সখিনা শব্দটা ঠিকই শুনতে পায়। বয়স হলেও ওর শ্রবণশক্তি তীক্ষ। ও দা উঁচিয়ে সুলেমানকে তাড়া করলে সুলেমান ছুটে পালায়। সখিনাও পিছু নেয়। একপর্যায়ে ও সুলেমানকে লক্ষ্য করে দা-টা ছুড়ে মারলে সেটা অল্পের জন্য ওর গায়ে লাগে না। তার পরও দা-টা কুড়িয়ে নিয়ে সুলেমানের পিছু ছাড়ে না। ও বুঝে গেছে যে রাজাকারটার গায়ে একটা কোপ দিতে না পারলে ওর মাথা ঠাণ্ডা হবে না। ওর শরীরে আগুন। আকাশ যদি সব বৃষ্টি ঝরিয়ে দেয়, তবু ওর আগুন নিভবে না। কিন্তু বেশিক্ষণ ওর দৌড়ানো হয় না। আকবর আলী ওর পথ আটকায়।
সখিনা খেঁকিয়ে বলে, কি অইছে?
আমার লগে আপনেরে যাইতে অইবে বুজান।
ক্যান? ফাতেমার ব্যাদনা উঠছে?
হ। মেলাক্ষণ ধইরা কঁকাইতাছে।
আর তুমি মিয়া বইয়া রইছ। চলো। ওই রাজাকার শুয়োরডারে মারতে পারলাম না।
পারবেন একদিন।
হেইদিন তুমি থাকবা আমার লগে?
গেরামে থাকলে থাকমু। আর যুদ্ধে গেলে—
থাম। বাতাসের কান আছে।
এই দ্যাশের বাতাস অহন আমাগো লগে। হুনলেও মুখ খুলব না।
সখিনা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে আকবর আলীকে দেখে। মানুষটা যুদ্ধে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে, শুধু স্ত্রীর প্রসবের অপেক্ষা। যে কচি মানুষটা পৃথিবীতে আসবে তার মুখটা দেখে তবেই তো বিদায় নেবে। সেটা হবে শুভ বিদায় নেওয়া। আকবর আলীর কপালে বড় একটা কাটা দাগ আছে। দুকান বরাবর একদম সোজা টানা লাইন, যেন একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। সখিনার চোখের আগুন নিভে গিয়ে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ওর শুকনো হাড়গোড়সর্বস্ব শরীরে কোথায় যেন কি আছে, যেটা এই গ্রামের অনেকের চেহারায় নেই, এটা আকবর আলীর ভাবনা।
সখিনা মৃদু কণ্ঠে বলে, এই গেরামের আকাশ-বাতাস-পশু-পক্ষী-তৃণলতা সব আমাগো পক্ষে। যুদ্ধে আমরাই জিতুম।
আকবর আলী সখিনার হাত থেকে দা-টা কেড়ে নিয়ে নিজের কপালে ছোঁয়ায়। সখিনার হাতে দা-টা ফেরত দিয়ে বলে, বুজান তাড়াতাড়ি চলেন।
তোমার কিন্তু মাইয়া অইবে আকবর আলী।
ক্যামনে বুঝলেন?
কত প্যাড খসাইলাম। আমি যা কই হেইডাই হয়।
সখিনার তীক্ষ খনখনে কণ্ঠে প্রবল আত্মবিশ্বাস। এ আত্মবিশ্বাসের বলে একটি ধারাল দা নিয়ে ও যুদ্ধ করতে নেমেছে। সুলেমানের মতো রাজাকাররা, যারা গায়ের জওয়ান মেয়েদের পাক বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়ার জন্য খুঁজে বেড়ায়, তাদের ও তাড়া করে। খুব সহজে ও বুঝতে পারে যে মানুষটার মতলব কি। সখিনা একই কণ্ঠস্বরে বলে, তোমার মাইয়াডা আর সময় পাইল না। যুদ্ধ মাথায় কইরা আসতে আছে। কথা শেষ করতে না করতে হো হো করে হাসে নিজের মনে।
হাসেন ক্যান বুজান?
মাইয়াডারে মিলিটারির হাত থাইকা বাঁচান লাগব না! সখিনার হাসি থামে না। আকবর আলী বিব্রত হয়ে বলে, কি যে কন বুজান।
সখিনার কণ্ঠস্বর একই রকম। কণ্ঠস্বরের হেরফের হয় না। বলে, যুদ্ধ যদি মেলা দিন চলে?
চলতে পারে। চলুক। আমার মাইয়া আপনের মতো মুক্তিযোদ্ধা অইবে। যুদ্ধ করবে।
ঠিক কইছ, মিলিটারির হাতে পড়ার আগে কয়ডারে মাইরা লইবে।
দুজনে কথা শেষ করতে করতে বাড়িতে পৌঁছে যায়।
ফাতেমার মা আমিনা বিবি শুকনো মুখে মেয়ের কাছে বসে আছে। মেয়েটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে, ফ্যাকাসে বিবর্ণ মুখ আলোহীন। ওর নিবু নিবু চোখের তারার দিকে তাকালে বুক ধড়ফড় করে। কিন্তু ব্যথা জোরেশোরে ওঠে না। প্রসবের সময়ই তো মেয়ে মানুষ বোঝে জোরেশোরে ব্যথা ওঠা কি! সখিনা দীর্ঘদিন ধরে দাইয়ের কাজ করছে। কতগুলো ছেলেমেয়ে ওর হাতে হয়েছে তার হিসাব নেই। জিজ্ঞেস করলে মাথা নেড়ে বলবে, হাজার হাজার। আকবর আলীর সঙ্গে বাড়িতে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। ফাতেমার কাছে বসে ওকে চেপেচুপে দেখে বলে, আর বেশিক্ষণ লাগব না। হইয়া যাইব।
হইয়া যাইব? আমিনা বিবি বিস্ময়ে সখিনার দিকে তাকায়। মেয়ে মানুষটা কি জাদু জানে, এমন করে কথা বলছে কিভাবে? তারপর জোরে জোরে বলে, আল্লাহ মাবুদ রহম করো।
আমিনা বিবি দুহাত ওপরে তোলে। দরুদ পড়ে মেয়ের কপালে ফুঁ দেয়। সখিনার দুহাত ধরে বলে, আপনেরে দেইখা আমার ধরে পরান আসছে।
সখিনা মুদৃ হাসে। ওর হাসিতে মায়াবী রহস্য আছে, আমিনা বিবির তাই মনে হয়। অন্যদের হাসিতে ওর এমন কিছু চোখে পড়েনি। এই গাঁয়ের কেউই সখিনার মতো না। সখিনা মুখে হাসি আটকে রেখে ফাতেমার পেটের কাপড় আলগা করে দেয়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আকবর আলীকে উঁচু কণ্ঠে বলে, নাড়ি কাডার লাইগা বেলেড আনছ? আমিনা বিবি বলে, সব রেডি আছে।
চুলায় গরম পানি রাখো।
আইচ্ছা।
আমিনা বিবি সুলতানের মাকে চুলায় এক হাঁড়ি পানি বসাতে বলে।
ত্যানা রাখছ?
দুইডা পুরান শাড়ি আছে।
সখিনা ঘুরে আমিনা বিবির মুখের দিকে তাকায়। আবার সেই রহস্যময় ভঙ্গি দুচোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে দপ করে নিভে যায়। সখিনা অভিজ্ঞ কণ্ঠে বলে, বাইচ্চা বিয়ানো মাইয়ালোগের একডা যুদ্ধ, বুজলা।
আমিনা বিবি মাথা নাড়ে। সে নিজে দশটা ছেমেয়ের জন্ম দিয়েছে। তার মধ্যে দুটা মরা হয়েছিল। যুদ্ধ কি ও বোঝেনি। বাচ্চা বিয়ানো খুব কঠিন সেটাও ওর মনে হয়নি। কিন্তু সখিনার অভিজ্ঞতা এমন কেন?
সখিনা মা হতে পারেনি। নিঃসন্তান। কিন্তু সখিনা যুদ্ধ বোঝে। সে জন্য সখিনা দেশের যুদ্ধকে নিজের দায়ের মাথায় তুলে নিয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধে নেমেছে। আমিনা বিবি হঠাৎ করে সখিনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। সখিনা ভ্রু কুঁচকে বলে, কি অইল সালাম করলা ক্যান?
আপনে সালাম পাওয়ার মানুষ হের লাইগা।
সখিনা হা হা করে হাসে। হাসতে হাসতে দা-টা উঠিয়ে বলে ইডা চিনো?
কি এডা?
যুদ্ধ। স্বাধীনতার যুদ্ধ।
ঠিক বুজছ। তুমিও মুক্তি। মুক্তিরা বাড়িতে আইলে ঠিকমতন খাওন দিও।
আমিনা বিবি ঘাড় কাত করার সঙ্গে সঙ্গে ফাতেমা ও মাগো বলে আর্তচিত্কার দিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে। কাছাকাছি যারা ছিল তারা উঠোনে জড়ো হয়। শুকনো মুখে তাকিয়ে থাকে বন্ধ দরজার দিকে। ফাতেমার আর্তনাদের শব্দে আকবর আলী বারান্দা থেকে নেমে চলে যায়। ওর বুকের ভেতর প্রবল জলের শব্দ গুমগুম করে। ও নিজেকে সামলাতে গিয়ে অনুভব করে ফাতেমার আর্তচিত্কার শুনে ওর দুচোখ জলে ভরে গেছে।
এর কিছুক্ষণের মধ্যে সখিনা দরজা খুলে চেঁচিয়ে বলে, একডা মাইয়া হইছে গো। চাঁদের মতো ফুটফুইট্টা মাইয়া। মিলিটারি আর রাজাকাররা দেখলে অহনই লইয়া যাইব। কইব, এই দ্যাশে এমুন খুবসুরত মাইয়া ডলনের লাইগা আর পাই নাই।
সখিনার কথা শুনে উঠোনে দাঁড়ানো মানুষগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যে যার কাজে চলে যায়। শুধু আকবর আলী একা দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবে, অহনই তো যুদ্ধে যাওয়ার সময়। মাইয়ার মাথা ছুঁইয়া কমু স্বাধীনতা না লইয়া ঘরে ফিরুম না। ওর নাম রাখুম চন্দ্রমণি।
একটু পরে সখিনা ওকে ডাকে। বলে, আহ মাইয়ার মুখ দ্যাহ।
আকবর আলী দ্রুত পায়ে ঘরে ঢোকে। ন্যাকড়ায় জড়ানো ছোট মানুষটা অপূর্ব সুন্দর, মাথা ভর্তি চুল। ও অপলক তাকিয়ে থাকে।
আমিনা বিবি ভীত কণ্ঠে বলে, নজর দিও না বাজান।
কোলে দিবেন?
সখিনা চেঁচিয়ে বলে, না কোলে দিমু না। অহন যাও। আকবর আলী ফাতেমার কপালে হাত রেখে বেরিয়ে আসে। নিচু এবং তীক্ষ স্বরে বলে, মাইয়া দেখছ। অহন যুদ্ধ। অহনই গেরাম ছাড়বা। তোমারে গেরামে দেখলে কল্লা ফালায়ে দিমু।
আকবর আলী সখিনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বলে, মাইয়ারে আপনের জিম্মায় থুইয়া গেলাম। মাইয়ার মায়েরেও দ্যাখবেন।
চিন্তা মাথায় রাখবা না। সব ঝাইড়ে ফালায়ে যাও। রব বাহিনীর কাছে টেরেনিং লইবা। ক্যাম্পের রাস্তা চিনো তো?
আকবর আলী মৃদু হেসে ঘাড় নাড়িয়ে চলে যায়। এ গ্রামের সব খোঁজ তো ওর নখদর্পণে। সবই তেমন আছে, শুধু পাক বাহিনীর ঘাঁটিগুলো নতুন, ওগুলো আবর্জনা, পোড়াতে হবে। সাধারণ মানুষ তো ঠিকই আছে, শুধু রাজাকারগুলো বদলা মানুষ, ওগুলোকে শেষ করতে হবে। এ দুটা বাড়তি জঞ্জাল ছাড়া দেশটা তো ওদের ঠিকই আছে। ও বাঁশঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সখিনার দৃষ্টি ওকে অনুসরণ করে। নড়তে পারে না সখিনা। মাথার ভেতর একটা প্রবল ঘূর্ণি ওকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। জ্বলে ওঠে চোখ। রব বাহিনীর ইনফর্মার হয়ে কাজ করে। সামনে একটা বড় যুদ্ধ, করতেই হবে, না করলে শুয়োরগুলো নড়বে না। ঘোঁত ঘোঁত করতেই থাকবে। সখিনা আপন ভাবনায় তলিয়ে যায়। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে, ঘরের ভেতর থেকে একটু আগে জন্ম নেওয়া চন্দ্রকন্যার কান্না ভেসে আসে। আহা, গানের মতো লাগছে, সখিনার বুক ভরে যায়, যুদ্ধের সময় জন্ম নিলেও যুদ্ধ বুঝবে না, কিন্তু দেশ স্বাধীন হলে দেশের নদীর জল ওর হবে, বাতাসের শ্বাস নেওয়াটা ওর নিজের হবে। ওর জন্য এসব আনবে বলেই তো ওর বাবা যুদ্ধে গেল। আজ থেকে মেয়েটির নাম চন্দ্রকলা।
ও ঘুরে দাঁড়াতেই দৌড়াতে দৌড়াতে আসে জামাল। ওকে দেখেই চিত্কার করে ওঠে, খালা গো!
কি অইছে?
আপনের বইনের পোলা তাজুলরে মিলিটারিরা গুলি দিছে। ও স্কুলের মাঠে চিৎ হইয়া পইড়া আছে।
সখিনা মুহূর্তমাত্র বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ঘরে ঢুকে নিজের পরনের শাড়িটা খুলে ফেলে ফাতেমার মেয়ের জন্য ন্যাকড়া বানানোর পুরনো শাড়িটা পরে। জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া শাড়িটার বিভিন্ন অংশ গায়ের ওপর টেনে রাখে। রান্নাঘরে গিয়ে চুলোর ছাই মাখায় মাথায়-হাতে-পায়ে-চুলে। ভিখারিণী সাজে। একটা নারিকেলের মালা দড়ি বেঁধে গলায় ঝুলিয়ে মাগো ভিখ দ্যান বলতে বলতে বেরিয়ে যায়। এভাবেই ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে নানা খবর পৌঁছায়। ছোটখাটো অপারেশনেও অংশ নিয়েছে। কখনো সরাসরি চলে যায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পে। কলসি ভরে টিউবওয়েল থেকে পানি এনে দেয়। দুবার দুজন রাজাকার হাত ধরে পাটক্ষেতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। বাধা দিয়ে কুলোতে পারেনি। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে এই বলে যে এটাও যুদ্ধ। শরীর দিয়ে যুদ্ধ। মাইয়া মানুষ পুরুষের চাইতে বেশি পারে। ও ধর্ষণের ব্যাপারটি গায়ে মাখেনি। বরং ওই ধর্ষণ ওকে আরো তেজি করেছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলেছে, দেহামু যুদ্ধ কারে কয়। তবে কেউ ওকে বেশি বিরক্ত করেনি—ওদের লক্ষ্য জেয়ান ডবকা মেয়ে। তখনই তো ওর হাতে দা উঠেছে। কুপিয়ে শেষ করার তাড়নায়। একদিন একজনকে পাগলিনী সেজে তাড়া করেছিল। লোকটি ব্রিজের ওপর থেকে লাফ দিয়ে পড়েছিল নদীতে।
সখিনা এসব ভাবতে ভাবতে মাঠের ধারে বড় গাবগাছটার নিচে বসে। স্পষ্ট দেখতে পায় জামালকে। গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, মুখটা তেমন আছে, যেমন ও ঘুমিয়ে থাকে, ঠিক তেমন—সখিনা নিজেকে বোঝায়, এমন বীরই তো চাই, চিৎ হয়ে নিজের আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে রাখবে।
সারা দিন পড়ে থাকে জামালের লাশ।
সারা দিন আকাশে ওড়ে শকুন।
সারা দিন বসে থাকে সখিনা।
সূর্য দপদপ করে মাথার ওপরে।
ওর খিদে পায় না।
ওর বুকের ভেতরে ক্রোধ জমে। ও দুচোখ ভরে শকুনের ওড়া দেখে, ভাবে মাঠ ভরে হাজার হাজার শকুন নামাতে হবে—মিলিটারি আর রাজাকারগুলোর চর্বিসর্বস্ব শরীর খুবলে খাবে ওরা। ওহ, বুকটা তড়পায়, কিন্তু কাঁদে না, ওর কান্নাও পায় না। যুদ্ধের সময় মানুষকে মরতে হবে, কিন্তু তার জন্য কাঁদতে হবে না। কাঁদলে ক্রোধ ভিজে যাবে। ক্রোধ ভেজানো চলবে না। একজন এসে ওকে একটা লাথি দিয়ে বলে, বসে আছিস ক্যান?
খিদা লাগছে বাজান।
খিতে পায় কেন? মরতে পারিস না?
তাইলে গুলি দ্যান, খাই আর মরি।
ওই তুই কে রে এত বড় কথা বলিস! মাথা তোল তো মুখটা দেখি। সখিনা মাথা তোলে না। কাত হয়ে পড়ে যায়। মুখ গোঁজে মাটিতে। লোকটা ওকে আরো একটা লাথি মেরে চলে যায়। শুয়ে থেকেই ও দেখতে পায় জামালের লাশ চ্যাংদোলা করে তুলে নদীতে ফেলার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। সখিনা দুহাতে ঘাস আঁকড়ে ধরে। ভাবে, গাছের ছায়ার নিচের কি শীতল মাটি, ওর শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে! তখন ওর চোখ ভিজতে শুরু করেছে। নিজেকে আর সামলানো যাচ্ছে না, কিছুতেই না, লোহার মানুষ হলেও এ সময় তার চোখ না ভিজে পারে না।
বুকের ভেতর ভেসে উঠে ছবি।
স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পরে আর একদিনও থাকেনি শ্বশুরবাড়িতে। কাউকে কিছু না বলে এক কাপড়ে বেরিয়ে চলে যায়। কোথায় যাবে? বড় বোনের সচ্ছল পরিবার। সেখানে থাকার জায়গা হতে পারে। বোনের বাড়িতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ১০ বছরের জামাল চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে বলেছিল, খালা আসছে। আমি খালারে আর ছাড়ুম না। খালা আমাগো বাড়িতে থাকবে।
ওর বোন দুলাভাইও ওর ফিরে না যাওয়ার সংকল্পের সঙ্গে একমত হয়। নিজের উপার্জনে ভাত খাবে বলে ধাত্রীবিদ্যা শেখে। সরকারি হাসপাতালে সাত টাকা বেতনে কাজ পায়। এ বছরে এটা বেড়ে হয়েছে ১৫ টাকা। সেই জামাল ওর চোখের সামনে বড় হয়েছে। ও কি বুঝে ওকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। ও কখনো ওই বালকের কাছে তা জানতে চায়নি। সেই বালক এখন যুবক। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার অপরাধে জীবন দিল। ওর বাবা-মা ভয়ে আসেনি। সখিনা এই মাঠে একা।
ও উঠে দাঁড়ায়।
দুদিন পাক বাহিনীর ক্যাম্প রেকি করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হয়। ক্যাম্পে যারা ছিল ওকে ঘিরে ধরে।
খবর কি বুজান?
অপারেশনে যাইবা?
কহন?
অহন। অহনই।
অহনই অহনই—সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে ছেলেরা। তৈরি হতে থাকে। একজন ওকে এক বাটি মুড়ি দেয়, সঙ্গে গুড়। সখিনা মুড়ি-গুড় খেয়ে দু-তিন গ্লাস পানি খায়। মনে হয় আজ রাতই ওর রাত—আজই একটা কিছু হবে।
সে রাতেই একটা কিছু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাক বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। আকস্মিক আক্রমণে হতাহত হয় বেশ কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার। সখিনা ওর দা দিয়ে কুপিয়ে একাই হত্যা করে পাঁচ রাজাকার। সে রাতে ক্যাম্পে ফেরার পথে সখিনা দেখতে পায় চন্দ্রকলার বিস্তার। আকবর আলীর মেয়েটির মুখ তারার মতো ফুটে থাকে গাঁয়ের আকাশে! জন্ম ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের মুহূর্তটিতে সখিনা আবার ব্যাকুল হয়ে জামালের জন্য কাঁদতে থাকে।
ক্যাম্পে ফিরে ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত রান্না করে। নুন ভাত আর মরিচ পোড়া। বিজয়ের আনন্দে সাদা ভাত ওদের কাছে অমৃত। ওরা তরকারি চায় না, মাছ না, মাংস না। গল্পতে, উচ্ছ্বাসে বিজয়ের আনন্দ ওদের থালার সাদা ভাতের প্রতিটি যেন প্রস্ফুটিত জুঁইফুল। রাতে ঘুম আসে না সখিনার। ক্যাম্পের বাইরে বসে থাকে একা।
স্বামীর বাড়ি ছেড়ে আসার পরে ও আর বিয়ে করেনি। প্রস্তাব এসেছিল অনেক। ও রাজি হয়নি। বেঁচে থাকাকে নিজের মতো করে নিয়েছে। মনের মতো লোক না পেলে একা থাকাই তো ভালো। খবরদারি করার কেউ থাকবে না। ও খুশি। বেশ কেটে গেল জীবন। এখন এই যুদ্ধ ওর জীবনকে বদলে দিয়েছে। ও আর দুঃখী বিবি এবং সোনারবের কন্যা না। ওর ডাকনাম ঘটকি না। ওর গাঁয়ের নাম গরুই না। ওর সামনে পথঘাট এখন অনেক বড়। ওর নদীটা সাগর আর ওর চারপাশের গাছগুলো পাঁচ শ বছরের পুরনো। শুয়োরগুলোকে মেরে সাবাড় করে দিতে পারলে সব কিছুর ভেতরে নতুন জীবন আসবে। ও নতুন জীবন পাবে। সখিনা বিবি হাতের কাছে রাখা দায়ের গায়ে চুমু খায়।
একদিন দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
সবার মনে আনন্দ।
উত্ফুল্ল জোয়ারে মানুষের ভেতরে স্রোতের ঢল।
কিন্তু সখিনা বিবি বেশি খুশি হতে পারে না। ওর বুকের ভেতর আশঙ্কা। রাজাকার সুলেমানটা তো মরেনি। ওকে শেষ করতে না পারলে জামালের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না।
ও একা ঘরে শুয়ে দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, স্বাধীনতার জন্য অনেক দিয়েছে, কিন্তু পুরো স্বাধীনতা পাওয়া যায়নি। জামালের মা পাগলের মতো দিন কাটায়।
একদিন কমান্ডার রব এসে বলে, আমাদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। আপনিও আমাদের সঙ্গে যাবেন সখিনা বুবু।
না। আমি যামু না। সখিনা তীক্ষ কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে।
কেন যাবেন না? দেশ স্বাধীন হয়েছে।
স্বাধীন অইলে কি অইবে। রাজাকার সুলেমান মরে নাই। আবার যুদ্ধ লাগলে দা পামু কই?
হা হা করে হাসতে হাসতে কমান্ডার চলে যায়। ভাবে, মানুষটার মাথা খারাপ হয়েছে। যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে আবার যুদ্ধের কথা ভাবতে হবে কেন?
সখিনা বিবিকে তখন ডাকতে এসেছে কেউ। ধর্ষণের শিকার একটি মেয়ের গর্ভ খালাস করতে হবে। মেয়েটিকে এত দিন ঘরের মাচার ওপর লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সখিনা তীব্রভাবে লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে, পোলা হোক, মাইয়া হোক আমারে দিবা? লোকটি আগ্রহ ভরে বলে, দিমু, দিমু। আমার মাইয়া তো তাইলে বাঁইচা যায়। জন্মের লগে লগে আপনে লইয়া আইসেন। অহন আমার লগে চলেন।
হ, চলো।
সখিনা দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে। আজ ও একটি নতুন কাজে যাচ্ছে। একটি যুদ্ধশিশুর মায়ের গর্ভ খালাস!
দাইজীবনে এই কাজটি ওর করা হয়নি। এমন কতগুলো মেয়ে আছে এই গাঁয়ে যাদের এমন গর্ভখালাস ওকে করতে হবে।
আর একটি যুদ্ধ তো এখনই শুরু হলো। সখিনা চারপাশে তাকায়। গ্রামটা কেমন নীরব হয়ে আছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে ওর পায়ের শব্দই কেবল মাটি ফাটিয়ে চৌচির করে দিচ্ছে। নিজের পায়ের শব্দ ওকে তেজি, একরোখা ও সাহসী করে তোলে। নিজেকেই বলে, সখিনা বিবির হাতে মেলা কাম।
জন্ম জুন ১৪, ১৯৪৭ সালে। তিনি একজন প্রখ্যাত নারী ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব্ব সংকটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহংকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দু’ বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৪ ই জুন, ১৯৪৭, রাজশাহী শহরে। তাঁর পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রাম। বাবা এ কে মোশাররফ হোসেন এবং মা মরিয়মন্নেসা বকুল। তিনি পিতা মাতার চতুর্থ সন্তান।
সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে বাংলা অ্যাকাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে। তিনি ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি পাওয়ার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকাতে উপসম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। ১৯৭০ সালে দু’টো চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য চিঠি পান। একটি বাংলা অ্যাকাডেমিতে অন্যটি পাবলিক সার্ভির্স কমিশন থেকে সরকারি কলেজের জন্য। বাংলা অ্যাকাডেমীর চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন বাংলা অ্যাকাডেমির তৎকালীন পরিচালক কবীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, আবদুল্লাহ আলমুতি শরফুদ্দিন প্রমুখ। এর পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সরকারি কলেজের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বোর্ডে শহিদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে পান। কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলা অ্যাকাডেমির ‘অভিধান প্রকল্প’, ‘বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রকল্প’, ‘বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলি প্রকাশ’, ‘লেখক অভিধান’, ‘চরিতাভিধান’ এবং ‘একশত এক সিরিজের’ গ্রন্থগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা অ্যাকাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকুরি থেকে অবসর নেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ উৎস থেকে নিরন্তর প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ভ্রমণ তাঁর নেশা। তাঁর মোট উপন্যাসের সংখ্যা ২১টি, গল্প গ্রন্থ ৭টি এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ৪টি। বহু পুরস্কার পেয়েছেন সেলিনা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলা অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক ইত্যাদি।