| 20 এপ্রিল 2024
Categories
শিশুতোষ

শিশুতোষ গল্প: কালোরাজার দুঃখ । চিত্রা দেব

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

জিনজি দুর্গের নাম নিশ্চয় সবাই শুনেছে, দেখেছে কম লোক। চোখের সামনে থাকলেও জিনজি অনেক সময় চোখ এড়িয়ে যায়। আজ সেই দুৰ্গজয়ের কথা বলি। ইতিহাসে আছে, দুর্গটা তৈরি করেন চোল রাজারা। দক্ষিণ ভারতে চোল সাম্রাজ্য বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। তৈরি যিনিই করুন, এমন সুন্দর পরিবেশে দুর্গ কমই দেখা গিয়েছে। ছ’শো ফুট ওপরে কৃষ্ণগিরি, রাজগিরি। আর চন্দ্ৰর্দুগা, তিনটি পাহাড়ের চুড়োয় মুকুটের মতো  শোভা পাচ্ছে জিনজি দুর্গ। প্রকৃতিই তার রক্ষাকর্তা, একবার ঢুকলে প্ৰাণ নিয়ে আর বেরোতে হত না শক্ৰদের। অসুবিধে ছিল একটা, জল আনতে হত।অনেক নীচ থেকে, কষ্ট করে।

সকলেই জানত জিনজি দুর্ভেদ্য, জয় করা যায় না। তবু সব দিন তো কারও সমান যায় না, একদিন চোল সম্রাটদের পতন হল । জিনজি এল বিজয়নগরের রাজাদের হাতে । এমন দুর্গ সকলেরই পছন্দ । শোনা যেত, রাজারা তাঁদের ঐশ্বর্য এনে লুকিয়ে রাখতেন জিনজিতে । কে আসবে এই দুর্গ জয় করতে ? অসম্ভব কষ্ট করে ভেতরে ঢুকলেও ধনাগার কোথায় লুকনো আছে। কেউ বুঝতেই পারত না, অত বড় দুর্গ, কোথায় খুঁজবে ?

আমি যখনকার কথা বলছি, তখন নানা হাত বদলে জিনজি রয়েছে গোলকুণ্ডা বিজাপুরের সুলতানের অধীনে। দীর্ঘ উনচল্লিশ বছর ধরে সুলতান জিনজিকে হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন, শুধু তাই নয়, বহু ধনরত্ন লুকিয়ে রেখেছিলেন এই দুর্গে। রাখবেন নাই-বা কেন, একমাত্র এখানেই দশটি সৈন্য আটকে দিতে পারত দশ হাজার সুসজ্জিত সৈন্যকে । অন্যত্র তো এই নিশ্চিন্ত আশ্রয়টি ছিল না। তা. ছাড়া দুটাে মিষ্টি জলের ঝরনাও ছিল দুর্গে নেই-নেই করেও জলের অভাব তাতে কিছুটা মিটত । খুব বিশ্বাসী দুৰ্গরক্ষকের হাতে ভার দেওয়া হত। তিনি খুব বড় বীর না হলেও কাজ চলে যেত। মোট কথা, জন্ম থেকেই পাথুরে দুর্গটি অজস্রবার আক্রান্ত হয়েছে এবং শত্রুর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন জিনজি একভাবে থাকায় মোটামুটি শান্তির পরিবেশ গড়ে উঠেছিল ।
তবু আর-একদিন জিনজি দুর্গের দরজায় এক রাজা তাঁর দলবল নিয়ে এসে দাঁড়ালেন । ঠিক কী হয়েছিল সেই কথা বলা কঠিন, কেননা ইতিহাসে এ-সম্বন্ধে কমই বলা হয়েছে। জিনজিতে তখনও উৎসব চলছে, দুৰ্গরক্ষকের ছেলের বিয়ের। বেশ কিছুদিন ধরে খাওয়াদাওয়া, হইহট্টগোল, নাচগান হওয়ার পর অতিথিরা সবে বিদায় নিয়েছেন, সেই সময় এসে পড়লেন বীর সেনাপতি । উৎসবের সময় কাজের লোক সেজে গুপ্তচরেরা দুর্গের সব খোঁজখবর নিয়ে গিয়েছে তা তো কেউ বুঝতে পারেনি, তাই বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই দুর্গের সুবেদার বুঝতে পারলেন দুর্গ বাঁচাবার ক্ষমতা তাঁর নেই। সেপাইরা যে যেখানে পেরেছে পালিয়েছে । তিনিও ছেলে এবং আত্মীয়স্বজন যাকে পেলেন তাকে নিয়ে গোপন পথ দিয়ে পালিয়ে গেলেন একেবারে বিজাপুরে। নতুন কনেবউ তাঁর সখীদের নিয়ে দুর্গেই যে পড়ে রইলেন, সে-কথা সবাই বেমালুম ভুলে গেল ।

এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমরা ইতিহাসে দুৰ্গজিয়ের কথা বহুবার পড়েছি, কিন্তু সত্যিকারের দুর্গাজয় ব্যাপারটির পেছনে লুঠ, মার এবং মেয়েদের অপমান করার ব্যাপারটি রাজাদের সময়ে খুব হত । এ-ব্যাপারে রাজা বা নবাবে কোনও তফাত ছিল না। পরাজিত দুর্গের বন্দিনীদের দাসী-বাঁদি করে নিয়ে যেত বিজয়ীরা । ধনরত্ন, সোনা-রুপো তো কেড়ে নিতই। সেই জন্যই দুৰ্গজিয়ে সৈন্যরা প্রাণপণ চেষ্টা করত। অনেক সময় খুব দামি-দামি জিনিস রাজার জন্য রেখে দিয়ে বাকি সবই ভাগ করে দেওয়া হত সৈন্যদের মধ্যে । যিনি জিনজি জয় করলেন, তিনি কিন্তু অহেতুক লুঠ বা মারামারি পছন্দ করতেন না, অধিকাংশ ধনই বিলিয়ে দিতেন সেনাদের মধ্যে । সেনাপতি তা জানলেও যখন বন্দিনী মেয়েটিকে আনা হল, তখন তাকে দেখে তিনি অবাক হয়ে গেলেন, এত সুন্দর চাঁদের মতো মেয়ে তিনি আগে কখনও দেখেননি, যেমন রূপ—তেমনই রং । এ মেয়ে তো সামান্য মেয়ে নয়, এও একটি দামি রত্ন । একে দাসী-বাঁদির মতো যাকে-তাকে বিলিয়ে না দিয়ে রাজার জন্যই রেখে দেওয়া উচিত, না হলে এই মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য সব সেনাই ঝগড়াঝাটি শুরু করে দেবে । এদিকে ষোলো বছরের ফুলবানু তো ভয়ে-ভাবনায় সারা । এক সুবেদারের মেয়ে, আর-এক সুবেদারের পুত্রবধু হয়ে এসেছে।

শ্বশুরবাড়িতে কিংবা হারেমে পা রাখতেই এ কী বিপত্তি ! কী করবে সে ? স্বামী ও শ্বশুর দু’জনেই পালিয়ে গেলেন তাকে ফেলে, সে এখন কী করবে ? অনেক সময় মেয়েরা দুঃখ-কষ্ট এড়াবার জন্য এরকম পরিস্থিতিতে বিষ খেয়ে মরত। ফুলবানু সে-সুযোগও পায়নি, সাহসও হয়নি ।

দিন কয়েক পরেই বিজয়ী রাজা বসলেন দুর্গ থেকে কী-কী ধনরত্ন পাওয়া গিয়েছে তার হিসেব নেওয়ার জন্য । সেনারা সবাই দু’পাশে দাঁড়িয়ে, আজ তারা পুরস্কার পাবে। সবাই খুশি । মন্ত্রী হিসেব করতে বসেছেন । রাজা বললেন, সেনাপতি, বলুন, এই দুর্গ সোনা-রুপো জমা পড়েছে কোষাগারে ?”

সেনাপতি বললেন, আপনার আদেশ অনুযায়ী সবই কোষাগারে জমা আছে, শুধু…

শুধু কী ?

একটি অমূল্য রত্ন কোষাগারে নেই, তাকে সসম্মানে হারেমেই রাখা হয়েছে । মেয়েটি পরাজিত সুবেদারের পুত্রবধু। এমন রূপসী মেয়ে কমই দেখা যায় । তাকেও অমূল্য রত্ন বলা চলে।
রাজা একটু বিস্মিত হয়ে সেনাপতির দিকে তাকালেন । সাধারণত তাঁর সৈন্যরা মেয়েদের অসম্মান করে না , আর সেনাপতিরও চরিত্রবান হিসেবে সুনাম আছে। সেই সেনাপতি সুন্দরী বলে একটি হারেমকন্যাকে বন্দি করে রেখে, তাকে অমূল্য রত্ন বলছেন দেখে রাজা মনে-মনে অধীর হয়ে উঠলেন । বললেন, অন্য ধনরত্নের হিসেব থাকুক, আগে সেই মেয়েটিকেই নিয়ে আসুন। এখনই…

সবাই অবাক ! সেনাপতি বললেন, এখানে নিয়ে আসব ?

হ্যাঁ, রাজার চােখে কৌতূহল। 

ফুলবানু ভয়ে-ভয়ে এল বলির পশুর মতো কাঁপতে-কাঁপতে । ফুলবানু নামটা অবশ্য ইতিহাসে নেই। যে বিখ্যাত নয়, ইতিহাস তার নাম লিখে রাখে না । কিন্তু ফুলের মতো মেয়েটিকে আমরা এই নামেই ডাকব। বন্দিনীর আজ কোনও সাজা নেই, শুধু লম্বা ঘোমটায় মুখখানি ঢাকা । রাজার আদেশে তাঁর সামনে ফুলবানুর ঘোমটা খুলে দিল দাসী, ভয়ে চোখ বুজে ফেলল সে । কিন্তু সভার সকলের চোখে যেন পলক পড়ে না, এত সুন্দর মেয়েটিকে দেখে সকলেরই ভাল লাগল, মন চঞ্চল হয়ে উঠল । রাজাও অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ । তারপর অভিভূত কণ্ঠে বললেন, সত্যি তুমি কী সুন্দর, চাঁদের আলোর মতো তোমার গায়ের রং । আমি কী ভাবছি জানো, বলে নিজের কালো বলিষ্ঠ হাত দুটি তুলে আলোতে ভাল করে দেখে নিয়ে শিশুর মতো হেসে উঠলেন, ইস, তুমি যদি আমার মা হতে, তা হলে। আমি এত কালো হতাম না ।

সভার সকলে অবাক! আর ফুলবানু ? সে তখন তার পদ্মফুলের পাপড়ির মতো বড়-বড় চােখ দুটি মেলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে জিজাবাঈয়ের কোল আলো-করা কালো রাজার মুখের দিকে । এমন আবার হয় নাকি ? সে কত কথা শুনেছে হারেমে বসে। কত অত্যাচার, কত অপমানের গল্প, তার দু’ চােখ ভিজে যায়, আহা সে যেন এমন একটি ছেলের মা হয়, যে নারীকে সম্মান দিতে পারে ।
ওদিকে শিবাজি তখন তাঁর সেনাপতি ও সমস্ত সৈন্যদের দিকে ফিরে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, তোমরা শুনলে তো আমি এই মেয়েটিকে মা বলেছি। কাজেই তোমরা সবাই একে আমার মা জিজাবাঈয়ের মতো সম্মান করবে । 

তারপর সেনাপতির দিকে তাকালেন, তোমার ওপর একটি বিশেষ দায়িত্ব দিচ্ছি। তুমি আমার মাকে সমস্ত দামি অলঙ্কার ফিরিয়ে দেবে আর তাকে রাজমাতার সম্মান দিয়ে পালকি করে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে বিজাপুরে। সেখানেই সুবেদার তাঁর ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন।  মাকে সসম্মানে তার বাড়িতে পৌছে দেওয়া হলে আমি খুশি হব। দেখো, কেউ যেন আমার মায়ের কোনও অসম্মান না করে ।

শিবাজি এতবার করে সাবধান করে দিয়েছিলেন, কেননা তিনি বুঝেছিলেন ফুলাবানুর অপরূপ রূপ যে-কোনও মানুষকে অভিভূত করে দিতে পারে। তাঁর সৈন্যরা ভাল এবং তাঁর অনুগত হলেও যদি-বা তাদের মনে কোনও দুষ্টুবুদ্ধি সাপের মতো ফণা তোলে, শিবাজির এই সাবধানবাণী সেই সাপের মাথায় লাঠি মারবে। তিনি যাকে মা বলেছেন তাঁর দিকে তাঁর প্রজারা কখনও তাকবে না।

যেমন কথা, তেমনই কাজ । ফুলবানুকে ফিরিয়ে দেওয়া হল তার দামি-দামি গয়না, তার রাজা ছেলের তরফ থেকেও দেওয়া হল অতি মূল্যবান রত্ন দিয়ে তৈরি করা অলঙ্কার, সব নিয়ে মেয়ে রানির মতো সসম্মানে ফিরে গেল তার স্বামীর সংসারে । শিবাজিকে সেই সংবাদ জানানো হল। শুনে খুশি হয়ে তিনি আর-একবার বললেন, সত্যি, মেয়েটি খুব সুন্দর, আমি ওর ছেলে হলে এত কালো হতাম না বোধ হয়।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত