| 20 এপ্রিল 2024
Categories
লোকসংস্কৃতি

লোকসংস্কৃতি: রঙিন হাঁড়ি শখের হাঁড়ি । নুসরাত জাহান

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

কিংবদন্তী আছে যে, হাতি নিজের শুঁড় দিয়ে প্রায়ই নিজের মাথায় কাদামাটি ছড়ায়। সে কাদামাটি শুকিয়ে একদিন তার গোলাকার কপালের ওপর থেকে এক খাপরা মাটিতে পড়ে গেলে তা দেখে মানুষের মনে মৃত্‍পাত্র তৈরির বুদ্ধি আসে। সংস্কৃত ভাষায় হাতির কপাল অর মাটির কলস শব্দদ্বয়ের প্রতিশব্দ হলো কুম্ভ। তা থেকে কুম্ভকার শব্দের উত্‍পত্তি। সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত ভেতরে গর্তবিশিষ্ট মাটির পাত্রের বয়স আনুমানিক দশ হাজার বছর। আগুনের আবিষ্কার এবং নব্যপ্রস্তর যুগে খাবার রান্না করার কৌশল আয়ত্তে আসার পর মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করার প্রয়োজন অনুভূত হয়। প্রথমে হাতে টিপে টিপে সাধারণ পাত্র তৈরি করা হতো। কুমারের চাকা আবিষ্কারের ফলে পটারি বা মৃত্‍পাত্র তৈরি রীতিমত একটি শিল্পে পরিণত হলো। সনাক্ত হলো লোক ও কারুশিল্প বলে। স্থানিক ও কালিক ব্যবধানে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে সাধারণ মৃত্‍পাত্র পরিণত হয় সৌন্দর্যের, চিত্র ও নকশাগুণ সম্পন্ন বর্ণাঢ্য হস্তশিল্পে। বাংলাদেশেও মৃত্‍পাত্রের মধ্যে হাঁড়ি সাধারণ গৃহস্থালীর প্রয়োজন থেকে সৌন্দর্যের, সুষমার, চিত্রগুণ সম্পন্ন চিত্রিত হাঁড়িতে পরিণত হয়েছে। অর্থাত্‍ সাধারণত দুই শ্রেণীর হাঁড়ি বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এক, রান্না-বান্নার কাজে, গৃহস্থালী প্রয়োজনে নানা গড়ন, মাপের, সাধারণ বড়, মাঝারি ও ছোট হাঁড়ি। আর দুই, চিত্রিত হাঁড়ি।

উত্‍সব, পালা-পার্বণ-পূজা উপলক্ষে গ্রামীণ মেলায় চিত্রিত হাঁড়ির পসরা বসে। এছাড়া বিয়ে ও অন্যান্য লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে মিষ্টি, পিঠাসহ চিত্রিত হাঁড়ি গ্রামে আত্মীয়-কুটুম্বের বাড়িতে উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। কোনো কোনো স্থানে বিবাহের সম্বন্ধ পাঠানোর সময় মিষ্টি পাঠানোর নিয়ম রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতিতে এবং চিত্রিত হাঁড়িতেই তা পাঠানো হতো পূর্বে। আবার কোনো গর্ভবতী নারীকে স্বাদভক্ষণের (কোনো কোনো অঞ্চলে “সাটুর” বলে পরিচিত) সময় সাত ধরনের মাছ, সাত ধরনের ফল, সাত ধরনের মিষ্টি ইত্যাদি নকশা করা হাঁড়িতে করে গর্ভবতী নারীকে প্রেরণ করা হতো। চিত্রিত নয় এমন কোনো সাধারণ হাঁড়িতে পাঠানো হতো না। তখন একটি ধারণা মানবমনে কাজ করতো যে, হাঁড়ির ভেতরে যাই থাকুক না কেন, হাঁড়িটি অবশ্যই চিত্রিত হওয়া চাই। নকশা হিসেবে ফুল, পাতা, পদ্মফুল, মাছ, প্রজাপতি, পানপাতার নকশা এবং সহযোগী সরাতে আঁকা হতো নানা নকশা। এসব হাঁড়ির গায়ে আকর্ষণীয়ভাবে লাল, নীল, হলুদ আর সবুজের প্রলেপ দেয়া হতো। সাম্প্রতিককালে এই চিত্রিত হাঁড়ির ব্যবহারে আরো বৈচিত্র্য এসেছে। যেমন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের তোরণ নির্মাণে, অন্দরসজ্জায় আজকাল চিত্রিত হাঁড়ির ব্যবহার বেশ চোখে পড়ে। এছাড়াও শহুরে এলাকায় বৈঠকখানায় চিত্রিত হাঁড়ি সংস্কৃতি পরিচায়ক, অহংকার ও গৌরবের বস্তু হিসেবে স্থান দখল করে নিচ্ছে। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের চিত্রিত হাঁড়ির নাম, গড়ন, নকশা, চিত্রগুণ এবং সৌন্দর্যে বিভিন্নতা ও পার্থক্য বেশ লক্ষণীয়। এই চিত্রিত হাঁড়ির নাম কোথাও রঙ্গের হাঁড়ি, কোথাও শখের হাঁড়ি নামে পরিচিত। হাঁড়ির গড়ন ও ব্যবহার ভেদেও রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। যেমন মঙ্গল হাঁড়ি, সাপুড়ে হাঁড়ি, বালির হাঁড়ি, ঝরা হাঁড়ি, ফুল হাঁড়ি, জাগরণ হাঁড়ি, গর্ভ হাঁড়ি, আইবুড়ো হাঁড়ি, বাকু হাঁড়ি ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশে এই চিত্রিত হাঁড়ির অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকলেও রাজশাহী অঞ্চলের শখের হাঁড়ির নাম বেশ জনপ্রিয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও একই রকম চিত্রিত হাঁড়ি তৈরি হয় এবং সেখানেও চিত্রিত হাঁড়ির নাম “শখের হাঁড়ি” বলে পরিচিত।


আরো পড়ুন: পুরাণে-ঐতিহ্যে শঙ্খশিল্প


বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই চিত্রিত হাঁড়ি পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অঞ্চলগুলো হলো রাজশাহীর সিন্দুরকুসুম্বী, বায়া, হরগ্রাম, বসন্তপুর, চাপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার বারোঘরিয়া গ্রাম, ঝিনাইগতি থানা, ঢাকার নয়াঘাট, মানিকগঞ্জের ধামরাই, কুমিল্লা, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী, ফরিদপুরের কোয়েলজুড়ি ও হাসরা, টাঙ্গাইলের কালিহাতি, জামালপুরের বজরাপুর, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডু থানার ইদিলপুর, ময়মনসিংহের বালাসুর। অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের চিত্রিত হাঁড়ির নাম, গড়ন, নকশা, মোটিফ, রঙের ব্যবহার ইত্যাদিতে রয়েছে বেশ লক্ষণীয় পার্থক্য। হাঁড়ির গড়নে অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্য উল্লেখ করার মতো। যেমন কোনো অঞ্চলে চিত্রিত হাঁড়িতে ঢাকনা আছে, আবার কোথাও নেই। কোনো কোনো অঞ্চলে চিত্রিত হাঁড়ির হাতলও থাকে। চিত্রে রঙ ও মোটিফের ব্যবহাররীতির আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেমন রাজশাহীর পবা থানার বসন্তপুরের শখের হাঁড়িতে ব্যবহৃত মোটিফ দেখতে পাওয়া যায় হাতি, ঘোড়া, পাখি, মাছ, রাজহাঁস, পাতিহাঁস, বিভিন্ন ধরনের ফুল, নকশী লতাপাতা, শাপলাফুল, প্যাঁচা, কবুতর, চড়ুই পাখি ইত্যাদি। গোয়ালন্দের শখের হাঁড়ির মোটিফ নকশী লতাপাতা, ফুল। আবার কোনোটাতে জ্যামিতিক নকশা। আজকাল অবশ্য নানা রকম চিত্রের আদল রূপায়ন করা হয়। সুদূর অতীতে যখন আধুনিক কালের মতো রঙ ছিল না, তখন আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা সাদা রঙ, চুলার কালো কয়লা, হাঁড়ি-পাতিলের নিচের কালো রঙ, লাল ইটের রঙ এবং সিঁদুর রঙ ব্যবহার করা হতো। রঙের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি ও চকচকে করে তোলার জন্য জিগা গাছের আঠা, বহেরা ফলের আঠা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার উপযোগী করে নেয়া হতো। হাঁড়ির রঙের আধিক্যে রাজশাহী অঞ্চলে লাল রঙের, ঢাকা, কুমিল্লা এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে হলুদ রঙের, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, শিলিগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর এলাকার হাঁড়িতে লাল রঙের ব্যবহার বেশি থাকে। তবে দুই বাংলার মৃত্‍শিল্পীদের হাঁড়ির রঙের তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যায় পাবনা, রাজশাহী, যশোর, রংপুর এবং ময়মনসিংহ জেলার তুলি শিল্পীদের চিত্রণ বেশি উন্নত ও সমাদৃত।

বাংলাদেশের হস্তশিল্পের এক অমূল্য সম্পদ চিত্রিত হাঁড়ি ধারণ করে আছে শ্বাশত বাংলার লোকসমাজের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, ধর্ম-বিশ্বাস, লৌকিক আচার-আচরণ এবং উত্‍সব। আকারে-গঠনে-গড়নে চিত্রিত হাঁড়ি গ্রাম-গঞ্জের মানুষের হৃদয়-মন জয় করেছিল। ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিবাহ, আচার-ব্রত অনুষ্ঠানে আভিজাত্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যেটি না হলে তখন আর চলতো না। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি বাসন-কোসন, হাঁড়ি, পাতিল, কলস এবং ছোট ছোট শিশুদের খেলনার স্থান দখল করে নিয়েছে। এছাড়া অর্থনৈতিক কারণে চিত্রিত হাঁড়ির প্রস্তুত ও বাজারজাতকরণে প্রতিকূল অবস্থার কারণে শিল্পীরা ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। সবকিছু মিলিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পটিকে আমরা হারাতে বসেছি। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত