| 21 জানুয়ারি 2025
Categories
উৎসব সংখ্যা ১৪৩১

উৎসব সংখ্যা প্রবন্ধ: সন্ত কবীর ও আগুন ফুলের গল্প । শিবাংশু দে

আনুমানিক পঠনকাল: 13 মিনিট

 

সেই সময়টি নিয়ে একটু ভেবে দেখা যেতে পারে। দিল্লির সুলতান, বিখ্যাত বা কুখ্যাত তুর্কি মুহম্মদ বিন তুঘলকের আমল শেষ হয়েছে।  তিনি  নিহত হয়েছেন ভাই ফিরোজ শাহ  তুঘলকের হাতে। ফিরোজ শাহ তুঘলকও মারা গেলেন ১৩৮৮ সালে। দিল্লির মসনদে প্রায় রোজ রাজাবদল। সীমান্তের ওপারে বহুদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলেন তুর্কো-মোঙ্গল যুদ্ধব্যবসায়ী তইমুর লংগ। ১৩৯৮ সালের শীতকালে তিনি আক্রমণ করলেন  দিল্লি। তৎকালীন সুলতান মাহমুদ শাহ পালিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু আট দিনের দিল্লি অবরোধে এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হলো এবং লুণ্ঠিত হলো সব সম্পদ। একজন মুসলিম শাসকের হাতে এতো মুসলিমের রক্তচিহ্ন বোধ হয় এদেশ প্রথম দেখেছিলো তখন। হিন্দু, হিন্দুর সঙ্গে নেই, মুসলিম, মুসলমানের সঙ্গে নেই। মানুষ মানুষের সঙ্গে নেই।  ইতিহাসের ঘোর অন্ধকার পর্ব শুরু হয়েছিলো সেদিন।

 

২.

আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ্যধর্মের দুটি পরম্পরা আছে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক, লোকাচারনির্ভর ‘ধর্মবিশ্বাস’।  অন্যটি তার আধ্যাত্মিক দর্শনের ঐতিহ্য। প্রথমটির সঙ্গে দ্বিতীয়টির কোনও সাযুজ্য নেই। প্রথম পরম্পরাটির অসারত্ব নিয়ে গত তিন হাজার বছর আমাদের সভ্যতায় ক্রমাগত চর্চা চলেছে । এদেশে বৈদিক দর্শনের বিপরীত পক্ষে  গড়ে ওঠা দর্শন গুলির আদিযুগে প্রথম পুরোধা ছিলেন শাক্যমুনি বুদ্ধ। সেই ঐতিহ্যের স্রোতে মধ্যযুগে প্রধান পুরুষ ছিলেন সন্ত কবীর। যদিও জন্মসূত্রে বুদ্ধ ছিলেন আর্যসভ্যতার প্রতিভূ এক সামন্তপুত্র। অন্যদিকে কবীর, সমাজের প্রান্তিকতম নিম্নবর্গের একটি একক স্বরমাত্র। দুজনের জন্যই চ্যালেন্জ ছিলো মানুষের মৃত্যু হলেও শেষ পর্যন্ত যে মানব থেকে যায়, সেই তত্ত্বটি প্রমাণ করে যাওয়া। দুজনের মধ্যে কবীরের কাজটি বোধ হয় একটু বেশি কঠিন ছিলো। কারণ তাঁর ছিলো মূলতঃ সমন্বয়ের সাধনা। রাম, হরি, আল্লাহ, ব্রাহ্মণ-আত্মণ, উপনিষদ-বেদান্ত, নাথপন্থা, নির্গুণ ব্রহ্ম, অলখ নিরঞ্জন, সুফিবাদ, এমনকি শংকরের মোহমুদ্গর জাতীয় ( মায়া মরি না মন মরা/ মর মর গয়া শরীর।/ আশা তৃষ্ণা না মরি/ কহ গয়ে দাস কবীর ।।) নানা পরস্পর বিচ্ছিন্ন মতবাদকে আত্মস্থ করে, বরণ আর বর্জনের ক্ষুরস্যধার পথে নিজের সাধনা আর লোকশিক্ষার পরম্পরা চালিয়ে যাওয়া। তাঁর সমকালীন ও পরবর্তী কালের ভক্তরা কবীরের কাজটি আরও কঠিন করে দিয়েছিলেন। কারণ তাঁকে মধ্যযুগের ‘ভক্তিবাদী’ সাধকদের মধ্যে  অগ্রণী ভূমিকা দেওয়া হয়। অথচ তিনি এবং শাক্যমুনি বুদ্ধ দুজনেই ছিলেন ভক্তিবাদের বিপ্রতীপ মেরুর বাসিন্দা। গভীর বাস্তব চিন্তা ও তীব্র নীতিবোধ ছিলো তাঁদের দাঁড়াবার জায়গা। প্রশ্নহীন, অন্ধ ‘ভক্তি’বাদকে তাঁরা আজীবন পরিহার করে চলেছিলেন। যদিও অনেকদিন পরের মানুষ আমাদের লালন সাঁই বলছেন,
‘ শুদ্ধ ভক্তি মাতোয়ালা,  ভক্ত কবীর  জেতে জোলা
সে ধরেছে ব্রজের কালা, দিয়ে সর্বস্বধন তাই।।‘


কবীরের ‘শুদ্ধ ভক্তি’ কি আসলে তাঁর অভিজ্ঞতা লব্ধ বাস্তববোধ?  ভারতীয় আধ্যাত্মিক সভ্যতা ভক্তিবাদের প্রতি বিশেষ আসক্ত। যুক্তি বা নীতিবোধকে লোকাচারের মলিন ধূলায় নির্বাসিত করে আশ্বস্ত বোধ করে। কবীরের জন্ম মধ্যযুগে। যখন দিকে দিকে একই প্রশ্ন অনুরণিত হতো, ‘এতো রক্ত কেন?’  এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে  সাধারণ মানুষের বিবেক অসহায়।  প্রতিহত, পর্যুদস্ত, পরাহত। ভক্তিবাদী আত্মসমর্পণের সহজ পথকে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হবার বাধ্যতা  তখন তাঁদের গ্রাস করেছিলো।  

 

৩.  

বারাণসী শহরের দক্ষিণে একটি প্রাচীন জলাশয় আছে। এই বিশাল সরোবরটির সঙ্গে কোনকালে গঙ্গার যোগসূত্র ছিলো। নদীর মতোই এর জলে তরঙ্গ উঠতো এবং মানুষজনের কাছে এর পবিত্রতার খ্যাতিও শোনা যেতো। তরঙ্গকে হিন্দিতে বলে লহর, আর ফার্সিতে জলাশয়কে বলে তাল, হিন্দিতে তা হয়ে যায় তালাও। এই সরোবরটিকে লোকে বলতো লহরতাল, অপভ্রংশে লহরতারা। তার জলে ছিলো পদ্মবন আর শীতল শান্তি। আজকের বারাণসী রেল স্টেশন থেকে তিন কিমি মতো দক্ষিণে । নদী গতিপথ পরিবর্তন করায় আজ গঙ্গার জল আর সেখানে পৌঁছোয়না । সরোবরের ব্যাপ্তি আর নেই।

 

একজন মুসলিম তন্তুবায়, নাম আলি, ডাকনাম নিরু, বিয়ে করতে গিয়েছিলেন  শহরের উপান্তে মান্দুর গাঁয়ে। এই মান্দুর আজকের মডুয়াডিহ। নতুন বৌ নীমাকে নিয়ে দ্বিরাগমন করতে যাবার সময় লহরতালের ধারে একটি সদ্যোজাত শিশুকে তাঁরা কুড়িয়ে পান। তার গর্ভধারিনীর কোনও খোঁজ নেই, দেখে মনে হয় উত্তমকুলে  জন্ম।  খোঁজাখুঁজি করেও যখন কোনও দাবিদার মেলেনা তখন এই দম্পতি তাকে আল্লাহর আশীর্বাদ ভেবে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নীরুর তাঁতবাড়ি ছিলো লহরতারার থেকে পাঁচ-ছ কিমি উত্তরে বরুণানদীর চৌকাঘাটের কাছে। সেখানে ছিলো একটা টিলার মতো উঁচু জমি, মুহল্লা নরহরপুরা, সেখানেই দরিদ্র নিরুজোলার দরিদ্রতর গেরস্থালী। আজ তার নাম নিরুটিলা। মৌলভি সাহেব সেই কুড়িয়ে পাওয়া শিশুর নাম দেন ঈশ্বরের নামে, কবীর। কবীর বড়ো হয়ে ওঠেন এই আবহে। বড়ো হবার পর  তাঁর  কাছে কেউ যখন বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইতো, তিনি বলতেন,

 

কবিরা তেরি ঝোপড়ি
গলকট্টো কে পাস ।
জো করেগা সো ভরেগা
তুম ক্যিঁউ হোত উদাস ।।
( কবীর, তোমার কুঁড়েঘর কসাইদের কাছাকাছি। যে পাপ করে, সেই তার মূল্য দেয় দেয়। তুমি কেন বিচলিত হও। 

 

সেটা ছিলো গলকট্টো অর্থাৎ কসাইদের টোলা। তারা ছাড়া থাকতো কিছু জুলাহা আর সস্তা গণিকা। শৈশব থেকেই এই দরিদ্র মানুষগুলি ও তাদের কাদামাটির জীবনধারার সংস্পর্শে থেকে কবির বুঝতে পেরেছিলেন পোষাকি ব্রাহ্মণ্য আধ্যাত্মিকতার বহ্বাড়ম্বর এই সব দরিদ্র সংখ্যাগুরু মানুষদের কাছে কতোটা মূল্যহীন।  

 

৪ .

 

নরহরপুরায় নিরুজোলার টিলার উপর ভাঙ্গাচোরা পর্ণকুটির আর পাশের একটা চবুতরা ছিলো কবীরের খাস দুনিয়া । একটু বড়ো হবার পর তিনি পিতার সঙ্গে জাতব্যবসায় যোগ দেন। দিনের শেষে এই চবুতরাটিই ছিলো সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে গল্পগুজবের ঠিকানা। এখানে বসেই কবীর আশপাশের নিরক্ষর, হতদরিদ্র, মানহীন শ্রমজীবীর দলকে আশ্বাস দিতেন, তাদের মানুষজন্ম বৃথা নয়। তাদেরও ঈশ্বরলাভ হতে পারে। ঈশ্বর শুধু ব্রাহ্মণ আর শেখ-সৈয়দের মৌরসিপট্টা নয়। দিনে দিনে কবিরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তার সঙ্গে মানুষের ভিড় নরহরপুরার পুরোনো চবুতরা ছাপিয়ে যায়। পাশে আর একটা নতুন  জায়গা তৈরি করতে হয়। কবীরের নামে তার নাম হয় কবীর চবুতরা। লোকমুখে সেই নাম কবীরচৌরা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই কবীরচৌরাতে বসেই  ধনীর আরও ধনলালসা দেখে ঈশ্বরের কাছে তাঁর আর্জি,

 

‘সাঁই ইতনা দিজিয়ে
জা ম্যঁয় কুটুম সমায় ।
ম্যঁয় ভি ভুখা না রহুঁ
সাধো ন ভুখা জায় ।।‘


(ঈশ্বর আমাকে ততোটুকুই (সম্পদ) দিন যাতে আমি আত্মজনদের ভরণপোষণ করতে পারি। আমি যেন অনাহারে না থাকি, সাধু ব্যক্তিদেরও যেন ক্ষুধার্ত না থাকতে হয়)

 

মধ্যযুগের কাশীতে ব্রাহ্মণ্যধর্মই মানুষের নিয়তি নির্ধারণ করতো। সমাজের সংখ্যাগুরু ইতরসমাজের মানুষ শাসিত হতো মনুস্মৃতি ও অন্যান্য ‘শাস্ত্র’-গ্রন্থে উল্লেখিত অবমাননাকর, নিপীড়নবাদী  নিদানের নিরিখে। ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতদের আত্মগর্ব ছিলো  আকাশছোঁয়া। লোকাচারের নিগড়ে বাঁধা এই ধর্মবিশ্বাসে বৃহত্তর মানবসমাজের জন্য কল্যাণকর কিছু  ছিলো না। প্রেমহীন, করুণাহীন, অনুভূতিহীন এই ব্যবস্থা কবীরকে ব্যথিত করতো। সেই সব ব্রাহ্মণ্যবাদী মানুষদের উদ্দেশে কবীর বলেছিলেন, 

 

‘পোথি পড়ে পড়ে জগ মুয়া
পণ্ডত বনেঁ ন কোয় ।
ঢাই আখর প্রেম কা
পড়ে সো পণ্ডত হোয় ।।‘

 

(সারা বিশ্বে শুধু পুথি পড়ে পড়ে কেউ পণ্ডিত হতে পারে না। ‘প্রেম’ নামক শব্দটির আড়াইটি অক্ষর  যে বুঝতে পারে, সেই প্রকৃত পণ্ডিত ) 

 

সর্বযুগে, সর্বকালে  ‘দেহি দেহি’ আকাঙ্খা থেকে মানুষের অব্যাহতি নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুরু ও রাজন্য ব্যবস্থা সেই আকাঙ্খাকে মূলধন করে অত্যাচার চালিয়ে যায়। তাঁরা কেউ পরকালে, কেউ ইহকালে মানুষকে ত্রাণ করার আশ্বাস দিয়ে যান। সে সব ‘মিথ্যা’ জেনেও মানুষের আকুলতা যায় না। ইতিহাসে এই বিড়ম্বনা আমরা গত তিন হাজার বছর ধরে চলে আসতে দেখি। এমন কী এই মুহূর্তেও তার বোলবালা আমাদের চকিত করে। স্তম্ভিত করে। কবীরের আমলে এই প্রবণতা আরও অনেক বেশি প্রকট ছিলো। কোনও সমস্যারই তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। বাস্তববাদী মানুষ জানেন উপযুক্ত সময় না এলে কিছুই ঘটে না। কবীর তাঁর অনুগামীদের সতর্ক করে বলেছিলেন, 

 

‘ধীরে ধীরে রে মনা
ধীরে সব কুছ হোয় ।
মালি সিঁচে সও ঘড়া
রিত আওয়ে ফল হোয় ।।‘


( হে (উৎকণ্ঠ) মন আমার,  ধৈর্য ধরতে শেখো।  মালি যদি বৃক্ষমূলে শত কলস জলও সিঞ্চন করে ( লাভ নেই )। উপযুক্ত ঋতু এলেই ফল আসবে। )

 

Shibanshu De

 

৫.  

এদেশের ইতিহাস  নিয়মানুগভাবে নথিবদ্ধ হতে শুরু করেছে সপ্তম-অষ্টম শতক থেকে।  তার পরবর্তী যুগের  মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই শিশুটির আবির্ভাবের তথ্য সতত কুয়াশায় অন্তরালে। শুধু আবির্ভাবেই নয়, তাঁর তিরোভাবের তথ্যও রূপকথার রাজ্যের কথকতা। ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণ পরস্পরবিরোধী।  এই মানুষটির সর্বসম্মত কোনও জীবনকথা এখনও পাওয়া যায়না। তাঁর জন্মসাল হিসেবে একবার বলা হয় ১৩৯৮, আবার কখনও ১৪৪০ বা ১৪৫৫ সন। তবে তিনি গুরু নানকের (জন্ম ১৪৬৯) অনেক আগেই এসেছিলেন সেটা নিশ্চিত। গুরু নানকের ‘জন্মসাক্ষি’ (সাখি) পঞ্জী বেশ নিষ্ঠা সহকারে গ্রন্থিত আছে। সেখানে দেখছি গুরু নানকের  প্রথম দেশযাত্রা, যাকে শিখরা ‘উদাসি’ বলে থাকেন, সেটি ছিলো ১৫০০ থেকে ১৫০৭ সালের মধ্যে। এই সময়ই গুরু নানক বারাণসীতে সন্ত কবীরের   সঙ্গ করেছিলেন। গুরু নানকের  সঙ্গী ছিলেন ভাই মর্দানা, একজন মুসলিম শিষ্য । এর ঠিক আগেই ১৪৯৯ সালে গুরু নানকের ইষ্টদর্শন হয় এবং তিনি প্রচার করতে থাকেন, ঈশ্বর তাঁকে বলেছেন জগতে হিন্দুও নেই, মুসলমানও নেই, শুধু ‘আমি’ আছি। তাই নানক সমস্ত প্রচলিত ধর্মমতকে অস্বীকার করে ‘ঈশ্বর’-এর  শিষ্য (শিখ)  হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন।

 

শুধুমাত্র ভক্তি ও প্রেমের মাধ্যমেই যে মানুষের উত্তরণ ঘটে সেই আদর্শই তিনি সন ১৫০০ থেকে ১৫২৪ পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষ, তিব্বত, মধ্য এসিয়া, আরবদেশ ও শ্রীলংকায় প্রচার করেন। গুরু নানক যখন বারাণসীতে এসেছিলেন, তখন সন্ত কবীরের  খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা মধ্যগগনে। কারণ গুরু নানকের ধর্মমত যেসব সাধকের চিন্তন ও বোধিপুষ্ট, সন্ত কবীর তার মধ্যে প্রধান। গুরু গ্রন্থসাহিবে সর্বাধিক গ্রন্থিত রচনা সন্ত কবীরের  বাণী থেকেই সংগৃহীত। তাই ধরে নেওয়া যায় মোটামুটি ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে পরে হতে পারে।  কিন্তু তিনি যে একদিন এদেশের মাটিতে বেঁচে ছিলেন, হেঁটে বেড়িয়েছেন, আর এদেশেই একদিন ঐহিক অস্তিত্ত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সামূহিক মানববিশ্বে লীন হয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ রয়ে গেছে কবীরের  রচনাবলী ও লোকবিশ্বাসের মধ্যে।  

 

Shibanshu De

৬. 

 

‘জাত জুলাহা নাম কবিরা, বনি বনি ফিরো উদাসী ….. ‘

 

(জাতে ​​​​​​​জোলা, ​​​​​​​নাম কবীর। ​​​​​​​দিক-দিগন্তরে মোহমুক্ত উদাসী হয়ে ​​​​​​​পরিভ্রমণ ​​​​​​​করে)

 

জুলাহা, বাংলায় যার নাম জোলা, অর্থাৎ ‘তন্তুবায়’ গোষ্ঠীর শ্রমজীবী শ্রেণী ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিলো। সেই সময় দেশের নানা  প্রান্তে বয়নশিল্পের অত্যন্ত উন্নতি ঘটেছিলো। কাশী তার মধ্যে একটি। স্বাভাবিকভাবেই সে সব স্থানে তন্তুবায়বর্গের মানুষদের বৃহৎ বসতি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সূত্রেই বারাণসীতে কবীরের পিতা-মাতা বসবাস করতেন। সন্ত কবীর স্বীকার করেছিলেন পালক পিতার বৃত্তিগত পরিচয়টি। তিনি ছিলেন এক গর্বিত ‘জুলাহা’। যেখানেই নিজের সম্পর্কে কিছু বলার অবকাশ পেতেন, নিজের শ্রমজীবী জাতিপরিচয়টি নিয়ে তিনি নির্দ্বিধায় মুখর  হয়েছেন। ঈশ্বর তাঁর কাছে একজন শ্রেষ্ঠ তন্তুবায়। ঠিক যেভাবে একজন জোলা সুতোর সঙ্গে সুতোর খেলায় মত্ত হয়ে অনুপুঙ্খ কৌশলে শিল্পসৃষ্টি করে, সেভাবেই ঈশ্বর মাতৃগর্ভ নামক তাঁত থেকে সমস্ত প্রাণ, সারা জগৎ সংসারকে উৎপন্ন করছেন। এই তত্ত্বটি তন্ত্র ও আগমের  মুখ্য সূত্র। ‘তন্ত্র’ শব্দটি  থেকেই ‘তাঁত’ শব্দের জন্ম হয়েছিলো।

 

নিজস্ব ঈশ্বরকে তিনি ‘হরি’ নামেই চিহ্নিত করতেন। ‘হরি’র মহিমা গীত তাঁর প্রিয়তম আরাধনা ছিলো। হরি’র প্রতি নিবেদন হিসেবে তিনি বলেছিলেন,

 

‘সাত সমন্দর কী মসি করৌঁ
লেখনি সব বনরাই ।
ধরতি সব কাগদ করৌঁ
হরিগুণ লিখা ন জাই ।।’

 

(সাত ​​​​​​​সমুদ্র ​​​​​​​যদি ​​​​​​​মসী ​​​​​​​(কালি) হয় ​​​​​​​অথবা ​​​​​​​অরণ্যের ​​​​​​​সব ​​​​​​​বৃক্ষই হয় ​​​​​​​কলম। সমগ্র বিশ্বও যদি কাগজ হয়, তবু ইশ্বরের মহিমা লিখে শেষ করা যাবে না) 

 

‘জন্মগত’ ভাবে  মুসলিম হলেও অধ্যাত্মদর্শনের প্রথম গুরুমুখী পাঠ তিনি নিয়ে ছিলেন সন্ত রামানন্দের (আনুমানিক ১২৯৯-১৪১০) কাছে।  রামানন্দ ভারতবর্ষে মধ্যযুগের ভক্তিবাদী অধ্যাত্ম আন্দোলনের প্রধান পুরুষ ছিলেন । তাঁর বৈষ্ণব দর্শনের সঙ্গে পারস্য থেকে আসা ইসলামি  সুফি দর্শন মিলেমিশে তৈরি হয় এ দেশের প্রথম সমন্বয়বাদী অধ্যাত্মসাধনা। পরবর্তীকালের ভারতবর্ষে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন বলতে বৃহত্তর জনমানসে যে বোধটি বিকশিত  হয়েছে তার অংকুর এই সময়েই স্ফুরিত হয়। এই আন্দোলনের সমস্ত নায়করা, যেমন, সন্ত কবীর, সন্ত রবিদাস, সন্ত নানক, পরবর্তীকালে সন্ত তুকারাম সবাই সন্ত রামানন্দের ভাবশিষ্য।  সন্ত রামানন্দ ও কবীরের  সম্পর্কটি ভারতবর্ষে পরবর্তীকালের অধ্যাত্ম ও রাজনৈতিক জগতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিংবদন্তি বলে সন্ত কবীর নিজের জন্মপরিচয় লুকিয়ে সন্ত রামানন্দের থেকে শিক্ষা নেন। কারণ তখনও পর্যন্ত প্রয়াগের ব্রাহ্মণ রামানন্দ কোনও ‘বিধর্মী’কে তাঁর উপদেশ দেওয়া স্বীকার করেননি। ইতিহাস বলে সন্ত রামানন্দ ও সন্ত কবীরের মধ্যে দীর্ঘ বোধবিনিময়ের ধারা দুজনকেই একসঙ্গে সমৃদ্ধ করে তোলে। এমন রটনাও রয়েছে যে কবীরের  মাতা ছিলেন এক অকালবিধবা ব্রাহ্মণ রমণী। রামানন্দ তাঁকে পুত্রবতী হবার বর দিয়েছিলেন। ফলতঃ তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তবে সম্ভবতঃ ঘটনা হলো, কবীরের প্রকৃত পিতা  রামানন্দের একজন ব্রাহ্মণ শিষ্য এবং কবীরের গর্ভধারিণী সেই ব্রাহ্মণ বিধবা রমণী। লোকলজ্জায় তাঁরা সদ্যোজাত সন্তানকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন লহরতারার জলে। সেখান থেকেই ‘ম্লেচ্ছ’ জোলা নিরু আর নিমা তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। অবশ্য আধুনিককালের পণ্ডিতরা এই কিংবদন্তিতে আস্থা রাখেন না। শার্ল ভডভিল বলেছেন, কবীর ছিলেন একেবারে নিম্নবর্গের আতরাফ মুসলমান পরিবারের সন্তান, যাঁরা ‘শুদ্ধ’ ইসলামি ধর্ম বা লোকাচার সম্বন্ধে বিশেষ ওয়কিফহাল ছিলেন না। তাঁরা সম্ভবত ছিলেন পুরুষানুক্রমিক নাথপন্থী দর্শনের অনুগামী ইতরবর্গের মানুষ। হয়তো নেহাৎ অর্বাচীন, কলমা কবুল করা মুসলমান। যার ফলে কবীরের রচনায় যেসব উদাহরণ, চিত্রকল্প, প্রতীকী সন্দর্ভ আমরা বার বার দেখতে পাই, সেখানে তন্ত্র, নাথপন্থা ও অন্যান্য লোকজ বিশ্বাসের প্রভাব বিশেষ প্রকট। ওয়েন্ডি ডনিগার তো তো সরাসরি বলেছেন, কবীর  সচেতনভাবে হিন্দু ও ইসলাম দুটি ধর্মবিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব ‘ধর্মমত’ প্রচার করেছিলেন। তার ভিত্তি স্থাপনা হয়েছিলো এই দুটি ধর্মের ধ্বংসাবশেষের উপর। নিঃসন্দেহে এ বিষয়ে তাঁর উত্তরসূরি ছিলেন মধ্যযুগের বহু সুফি সাধক। তবে কবীর ‘জুলাহা’ থেকে সন্ত কবীর হয়ে ওঠার পথটি একেবারেই মসৃণ ছিলো না। বাইবেলে সন্ত লুক কথিত সুসমাচারে ‘Prodigal Son’-কে যে সমস্ত যন্ত্রণা ও দুঃখভোগের পালা পেরিয়ে আসতে হয়েছিলো, কবীরের পরীক্ষা যেন তার থেকেও অনেক বেশি। 

 

৭.

 

সন্ত কবীরের   নিজস্ব ব্যাখ্যায় সন্ত রামানন্দ অনুসৃত, শ্রীরামানুজ কথিত নির্গুণ ব্রহ্ম, একেশ্বরবাদ ও প্রেমভক্তির পথে ঈশ্বর, আল্লাহ, হরি, রাম বা অলখ নিরঞ্জন কেন্দ্রিক দর্শনতত্ত্ব সেই সময় দরিদ্র, নিপীড়িত ইতরযানী ভারতবাসীর কাছে বিপুল মাত্রায় আদৃত হয়েছিলো।

 

‘জব ম্যঁয় থা, তব হরি নহি
অব হরি হ্যাঁয়, ম্যঁয় নহি
সব অঁধিয়ারা মিট গয়া
জব দীপক দেখা ম্যঁয়নে।।‘


(​​যখন ​​​​​​​আমার ​​​​​​​মধ্যে ​​​​​​​’আমিত্ব ‘ছিলো,  ঈশ্বর ​​​​​​সেখানে বাস করতেন না। ​​ ​​​​​​​এখন ​​​​​​​’আমিত্ব’ ত্যাগ ​​​​​​​করেছি, আমার ​​​​​​​হৃদয়ে ​​​​​​​ঈশ্বরের ​​​​​​​বাস।  তাঁর ​​​​​​​প্রদীপের ​​​​​​​আলো  আমার ​​​​​​​মনের ​​​​​​​সব ​​​​​​​অন্ধকার ​​​​​​​দূর ​​​​​​​করে ​​​​​​​দিয়েছে। ​​​​​​​)

 

 

আপন শ্রেণিস্বার্থের প্রতি মানুষ যে কখনও উদাসীন থাকতে পারে না, সে বিষয়ে তিনি সজাগ ছিলেন। এটা ঘটনা, পুরোহিত বা শাসক কখনও শূদ্রশ্রেণির উত্থান সহ্য করে না। তিনি উচ্চবর্ণীয় মানুষদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, কিন্তু কখনও অপমান করেননি। ক্ষুদ্র, আবিল ভাবনাসঞ্জাত কলহ থেকে তিনি নিজেকে অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।  নিজের আত্মিক অবস্থান সম্বন্ধে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, 


‘কবীরা খড়া বজার মেঁ, মাঁগে সবকা খ্যয়ের ।
না কাহুসে দোস্তি, না কাহুসে ব্যয়ের ।।‘

(‘বজার’ মানে এই সমাজবিশ্ব। কবীর সেখানে দাঁড়িয়ে সবার মঙ্গল কামনা করছে। তার সঙ্গে কারও বন্ধুতা নেই, শত্রুতাও নেই কারও প্রতি)

 

ইতিহাসের অন্ধযুগে সহায়হীন নিপীড়িত শ্রমজীবী শ্রেণি, ইতরমানুষদের শুশ্রূষায় প্রদীপের আলো হাতে এগিয়ে এসেছিলেন সন্ত কবীর । তিনি সন্ন্যাসী ছিলেন না। সংসার করেছিলেন, পত্নীর নাম ছিলো ‘লোই’ । এক পুত্র কমাল আর কন্যা কমালি। পুত্র কমাল পিতার সাধনার মর্ম বুঝতেন না। তিনি ছিলেন বিষয়বিষে জর্জরিত । কবীর এক দোহায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন,

 

‘বুরা বংস কবির কা, উপজা পুত কমাল
হরি কে সুমিরন ছোড়কে, ঘর লে আয়া মাল।।’


​​(কবীরের ​​​​​​​বংশধর তার ​​​​​​​নিকৃষ্ট ​​​​​​​পুত্র ​​​​​​​কমাল। ​​​​​​​ঈশ্বরকে ​​​​​​​স্মরণ ​​​​​​​না ​​​​​​​করে ​​​​​​​সে ​​​​​​​শুধু ​​​​​​​পার্থিব ​​​​​​​বস্তুর ​​​​​​​প্রতি লালায়িত)

 

 ​​​​​​গুরু রামানন্দ ও শিষ্য কবীরের মূল কর্মক্ষেত্র ছিলো শহর বনারস। গুরু ছিলেন সে সময়ের ভারতবর্ষে একজন শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, দার্শনিক ও প্রসিদ্ধ চিন্তানায়ক । চেলা ছিলেন ‘নিরক্ষর’ সামাজিক মর্যাদাহীন জোলা। নিজের সম্বন্ধে কবির বলেছিলেন,

 

‘মসি কাগদ ছুয়ো নহি
কলম গহি নহি হাথ।।’


(কালি ​​​​​​​বা ​​​​​​​কাগজ ​​​​​​​কখনও ​​​​​​​ছুঁয়ে ​​​​​​​দেখিনি। কলমও ​​​​​​​কখনও ​​​​​​​হাতে ​​​​​​​ধরিনি)

 

অন্যদিকে গুরু সম্বন্ধে বলেছিলেন,

 

‘গুরু গোবিন্দ দোনো খড়েঁ
কাকে লাগু পাঁয়
বলিহারি গুরু আপনো
গোবিন্দ দিয়ো মিলায়।।’

(আমার ​​​​​​​সামনে ​​​​​​​যখন ​​​​​​​গুরু ​​​​​​​ও ​​​​​​​ঈশ্বর দুজনেই ​​​​​​​এসে ​​​​​​​দাঁড়ান, ​​​​​​​(বুঝতে ​​​​​​​পারি না) কার ​​​​​​​চরণ ​​​​​​​স্পর্শ ​​​​​​​করবো? ​​​​​​​আমি ​​​​​​​ধন্য ​​​​​​​আমার ​​​​​​​গুরুকে ​​​​​​​পেয়ে। ​​​​​​​তিনিই ​​​​​​​তো আমাকে ঈশ্বর ​​​​​​​সকাশে নিয়ে ​​​​​​​গেছেন।)

 

৮. 

 

সন্ত কবীর ছিলেন ভারতবর্ষের শাশ্বত ইতরযানী বোধিবিশ্বের ভাণ্ডারী ও নায়ক। ব্রাহ্মণ্যবোধ ও উপলব্ধির চেনা কক্ষপথের বাইরে  আবহমানকাল ধরে এদেশে গরিষ্ঠ মানুষের মননজগতের  শ্রেষ্ঠ ফসল পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিলো সন্ত কবীরের অমৃতবাণীর মাধ্যমে। তাঁর বাণীর প্রথম প্রামাণ্য সংকলন পাওয়া গুরু অর্জনদেব সংকলিত শিখদের ‘আদিগ্রন্থ’  আর গোবিন্দওয়াল পোথির  মধ্যে। তার পর রাজস্থান থেকে সংকলিত ‘বীজক’ আর বুন্দেলখণ্ডের অনুগামীদের সংগৃহীত ‘অনুরাগসাগর’ও কবীরের সৃজনবিশ্বকে ধরে রেখেছে। । যেহেতু এসবের প্রণেতা কবীর ছিলেন নিরক্ষর, তাই এর প্রচার ছিলো শ্রুতিনির্ভর। এর প্রামাণ্যতা শুধু বাচনিক পরম্পরা নির্ভর।  উইলসন-সাহেবের মতে কবীরের  রচিত দোহাসংকলনের সংখ্যা আট। বিশপ ওয়েস্টকট সাহেব বলেছেন সংখ্যাটি চুরাশি। অন্যমতে রামদাস গৌড় বলেন কবীরের  রচনার একাত্তরটি সংগ্রহ রয়েছে। তবে মনে করা হয় তাঁর সমস্ত রচনাই ‘বীজকে’র মধ্যে মোটামুটি গ্রন্থিত আছে। বীজকের তিনটি ভাগ আছে, রমৈনি, সবদ আর সারওয়ি। শৈলীর বিচারে তাঁর রচনায় রয়েছে তিনধরণের রচনা। দোহে, সলোক (শ্লোক) আর সাখি (সাক্ষী)। তাঁর রচনাগুলি যেহেতু ভক্তদের শ্রুতির মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিলো, তাই অনেক ভাষায় তার ভিন্ন রূপও দেখা যায়। যেমন, পঞ্জাবি, ব্রজভাখ, রাজস্থানী, খড়ি বোলি, অওধি, পুরবি ইত্যাদি।

পশ্চিমের সংস্পর্শে আসা ভারতীয়দের মধ্যে  বিদেশে কবীরবাণী প্রচারের প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অগ্রগণ্য। ১৯১৫ সালে ‘সংস অফ কবির’ নামে তাঁর অনুদিত কবীরের  একশোটি কবিতা লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ইভলিন আন্ডারহিল  এই সংকলনটির ভূমিকা লিখে দেন। এই বইটি পড়েই ডব্লিউ বি ইয়েটস পশ্চিমে কবীর’কে বিস্তৃত পরিচিতি দান করেছিলেন। পরবর্তীকালের গবেষকদের মতে এই একশোটি কবিতার মধ্যে বড়ো জোর ছ’টি কবিতা কবীরের  নিজস্ব রচনা। বাকিগুলি সম্ভবতঃ কবীরের  শিষ্য-প্রশিষ্য নানা ভক্ত সাধকের সৃষ্টি। যদিও সেগুলিতে কবীরের  দর্শন ও রচনা শৈলী বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করা হয়েছিলো।

 

৯.

কবীরের  তিরোভাব হয়েছিলো বারাণসি থেকে প্রায় দুশো কিমি দূরে গোরখপুরের কাছে মগহরে। সেকালের ব্রাহ্মণ্য সমাজ রটনা করতেন কাশীতে মৃত্যু হলে মানুষের অক্ষয় স্বর্গবাস হয়। অন্যদিকে ‘মগহর’ জনপদটি চিরকালই দুর্নামের ভাগী ছিলো। কিংবদন্তি অনুযায়ী  পুরাকালে তার নাম ছিলো ‘মার্গহরণ’। সংগঠিত দস্যুচক্র পথিক ও যাত্রীদের সর্বস্বহরণ করতো। একজন লুণ্ঠিত ব্রাহ্মণ অভিশাপ দিয়েছিলেন এই জনপদ হবে  নরকের দেউড়ি। এখানে যারই মৃত্যু হবে তার অনন্ত নরকবাস নিশ্চিত। অভিশাপ-ভীত অধিবাসীরা স্থানত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে থাকেন। ক্রমে এই জনপদ প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কবীর তাঁর অনুগামীদের ভয় ও কুসংস্কারমুক্ত হতে নির্দেশ দিতেন।

Shibanshu De

 

তাঁর তখন অনেক বয়স হয়েছে। বহু মানুষ তাঁকে মান্য করে। মগহরে হঠাৎ তীব্র অনাবৃষ্টি দেখা দেয়।  কিছু স্থানীয় অধিবাসী তাঁকে অনুরোধ করেন মগহরে যাবার জন্য। তাঁদের বিশ্বাস, কবীর মগহরে এলেই বৃষ্টিপাত হবে। কবীর যেতে অস্বীকার করেন। কারণ তিনি কোনও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে বিশ্বাস করতেন না। তখন তাঁর অনুগামীরা কাতর প্রার্থনা জানান কবীর যদি তাঁর শেষ জীবন মগহরে যাপন করেন তাহলে ওই স্থান নিয়ে মানুষের মনে নরকবাসের যে প্রচার আছে, তা নিরসন হবে। এই প্রার্থনাও কবীরকে বিচলিত করেনি। তখন তাঁর শরীর-স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়েছে। কাশী ত্যাগের শক্তি বিশেষ অবশিষ্ট নেই। ইচ্ছেও নেই। তিনি ‘স্বর্গ-নরক’ ইত্যাদি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সারা জীবন লড়াই করে গেছেন। তবু কেন মগহরে নির্বাসিত হতে তিনি রাজি হয়ে গেলেন, তা এখনও একটি প্রহেলিকা। একটা তত্ত্ব, তিনি ভক্তদের অনুরোধে নিমরাজি হয়েছিলেন। অন্য তত্ত্বটি তৎকালীন শাসক তাঁকে বারাণসী থেকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। কবীর কাশীর সঙ্গে এতো নিবিড় ভাবে বিজড়িত ছিলেন যে কাশীত্যাগ তাঁর জন্য এক শাস্তিস্বরূপ ছিলো। মগহরের  স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যায় প্রায় সমান ছিলেন। শোনা যায়, উভয় সম্প্রদায়ই কবীরের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন। কিন্তু মগহরে মৃত্যু-উত্তর ‘নরকভোগ’ জাতীয় কুসংস্কার ও দুষ্প্রচারের বিরুদ্ধে কবীর আজীবন লড়াই করে গেছেন।  সেটি নিবারণ’ করার জন্য তাঁর কাশীত্যাগ বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাঁর একটি বিখ্যাত বাণী আছে,  ‘জো কবীরা কাশী মুয়ে তো রামে কওন নিহোরা? অর্থাৎ কাশীতে মারা গেলেই যদি স্বর্গলাভ হয়, তবে ঈশ্বরের আরাধনা করার প্রয়োজন কোথায়? তাঁর রচনায় পাওয়া যায় কাশীত্যাগের সময় তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে  পড়েছিলো। তিনি একেবারেই ইচ্ছুক ছিলেন না। তবু তিনি মগহর প্রস্থান করেছিলেন এবং সেখানেই তাঁর তিরোভাব ঘটে। তাঁর জন্মের কাহিনীও  এতোই অস্পষ্ট যে তাঁর প্রকৃত জন্মস্থান কাশী কি না তা নিয়েও কারো কারো  সংশয় রয়েছে। তবে কাশী তাঁর কর্মভূমি এবং ভারতবোধের চিরকালীন  শিক্ষা তিনি এখানেই অর্জন করেছিলেন।  এই স্থান কবির সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা।  একসময়ের গণিকা, কসাই ও অন্যান্য ‘অসামাজিক’ পেশায় নিয়োজিত মানুষ অধ্যুষিত এই স্থানে বসবাস করে মহাত্মা কবীর  কোন প্রেরণায় নিখিল মানবাত্মার কাছে তাঁর শাশ্বত সন্দেশ পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন,  তা হৃদয়ঙ্গম করার প্রয়াস আধুনিক ভারতীয়দের জন্য এক দায়বদ্ধতা। অন্ধকার মধ্যযুগে ভারতদর্শনের সারসংক্ষেপ একজন ‘অশিক্ষিত’, হতদরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিলো আর্যাবর্তের সংখ্যাগুরু নিপীড়িত, দরিদ্র, হতমান ইতর মানবজাতির কাছে আত্মার শুশ্রূষা হয়ে।  

 

১০.

 

যে রাজশক্তি ও ব্রাহ্মণ্য সমাজ আজীবন কবীরকে উৎপীড়ন করতে চেয়েছেন, তাঁদের প্রতিও কবীর কখনও কটূক্তি করেননি। তিনি ছিলেন একান্ত বাস্তববাদী। তিনি গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন অপরের দোষত্রুটি নিয়ে সরব হওয়া একটি অন্যায় কাজ। প্রত্যেকে যদি নিজের অন্দরমহলে উঁকি দিয়ে দেখে, তবে সেখানে অনেক বেশি অন্ধকার দেখতে পাবে। 

 

‘বুরা ​​​​​​​যো ​​​​​​​দেখন ​​​​​​​ম্যাঁয় ​​​​​​​চলা 

বুরা ​​​​​​​না ​​​​​​​মিলিয়ো ​​​​​​​কোয়ে  

জব মন ​​​​​​​খোজা ​​​​​​​আপনো 

তো মুঝসে ​​​​​​​বুরা ​​​​​​​না ​​​​​​​কোয়ে ‘

 

(বাইরের জগতে) দুষ্ট ব্যক্তি খুঁজতে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু কাউকে খুঁজে পেলাম না। নিজের ভিতরে খুঁজতে গিয়ে দেখি, আমার থেকে নিকৃষ্ট দুষ্ট আর কেউ নেই। 

 

শাক্যমুনি বুদ্ধের মতো কবীরও কোনও বিশেষ ‘ধর্মীয়’ মতের প্রচার করেননি। অন্যদিকে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমত, ব্রাহ্মণ্য হোক বা ইসলামি, তাদের যাথার্থ্য অস্বীকার করে গেছেন। সমস্ত ‘ধর্মীয়’ লোকাচার, তথাকথিত ‘শাস্ত্রবাক্য’, প্রতীক বা চিহ্নের গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করেননি। পরবর্তীকালে লালন শাহ যখন বলেন ‘তোমার পথ ঢাইক্যাসে  মন্দিরে-মসজিদে’, সেই প্রত্যয়ের বীজটি রোপণ করেছিলেন কবীর। তিনি নিম্নবর্গীয় মানুষের মধ্যে প্রচলিত বারাণসীর লোকভাষা ব্যবহার করতেন। তাঁর থেকে প্রায় দু’হাজার আগে শাক্যমুনি বুদ্ধও এই কাজটি করেছিলেন। তিনি সমকালীন ‘ধর্ম’ আলোচনার ভাষা ‘শ্রুতি’ বা দেবভাষাকে অস্বীকার করে অকুলীন শূদ্রভাষা ‘পালি’-র মাধ্যমে নিজস্ব ধারণা প্রচার করতেন। এমন কি তৎকালীন ‘ব্রাহ্মণ্য’ মূল্যবোধের ধারক-বাহক গোস্বামী তুলসীদাস’ও সংস্কৃত ভাষা পরিহার করে স্থানীয় অওয়ধি ভাষায় ‘রাম-চরিত-মানস’ রচনা করেছিলেন। কিংবদন্তি বলে, তুলসী নাকি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অনার্য দেবতা শিব-এর স্বপ্নাদেশের প্রেক্ষিতে। 

 

Shibanshu De

কবীরের দেহাবসানের পর তাঁর মুসলিম অনুগামীরা মগহরে একটি মাজার বা সমাধি-মন্দির স্থাপনা করেন। পরবর্তীকালে হিন্দু অনুগামীরাও মাজারের পাশে অন্য একটি স্মৃতি-মন্দির নির্মাণ করেন। কাশীতে কবীরের অনুগামীরা ‘সুরত গোপাল’-এর নেতৃত্বে একটি শাখা-মত প্রচার করতে অগ্রণী হন। এর নাম ‘কবীর-পন্থ’ বা কবীর নির্দেশিত পথ। কবীরের অন্য অনুগামীদের মধ্যে বণিক ধর্মদাসও একটি অন্য পন্থা অনুসরণ করতে থাকেন। সাধক মলুকদাসও ছিলেন কবীরের অনুগামী। তবে ষোলো শতকের প্রসিদ্ধ সাধক  ‘দাদু’, কবীরের সমন্বয়ী আধ্যাত্মিক মতকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন। কবীরের মতাদর্শকে আধার করে দাদু ‘পরমব্রহ্ম’ নামে একটি সম্প্রদায় নির্মাণ করেছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিলো প্রেম ও সৌহার্দ্যের বন্ধনে সমস্ত মানবজাতিকে সম্মিলিত করা। এই মতের প্রতিনিধি সুন্দরদাস,  ধরণীদাস,  ভানসাহেব এবং  রজ্জব, মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত ছিলেন।

 

এদেশের একজন প্রধান ধর্ম ও দার্শনিক গুরু নানক, কবীরের শিক্ষায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর নবধর্ম ‘শিখপন্থ’-এর দার্শনিক ভিত্তি বহুলাংশে কবীর প্রভাবিত ছিলো। আচার্য নীহাররঞ্জন রায় বলেছিলেন,

 

‘One of the tallest of Guru Nanak’s predecessors, perhaps an elder comtemporary, in the line of mystic sants and sadhus, and the greatest representative of what is called the Sant synthesis was Kabir, and it was Kabir’s way of life and thought that seems to have had the greatest impact on the life and mind of Guru Nanak…’

(The Concept of Sahaj in Guru Nanak’s Theology and its Antecedents- Nihar Ranjan Ray)

 

লোভ, শোক, মোহ, মাৎসর্য-কাতর সামাজিক মানুষকে স্বরচিত অন্ধকূপ থেকে মুক্তি দিতে কবীর সারাজীবন নানা ভাবে প্রয়াস করে গেছেন। তাঁর এই উপদেশটি যেন শাক্যমুনি বুদ্ধ কথিত ‘তৃষ্ণা’ মুক্তির পথে এক নিবিড় পদক্ষেপ। জটিল ঐহিক মানব জীবনের অনন্ত কূট বিড়ম্বনা থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার এক বাতিঘর। এক প্রেয় শান্তিকল্যাণ।

 

“চাহ মিটি, চিন্তা মিটি, মনওয়া বেপরওয়াহ
জিসকো কুছ নহি চাহিয়ে, উওহ হ্যাঁয় শহনশাহ।।”


​​(যখন ​​​​​​​প্রাপ্তির ​​​​​​​তৃষ্ণা ​​​​​​​ মিটে ​​​​​​​যায়, ​​​​​​​চিন্তাও ​​​​​​​দূর ​​​​​​​হয়ে ​​​​​​​যায়। ​​​​​​​মন ​​​​​​​তখন ​​​​​​​মুক্ত, ​​​​​​​স্বাধীন। ​​​​​​​যার ​​​​​​​কোনও ​​​​​​​চাহিদা ​​​​​​​নেই ​​​​​​​সেই ​​​​​​​প্রকৃত ​​​​​​​রাজার রাজা)

 

 

তাঁর মরদেহ নাকি মানুষ খুঁজে পায়নি। পেয়েছিলো কিছু ফুল। ফুলেরই অগ্নি সংস্কার করেছিলো সবাই। তিনি বলতেন, যে নিজের বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে, কবীর শুধু তাকেই সঙ্গে নিয়ে চলেন। তারাই আগুনের ফুল হয়ে আগামী মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। কবীরের সামগ্রিক আধ্যাত্মিক অবস্থান ও বিশ্বাসকে যদি একটি মাত্র দোহার মধ্যে ধরতে চাওয়া হয়, তবে এই দুটি পংক্তির কোনও বিকল্প নেই।

 

‘কবীরা খড়া বজার মেঁ, লিয়ে লুখাতি হাথ, 

জো ঘর ফুঁকে অপনা, চলে হমারে সাথ ।।‘ 

 

(কবীর জ্বলন্ত মশাল হাতে ‘বাজার’ (যাপনবিশ্ব)-এর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যে (মানুষ) নিজের ‘বাড়ি’ (অহমিকা) জ্বালিয়ে দেবার মতো শক্তি রাখে, সেই শুধু আমার সঙ্গে চলুক।)

 

 

 

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

 

 

গ্রন্থঋণ

কবীর- ক্ষিতিমোহন সেন

कबीर: हजारी प्रसाद द्बिवेदी 

प्राचीन कबीर बीजक – (भाषा टीका)

अकथ कहानी प्रेम के – कबीर की कविता और उनका समय – पुरुषोत्तम अग्रवाल 

कबीर साखी 

कहत कबीर: सुरेश पटेल  

 

Songs of Kabir: by Rabindranath Tagore and Evelyn Underhill

Drunk on Love: An Essential Introduction to the Life, Ideas and Poetry of Kabir

Rikhi Vipul

Kabir the Vision of Wisdom- Chandan Sinha

Ocean of Love: The Anurag Sagar of Kabir: Michael Raysson

Simple Spirituality: RECALLING KABIR : Arun Tiwari

Kabir- Ecstatic Poems: Robert Bly

 

 

 

 

 

 

 

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত