| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক প্রবন্ধ সাহিত্য

রাধাকৃষ্ণপ্রেমের দ্বিতীয় কাব্য  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (পর্ব-৫) । দিলীপ মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

 

[বড়ু চণ্ডীদাসের প্রামাণ্য জীবনী  পাওয়া যায় নি। অনুমান করা হয় তিনি পঞ্চদশ শতকের মানুষ। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির সমসাময়িক। বিদ্যাপতির মতো তাঁর লেখায় নাগর-বৈদগ্ধ্য নেই। জয়দেবের পরে তিনি রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার কাব্য লিখেছেন।  গীতিরস থাকলেও  তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একটি কাহিনিকাব্য। নানা কারণে এই কাব্যটি বাংলাসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য] আজ থাকছে পর্ব-৫।

 

 

বসুদেব, গর্গাচার্য, উগ্রসেন প্রভৃতি দ্বারাবতীতে এসে বিরাট কর্মকাণ্ড দেখে বিস্মিত হলেন। রাজপুরীটির অলঙ্করণ পারিপাট্য দৃষ্টিনন্দন। নিধিপতি  শঙ্খের আর্থিক অনুদানে নগরবাসীর প্রয়োজনীয় সামগ্রীর কোন অভাব নেই। সমুদ্রবেষ্টিত বলে দ্বারাবতী বাণিজ্য সহায়ক। তাই এখানে নানা বণিকের সমাবেশ। বৃত্তি ও কর্মানুযায়ী নগরে নানা শ্রেণির মানুষের বাস। জাতিভেদের কঠোরতা নেই।

কৃষ্ণ দ্বারাবতীকে সুরক্ষিত করে রাখার নানা উপায়  অবলম্বন করেছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতির স্বাভাবিক সুরক্ষা বলয়। স্থানটি সমুদ্রবেষ্টিত বলে বহিঃশত্রুর নির্বিচার আক্রমণ সম্ভব নয়। প্রধান দ্বারের সম্মুখে আছে রৈবতক দুর্গ। সে দুর্গের প্রহরীরা সর্বদা সজাগ। যে কেউ যখন-তখন দ্বারাবতীতে প্রবেশ করতে পারে না। দুর্গ থেকে নগরে প্রবেশের অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়। বৃন্দাবনের আভীর জাতির  গোপসেনাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে যে নারায়ণী সেনা, তাদের সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। দ্বারাবতীবাসীদের দেওয়া হয়েছে এক স্মারকচিহ্ন। দ্বাররক্ষককে সেটি দেখিয়ে বাহিরে যাওয়া যায়, কিংবা বাহির থেকে ভিতরে প্রবেশ করা যায়।

নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা ।

শুধু তাই নয়। রাজকার্যের বিবিধ বিভাগ সুবিন্যস্ত করে দিয়েছেন কৃষ্ণ। নৃপতিপদে উগ্রসেনকে, পুরোহিতপদে কাশ্যপকে, প্রধান সেনাপতির পদে অনাধৃষ্টিকে, মন্ত্রীপদে বিকদ্রুকে, সারথীপদে দারুককে, সৈনাধ্যক্ষপদে সাত্যকি ও কৃতবর্মাকে নিষুক্ত করা হয়েছে। যদুবংশের মোট আটটি শাখার দশজন প্রবীণকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে মন্ত্রীমণ্ডলী।

স্বৈরাচার পছন্দ করতেন না কৃষ্ণ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ছিল তাঁর কাম্য। দ্বারাবতীতে তিনি সেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করলেন।  এখানকার নাগরিকরা যাতে সুনাগরিক হতে পারে সে দিকে দৃষ্টি ছিল কৃষ্ণের। সুনাগরিক কেবল অধিকার ভোগ করেন না, নিজ নিজ দায়িত্বও পালন করেন। দাদা বলরামের সঙ্গে রেবত জাতির কন্যা রেবতীর বিবাহের ব্যবস্থা করলেন তিনি।

এর মধ্যে একদিন বিদর্ভের রাজপুরোহিত সুদেব হাজির হলেন দ্বারাবতীতে।

বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিণীর গোপন এক পত্র নিয়ে এসেছেন তিনি। রাজকন্যা জানিয়েছেন পুনর্বার তাঁর স্বয়ংবরসভার আয়োজন করা হচ্ছে। এতে তিনি অপমানিত বোধ করছেন। প্রথম স্বয়ংবরসভা পণ্ড হবার পরে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে তিনি আর কোন রাজপুত্রের কণ্ঠে বরমাল্য অর্পণ করবেন না; কারণ তাঁরা কাপুরুষ। প্রকৃত বীরকে সম্মান প্রদর্শন করেন না  তাঁরা। রাজকন্যা সেদিন থেকে কৃষ্ণকে বরণ করে নিয়েছিলেন তাঁর পতিরূপে।

আজ সংকটকালে, তিনি তাই স্মরণ করছেন কৃষ্ণকে। তিনি চান কৃষ্ণ তাঁকে উদ্ধার করুন, স্ত্রীর মর্যাদা দিন।  আর কৃষ্ণ যদি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে তিনি আত্মঘাতিনী হবেন। অন্য কোন বিকল্প নেই।

পত্রপাঠ করে কৃষ্ণ বিমূঢ় হলেন। কি করবেন তিনি! এই মুহুর্তে তাঁর বিবাহের কোন ইচ্ছা নেই। ব্যক্তিগত সুখের জন্য তিনি তাঁর কর্তব্য বিসর্জন দিতে পারেন না। কিন্তু তিনি যদি প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে এক নারী প্রাণ বিসর্জন দেবেন। একেই বলে উভয় সংকট। আরও একটা বিপদ আছে। রুক্মিণীকে হরণ করে  নিয়ে এলে নতুন এক সংঘর্ষের সূচনা হবে। কারণ যে শিশুপালের সঙ্গে রুক্মিণীর বিবাহ দিতে চান তাঁর পরিবার, সেই শিশুপাল জরাসন্ধের প্রিয়।

দাদা বলরামকে কৃষ্ণ জানালেন এই সমস্যার কথা। বলরাম বলে দিলেন হরণ করতে হবে রুক্মিণীকে। জরাসন্ধ আক্রমণ করলে তাকে প্রতিহত করবেন বলরাম।

হরণ পরিকল্পনার একটা সূত্র রুক্মিণী তাঁর পত্রে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণ সেই সূত্র অনুযায়ী অগ্রসর হবার কথা ভাবলেন।  তিনি বৃষ্ণিদের সঙ্গে বিদর্ভে উপস্থিত হয়ে পরদিনের প্রভাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

পরদিন প্রভাতে রথারোহিত হয়ে রুক্মিণি যাচ্ছিলেন মন্দিরের দিকে। তাঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন কৃষ্ণ। রুক্মিণী পূজাপর্ব সমাপ্ত করে মন্দির থেকে বহির্গত হবার পরে কৃষ্ণ তাঁকে তাঁর রথে তুলে নিলেন। রক্ষীরা আক্রমণ করলে তাদের প্রতিহত করতে লাগলেন বৃষ্ণিরা।

রুক্মিণী হরণ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল লোকমুখে। ত্বরিতগতিতে জরাসন্ধ তাঁর দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। তুমুল যুদ্ধ হল বৃষ্ণিদের সঙ্গে। বলরামের সুযোগ্য নেতৃত্বে পরাজিত হল জরাসন্ধের বাহিনী।

এদিকে বিদর্ভ রাজপুত্র রুক্মি কৃষ্ণের রথের পশ্চাদ্ধাবন করছিলেন। নর্মদা নদীতীরে কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ হল তাঁর। পরাজিত হলেন তিনি। কৃষ্ণ তাঁকে হত্যা করতে গেলে রুক্মিণীর অনুরোধে নিবৃত্ত হলেন। শাস্তি হিসাবে রুক্মির মস্তক মুণ্ডন করা   হল।

দ্বারাবতীতে ঘটা করে  বিবাহ হল কৃষ্ণ-রুক্মিণীর।


আরো পড়ুন: রাধাকৃষ্ণপ্রেমের দ্বিতীয় কাব্য  শ্রীকৃষ্ণকীর্তন (পর্ব-৪)


আনন্দের অন্ত ছিল না রুক্মিণীর মনে। একজন বিবেচক, হৃদয়বান স্বামী লাভ করেছেন তিনি। এই মানুষটির হৃদয়রাজ্যের রানি হবেন তিনি। তিনিই হবেন কৃষ্ণের ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু  অচিরেই রুক্মিণী দেখতে পেলেন আপন দায়িত্ব কর্তব্য পরিহার করার মানুষ কৃষ্ণ নন। এ কথা ঠিক যে রুক্মিণীর প্রতি কৃষ্ণ উদাসীন নন, কিন্তু তাঁকে লাভ করে কৃষ্ণ জগৎ সংসার বিস্মৃত হন নি। তাই অভিমান হয়েছিল রুক্মিণীর। অবশ্য সেই অভিমান তিনি প্রকাশ করেন নি। তারপরে ঘটল এক অঘটন।

যাদব বংশের সত্রাজিৎ ছিলেন রত্ন ব্যবসায়ী। তাঁর কাছে ছিল এক দুর্লভ স্যমন্তক মণি। কৃষ্ণকে তিনি বলেছিলেন সেই মণির কথা। কৃষ্ণ তাঁকে জানিয়েছিলেন যে মণিটি মহা মূল্যবান। সত্রাজিৎ যেন সেটি সযত্নে রাখেন। নিরাপত্তার কারণে সত্রাজিৎ মণিটি তাঁর ভ্রাতা প্রসেনজিতের কাছে গচ্ছিত রাখেন। প্রসেনজিৎ সে মণি তাঁর কণ্ঠহারের সঙ্গে সংলগ্ন করে রাখতেন।

একদিন ঋক্ষবান পর্বতে মৃগয়া করতে গিয়ে প্রসেনজিৎ নিহত হন এক সিংহের হাতে। সে অঞ্চলের অনার্য সর্দার জাম্ববান বনপথে ভ্রমণকালে প্রসেনজিতের মৃতদেহ ও স্যমন্তক মণি দেখতে পান। মণিটি  হস্তগত করেন তিনি।

কিন্তু সত্রাজিতের সন্দেহ  হয়  কৃষ্ণকে। কারণ, একমাত্র কৃষ্ণই জানতেন এই মণির কথা। হয়তো মণিলোভাতুর হয়ে কৃষ্ণই তাঁর ভ্রাতাকে হত্যা করে মণিটি হস্তগত করেছেন। সত্রাজিতের এই সন্দেহ লোকমুখে প্রচারিত হয়। মনের সন্দেহ মারাত্মক। কৃষ্ণ তাই অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। এরপর মানুষ নগর নির্মাণের কার্যকলাপও সন্দেহের চোখে দেখবেন, তার ফলে ঐক্যবদ্ধ যাদব নগরী গঠনের স্বপ্ন বিনষ্ট হয়ে যাবে।

এই সন্দেহাপবাদ দূর করতেই হবে।

কৃষ্ণ তার পথানুসন্ধান করতে থাকেন।

নিজস্ব গুপ্তচরদের মাধ্যমে তিনি প্রসেনজিতের মৃত্যুর কারণ অবগত হন। তিনি অবগত হন যে সে অঞ্চলের সর্দার হলেন জাম্ববান। মণিটি জাম্ববানের কাছেও থাকতে পারে। কৃষ্ণ জাম্ববানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জাম্ববান স্বীকার করেন যে মণিটি তাঁর কাছেই আছে। তিনি তা ফেরৎ দিতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন।

যুদ্ধ পরিহার করতে চেয়েছিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু জাম্ববানের অবিচলতার জন্য পারলেন না। যুদ্ধ আরম্ভ হবার পরে জাম্ববান উপলব্ধি করলেন যে তাঁর পক্ষে জয়লাভ করা অসম্ভব। তখন জাম্ববান একটি শর্তে মণিটি ফেরৎ দেবার কথা বললেন। শর্ত হল কৃষ্ণকে তাঁর কন্যা জাম্ববতীকে বিবাহ করতে হবে।

শর্ত মেনে নিলেন কৃষ্ণ দুটি কারণে। প্রথমত, এতে অনর্থক রক্তপাত বন্ধ হবে। দ্বিতীয়ত, তিনি চৌর্যাপরাধ থেকে মুক্ত হবেন, এবং তাঁর ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ থাকবে।

অতঃপর কৃষ্ণ সমূ্হ ঘটনা বিবৃত করে সত্রাজিতকে মণিটি ফেরৎ দিলেন। অনুশোচনায় দগ্ধ সত্রাজিৎ সে মণি উপহারস্বরূপ কৃষ্ণকেই দিলেন।   

[ক্রমশ]

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত