়েট পুরষ্কারেও পুরষ্কৃত হন তার কবিতার জন্য। এরপরে ২০১৩ সালে পুলিৎজার পুরষ্কার পেয়ে সবার নজরে আসেন। তবে তার কবিতার বিষয়বস্তু আর তার সাবলীল উপস্থাপনা এসব পুরষ্কার ছাড়াও নজরে নিয়ে আসার যোগ্যতা রাখে।ছোটবেলা থেকেই নানান ধরনের পারিবারিক অত্যাচারের স্বীকার হন মদ্যপ পিতার কারনে।তার কবিতায় তার ব্যক্তিগত জীবন যেভাবে উঠে আসে তা আমাদের জীবনকে সহজেই ছুঁয়ে যায়।পি এইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি সিদ্বান্ত নেন কবিতায় তার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে নিয়ে আসার।পাঠক কিভাবে বিষয়টিকে নেবেন সেটা না ভেবেই।তার ফলেই আমরা তার কাছ থেকে এমন অসাধারন কিছু কবিতা পাই যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।তিনি ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যানুরাগী ছিলেন।পরবর্তীতে তিনি সৃজনশীল লেখা বিষয়ে শিক্ষকতার সাথে জড়িত থাকেন।বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কে লুকোনো দিক, যৌনতা, নারীর প্রতি বৈষম্য প্রভৃতিই তার কবিতার মূল উপজীব্য।
টানাটানি এখন প্রতি ঘন্টায় সে বদলে যাচ্ছে, কিছু পুরনো সক্ষমতা খসে পড়ছে হাঁটু পর্যন্ত শরীর টিনের মতো রঙ, কালো আর ধূসর রঙের চুল গ্রীজের মতো কিছু নিত্য আচারের প্রলেপে পুরু হয়ে উঠেছে, আমার বাবা চলছেন, ঘন্টায় ঘন্টায়, প্রথমে মাথা, মৃত্যুর দিকে, আমি আমার ভেতরে তার মৃত্যুর দিকে আগানোর প্রতি ইঞ্চি বুঝতে পারি, যেভাবে প্রত্যেক শিশু নড়াচড়া করে, ধীরে, আমার শরীরের ভেতর দিয়ে যায়, যেন আমার ভেতর দিয়ে নদীকে টেনে তোলা হচ্ছে আর আমি সেটা ঈশ্বরের মতো অনুভব করছি, এবং পৃথিবী চাপ দিচ্ছে, এই বিশ্বভ্রম্মান্ড নিজেকে আমার ভেতর দিয়ে ভারি করে সহজেই টেনে তুলছে, একটি রুমালকে আংটির ভেতর দিয়ে নেয়ার মতো করে যেন টেনে তুলছে আমার ভেতর দিয়ে, যেন আমার বাবা নিরাপদে আমার ভেতরে বাঁচতে পারতেন আর মরতে পারতেন। সবটুকু আমরা বেশিরভাগ মানুষই কখনো ধারন করিনা আমাদের মধ্যে অনেকে কখনো জন্ম গ্রহন করেনা আমরা ঘন্টা, সপ্তাহ ধরে আমাদের ব্যক্তিগত সমুদ্রেই থাকি আমাদের অতিরিক্ত বা হারানো অঙ্গ সাথে নিয়ে অথবা আমাদের দুর্বল দ্বিতীয় মাথাটিকে শক্ত করে ধরে রেখে আমাদের বুক থেকে জন্ম, আমাদের বাহুতে আর আমাদের মধ্যে অনেকেই এর কান্ডে গড়ে ওঠা সমুদ্রফল, সামুদ্রিক শ্যাওলা, চাকার স্বপ্ন দেখে যা আমাদের আগের মাসগুলোতে সংগৃহীত। এবং কেউ কেউ আছে যারা মুহুর্তের জন্য জন্মগ্রহন করে অন্যরা দুটি বা তিনটি গ্রীস্মকালের জন্য অথবা চারটি আর যখন তারা চলে যায় সবকিছু চলে যায় পৃথিবী মহাকাশ যেখানে কিছুই নেই সেখানেও ভালোবাসা থেকে যায় আর তা খোঁজে। প্রথম ঘন্টা আমি সবচেয়ে বেশি নিজের মধ্যেই ছিলাম ওই সময়টায়। আমি আমার মাকে ধীরে সরিয়ে নিলাম। একটু হেলান দিয়ে আমি প্রথম নিঃশ্বাসটুকু নিলাম ওই ঘরে বাতাস যেন আমাকে বাবলের মতো প্রবাহিত করছিলো যতদুর চোখ যায়, সেই দৃষ্টিরেখার সীমানা ধরে আমাকে যেতে হয়েছিলো আবার ফিরে আসতে হয়েছিলো। আবার গিয়ে আবার ফেরা। মহাকর্ষের সীমানা ধরে প্রবল বায়ুপ্রবাহ আমাকে যেন আদরের স্পর্শ করছিলো। তার মাখনের মতো রক্তের ঘ্রান পাচ্ছিলাম। বাতাস খুব আলতো করে আমার ত্বক আর জিহবা স্পর্শ করছিলো। বাতাস আমার ভেতরে প্রবেশ করে ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস বের করে নিয়ে আসছিলো, যা আমার ছিলো কিনা আমি জানিনা। আমি ভীত ছিলামনা। আমি শান্ত হয়ে শুয়ে তাকালাম আর শব্দহীন চিন্তায় ডুবে গেলাম। আমার মন সরাসরি অক্সিজেন নিচ্ছিলো, আর মুখে তার একটা সমৃদ্ধ মিশ্রন ঘটলো। আমি কাউকে ঘৃনা করিনা। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম আর সবকিছু মজার মনে হলো। আমি স্বাধীন, এখন আর কাউকে ভালোবাসিনা আমি কারো ছিলামনা। আমি দুধ পান করিনি এমনকি কেউ আমার হৃদয়ে ছিলোওনা। আমি খুব একটা মানুষের মতো ছিলাম না। আমার জন্য কেউ ছিলো বলে জানতামও না। আমি ঈশ্বরের মতোন করে এক ঘন্টা যাবৎ শুয়ে আছি। তখন তারা আমার কাছে আসলো আর আমার মাকে নিয়ে গেলো। ভালোবাসাহীন যৌনতা কিভাবে ওরা করে, একজন মানুষ কি করে ভালোবাসা ছাড়াই যৌন সম্পর্কে স্থাপন করে? বরফে ভর দেয়া চালক বরফের উপরে যেমন সুন্দর করে চলে ঠিক তেমন করে একে অন্যের উপর দিয়ে গড়িয়ে যায় যেন নর্তকী। আঙ্গুলের বোঁটার মতো একে অন্যের শরীরের ভেতরে জড়িয়ে থাকে মুখগুলি মাংসের পুরু ফালির মতো লাল মদ যেন নবজাতক যাদের মায়েরা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে এখনই। কিভাবে তারা আসে আর আসে আর আসে ঈশ্বরের কাছে আর শান্ত পানির কাছে কিন্তু ভালোবাসার কাছে আসেনা অথচ তারা ভালোবাসা নিয়েই এসেছিলো। তাদের যৌথ ত্বকের বাষ্পের মতো কি আলো ধীরে ধীরে উঠে আসে? এরাই হলেন সত্যিকারের ধার্মিক, প্রকৃতিবাদী, জয়ী এরাই হলেন তাহারা, যারা মিথ্যুক মূসাকে গ্রহন করবেনা আর ঈশ্বরের পরিবর্তে এরা পাদ্রীকে ভালোবাসেন। তারা তাদের আনন্দের জন্য প্রেমিক বা প্রেমিকা খুঁজতে ভুল করেন না। তারা মহান দৌড়বিদের মতো। রাস্তার উপরিভাগের সাথে যে তারা একা সেটা তারা জানেন। ঠান্ডা,বাতাস, তাদের উপযুক্ত মাপের জুতা, সর্বোপরি তাদের হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যই শুধুমাত্র বিবেচ্য বিষয় যেমন বিছানায় সঙ্গীই বিবেচ্য বিষয় এবং সত্যিটা বিবেচ্য বিষয় নয় কেননা এটিই বিশ্বভ্রম্মান্ডে একমাত্র শরীর যা এর সবচেয়ে ভালো সময়টিতেও একলাই থাকে। ক্ষতির উর্ধ্বে বাবা মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে হঠাৎই আমি উপলব্ধি করি আমার জন্য তার ভালোবাসা কতোটা নিরাপদ ছিল। কোনোকিছুই একে স্পর্শ করতে পারতোনা। গত বছরেই আমি ঘরে প্রবেশ করলে কখনও কখনও তার মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। আর তার স্ত্রী বললেন, একদিন নাকি অর্ধঘুমন্ত অবস্থায় তার স্ত্রীর মুখে আমার নাম শুনে তিনি হেসে উঠেছিলেন। তিনি আমার স্পৃহাকে শ্রদ্ধা করতেন, যখন তিনি আমাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখতেন তখন। তারা একজনকে বেঁধে রাখতেন যাকে আবার শ্রদ্ধাও করতেন। আর যখন উনি সপ্তাহ অবধি কথা বলতেননা আমিও একজন ছিলাম যার সাথে উনি কথা বলতেননা এমন একজন, যার একটা স্থান আছে তার জীবনে। শেষ সপ্তাহে এমনকি তিনি এটাও বলেছেন, একদা ভুল করে আমি তার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করছি, “কেমন আছো” আর তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, ” আমিও তোমাকে ভালোবাসি” তখন থেকেই আমাকে ওই শব্দটি হারাতে হয়েছে। তখন থেকে একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত আমি তাকে আঘাত করে ভুল করতে পারতাম আর তিনি তার সেই পুরনো বিতৃষ্ণা ভরা মুখে আমার জীবনকে আক্রমন করতে পারতেন। আমি এ বিষয়ে খুব একটা ভাবিনি। আমি তার মুখ মুছিয়ে দেয়ায় ব্যস্ত ছিলাম আর তার খাবারের কাপ ধরে ছিলাম আর তার কাঁধ স্পর্শ করেছিলাম। কিন্তু তখন, তিনি মারা যাওয়ার কিছুক্ষন পরে আমি হঠাৎ অবাক হয়ে ভাবলাম তিনি এখন আমাকে সদাই ভালোবাসবেন আর আমি হাসলাম যে তিনি মৃত, মৃত।

তিনি ইংরেজি সাহিত্যের নিয়ে পড়াশুনা করে এখন এম ফিল করছেন টি.এস. এলিয়েটের কবিতা নিয়ে।বর্তমানে শিক্ষকতার সাথে জড়িত আছেন।