| 29 মার্চ 2024
Categories
শিশু-কিশোর কলধ্বনি

ভুতুমের সাথে শাওনের যুদ্ধ                                                                

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

               

              

চমকে গেলে? ঠিক ধরেছ, ভুতুম এমন কাজ করতেই পারে না। দুষ্টু লোককে জব্দ করতে পারে, পুলিশে ধরিয়েও দিতে পারে। তাই বলে যুদ্ধ! তাও আবার শাওনের মতো ভালো মেয়ের সঙ্গে! কক্ষনো না।

ভুতুমের নাম শুনেই তোমরা অনেক কিছু ভেবে ফেলেছো? হ্যাঁ, মানছি ভুতুম দুষ্টু প্রমোটারকে জব্দ করেছিল। আবার ফুটবল বিশ্বকাপের সময় কুখ্যাত স্মাগলারকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল। সবই বুঝলাম। তাই বলে শাওনের সঙ্গে? উঁহু! ঠিক মিলছে না। তোমাদের মতো আমিও গুলিয়ে ফেলছি। যাকগে, বেশি ভাবনা-চিন্তা করার দরকার নেই। তার থেকে এক কাজ করি বরং, চলো আমরা সবাই চুপিচুপি শাওনদের বাড়ি যাই। তাহলেই জানতে পারবো কি ঘটনা ঘটেছিল।

কিরে, একা থাকতে পারবি তো? আমাদের আসতে কিন্তু দেরী হবে। জানিসই তো! ডক্টর সাহার চেম্বারে পেশেন্টদের কেমন ভীড় হয়। যদিও সাধন নাম লিখিয়েছে, সেও আটচল্লিশ নম্বর। না! তোকে একা বাড়িতে রেখে যেতে মন চাইছে না। শেষে ভয় টয় পেয়ে এক কান্ড ঘটাবি।

শাওন মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বললো, ও মা- আ! আমি কী এখনো ছোটো আছি নাকি? ক্লাস নাইন আমার। পরের বছরই মাধ্যমিক। বুঝতে পারছো?

এবারে সলিল কাকু ধপাস্ করে সোফায় বসে পড়ল। নাও, তোমরা মা-মেয়ে আগে ঠিক করো, কি করবে। তারপর যাওয়া।

তোমাদের নিয়ে আর পারা যায় না। এই নিয়ে রিন্টু তিনবার ফোন করল। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে আর স্বপ্না তুমি যদি ডাক্তার দেখাতে না যেতে চাও, যেও না। আমি রিন্টুকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে আসছি।

বাহ রে! আমি যাবো না সে কথা কখন বললাম। দেখছো আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। বেশ, যেতে হবে না তোমায়। এতই যদি বিরক্তি তবে খুলে ফেলছি শাড়ি। রাতে একসঙ্গে তিনটে পেইন কিলার খেয়ে নেবো।

এবারে শাওন বুঝল, ব্যাপারটা পুরো হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই মায়ের গালে চুমু খেয়ে বললো, মা- মা- আমার ভালো মা, তুমি একদম চিন্তা কোরোনা। তোমার মনে নেই রূপা ম্যাম প্রজেক্ট দিয়েছে, ওটা আজ শেষ করতেই হবে। না হলে কাল স্কুলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। প্লিজ মা ওঠো, আর দেরী কোরো না। তোমার নম্বর ডাকা হয়ে যাবে আর জানোতো একবার কল হয়ে গেলে একদম শেষে দেখাতে হবে।

ভয় পাবার মতো সত্যি কিছু নেই। দোতলা বাড়ি। উপর- নীচে দুটো কলাপসিবল গেট। শক্ত-পোক্ত কাঠের দরজা। নীচের ঘরগুলো তালা দেওয়া। সলিল কাকু সব দরজাতেই নিজের হাতে তালা দিয়ে গেছেন। পাঁচিলের গেটেও। যাতে বেশি রাত হলে, শাওন ঘুমিয়ে গেলে শাওনকে ডাকতে না হয়।

মা-বাবা বেরিয়ে যাবার পর শাওন এক পাক নেচে নিলো। মাঝে মাঝে একা থাকতে ভালোই লাগে। সারাক্ষণ মায়ের চোখের সামনে ওহ! এক এক সময় অসহ্য লাগে।

“শাওন কি ব্যাপার, এখনো ইতিহাস বই খুলে বসে আছো? অঙ্ক কখন করবে? ঘুম! পড়তে বসলেই ঘুম। উঠে পড় বলছি। একি! পায়ে চটি নেই কেন? চুল আঁচড়াওনি কেন?” কেন? কেন? কেন? সারাক্ষণ শাসন আর শাসন। ভালো লাগেনা শাওনের।

দু-মিনিট আগেই কবিতা মাসি ঘর মুছে গেছে লায়জল দিয়ে। তবুও খালি পায়ে হাঁটা চলবে না। সলিল কাকু তো বলেনই, বাতিক- বাতিক- বাতিকগ্রস্ত মহিলা। মাত্র বিয়াল্লিশেই বেঁকে গেছে তবুও শুচিবাই ছাড়বে না। নীচের ঘরগুলো অনায়াসে দুটো ফ্যামিলিকে ভাড়া দেওয়া যায়, তাহলে কোথাও গেলে বাড়ি পাহারার সমস্যা থাকে না আর যদি ভাড়াটিয়াদের কোনো ছোটো বাচ্চা থাকে, দারুন মজা হয় শাওনের। ওদের সঙ্গে খেলা করতে পারে। ধ্যাত্! একা একা ভালো লাগে না।

না, ভাড়া দেওয়া চলবে না। এক নম্বর- ঘর নোংরা হবে। দুই- যদি ঝগড়ুটে হয়! ভাড়া না দেওয়ার স্বপক্ষে দীর্ঘ তালিকা। সলিল কাকু হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছে, আমার সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো দরকার নেই। একেই বকে বকে কানের পোকা বের করে দিচ্ছে।

কী অবস্থা শাওনের! মা,বাবা বাড়ি নেই, তবুও ওদের কথাই ভেবে যাচ্ছে। যা বাব্বা! এর মধ্যেই অন্ধকার হয়ে গেল! জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, রাস্তার আলো জ্বলে গেছে। কিন্তু এখন তো মোটে পাঁচটা বাজে। মেঘ টেঘ করেনি তো! যাকগে বাবা ওসব, ঠাকুরের কাছে প্রদীপ না জ্বালালে মা আবার বকবে। তাই শাওন অনেকটা তেল ঢেলে ঠাকুরের সামনে প্রদীপ জ্বেলে, প্রণাম করে লক্ষী মেয়ের মতো দুধ বিস্কুট খেয়ে পড়তে বসল। সত্যি প্রজেক্টটা না হলে রূপা ম্যামের কাছে খুব বকা খেতে হবে।

খুব মন দিয়ে পড়ছিল শাওন। কতক্ষণ কেটে গেছে খেয়াল নেই। একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে যেতেই শাওনের মনে পড়ল, যাহ!প্রদীপটা নেভানোই হয়নি। প্রদীপটা পুরো কালো হয়ে গেছে। কাল সকালে পুজো দিতে এসে প্রদীপের এই অবস্থা দেখে স্বপ্না কাকিমা আর আস্ত রাখবে না শাওনকে। তাড়াতাড়ি করে প্রদীপটা নিয়ে মাজবে বলে যেই হাত বাড়িয়েছে দপ্ করে কারেন্ট চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই দমকা বাতাস এসে নাড়িয়ে দিল ওকে। প্রায় সাথে সাথে বাজ পড়ার শব্দ। বাজের শব্দে শাওন খুব ভয় পেল। ডাইনিং রুমের খোলা জানালা বাতাসের ধাক্কায় শব্দ করছে খুব। কি অন্ধকার! সব ঘটনাগুলো একসঙ্গেই ঘটে গেল। শাওন টর্চ নেবে বলে পা টিপে টিপে সেলফের কাছে যেতে গিয়ে “মাগো—ও” বলে চিৎকার করে উঠল। টর্চটা ধরার আগেই ছিটকে পড়ল মেঝেয়। জ্বলেও উঠল একবার। শাওন সে আলোয় দুটো জিনিস দেখলো। একটা মস্ত বড় কালো টিকটিকি টর্চের ধাক্কায় থেঁতলে গেছে। আর-আর-আর ওটা কী? ভালো করে দেখার আগেই টর্চের আলোটা নিভে গেল।

শাওন কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে। শাওন চিৎকার করতে গেল, গলা দিয়ে স্বর বেরুলো না। সারা ঘরে কি সব যেন উড়ে বেড়াচ্ছে। ফড়ফড়, ক্যাঁচ ক্যাঁচ। বাজ পড়ছে ঘনঘন। আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। কি যেন ভেঙ্গে পড়ল। গাছ? নাকি পরেশদের টালির ঘর?

ঝড়টা মাঝে মাঝে থামছে। বৃষ্টি পড়ছে জোরে। সেলফের ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে শাওন। পা-টা যেই একটু বাড়িয়েছে, ও মাগো! কি? কে এটা? কে? কে…? একেবারে ঘাড়ের পরে উঁহ্! মাগো… খামচে ধরেছে। ঘাড়ে হাত দিল শাওন। চটচটে কী যেন। রক্ত? কে ঢুকেছে ঘরে? চোর? ডাকাত? নাকি অন্য কিছু? কিন্তু কোথা দিয়ে ঢুকলো? সামনের দুটো জানালা ছাড়া সব তো বন্ধ। তবে কি — তবে কি দরজা ভেঙ্গে ফেলেছে ? না, না , তা হবে না। খুব শক্ত দরজা।

তাহলে? ভূ…ত…ভূ…ত…।

না, না, ভূতের হাত তো ঠান্ডা হয়, শাওন একশো ভূতের গল্পের বইয়ে পড়েছে। আর খুব শক্ত। হাড় খটখট করে বাজে। কিন্তু এর গা কেমন যেন নরম নরম। না, না, ভয় পেলে হবে না। আলো, আলো,  আলো জ্বলতে হবে। আলো দেখলে ভূত ভয়ে পালিয়ে যাবে। দেশলাই, দেশলাই। সেও তো সিংহাসনের ওখানে। খুব সাহস করে শাওন দু’পা বাড়িয়েছে, আবার! আবার সে! এবার শাওনের পায়ে আঘাত করেছে। ও কি! ও কে! ও কিসের আলো ? ভূ…ত…ভূতের চোখ! ওরে বাবারে! খেয়ে ফেললো রে!

না, কিছুতেই না। ভয় পেলে চলবে না। শাওন অনেক ভূতের বই পড়ে। ও জানে যত ভয় পাবে, ভূত তত কাছে আসবে। তারপর…তারপর-ঘাড়-। নাহ! এভাবে হবে না। ঝাঁটা-ঝাঁটা কই? ঠিক “ভূত কুটুম” বইতে পড়েছিলো শাওন ঝাঁটাই হল একমাত্র অস্ত্র ভূত তাড়ানোর।

আয়-আ-য়-কাছে আয়। দেখি কত সাহস তোর! শাওন হাতড়ে হাতড়ে ঝাঁটা খুঁজে ঝাড়ুটাকে গদার মতো করে ঘোরাতে লাগলো। ঝনঝন করে কাঁচের বাসন ভেঙ্গে পড়ল। কাপ- প্লেট? শাওন কি তবে রান্নাঘরে? আবার, আবার! চুলটাকে খিঁমচে টেনে দিয়ে চলে গেল। অন্ধকারের মধ্যেই শাওন এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে।

“কাছে আয়, কাছে আয়, ভয় পেয়েছে, ভূতে ভয় পেয়েছে।  তাই কাছে আসছেনা। হা-হা-হা। ভূতে ভয় পেয়েছে। হা-হা-হা…।

ঘড়ির কাঁটা রাত্রি দুটোর ঘর পেরিয়ে গেছে তাও আধঘন্টা হয়ে গেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ঝড়ও। চাপ চাপ অন্ধকার। আলো আসেনি। আসাননগর আর ভীমপুরের মাঝে বিরাট একটা গাছ পড়ে গেছে রাস্তার উপরে। সারা রাস্তাতেই ছোটো বড় অসংখ্য গাছের ডাল ছড়িয়ে আছে। বহু কষ্টে বাড়ি ফিরেছে স্বপ্না কাকিমারা। শাওনের জন্য দুশ্চিন্তায় স্বপ্না কাকিমা নিজের কোমরের ব্যথার কথা ভুলে গেছেন।

গোটা বাড়ি অন্ধকার। নিজেদের বাড়িটাকে অচেনা লাগছে। উঠোন জুড়ে প্রচুর গাছের ডাল, পাতা ছড়িয়ে আছে। টর্চের আলোয় তালা খুলে ঘরে ঢুকেই কাকু কাকিমা দুজনেই হতভম্ব।

এ কি! কি হয়েছে? সারা ঘর লন্ডভন্ড! মাথার উপরে ঝাড়ু ঘুরিয়েই চলেছে শাওন। মাথার চুল যেন কাকের বাসা। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। সারা গায়ে আঁচড়ের দাগ। রক্ত ঝরছে। বিড়বিড় করে বলেই চলেছে, হা-হা-হা ভূতে ভয় পেয়েছে, ভূতে ভয় পেয়েছে। স্বপ্না কাকিমা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন, কী ওটা?

সলিল কাকু নীচের দিকে আলোটা ফেলতেই দেখতে পেলেন। একটা বড় প্যাঁচা। ভুতুম প্যাঁচা। গোল গোল হলুদ চোখ জ্বলছে। তবে জড়োসড়ো হয়ে বসার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে শাওনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরেই গেছে। বেচারা ভুতুম! না, না, ভূত নয় প্যাঁচা।                               

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত