| 8 অক্টোবর 2024
Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ সাহিত্য

রাধাকৃষ্ণপ্রেমের দ্বিতীয় কাব্য  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (পর্ব-৪) । দিলীপ মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

[বড়ু চণ্ডীদাসের প্রামাণ্য জীবনী  পাওয়া যায় নি। অনুমান করা হয় তিনি পঞ্চদশ শতকের মানুষ। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির সমসাময়িক। বিদ্যাপতির মতো তাঁর লেখায় নাগর-বৈদগ্ধ্য নেই। জয়দেবের পরে তিনি রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার কাব্য লিখেছেন।  গীতিরস থাকলেও  তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একটি কাহিনিকাব্য। নানা কারণে এই কাব্যটি বাংলাসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য] আজ থাকছে পর্ব-৪।

 

।। হারখণ্ড ।।

যশোদার কাছে এসে রাধা অভিযোগের সুরে বললেন, ‘তোমার কানাই আমার পট্টবস্ত্র আর সাতলহরী হার অপহরণ করেছিল। শেষ পর্ষন্ত পট্টবস্ত্র ফেরত দিলেও সে হার ফেরত দেয় নি এখনও।’

অবাক হয়ে যশোদা বলেন, ‘সে কি কথা!’

-‘ কৃষ্ণ বড় বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। শাসন করো তাকে। যখন তখন সে আমাকে আর আমার সখীদের উৎপীড়ন করে। কংস যদি এ কথা জানতে পারে, তবে বড় অনর্থ হবে।’

যশোদা কৃষ্ণকে ডেকে তিরস্কার করে বললেন, ‘তোমার জন্য আর কত গঞ্জনা সহ্য করব আমি! কুবুদ্ধি পরিত্যাগ করো কানাই। সংযত করো মনকে।’

 

 

।। বাণখণ্ড ।।

যশোদার কাছে কৃষ্ণের নামে অভিযোগ করে এসেছিলেন রাধা। সে জন্য ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন কৃষ্ণ। বড়াই তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘রাধা বাড়াবাড়ি করছে। তোমার কথা বলতে গেলাম তাকে, সে আমাকে গালমন্দ করল। নিজেকে সতী বলে ঘোষণা করল। তুমি দেব বনমালী, অথচ রাধা তোমাকে একটুও সমীহ করে না।’

এ রকম অবস্থায় কি করা যায় তা জানতে চান কৃষ্ণ। বড়াই বলেন, ‘শোনো কানাই, আমি রাধাকে বৃন্দাবনে নিয়ে আসছি। তুমি তার উপর স্তম্ভন, মোহন, দহন, শোষণ, উচাটন বাণ নিক্ষেপ করো।’

মথুরার পথে যমুনা পার হয়ে রাধা এলেন বৃন্দাবনে। দেখলেন কদম্বতলায় বসে আছেন কৃষ্ণ। রাধাকে দেখে কৃষ্ণ বলেন, ‘অকারণে আমার এত নিন্দা করছ কেন? আজ আমি প্রতিশোধ নেব। পঞ্চবাণে আঘাত করব তোমাকে। দেখি কে বাঁচায়  তোমাকে! এরপরে আমি আইহন আর কংসকেও হত্যা করব।’

বাণের কথা শুনে ভীত হলেন রাধা। প্রাণরক্ষার জন্য মিনতি করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু কৃষ্ণ কোন কথা শুনলেন না। তিনি বাণ নিক্ষেপ করলেন। অনুতাপ করতে করতে রাধা মূর্চ্ছিতা  হলেন।  রাধার মনে জেগে উঠল কৃষ্ণপ্রেম। বড়াইএর অনুরোধে রাধার জ্ঞান ফিরিয়ে দিলেন কৃষ্ণ।

 

 

 

।। বংশীখণ্ড ।।

সখীদের সঙ্গে যমুনার ঘাটে স্নান করতে যান রাধা। নদীর তীরে বসে থাকেন কৃষ্ণ। যুবতীদের রঙ্গ দেখেন। কখনও বাজান করতাল, কখনও বা মৃদঙ্গ। সখীরাও কৃষ্ণের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশায় মেতে ওঠেন। রাধা কিন্তু নিস্পৃহ থাকেন।

রাধার দৃষ্টি আকর্যণের জন্য কৃষ্ণ তৈরি করেন এক মোহন সুন্দর বাঁশি। সে বাঁশিতে আবার সোনা ও হিরের কাজ। সে বাঁশির সুর আকুল করে তোলে মনকে । ব্যাকুল হয়ে ওঠে রাধার মন।

পরের দিন রাধা সেই সুরের আকর্ষণে আবার যান যমুনার ঘাটে। কিন্তু ঘাট যে শূন্য। কোথায় কৃষ্ণ! কোথায় সে মোহন বাঁশির সুর! রাধা বড়াইকে বলেন কৃষ্ণের কথা। তিরস্কার করে বড়াই বলেন, ‘কত বড় বংশের কন্যা  তুমি, কত বড় বংশের বধূ। কেন পরপুরুষের সঙ্গ কামনা করছে? আগে যা হবার হয়েছে, নতুন করে আবার কেন পাপে জড়াতে চাইছ?’

ঠিক তখনি মাঝ বৃন্দাবন থেকে ভেসে আসে বাঁশির সুর।

কি যে জাদু আছে সে সুরে! রাধার প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। বর্তমান ভুলে যান তিনি। কাতর অনুরোধ করে তিনি বড়াইকে বলেন, ‘যেমন করে পারো আমার কানাইকে এনে দাও বড়াই।’

ঘরের কাজে আর মন বসে না রাধার। এলোমেলো হয়ে যায় তাঁর জীবন। আগুন জ্বলে মনে। দাবানলের মতো দৃশ্যমান নয় বলে কেউ বুঝতে পারে না। রাধা যদি পাখি হতেন, তাহলে উড়ে চলে যেতে পারতেন তাঁর  দয়িতের কাছে।

সরস বসন্ত এসেছে ধরায়। রাধা অনুভব করেন তীব্র বিরহজ্বালা। বড়াইকে নিয়ে তিনি বৃন্দাবনে যান। কৃষ্ণের সন্ধানে। কিন্তু কৃষ্ণের দেখা পান না। ফিরে আসতে হয় ব্যর্থ  হয়ে।

গভীর রাতে আবার ভেসে আসে বাঁশির সুর। রাধা আকুল পাগলপারা।  শয্যায় উঠে বসেন তিনি। স্বামী আইহনকে নিদ্রিত দেখে চুপিসারে বেরিয়ে পড়েন। পাগলের মতো খুঁজতে থাকেন কানাইকে। তারপরে মূর্চ্ছিতা হয়ে পড়েন। তাঁকে ভোরবেলা উদ্ধার করে আনেন বড়াই।

রাধার অবস্থা দেখে বড় দুঃখ হয় বড়াইএর। রাধাকে তিনি বলেন, ‘চলো, যমুনায় জল আনতে যাই। কৃষ্ণ সেখানে   থাকবে। তুমি ছল করে চুরি করে আনবে তার বাঁশি।’

–‘কি করে চুরি করব বাঁশি?’

-‘আমি মন্ত্র পড়ে কৃষ্ণকে নিদ্রিত করে রাখব। সেই সুযোগে তুমি বাঁশি চুরি করবে।’

–‘লাভ কি হবে বাঁশি চুরি করে?’

–‘লাভ আছে। সেই বাঁশি নিতে তোমার কাছে আসতে হবে কানাইকে।’

বড়াইএর পরিকল্পনামতো রাধা কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করেন। তখন কৃষ্ণ বিলাপ শুরু করেন। বড়াই বলেন, ‘তুমি গোপীদের অপমান করেছ। প্রতিশোধ নেবার জন্য তারাই বাঁশি চুরি করেছে।’

কৃষ্ণ যান গোপীদের কাছে। হঠাৎ দেখতে পান দূরে দাঁড়িয়ে রাধা মুচকি হাসছেন। চোর কে তা বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু রাধা কিছুতেই স্বীকার করতে চান না। অনুনয়ে কোন কাজ না হওয়ায় কৃষ্ণ ভীতি প্রদর্শন করে বলেন, ‘প্রাণে বাঁচতে চাও তো ফেরত দাও বাঁশি। না হলে তোমার বসন-ভূষণ কেড়ে নেব, বেঁধে রাখব তোমাকে, হত্যা করতেও দ্বিধা করব না, বুঝলে?’

রাধা বলেন, ‘মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ কানাই। যাও বড়াইকে ধরো। সেই চতুরা বুড়ি লুকিয়ে রেখেছে তোমার বাঁশি।’

বিভ্রান্ত কৃষ্ণ বলেন, ‘তুমি বড়াইএর দোষ দাও, বড়াই তোমার দোষ দেয়। কিন্তু রাধা, আমি জানি বড়াই নয়, তুমিই লুকিয়ে রেখেছ আমার বাঁশি।’

কথা বলতে বলতে কৃষ্ণ রাধার বস্ত্রাঞ্চল ধরে বলেন, ‘ বাঁশি না পেলে যেতে দেব না তোমাকে।’

তখন মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন বড়াই, কৃষ্ণকে বলেন, ‘তুমি হাতজোড় করে বিনীতভাবে রাধার কাছে বাঁশি চাও কানাই।’

বড়াইএর কথামতো কৃষ্ণ রাধার কাছে হাতজোড় করে দাঁড়ান। রাধা বলেন, ‘ এরপর থেকে আমার কথামতো চলার প্রতিশ্রুতি দেলে বাঁশি ফেরত পাবে।’

কৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দেন।

রাধা বলেন, ‘আমি বিরহে কাতর হলে তুমি আমাকে সঙ্গ দেবে। কোন অন্যথা হবে না তো!’

কৃষ্ণ জানান যে কোন অন্যথা হবে না।

রাধা তখন বাঁশি ফেরত দেন কৃষ্ণকে।

 


আরো পড়ুন: রাধাকৃষ্ণপ্রেমের দ্বিতীয় কাব্য  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (পর্ব-৩)


 

।। রাধাবিরহ ।।

 

দীর্ঘকাল দেখা নেই কৃষ্ণের। এদিকে চৈত্রমাস এসেছে। ঋতুরাজ বসন্তের সমারোহ চারদিকে। বিরহজ্বালায় দগ্ধ হচ্ছে রাধার হৃদয়।

কোথায় গেলেন কৃষ্ণ!

নিজের প্রতিশপুতি কি ভুলে গেলেন তিনি!

বড়াইকে সঙ্গে নিয়ে রাধা যান বৃন্দাবনে। মোহিনী বেশ ধারণ করে কদম্বতলায় রচনা করেন শয্যা। অপেক্ষা করেন, অপেক্ষা করেন, কিন্তু কৃষ্ণের দেখা পাওয়া যায় না।

বৃন্দাবনের পথে পাগলের মতো ঘুরতে ঘুরতে রাধা একদিন দেখলেন গোচারণরত কৃষ্ণকে। তাঁর কাছে গিয়ে রাধা বলেন, ‘কানাই আমি যদি কোন দোষ করে থাকি, ক্ষমা করো। কিন্তু তোমার বিরহ আর সহ্য করতে পারছি না।’

কৃষ্ণ কঠিনভাবে বলেন, ‘তোমার কাঁদুনিতে ভুলছি না। আমার আশাত্যাগ করো, নিজের বাড়িতে যাও।’

এ কথা বলে সেখান থেকে চলে যান কৃষ্ণ। চোখের জলে ভাসতে থাকে রাধার বুক।

নারদের মুখে খবর পাওয়া যায় কদম্বতলায় শয্যা রচনা করে বসে আছেন কৃষ্ণ।  বড়াইকে নিয়ে ছুটে যান রাধা। কৃষ্ণকে দেখে আনন্দে মূর্চ্ছা যান তিনি। বড়াইএর অনুরোধে রাধাকে গ্রহণ করেন কৃষ্ণ। মিলন হয়  তাঁদের। তারপরে  রাধা নিদ্রিতা হলে কৃষ্ণ বড়াইকে বলেন, ‘আমি মথুরায় চললাম। তুমি রাধাকে সাবধানে রাখবে।’

জাগ্রত হয়ে কৃষ্ণকে দেখতে না পেয়ে হাহাকার করে ওঠেন রাধা।

কয়েক দিন পরে রাধার কাতর অনুরোধে কৃষ্ণের সন্ধানে বড়াই যান মথুরায়। সেখানে তিনি  কৃষ্ণের আশ্চর্য পরিবর্তন দেখতে পান। দেখতে পান রাধা সম্পর্কে কৃষ্ণের আর কোন আগ্রহ নেই। কংসাসুরকে বধ করাই এখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কৃষ্ণ বড়াইকে জানান যে রাধা বড় প্রগলভ. তাঁকে দেখলে কৃষ্ণের  হদকম্প হয়, তাই রাধার মুখ দর্শনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাঁর নেই।

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত