[বড়ু চণ্ডীদাসের প্রামাণ্য জীবনী পাওয়া যায় নি। অনুমান করা হয় তিনি পঞ্চদশ শতকের মানুষ। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির সমসাময়িক। বিদ্যাপতির মতো তাঁর লেখায় নাগর-বৈদগ্ধ্য নেই। জয়দেবের পরে তিনি রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার কাব্য লিখেছেন। গীতিরস থাকলেও তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একটি কাহিনিকাব্য। নানা কারণে এই কাব্যটি বাংলাসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য]
।। জন্মখণ্ড ।।
কংসাসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন দেবতারা। সৃষ্টি যাচ্ছে রসাতলে। চিন্তিত দেবতারা। একটা প্রতিবিধান করা দরকার। দেবতারা এলেন দেবাদিদেব ব্রহ্মার কাছে। সব শুনলেন ব্রহ্মা। তিনি দেবতাদের নিয়ে গেলেন সাগরে। সেখানেই আছেন শ্রীহরি। একমাত্র তিনিই করতে পারেন প্রতিবিধান। দেবতাদের স্তবে তুষ্ট হলেন শ্রীহরি। তিনি তাঁদের একটি শ্বেত ও একটি কৃষ্ণ কেশ দিয়ে বললেন যে একটি কেশ থেকে বসুদেবপত্নী রোহিণীর গর্ভে জন্ম নেবেন বলরাম, আর দেবকীর গর্ভে জন্ম নেবেন বনমালী কৃষ্ণ। কংসাসুর নিহত হবেন এই কৃষ্ণের হাতে।
কংসাসুর নিধনের ব্যাপারে দেবতাদের মন্ত্রণার কথা কানে গেল নারদমুনির। সে কথা কংসকে জানাবার জন্য তিনি ছুটে এলেন তাঁর কাছে। তাঁর রঙ্গ কৌতুল দেখে কংস যখন হাসছিলেন, তখন নারদ বললেন, ‘হাসছ হাসো, কিন্তু তোমার বিনাশ আসন্ন।’
এ কি কথা বলছেন নারদমুনি! হাসি বন্ধ হয়ে গেল কংসের। কার হাতে মৃত্যু হবে কংসের? নারদ বললেন, ‘ দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্মাবে যে সন্তান, তার হাতেই মৃত্যু হবে তোমার।’
নারদের কথা শুনে সচকিত কংস। না, তিনি কোন ঝুঁকি নেবেন না। দেবকীর সব সন্তানকেই হত্যা করবেন তিনি। নিজের ভগ্নী বলে কোন দয়া-মায়া করা যাবে না।
এদিকে কংসের কাছ থেকে নারদ এলেন বসুদেবের কাছে। বললেন, ‘শোনো বসুদেব, তোমার পত্নী দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্ম নেবেন ভগবান নারায়ণ। তিনি হত্যা করবেন কংসকে। তাই কংস তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হবেন। কি করে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তানকে রক্ষা করতে হবে, সে পথ তোমাকে পরে বলে দেব।’
আতঙ্কগ্রস্ত কংস দেবকীর ছয়টি গর্ভ নষ্ট করে দিলেন। সপ্তম গর্ভে শ্বেতকেশ থেকে জন্ম হল বলভদ্রের। জননীর গর্ভপাতের ছল করে বলভদ্র আশ্রয় নিলেন রোহিণীর গর্ভে। অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণকেশ থেকে জন্ম হল শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণের। দেবকীর অষ্টম গর্ভের কথা শুনে কংস প্রহরীদের মোতায়েন করেছেন। সন্তানের জন্ম হলে সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হবে তাকে। শত্রুর শেষ রাখবেন না কংস।
দশমাস পরে এক অন্ধকার বর্ষণমুখর রাতে জন্ম হল কৃষ্ণের। দেবতাদের অনুগ্রহে সে কথা অবগত হলেন বসুদেব। আর ঠিক একই সময়ে যশোদা প্রসব করলেন একটি কন্যা সন্তান। প্রায় অচৈতন্য ছিলেন যশোদা, তাই জানতে পারলেন না কন্যা সন্তানের কথা।
পূর্ব পরামর্শমতো বসুদেব দেবকীর নবজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে নামলেন পথে। দৈবমায়ায় কংসের প্রহরীরা তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কৃষ্ণকে নিয়ে যশোদার গৃহে এলেন বসুদেব। কৃষ্ণকে যশোদার কোলে দিয়ে যশোদার কন্যা সন্তানকে নিয়ে এলেন দেবকীর কাছে। সেই কন্যার কান্নার শব্দে নিদ্রাভঙ্গ হল প্রহরীদের। খবর গেল কংসের কাছে। কালবিলম্ব না করে তিনি ছুটে এলেন কারাগৃহে। কংস সেই নবজাত কন্যাকে আছড়ে ফেললেন পাথরে। সেই সময় এক দৈববাণী হল: তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। তাহলে কি গোকুলের নন্দসন্তান তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। কংস পুতনাকে পাঠালেন নন্দগৃহে। স্তন্যপানের ছলনায় কৃষ্ণ তাকে বধ করলেন। তারপর গেল যমলার্জুন। সেও নিহত হল। এভাবে নিহত হল কেশী আদি অসুর। প্রমাদ গুনলেন কংস।
নন্দ আর যশোদার স্নেহচ্ছায়ায় বর্ধিত হতে লাগলেন কৃষ্ণ। ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর অনুপম দেহলাবণ্য। তাঁর ললাটের দুই দিক লঘু এবং মধ্যভাগ প্রশস্ত। নাসিকা ও লোচন সুগঠিত। ভ্রূ বঙ্কিম। ওষ্ঠাধর প্রবালসদৃশ। করযুগল আজানুলম্বিত। বক্ষস্থল মরকত মণিফলকসদৃশ। কটিদেশ সূক্ষ্ম, জঙ্ঘা রামরম্ভাসদৃশ। কেশরাসী কুঞ্চিত ও দীর্ঘ। পরিধানে পীতবস্ত্র। হাতে মনোহর বংশী।
কৃষ্ণের সম্ভোগের জন্য দেবতাদের নির্দেশে দেবী লক্ষ্মী সাগরের গৃহে পদ্মার উদরে জন্মগ্রহণ করলেন। অপরূপ সৌন্দর্যশালিনী সেই কন্যার নাম হল রাধা। নপুংসক আইহনের সঙ্গে বিবাহ হল রাধার। রাধার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিযুক্ত করা হল কুদর্শনা বৃদ্ধা বড়াইকে।
।। তাম্বুলখণ্ড ।।
দধি-দুগ্ধের পসরা নিয়ে বড়াই ও সখীদের সঙ্গে রাধা বনপথে প্রত্যহ যান মথুরায়। একদিন চলতে চলতে রাধা বড়াইকে পেছনে ফেলে চলে এলেন বকুলতলায়। তারপরে খেয়াল হল তাঁর সঙ্গে বড়াই তো নেই। এদিকে রাধার হদিশ না পেয়ে বড়াইএর মনেও জাগল শঙ্কা। কর্তব্যে এই ত্রুটি ক্ষমা করবে না আইহনের পরিবার।
পথ চলতে চলতে বড়াই দেখতে পেলেন গোচারণরত এক রাখালকে। কাছে গিয়ে বড়াই বুঝলেন রাখাল তাঁর পরিচিত। নাম তার কানাই। হয়তো কানাই পারবে রাধার হদিশ দিতে। কানাই অর্থাৎ কৃষ্ণ বড়াইকে দেখে বললেন, ‘কি গো, বৃন্দাবনের পথে পথে এমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? কিছু হারিয়েছে না কি?’
বড়াই বললেন, ‘সুন্দরী নাতনীকে নিয়ে আসছিলাম। তাকে আর খুঁজে পাচ্ছি না।’
কৃষ্ণ বলেন, ‘সে কি! হারিয়ে গেল! নাম কি তার? দেখতে কেমন?’
-‘বৃন্দাবনের পথেই হারিয়েছি তাকে। নাম তার চন্দ্রাবলী। ত্রৈলোক্যসুন্দরী সে। বাছা, আমাকে তুমি মথুরার পথ বলে দাও।’
কৃষ্ণ বলেন, ‘নিশ্চয়ই বলে দেব মথুরার পথ। তবে একটা শর্তে। তুমি আমাকে তোমার নাতনীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে, বুঝলে!’
-‘এ আর এমন কি! তোমার সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দেব, কথা দিলাম।’
-‘বেশ। তাহলে তার রূপের একটু বর্ণনা দাও।’
-‘শোনো তবে। তার কেশপাশে সুরঙ্গ সিন্দুর দীপ্তি পাচ্ছে, যেন সজল মেঘের ভিতর দিয়ে উদয় হচ্ছে সূর্যের। তার অম্লান আননের দ্যুতি কনককমলের মতো। তাকে দেখলে মোহগ্রস্ত হয় তপস্বীরও মন। তার অলকাবলির ললিতকান্তি দেখে তমালকলিকারা লজ্জিত হয়। তার কজ্জলশোভিত অলস লোচন দেখে নীলোৎপল প্রবেশ করে জলে। শঙ্খ লজ্জা পায় তার কণ্ঠদেশ দেখে। পক্ক্ব দাড়িম্ব অভিমানে বিদীর্ণ হয় তার পয়োধরযুগলকে দেখে। কটিদেশ তার ক্ষীণ, গুরুভার বিপুল নিতম্ব। মত্ত রাজহংস অপেক্ষা অনুপম তার গতি। ’
রাধার রূপ বর্ণনা শুনে কৃষ্ণ কামকাতর হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘রাধার রূপ বর্ণনা শুনে আমি কাতর হয়ে পড়েছি। এমন পুষ্পিত, মধুকরগুঞ্জিত বসন্তে আমি আর ধৈর্য রাখতে পারছি না। তুমি তাকে নিয়ে এসো।’
-‘ কথা রাখব তোমার। এখন তুমি বলে দাও মথুরার পথ। আমি ঠিক রাধাকে নিয়ে আসব তোমার কাছে।’
অবশেষে রাধার দেখা পেলেন বড়াই। রাধার হাতে তুলে দিলেন কর্পূর, তাম্বুল, ফুল আর নেত্রবস্ত্র; বললেন এসব পাঠিয়েছেন কৃষ্ণ। বড়াইএর কথা শুনে অতীব ক্রুদ্ধ হলেন রাধা। মাটিতে ফেলে দেন কৃষ্ণপ্রদত্ত দ্রব্যাদি। তখন বড়াই তিরস্কার করে বলেন, ‘ছিঃ, এমন কাজ করতে নেই। নন্দ নন্দন কৃষ্ণ যে তোমার বিরহে কাতর।’
রাধা বলেন, ‘ঘরে আমার সুলক্ষণযুক্ত স্বামী আছেন। নন্দদুলাল গোপালক কৃষ্ণ আমার কে? তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করতে আমার বয়েই গেছে।’
প্রত্যুত্তরে বড়াই বলেন, ‘যে দেবতাকে স্মরণ করলে পাপমুক্তি ঘটে, তার সঙ্গে প্রেম সম্পর্ক হলে তুমি যে বিষ্ণুলোকে যাবে।’
-‘দরকার নেই বিষ্ণুলোক। বড়াই তোমার মতলবটা কি? বয়স তো অনেক হল, এসব কুকথা বলতে লজ্জা করে না তোমার? আর কক্ষণও বলবে না এসব কথা।
চলবে…
গবেষক