| 16 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প পুনঃপাঠ সাহিত্য

পুনর্পাঠ: চন্দনেশ্বরের মাচানতলায় । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 15 মিনিট

আমাদের এখান থেকে কলকাতার ট্রেন আরও বাইশ মিনিটের ছুট দিয়ে তবে একটা নদীর সামনে গিয়ে থামে। তার ওপারেই বাদা। অনেকে বলে লাট অঞ্চল। সেখান থেকে অভাবী মানুষ নদী পেরিয়ে ট্রেনে এসে ওঠে। কলকাতার রাস্তায় গিয়ে ভিক্ষা করে। আশ্চর্য! সেখান থেকেই সস্তায় চাল ইলেকট্রিক ট্রেনে স্মাগল্ হয়ে কলকাতায় ঢোকে।

ট্রেন লাইনের দু’ধারে ছড়ানো সব গ্রাম, ধানক্ষেত–দূরে দূরে সাবেক জমিদারের পরিত্যক্ত চাষবাড়ি।
এসব দিক থেকেই আমাদের স্টেশনে অনেকে রিক্সা চালাতে আসে। অন্য অন্য জায়গায় দেখেছি–রিক্সার পেছনে রিক্সার নাম লেখা থাকে। এখানে লেখা থাকে মালিকের নাম। প্রোঃ অবিনাশ নস্কর কিংবা প্রোঃ দেবু ঘোষ ইত্যাদি লাল রঙে লেখা প্রায়ই এখানকার বাজারে চলন্ত রিক্সার পেছনে দেখা যাবে। সিটগুলো ছোট। দুজনে বসলে পেলভিসে লাগবে।

রিক্সাগুলো সাত-পুরনো। রাস্তা একটু খাড়াই হলেই চেন খুলে যাবে। প্রায়ই লিক নয়ত পাঙচার লেগেই আছে। এমন রিক্সাও বাদা থেকে আমদানি আনকোরা চালিয়ের হাতে পড়ে–বলা ভালো, পায়ে পড়ে প্রথম প্রথম দিব্যি চলে। ছুটন্ত রিক্সায় বসে ওদের পায়ের মাস্ল্ দেখে বুঝতে পারি, লাট অঞ্চলের মানুষটি কতদিন হলো রিক্সাওয়ালা হয়েছে।
ট্রেন আচমকা বন্ধ হলে ওদের সুসময়। তখন সারা দিনে দশ-বারো টাকা কামানো কিছুই নয়। ফাঁকা রাস্তা ধরে জংশনে পৌঁছে দিতে পারলে প্যাসেঞ্জাররা অন্য লাইনের ট্রেন ধরে কলকাতায় যায়। দিনের বেলায় অনেক সময় মন্দা যায়। কিন্তু লাস্ট ট্রেনের প্যাসেঞ্জাররা রাত পৌনে বারোটা নাগাদ স্টেশনে নেমে যখন রিক্সা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে–তখন মনে হয়–নাঃ! কাজ বটে একটা। সেই সময় যেসব এলাকায় ইলেকট্রিক যায়নি–সেখানকার প্যাসেঞ্জাররাই বেশি করে রিক্সা চায়। আসলে রিক্সায় চড়া যতটা না দরকার–তার চেয়ে বেশি দরকার অন্ধকার পথে একজন সঙ্গী। রিক্সাওয়ালারা তা জানে। তাই রওনা দেবার আগে বাতিটা ধরিয়ে নেয়।

এইভাবেই আমার সঙ্গে তরুর আলাপ হয়েছিল। লাস্ট ট্রেনে ফিরলে তরু আমায় পৌঁছে দিত।
কোলে মার্কেটে আমার সবজি যায়। উচ্ছে, ঝিঙে, পটল, আলু–যখনকার যা–পাইকারি দরে আমি কিনি। কোথাও কোথাও চাষের সময় আমি গাঁয়ে গিয়ে চাষিদের দাদন দিয়ে রাখি। ফসল উঠলে ফসলটা আমার গোলায় জমা দিয়ে চাষি হিসাবপত্র কাটান ছাঁটান করে।

ফলে আমাকে অনেক সময়েই এমন এমন জায়গা যেতে হয় যেখানে বাস নেই। অনেক সময় আমি হেঁটেও যাই। আবার বাস পেলে বাস। রিক্সা পেলে রিক্সা। যখন যে রকম। এদিকটায় কোল্ড স্টোরেজ এখনো হয়নি বলে আমার মতো লোকের ব্যবসা খারাপ চলে না। বিশেষত বরবটি আমাকে গত বোশেখে অপর্যাপ্ত পয়সা দিয়েছে।
এদিককার চাষিরা বেশ ভালো ফলায়। কেউ কেউ তো দশ বিঘে অবধি শুধু লঙ্কাই লাগায় এক এক মরসুমে। একদিন অন্তর একদিন দু’মণ তিন মণ শুধু লঙ্কাই আমাকে কিনতে হয়। ইদানীং দেখছি অসময়ের মুলো ভালো পয়সা দিচ্ছে। কলকাতার হোটেলে যে কী না লাগে!
তরু একদিন বলল, ‘বাবু আমায় টায়ার কিনে দাও একজোড়া। রিক্সা চড়িয়ে শোধ করে দেব।’
কত লাগবে?
আঠারো টাকা বিশ পয়সা!
দিলাম আমি। কিন্তু দিয়ে বিপদে পড়লাম। আমাকে স্টেশনে দেখলেই তরু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। কারণ সিম্পল্। আমি চড়লেই তো পয়সা পাবে না ও। ধার কাটান যাবে। কাছে গেলে বলে, ভাড়া হয়ে গেছে বাবু। আমার মতো লোক তো ওর গলায় গামছা দিয়ে পয়সা আদায় করতে পারে না। তাহলে একটা কথা হবে। তা ছাড়া এই চন্দনেশ্বরে আমাকে সবাই চেনে। কেউ কেউ পাট উঠলে পাট রেখে টাকা নেয়। ডাল উঠলে ডাল রেখেও টাকা নেয়। আমার গোলার গায়েই একটা বড় ঘর নিয়েছি। সেখানে আমার রাখী কারবার। জিনিস রেখে আমার টাকা নেয়। দর উঠলে বেচে দিয়ে আমার জায়গায় ভাড়া–সুদসমেত টাকা ফেরত দেয়।

এ জায়গাটি আমার বড় ভালো লাগে। এখানে আমার দেশ নয়। কিন্তু এখন দেশ হয়ে গেছে। এখানে বোস ডাক্তার আমাকে ইঞ্জেকশন দেয়। দুর্গা ডাক্তারের মিকশ্চার আমাদের বর্ষাকালের সঙ্গী। কাছাকাছি ঘোষপুরের মর্তমান কলার মতো অত বড়, অত ভালো কলা আমি কোথাও দেখিনি। এখানকার পঞ্চাননতলায় সারা বছর পুজো, নাম-গান লেগে থাকে। নিশে, পালান ওরা গাঁজা খায়। চোত মাস ভর হরির নাম করে। চরণ মাত্র একটি। হরে রাম হরে রাম–রাম রাম হরে হরে। একটি মাস ধরে গাইলেও পুরনো হয় না। কেউ বা তখন সন্ন্যাস নেয়। পরনের বস্ত্র বাবার রঙে ছোপান। বাবার নাম করে তারকেশ্বরের দিকে পাড়ি দেয়। ফিরে আসে ন্যাড়া হয়ে। হাতে একটি পাঁচ-ছ কিলোর কুমড়ো। সেখানে নাকি সস্তা।

এখানে গমকল আছে। ধানকল আছে। তিনটে অপেরা পার্টি ছাড়াও অ্যালোপাথ, হোমোপাথ সমেত মোট সতেরোজন ডাক্তার আছে। ভোর রাতে ভেড়ির নোনা মাছ এখানেই নিলাম হয়। ট্রেন বোঝাই দিয়ে এখানকার তাড়ি কলকাতায় যায়। তাতে ব্যবসায়ীরা স্যাকারিন মিল্ক পাউডার আর খালের জল ইত্যাদি মেশায়। এখানকার লোক ও তাড়ি খাবে না।
বরং কলকাতার বাসি সিনেমা এখানকার হলে লোক লাইন দিয়ে দেখে। গাদা গাদা আলুর চপ আর বিড়ি পাতার দোকান রাস্তার দু’ধারে। সম্প্রতি একটি ব্যাংক হয়েছে। ব্যাংকবাড়ির এক তলায় একটি সুন্দর কাপড়ের দোকানও হয়েছে। মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা যত ছোট হচ্ছে–দামও তত বাড়ছে। রবিবার সকালে পিচ রাস্তার গায়ে মোটা তে-পলতের ডালে পাঁঠা-খাসির ছাল ছাড়িয়ে টাঙিয়ে দিয়ে বিক্রি হয়। কলকাতার চেয়ে কেজিতে পঞ্চাশ পয়সা কম।
নতুন নতুন লেদ মেশিন বসেছে। কাছাকাছি সারের দোকান। বিষের দোকান। কেরোসিন মাঝে মাঝে হাওয়া হয়। সরষের ঘানি আছে। খাঁটি কলম্বোর নারকেল তেল বারো টাকা কেজি। একখানা হাল বর্ষায় পাঁচ-ছ টাকা। বোরোতে সাত টাকা অবধি ওঠে। সরষের খোল ষাট পয়সা–গরুর ভূষির কেজি এক টাকা। চিনি নেই। একজন ডেকরেটর আছে। বিয়ে শ্রাদ্ধ সে একাই সামলায়। একটা ছাপখানা ছিল। কোশ্চেন আউট হয় বলে পুলিশ এসে বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনটে প্রাইমারি একটা উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়াও দুটো টিউটোরিয়াল হোম আছে। একটির সাইনবোর্ডে পরিষ্কার লেখা আছে–টাকা অনুযায়ী গ্যারান্টিসহ ফার্স্ট ডিভিশনে, সেকেন্ড ডিভিশনে এবং থার্ড ডিভিশনে পাস করানো হয়। গ্যারান্টিসহ ফেল করানো হয়–এ কথা শুধু লেখা নেই।

নানান দোকানের বারান্দায় ঘুগনি বসে রাত আটটার পর। তার সঙ্গে চোলাই চলে। প্রকাশ্যে কোনো বেশ্যালয় নেই। সৌণ্ডিকালয় একটিই। মালিক একজন মুখার্জী ব্রাহ্মণ। কু-লোকে বলে দেশিতে তিনি ভুরি পরিমাণ জল মেশান। শ্মশান এখান থেকে আট মাইল। টি বি হলে লোকে কলেজে যাওয়ার চেষ্টা করে। বেশির ভাগই সিট পায় না।
মুড়ি-মুড়কির যুবাবয়সী দোকানদার মৌজা দিয়ে পাম্প-সু পরে বিয়ে করতে যায়। বউ নিয়ে ফেরার পথে রিক্সা-সাইকেলের পেছনে পেছনে ব্যান্ডপার্টি যায় গাঁয়ের পথ দিয়ে। নতুন খড় উঠলে কাহন ষোলো টাকা। একজোড়া ভালো বলদ আট শ টাকা। পুরনো ধানের বস্তা আশি টাকা অবধি ওঠে। জল দেবার পাম্প ভাড়া এক ঘণ্টা চার টাকা পর্যন্ত।

ফটো তোলার ফটো বাঁধাইয়ের দোকান একটিই। কংগ্রেস, সি পি আই, সি পি এম নিত্যপদশ্রী নামে একটি জুতোর দোকান বসেই আড্ডা দেয়। খদ্দেরদের তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জুতো বাছাই করতে হয়। বালি, সিমেন্ট কোনোটাই ন্যায্য দামে পাবার উপায় নেই। লোকাল তামাকে দোকানে গুড়ের ভাগই বেশি মেশায়।

দুটি ইটখোলায় রাঁচি, পুরুলিয়ার মেয়ে-পুরুষ খাটতে আসে ফি’বছর। তারাই স্টেশনারি দোকানগুলোর সস্তার মালপত্র কিনে কিনে দোকানগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে। ওরা মাস সাতেক থাকতে থাকতেই ইটখোলাতেই মুরগি পোষে, ডিমে তা দিয়ে ছানা করায়–সেসব জিনিস বাজারেও আসে।

তা ছাড়া শীতকালে ধানক্ষেতে ভেড়িতে কাদাখোঁচা ডৌখোল বেলেহাঁস ধরা পড়লে আজাহার মোল্লা সর্বাগ্রে আমার কাছেই নিয়ে আসে। ছ-সাতজন ওয়াগন ব্রেকার ছিল–তার বেশির ভাগই এখন ফেরার–দু-একজন ধরা পড়ার পর মার খেয়ে পুলিশ হাসপাতালে।

এই হলো গিয়ে আমাদের চন্দনেশ্বর। একটু এলোমেলো করে বলা হলো। তা হোক এখানে সবই সব সময় নিজের কোলে ঝোল টানতে ব্যস্ত। তা তো সব জায়গাতেই। কোথায় বা না? কেউ কেউ জমি কেনাবেচা করে দু’পয়সা করছে। বিধবা কিংবা নাবালক অনাথের সম্পত্তিও মাঝেমধ্যে বেহাত যে হয় না তা নয়। কেউ নারকেল গাছ সদরে জমা দিয়ে দেয়। কেউবা পুজো-আচ্চার দিন এক কাঁদি ডাব পেড়ে নিয়ে বাজারের মুখে এসে বসে। বেচে পয়সা দিয়ে বাজারহাট করে বাড়ি ফেরে।

তা তরু আমাকে ঠকিয়েছে তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। মানুষই তো মানুষকে ঠকায়। আমি তো বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে না-খেয়ে-পড়ে নেই। কিন্তু ও আমায় রিক্সায় তোলে না। কেন? মুখ ঘুরিয়ে থাকে। আমি ওকে নতুন করেই আবার ভাড়া দিতাম। ব্যাপারটা আমার অপমান লাগে। কাজের মধ্যে থাকি। ভুলেও যাই আবার। ঢ্যাঁড়সটা এবার সময় মতো ধরতে পারলে পয়সা আছে।

রাত ন’টার ভেতর গোলায় চাবি দিয়ে বাড়ি ফিরলাম। দেখি গিনি্ন আমার আয়না ধরে পাউডার ঘষছে মুখে। বড়ছেলে বলল, যাত্রা দেখতে যাচ্ছি বাবা। কৃষ্ণ-শকুনি পালার টিকিট দিয়ে গেছে। আমার বউ বিয়ের আগে গড়িয়াহাটার মোড়ে ব্লাউজ কিনেছে। আলেয়ায় সিনেমা দেখেছে। এখানেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বেশ। অনেকে ওকে দিদি ডাকে। বউদি ডাকে। পাশ থেকে দেখলে খুব সুন্দর দেখায়। আজও দেখাচ্ছিল।

আমিও গেলাম যাত্রা দেখতে। সামনের দিকে বসেছি। একেবারে প্রথম সারিতে বাজনদাররা বসেছে। দেখি তার ভেতর তরু মুখ লুকিয়ে ফ্লুট বাজাচ্ছে। সব বাজনা থামলেও তরুর ফ্লুট সুরেলা গানের দোলটুকু সবার মনে চারিয়ে দিচ্ছিল। ওর যে এত গুণ জানতাম না। যাত্রায় মেতেছে। তাই আজকাল আর রিক্সা চালাতে দেখি না।
যাত্রা ভাঙল রাত চারটেয়। আগে বেরিয়ে একখানা রিক্সা ধরলাম। বললাম, আমার বাড়ি চেনো তো–
না বাবু।

অল্প আলো। মুখখানা দেখতে পেলাম না রিক্সাওয়ালার। ডিরেকশন দিয়ে দিলাম। মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে রিক্সাটা ফিরতি পথে আমাকেও পৌঁছে দিল। নির্জন পথ। শেষ রাতের চাঁদ সব জায়গায় আলো দিতে পারেনি। ঢোল-কলমির ঝোপ-ঝাড়ে জোনাকি–উঁচু-নিচু, উঁচু-নিচু। একটু বেশি ভাড়া দিতে গেলাম। রিক্সাওয়ালা রিফিউজ করল। যা লেয্য তাই দিন।

রিক্সাটা চলে যেতে পেছনে কারও নাম লেখা দেখলাম না। কার রিক্সা বোঝারও উপায় নেই। রিক্সাওয়ালার মুখও ভালো করে দেখিনি। লাট অঞ্চল থেকে লোকটা বোধ হয় নতুন এসেছে।

একদিন ঝড়ে দেবেনের গমকলের তিনখানা টিন উড়ে গেল। আরেকদিন পঞ্চাননতলায় পুজো দিতে গিয়ে চাকবেড়ের এক মেয়েছেলের ওপর ভর হলো। আমাদের চন্দনেশ্বরে এই সবই হলো খবর। মাঝেমধ্যে শেষ রাতে ডাকাতি হয়ে যাওয়ার খবরও আসে। দূর দূর গাঁয়ে।

লরি থেকে উচ্ছে উঠছিল গোলায়। সকালবেলা। পেমেন্ট দিয়ে বসে আছি। লোক থাকলেও নজর রাখতে হচ্ছে লরির দিকে। বছর ছত্রিশ-সাঁইত্রিশের একজন লোক সোজা আমার কাছে এসে বলল, বাজার ভেঙে গেছে বাবু। আড়াই শ ঢ্যাঁড়স দরকার ছিল বড়–একজন কুটুম্ব এসে গেল।

আমার এখানে তো খুচরো চলে না বাবা। আর কিছু বললাম না। আমি তালগাছতলায় পাইকারি দরে বিলিতি আমড়া কিনে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। খুচরো কিনতে লোক পাঠিয়ে বড় বড় ব্যাপারিরা দরের আন্দাজ নেয় আমি জানতাম।
লোকটি বলল, যাত্রা দেখে আপনি ফিরলেন। আমি পৌঁছে দিলাম বাবু।
ওঃ। তোমার রিক্সা ছিল। তাইতো। নিয়ে যাও–পয়সা দিতে হবে না।
বিনে পয়সায় নেব না।

অতএব ওজন করে পয়সা নিয়ে আড়াই শ ঢ্যাঁড়স দিতে হলো। চলে যাচ্ছিল। ডেকে বললাম, তোমার নাম কি গো?
অমৃত। অমৃত দাশ।
তুমি তো এখানকার লোক নও।
নারকেলবেড়ে আমাদের বাড়ি। আমি মাস তিনেক হলো এদিকে রিক্সা চালাচ্ছি।
তোমার রিক্সাখানা ভালো করো। আমি টাকা দিচ্ছি। চড়িয়ে চড়িয়ে শোধ করে দেবে।
টাকার দরকার নেই। রিক্সা আমি বানাতে জানি।
তাহলে অনেক রিক্সা বানিয়ে ভাড়া খাটাও।
আমি আর বাড়াব না। আটখানা রিক্সা বানিয়েছিলাম একে একে।
সেসব রিক্সা কোথায়?

আজ এটা ভাঙে। কাল ওটা ভাঙে। অন্য যারা চালায় তাদের সব দিয়ে দিয়েছি। এই একখানা নিজের জন্য রেখেছি। যেমন পয়সা আসে তেমন দিন কাটে। রান্নাটা চড়িয়ে দিইগে। ঘরে লোক আছে। বিকেলে এসে কথা বলব বাবু।
তোমার বউ ছেলে-মেয়ে কোথায়?
সে-কাজটা করা হয়নি বাবু।

মনে মনে ভাবলাম, অমৃতর কোনো রোগবালাই থাকতে পারে। তাই হয়তো বিয়ে হয়নি। রিক্সা চালিয়ে চালিয়ে অনেকের কাশ রোগ হয়। লোকটা বিবেচক। অসুখ সুদ্ধ বিয়ে করে আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ করেনি। চেহারাটা ক্ষয়াটে চোখ জ্বল জ্বল করছে। হাফশার্টের নিচে লুঙ্গি। কোমরে গামছা প্যাঁচানো। তোমার অসুখটা কিসের বাবা?
অসুখ? আমি নীরোগ বাবু। স্টেশনের কলের পরিষ্কার জল খাই। শিবুর দোকান থেকে আটার রুটি কিনি–সঙ্গে ডাল দেয়। চলে যায়।
তবে বিয়ে করোনি কেন?
অমৃত মাথা নিচু করে যা বলল, তা আমার কাছে স্রেফ ন্যাকামি বলেই মনে হলো। পরিষ্কার বলল, কত লোকের দুঃখ বাবু। কত অসুখ। কত শোকতাপ। এসব দেখে আর বিয়ে করা হয়নি। আমি তাই যতটা পারি লোকের দুঃখু কমাবার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদি কোনো শেকড়বাকড় জানতাম–তাহলে এই চন্দনেশ্বরের সব জ্বালা যন্ত্রণার আমি একাই উপশম করতাম। আমি যাই বাবু। রান্না চড়াতে হবে–
এ যে দেখি ভালো ভালো কথা বলছে! শাপভ্রষ্ট রিক্সাওয়ালা! এই যে বললে দোকান থেকে কিনে খাও–তবে রান্না চাপাচ্ছ যে!

আমার তো চলে যায় বাবু। গরমকালে রাতের বেলা প্লাটফর্মে শুয়ে থাকি। রেলপুকুরে চান করি। ঘর একখানা নেওয়া আছে। অবশ্য ঝড়-বৃষ্টির জন্যে। কিন্তু মাঝেমধ্যে কলকাতা যাওয়ার পথে দেশগাঁয়ের রুগীরা আমার ঘরে আশ্রয় পায়। এনার আবার পেটে ঘা। বিকেলের গাড়িতে কলেজে ভর্তি হতে যাবে। দোকানের রান্না সয় না বলে আমি রান্না করে দিচ্ছি। দুটো ভাত ফোটান হয়ে গেছে।
অল্প বয়সে কোনো গুরুতর পাপ করেছিলে?
খানিক ভেবে অমৃত বলল, মনে তো পড়ে না। তবে খুব ছোট বয়সে একটা বিড়ালকে এক হর্তুকি গাছের গোড়ায় বেঁধে রেখে সে গাছের গায়ে ইয়া লম্বা এক মৌচাকে ঢিল মেরেছিলাম। বিড়ালটা মারা যায়।
দেখতে দেখতে অমৃতের চোখের কোণে জল এসে গেল। তাকে যদি পাপ বলেন–তাহলে করেছি।
না। না। সে রকম না। জ্ঞান বয়সে খুব কোনো পাপ করেছিলে? সেই অনুতাপে এখন–
মনে তো পড়ে না–

কাজে থাকি। কাজে ঘুরি। অমৃত আমার মন থেকে একদম মুছে গেল। গঞ্জ-গাঁয়ের মতো এই চন্দনেশ্বরে আমি খুব কম লোককেই হাত তুলে করজোড়ে নমস্কার করি। কিন্তু কী হলো ঠিক বলতে পারব না। পথে-ঘাটে আচমকা অমৃতের মুখোমুখি হলেই আমি দু’হাত তুলে নমস্কার করে ফেলি। অমৃতও লজ্জায় মাথা নোয়ায়। মুখের হাসিটা নির্মল। সেই লুঙ্গি, সেই হাফশার্ট, কোমরে গামছা–মাঝে ধ্যে গালে দাড়ি। বলি, কেমন আছো?
খুব ভালো বাবু। খুব সুখে আছি। যেমন চালাচ্ছেন তিনি তেমন চলছি।
তোমার রিক্সা কেমন চলছে?
সামনের চাকাটা ফিরে ফিরে লিক হচ্ছে বাবু। তা আমি নিজেই সারিয়ে নিই। যন্ত্রপাতি সব আমার নিজের আছে।
গঁাঁজাখোর নিশি, পালান, যদু একদিন আধ মণ মুসুরির ডাল চাইতে এলো। বাজার-সুদ্ধু সবার কাছে চায় ওরা। কাঙালি ভোজন করাবে।
বললাম, তোরা নিজেরাই তো কাঙালি।
ওরা হেসে মাথা নেড়ে বলল, না বাবু। আমরা খুব সুখে আছি। ভগবানের কৃপায় কোনো অভাব নেই আমাদের।
অভাব বুঝবে কোত্থেকে? সারা দিন তো গাঁজার ওপর আছো। ডাল দিতে পারব না। আধমণ আলু পটল দিয়ে দিচ্ছি। তাই নিয়ে যাও।
ওরা তাতেও রাজি। ছাতা পড়া পচা-ধচা কিছু আলু পটল বিদেয় হওয়ায় গোলায় জায়গা হলো।
ওরা যাবার সময় বললাম, তোদের দলে অমৃতকে নিসনে কেন?
কে অমৃত?
রিক্সা চালায় অমৃত দাশ–
ক্ষ্যাপা অমৃত। ওর কথা বলবেন না বাবু। আমরা নাম-গানে ডেকেছিলাম। কিন্তু ওনার সময় নেই। এক একদিন খালি রিক্সা চালিয়ে একেদিক যায়! নির্জন জায়গায় নাকি ভগবানের খোঁজ করে–বুঝুন ব্যাপার! প্যাসেঞ্জার ফিরিয়ে দেয় তখন।

গোলা বন্ধ করে বসে আছি। লাস্ট ট্রেনে বারো বোঝা মোচা যাবে কোলে মার্কেটে। কিছু এঁচোড় আছে। পেঁপে আছে। থোড় আছে দু’বস্তা। ভেন্ডার কামরায় মাল তুলে দিয়ে তবে বাড়ি ফিরব। খুব গুমোট যাচ্ছে ক’দিন। এমন সময় খালি রিক্সা নিয়ে অমৃত এসে হাজির। চলুন ঘুরে আসি বাবু।
কোথায়?
এই সুদের চর অব্দি যাব। জোছনায় ফিরে আসব।
আমার যে মাল ওঠেনি ট্রেনে।
তুলে দিয়ে চলুন।
ট্রেন যে আসেনি।
এলে যাবেন।
কৌতূহল ছিল। ট্রেন এলো। বোঝাগুলো তুলে দিয়ে অমৃতের রিক্সায় উঠে বসলাম। আমি কিন্তু এক পিঠের বেশি ভাড়া দিতে পারব না। হাঁটতেও পারব না।

আপনাকে কিছুই দিতে হবে না। এখন একটা বাতাস দেবেন ভগবান। রিক্সা ঠেলে তিনিই সুদের চরে নে যাবেন। আমার কিছু করার থাকবে না। একেবারে পাল টেনে লৌকোর মতো টেনে নে যাবেন।
মনে মনে ভাবলাম, সুদের চরে ঝিঙে-শসা–নানান সবজির বড় চাষ হয়। চোখে দেখে আসা যাবে। এখন রোদের তাত লাগার ভয় নেই। দিব্যি ফিকে জ্যোৎস্না উঠেছে।
সত্যি। রিক্সাখানা বাতাসেই ঠেলে নিয়ে চলল। অবশ্য অমৃতর প্যাডল করতে হচ্ছিল। ছ’মাইল রাস্তা তো কম নয়। কিন্তু আধঘণ্টাও বোধ হয় লাগল না।

একদা বিদ্যাধরী এই বিরাট তল্লাটের ওপর দিয়ে বয়ে যেত। এখন নদী নেই। তার বিরাট চর জেগে আছে। জল শুকিয়ে গেছে শ’পঞ্চাশ বছর আগে। নির্জন চরের ওপর শসা, ঝিঙে–নানান সবজির মাচান। লতায় লতায় জায়গাটা জঙ্গল হয়ে আছে। আমি রিক্সায় বসে রইলাম। অমৃত দিব্যি দু’খানা মাচানের পাশ কাটিয়ে একটা ঢিবি মতন জায়গায় উঠে ডাকল আমায়, চলে আসুন–এখান থেকে ভগবানকে দেখার খুব সুবিধে–
আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে। চাষিরা সন্ধেরাতে ঘুমোয়। এবার জেগে উঠে পাহারা দিতে এসে আমাদের এ জায়গায় পেলে আচ্ছা ঠ্যাঙান ঠ্যাঙাবে। তবু অমৃতের ডাকাডাকিতে যেতে হলো। চোরের উপদ্রব বলে সবজি চাষিরা কাঁটাসুদ্ধ বাবলা ডাল ছড়িয়ে রেখেছে। অনেক কষ্টে সেসব পার হয়ে ঢিবিতে উঠলাম। এখন ফিরে চল অমৃত। আর বলতে পারলাম না–আমার গিনি্ন রাতে আমার সঙ্গে খেতে বসেন। ঢুলু ঢুলু চোখে আমরা দু’জনে লুচি দিয়ে ক্ষীর মুড়ি খাই। রাতে ঝোল ঝাল ইদানীং আর সয় না। তাই মাছভাজা থাকে। তিনি এতক্ষণ নিশ্চয় বসে আছেন।
এখানে আসুন না। দেখবেন একটা জিনিস।
কোথায় কী! দু’ধারে দু’সারি বড় বড় তালগাছ–তার ভেতর দিয়ে পাতলা মেঘ মাখান একফালি অপুষ্ট চাঁদ উঠেছে!
দেখেছেন?
কী দেখব?
বুঝলেন না!
কী বুঝব? পায়ে ততক্ষণে লাল পিঁপড়ে উঠে কামড়াতে শুরু করেছে। হাত দিয়ে পিঁপড়ে ডলে ডলে মারছি আর ভাবছি, কোথায় কী! ফাঁকা মাঠে চাঁদ দেখাচ্ছে শুধু। এ তো বাজারে বসেই দেখা যেত। কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হয়, ও সত্যিই কিছু দেখার জিনিস পেয়েছে। হবেও বা। আমরা পাপ মন বলেই কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সারা দিন আলু পটল ঝিঙে উচ্ছে করে বেড়াই তো। যাক গিয়ে। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে বুড়োবুড়ি কাশী যাব–এ তো ঠিক করাই আছে। তখন সকাল সন্ধে গঙ্গা চান করে সব পাপ ধুয়ে ফেলব। অমৃতের এখনকার সব পুণ্য আমি তখন এক একদিনে কিনব। মায়ের নামে নীলমণি কর বিদ্যালয়ে একটা বারান্দা করে দিয়েছি গত সনে। চুন-সুরকির গাঁথুনি। ভেতরে মাটি। ওপরে এক পটি ইট আজ মেরে দিয়েছি। চাঁদের চারদিকে একটা নীল লাইন দেখছেন?
জিনিসটা আমি জানতাম। আমার গিনি্ন শিখিয়েছে আমায়। ওর নাম চন্দ্রসভা। লাইনটা চাঁদের যত কাছাকাছি হবে ততই বৃষ্টির দিন নাকি এগিয়ে আসে। বৃষ্টি হওয়া খুব দরকার। মাঠের পর মাঠ জ্বলে যাচ্ছে।
ওটা হলো গিয়ে ভগবানের দুঃখ। সারা জগতের জন্যে তার গা দিয়ে কেমন মায়া মমতা জমা হয়েছে দেখুন।
কচু। আর ক’দিন পরেই বৃষ্টি হবে তাই। অমৃত এবার ফিরে চল বাবা। রাত বাড়ছে। ফিরতি পথে ছেনতাই হতে পারে। আমার হাতে ঘড়ি রয়েছে–
চাইলে দিয়ে দেবেন। আপনার তো আটকাবে না। আবার হবে।
মনে মনে বললাম, কী অলক্ষুণে লোক রে বাবা! আমি একা একা রিক্সায় এসে বসলাম। ও আরও খানিকক্ষণ ভগবান দেখে তবে ফিরে এলো।
হ্যাঁ রে তোর ভগবান দেখতে কেমন?
খুব ফরসা। গায়ে খুব সোন্দর গন্ধ।

ফেরার পথে ভগবান বাতাস না দেওয়ায় বেশ বেগ পেতে হলো অমৃতকে। রাস্তা তো কম নয়। বাড়ির সামনে নেমে ওকে তিনটে টাকা দিতে গেলাম। জিব কেটে রিক্সার হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে নিল। আপনি সঙ্গে না থাকলে দেখাই হতো না।
ক’দিনের ভেতর পটলের দর যে এত লাফাবে জানতাম না। কেজি আশি পয়সা থেকে এক লাফে তিন টাকা। সামান্য বৃষ্টিতে নিচু জমির পটল নষ্ট হয়ে গেল। ডাঙা জমির পটল তখনও পুষ্ট হয়নি। ভাঙলে ভেতরটা খোকাখুকুর বার্লির রং এখনো কাটিয়ে ওঠেনি। তাই দূর দূর গাঁয়ে পুষ্ট পটলের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছি। বড় একটা অর্ডার ছিল।
সেই সময় একদিন বিকেলে অমৃত এলো। মুখখানা শুকনো। আকাশ জুড়ে গাঢ় মেঘ থাকায় ওর ক’দিন ভগবান দেখা হয়নি। বাস স্ট্রাইক বলে আমারও আজ বেরোনো হয়নি। মন-মেজাজ ভালো ছিল না। এমন সময় গোলায় ঢুকে বেচারা প্রথমেই আমার ধমক খেল।

খাটের নিচে বসে হাজরা নস্কর থাবা দিয়ে দিয়ে আরশোলা ধরছিল তখন। আলুর বস্তা, পটলের ডাঁই, ঝিঙের ডালা-গোলার ভেতর অন্ধকারে যেখানে যত আরশোলা ছিল–সব তাড়িয়ে হাজরা খাটের নিচে এনেছে। থাবা দিয়ে ধরছে আর পলিথিনের ব্যাগে পুরছে। মাঝরাতে বঁড়শিতে এই আরশোলার টোপ গেঁথে ব্যাঙের গর্তের মুখে ধরবে। আর অমনি ব্যাঙ লাফিয়ে এসে টোপ গিলবে। তখন কপাৎ করে ব্যাঙটা ধরে কোমরে ঝোলানো মাটির কলসির ভেতরে পুরবে। সকালে আড়তে সাপ্লাই দেবে চার টাকা কেজি। এই করে এখানকার অনেকে এখন সংসার চালাচ্ছে। ভালো কল বেরিয়েছে। বাজারে লোকে বলাবলি করে, ব্যাঙের কী ভাগ্য।

চন্দনেশ্বরের ব্যাঙ এরোপ্লেনে উঠে বিলেত আমেরিকা যাচ্ছে। সাহেব-মেমেদের ভাতের পাতে এদের বড় আদর।
অনেক ধানাইপানাই করে অমৃত বলল, এটা কি ঠিক হচ্ছে বাবু? এই যে ব্যাঙগুলো খুন হচ্ছে–আর আপনার গোলা থেকে টোপের আরশোলা যাচ্ছে–
খাটের নিচু থেকে ঝুলকালি মাখা হাজরা মারমূর্তি হয়ে বেরিয়ে এল। হাত-দা খানা উঁচিয়ে বলল ভগবানের ব্যাটা, আরেকটা কথা বললে তোমায় কোপাব। দেশসুদ্ধ অ্যাতোগুলো পেট তুমি খাওয়াতে?
মাঝখানে পড়ে দু’জনকে আলাদা করে দিলাম। হাজরাকে বললাম, তোমার কাজ তুমি করো গিয়ে। মনে মনে আমি খুশি। ব্যাটাচ্ছেলের ভগবানবাজি কিছু থামবে এখন। আর হাজরাও নিখরচায় আমার গোলা আরশোলা-শূন্য করে দিচ্ছে। লোক দিয়ে করাতে গেলে নিদেন দুটো লোকের মজুরি যেত।
হাজরা খাটের নিচে ঢুকে যেতেই অমৃতর মুখ আবার প্রসন্ন হয়ে উঠল।
আপনি সেদিনকার আগে কখনো ভগবান দেখেছেন?
কী আর বলব! সেদিনও আমি ভগবান দেখিনি। তার আগেও কোনদিন দেখিনি।
ভগবানের কথা কখনো ভেবেছেন মন দিয়ে?
এরও জবাব দেওয়া যায় না। ভগবানের কথা ছোট বয়স থেকে মাঝে মাঝে অবশ্য ভেবে এসেছি। মনে আছে স্কুলে যাবার পথে আচমকা পেট ধরে বেগ এলে ভগবানের নাম করেছি। বললাম, কিন্তু অমৃত তুমি সে রাতে ওখানে ভগবান দেখলে কোথায়?
কেন? সবটা জায়গা জুড়েই। গদগদ হয়ে বলল, এমন আলো। অমন ছায়া।
আমি আর থাকতে পারলাম না। প্রায় ভেঙিয়ে উঠলাম, অমন তালগাছের সারি–
ও ভাবল, আমি বুঝি ওর সাপোর্টার। তাই আদৌ সন্দেহ না করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল, তার ভেতর দিয়ে–
এমন তদগত লোককে বেশিক্ষণ ভেঙানোও যায় না। আমিই মানে মানে মনের ভেতরে রণে ভঙ্গ দিলাম। বিকেল বেলা। পথ দিয়ে খড়ের তড়পা বোঝাই গো-গাড়ি যাচ্ছে। সত্যিই তো, আমি কি কোনদিন ভগবানের কথা ভেবেছি? ভগবান নিশ্চয় কোন উঁচু চেয়ারে বসেন। অসময়ে অজাগায় বেগ এলে তাঁকে যেমন ডেকেছি, বেগ চলে গেলে বেমালুম ভুলে গেছি। এ জন্য তিনি কি রাগ করে আছেন? সে-জন্যেই কি পটলের ফড়েদের সঙ্গে আজ আমি গোলদার হয়েও হেরে যাচ্ছি?

স্কুলে থাকতে অঙ্ক পরীক্ষার কদিন তাঁকে ডেকেছি। সিমপ্লিফিকেশন আর ইউনিটারি মেথডের অঙ্ক দুটো বাইরে থেকে সাপ্লাই আসার পর তাঁকে ভুলে গেছি। রেজাল্ট বেরবার আগে কতবার ভেবেছি–আমি কি ম্যাথামেটিকসে তিরিশ পাব না ভগবান? হাত তিন টুকরো ইট নিয়ে সামনের লাইট পোস্টে ছুঁড়তে গিয়ে ভেবেছি–প্রথম টুকরোটা যদি পোস্টটার গায়ে লাগে তাহলে আমি পাস। যখন একটাও লাগল না–তখন মনে মনে বলেছি, নিশ্চয় পাস করব। ভগবান আছেন না!
এখান থেকে মাচানতলার রাস্তা তা আট মাইল হবে। উত্তর দিকে তেমন কোন বড় জায়গা নেই বলে সবাই বলে চন্দনেশ্বরের মাচানতলা। এ তল্লাটে সবচেয়ে ভাল পটলের জমি ওদিকটায়। আজ বাস স্ট্রাইক বলে কোন ফড়ে বা ব্যাপারি মাচানতলার মাঠে পেঁৗছতে পারবে না। বললাম, এক জায়গায় যাবে অমৃত?
কোনদিকে?
ভগবানের খোঁজ সবদিকেই করতে হয়–এ কথাটা মানো তো?
নিশ্চয়ই। তিনি তো সব জায়গায়।
তাহলে তুমি পঞ্চাননতলায় গিয়ে নিশি, পালান ওদের সঙ্গে বসে ঠাকুরের থানে নাম-গান কর না কেন?
আমার গানের গলা নেই বাবু। তাছাড়া অমন হাউ-মাউ করে পাড়া জাগিয়ে রেখে ভগবান ভগবান করা আমার ঠিক পোষায় না বাবু। আমি মেলাতে পারি না ওদের সঙ্গে। আপনি কোন্দিকির কথা বলছিলেন?
যাবে? উত্তুর। ফাঁকা চর জায়গা। ভুঁইয়ে ডাঙা জমিতে অঢেল পটল। তার ওপর যত দূর তাকাবে মাচান তুলে দিয়ে দিয়ে চাষিরা শসা করছে, ঝিঙে করছে, লাউ করছে–এ রকম প্রায় সারা বছরই চলে। জায়গাটায় গেলে চোখ জুড়োয়।
খুব নির্জন?
ভীষণ? দূরে দূরে দূরে চাষিরা খোন্তা দিয়ে নিড়েন দিচ্ছে। কোপ দিচ্ছে। ঘাস আগাছা তুলছে। অনেক পেছন দিয়ে কোম্পানি আমলের উঁচু বাঁধ চলে গেছে।
এখন যাবেন?
রাত হয়ে যাবে যেতে যেতে। কাল খুব ভোরে রিক্সা নিয়ে আয়। রাত থাকতে বেরোব।
বেশ।
কিন্তু–
আমি চুপ করে আছি দেখে বলল, কী বাবু?
না তেমন কিছু না। কিন্তু অমৃত, তোর তো ব্যবসা নষ্ট হবে। সকালের প্যাসেঞ্জার সব হারাবি। আমিও যাতায়াত ষোল মাইল একটা পয়সা দিতে পারব না। ভগবান দেখিয়ে বেড়ানো তো আমার কারবার নয়।
আপনি দেবেন কেন? কাজের ক্ষেতি করে যাচ্ছেন এই তো যথেষ্ট। আমার পয়সার কথা ভাববেন না। ফিরে এসে গাড়ি বের করলেই পয়সা হয়ে বেশি হয়ে যাবে–
তোর টাকাকড়ি রাখিস কোথায়?
সেই তো এক মুশকিল হয়ে গেছে। কিছু খুচরো আর নোট পাহারা দিতে গিয়ে মনটা খিচড়ে যায় বাবু। আমার তো বিশেষ কোন খরচা নেই। তাই বেশ জমে গেছে এ ক’মাসে। দু’তিনশো টাকাতো হামেশা হাতে থাকে।
আমার কাছে রেখে যাবি। দরকার মতো নিবি।
খুব ভাল হয় বাবু। তাহলে মনটা সরল রাখতে পারি।

আমারও একটা সুবিধা ছিল। গোলায় পয়সা বিশেষ রাখি না। কাজের লোকেদের হাতটান আছে। বাড়িতে নোটের তাড়া রেখে দেখেছি–গিন্নির খুব সুবিধে হয়। খরচ করে দিয়ে বলে, তুমি আমার কোন্ শখটা রেখেছো? এরপর কিছু বলা যায়! ব্যাংকবাড়িটা হয়ে আমাদের মতো লোকের খুব সুবিধে হয়েছে। এলোমেলো খরচার ভয় নেই। আমার আসলে নিজের টাকা ভাঙাতে বড় গায়ে লাগে। অমৃত যদি রেখে যায়–তাহলে রোজকার কারবারে টাকাটা ঘুরবে।
তাহলে কাল সকালেই আসিস। মাচানতলা যাওয়ার আগে বাড়িতে রেখে যাব।

কলকাতার ফার্স্ট লোকাল তখনো আসেনি। আকাশে চাঁদ থাকতে থাকতে প্রায় শতিনেক টাকা গুনে গেঁথে ধুতিতে বেঁধে নিলাম। তারপর রিক্সায় বসে বললাম, নে এখন চালা অমৃত। দেখি কত জোরে তোর গাড়ি যায়।
এখন বাবু, ভগবান বাতাস দেবেন। পাখির মতো উড়ে যাব।
ভগবানের নিকুচি করেছে। কিন্তু এসব কথা তো জোরে বলা যায় না। যাতায়াত ষোল মাইল বিনে ভাড়ায় ওরই রিক্সায় যাব। ওরই টাকায় দরকার হলে চাষিদের পটল বাবদে আগাম দেব। ভোর রাতে ঠাণ্ডা বাতাস ভালই লাগছিল।
আকাশ ফরসা হওয়ার মুখে মুখে চন্দনেশ্বরের মাচানতলায় গিয়ে হাজির হলাম। এত ভোরে এদিকে আসিনি। রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
পিচ রাস্তা থেকে গাছপালার আড়াল দিয়ে বাঁক নিয়ে মাটির রাস্তায় পড়েই খানিক এগিয়ে এই মাচানতলা।
চর জায়গা। বেলে মাটি হবে। ছ’সাত মাইল জুড়ে ভুঁইয়ের ওপর পটল চাষ। পাতায় পটলে মিশে আছে। এক এক কিতা চাষ আর তার পাশ দিয়ে শসা, ঝিঙের মাচান–সবুজ সবুজ–উঁচু-নিচ–যত দূর চোখ যায়। পাশেই কাছাকাছি চাষিদের গাঁয়ের আভাস। ভোর হতেই ছাগল, গরু বেরিয়ে পড়েছে। অমৃত এক কোণে দাঁড়িয়ে ঘেমে যাওয়া শরীরে বাতাস লাগাচ্ছিল। এতটা পথ একটানা প্রায় না থেমেই চলে এসেছে। গা জুড়োচ্ছিল ও। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুজনের চোখ জুড়িয়ে আসছিল। দূরে কোম্পানি বাঁধের মাটি পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে উঠে গেছে।
এত পটল আমি গোলায় নিয়ে তুলব কী করে? চাষিরা এরই ভেতর সব দূরে দূরে ছড়িয়ে ছড়িয়ে ক্ষেতে নেমেছে।
এখানেই ভগবান থাকেন?
হ্যাঁ। ওই মাচানে–
ক্যাবলাকার্তিক অমৃত তদ্দণ্ডে মাচানতলার দিকে এগিয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে একজন চাষি ধামা হাতে হা হা করে ছুটে এল। পটল তুলছিল। অমৃতকে আটকাল। হাত-পা ধোয়া? জল সরেছ?
পটল ক্ষেতে তো এমনি ঢোকা যায় না। চাষিরাও খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ক্ষেতে নামে। বাধা পেয়ে অমৃতর বিশ্বাস আরও বেড়ে গেল। তবে কি এই মাঠটাই একটা আস্ত মন্দির? কোম্পানি বাঁধের ঠিক ওপরে এক চাকা মেঘ গুরুগম্ভীর হয়ে জমে আছে। মাচানের ওপর লতানো শুঁড়গুলো সামান্য বাতাসে লক লক করে উঠছিল। আমি হাত-পা ধুয়ে আসছি। অমৃত এক ছুটে পাশের ডোবায় নেমে গেল।
এখানকার চাষিরা সাধারণত কিছু গম্ভীর। এ আমি আগেই জানতাম। ওদের কোন তাড়াহুড়ো নেই। বললাম, মণ কত করে?
চলি্লশ টাকা করে দেবেন।
আমার সারা শরীর নেচে উঠল। এরা কি বাজারের খবর জানে না? না, এদিকে এখনো ফড়ে এসে পেঁৗছয় নি? তা কী করে সম্ভব? চন্দনেশ্বরের পাইকারি দরই তো এখন এর দ্বিগুণ। কোলে মারকেটে না জানি কী অবস্থা। যত দূর চোখ যায়–শুধু পটল। নিজের গোলায় এত পটলের জায়গা হওয়া সম্ভব নয়। একটা উপায় আছে। আগাম দিয়ে দিয়ে সব পটল দরবন্দী করে আটকাও। তারপর এখান থেকেই লরি বোঝাই দিয়ে শেয়ালদা বাজারে। কিন্তু তাতে অনেক লোকজন চাই। অনেক টাকা চাই।
তাহলে কিছু কিছু আগাম রাখো সবাই।
চাষি ঘুরে দাঁড়াল। মাচানতলায় আমরা কেউ আগাম রাখি না বাবু। যেমন যেমন মাল নেবেন–তেমন তেমন দাম দেবেন। জানতাম। বড় শক্ত জায়গা। এরা ধীরে সুস্থে কথা বলে। এদের গরু-ছাগলের চেহারা অতি ধীরস্থির–পরিপূর্ণ। অবশ্য কারণ একটাই। এখানকার মাটি বাছাই সবজি-পটলে ছয়লাপ করে দিচ্ছে বছরের পর বছর।
এখানকার মাটি, বাবু আমাদের কোনবার ফেরায় নি। তিনি নিঝি এখানে থাকেন–
অর্থাৎ লক্ষ্মী থাকেন? আমার পাশে যে অমৃত কখন হাত-পা ধুয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝি নি।
কোনদিকি?
চাষি অমৃতকে হাত ঘুরিয়ে সবটা দেখালো। কোনদিকি নয়? সবটা তুমি নিঝি ঘুরে ঘুরে দেখ। হলুদ ফুল। সবুজ লতা। শসার মাচানে সাদায় সবুজে লাইন টানা জালি পড়েছে। তার ভেতর দিয়ে এক এক কিতা পটল চাষের দীর্ঘ টানা লাইন–সেই একেবারে কোম্পানি বাঁধের গা অবধি চলে গেছে। সেখানে গিয়ে দৃষ্টি হারিয়ে যায়। তার ভেতর দিয়ে ভেতরে দিয়ে অমৃত এগোচ্ছিল। এক-এক মাচানের সামনে দাঁড়ায় আর সম্ভ্রমে চোখ নেমে আসে ওর। কী সবুজ। কী শান্ত। ফুলে ফুলে রেণু কুড়চ্ছে কিছু অক্লান্ত ফড়িং। সঙ্গে আছে একপাল নাম না-জানা পোকা। কচি ডগাগুলো ফিনফিনে বাতাসে হিল হিল করে কাঁপছে।

এদিকে রিক্সাখানা মাটির রাস্তায় দাঁড়ানো। পেছনে কোন মালিকের নাম লেখা নেই। আমি কোমরে টাকা গুঁজে দাঁড়িয়ে। ওদিকে অমৃত দাশ একেক কিতা পটল ক্ষেত পার হয়–আর একজন দু’জন করে চাষি তার সঙ্গে নেয়। মাচানতলার শিশির তখনো শুকোয় নি। অমৃতের দলটা আস্তে আস্তে ভারী হচ্ছে। তাতে কচি মাথা, কাঁচা মাথা, পাকা মাথা–সব এসে ভিড়ছে। সারা মাঠের মানুষজন কুড়িয়ে নিয়ে ও এগোচ্ছিল। আর ভোরবেলাতেই মাচানতলায় নেমে আসা কুঁচো পাখির ঝাঁক, ওরা কাছাকাছি যেতেই ছররার ধারায় আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল। খানিক উড়েই আবার এক জোটে মাচান বদলে বদলে নেমে পড়ছিল ঝাঁক ধরে।

অমৃত দেখল এখানে ভগবানের কোন শেষ নেই। যতই এগোয় ততই বেড়ে যায়। মনটা কিসে ভরে যাচ্ছে। মাচানে মাচানে কোম্পানি বাঁধ অবধি ছেয়ে আছে। বাতাসে কিসের সুবাস। চাষিরাও এমন সমঝদার পায় নি কোনদিন। ফলন, গাছের বাড়, পুষ্ট ফল–যা কিনা ওদের কাছে আগাগোড়াই ঈশ্বরের আশীর্বাদ–অর্থাৎ সাক্ষাৎ ভগবান–তাই খুব মন দিয়ে অমৃতকে ওরা দেখাচ্ছিল। চষা মাটির ওপর দিয়ে ভারী দলটা নিয়ে এগোতে এগোতে অনেকগুলো মাথার ওপর দিয়ে অমৃত একবার ফিরে তাকাল। পেছনেও সেই একই ছবি। হলুদ ফুল। গুঁড়ো গুঁড়ো পরাগ মাখানো কেশরগুলি ফুলের লাল জন্মভূমি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভোরের বাতাসে দুলছে। মাচানের পর মাচান ফেলে এসেছে অমৃত। তার শেষে রিক্সাখানা কত ছোট দেখাচ্ছে। সিটে সাদাপানা একটা মানুষ বসে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছে। এখান থেকে কুচো কুচো পাখির চেয়েও ছোট দেখাচ্ছে শ্যামলবাবুকে। মানুষটা বড় ভাল। তাঁর জন্যেই ওর আজ এখানে আসা হলো।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত