| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এর ছোট গল্প | মৎস্যপুরাণ

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

আজ ২৫ মার্চ সম্পাদক ও লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল এগিয়ে দিয়ে-খাবার জলের গ্লাস হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুকুন্দ এক এক সময় বেঞ্চে এসে বসে। জিরোবে বলে। কিন্তু বসবার উপায় নেই। অফিসে সাহেব আন্দাজে বেয়ারা ভীষণ কম। জল এগিয়ে দিতে না দিতে আরেকজন চা আনতে পাঠায় । চা ঢেলে দিতে না দিতে বাবুরা কেউ সিগারেট কিনতে পাঠায়। মাঝ বিকেলে মুকুন্দর মাথা ঘোরে। অর্ধেক তৈরি বাড়িতে উঠে এসেছে অফিস। লিফট হয়নি এখনো । তাই ওঠা নামাতেই তার হাটু ভেঙে আসে।

তাতেও দুঃখ ছিল না মুকুন্দর। যেমন বাবুরা-সাহেবরা–তেমনি তার কাজের সঙ্গী সাথী অন্য বেয়ারারাও মুকুন্দকে পেলেই হল – ভীষণ ক্ষমাঘেন্নার গলায় ডাকবে – কি রে মুকুন্দ – কলকাতার জল সহ্য হচ্ছে তো ! 
মুকুন্দর দেশ কেশেডাঙা। কেষ্টনগর লাইনে পাগলাচণ্ডী স্টেশনে নেমে ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে তিন ক্রোশ হেঁটে যেতে হয় । বাওড় বিলের জায়গা । ছোটবেলা থেকে মাছ ধরে আসা মানুষ।  শাল গজাল তো ধরেছেই কোচে গেথে—এমনকি ইটখোলার ব্যোমে বড়শী ফেলে বড় বড় কাৎলাও ধরেছে। 
কাজে ঢুকে এসব গল্প তোড়ে বলে গেছে মুকুন্দ । বলতে বলতে নিজের দেশের কথায় মুগ্ধ মুকুন্দ এই বলে কথা শেষ করেছে – 
সে কি জল বাওড়ের – না-পাতলা না-ভারি – ঝাঁঝিতে শ্যাওলায় গম্ভীর কালো– আর তার ভেতর বড় বড় সফরি মাছের লেজের ঘাই –আশপাশের গাছে মাছরাঙা পাখিটা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। 
সেই কথায় অফিসমৃদ্ধ সবাই তাকে থাবড়ে বসিয়ে দেয়। আর বলে – কলকাতার জল সহ্য হচ্ছে তো ! 
আপনাদের বিশ্বেস হবে কোথেকে ! বরফ ঠাসা মাছ খেয়ে আসছেন । আরও কথা তার মুখে আসে। কিন্তু বলে না মুকুন্দ। যেমন-
কেনেন তো দুশো গ্রাম তিনশো গ্রাম কাটাপোনা।
নয়তো ধাড়ি তেলাপিয়া কিনে নিয়ে গিয়ে রাঁধেন তো সর্ষেপাতুড়ি।
আমাদের দেশের মাছগুলো জ্যান্তদশায় কলকাতার ক্লাস ওয়ান-টুয়ের বাচ্চাদের সাইজ।
এক একটা বাওড়-বিল দশ হাজার বিঘের।
তাতে পদ্ম ফোটে–পদ্ম গোখরোও থাকে–আবার বিশ-বাইশ কিলোর পাকা রুইও ঘোরে নি:শব্দে গম্ভীর চালে।
শহর কলকাতায় বর্ষায় জল জমে। নয়তো সারাটা শহর কেমন কেঠো কেঠো। শুকনো বেঞ্চে বসে কোন কথা পাড়লেই তার সঙ্গীসাথীরা চড়াস করে তার পিঠে থাবড়া কষায় ।
আরে চুপ কর। তোর আবার কথা কিসের মুকুন্দ । 

তার পিঠটা যেন হাতের সুখ করার জায়গা। তার গলার শব্দ যেন বেরিয়ে এলেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে চেপে দেবার জিনিস।

সে যা-ই বলুক না কেন– ওই মাছের গল্প-বিল-বাওড়ের জলের কথা বলার পর থেকেই সবাই তাকে কথা বললেই চেপে ধরে–থামিয়ে দেয়–হাসি মশকরায় ডুবিয়ে দেয়। 
ওঃ ! মুকুন্দ বলেছে ? তাহলে তো না হয়েই যায় না। 
সে যদি সূর্য ওঠার কথাও বলে–কিংবা মুহুরির ডালের দাম নিয়ে কথা বলে –তাও তাকে অফিসমৃদ্ধ সবাই চেপে বসিয়ে দেয়। ভাবখানা–তুই আবার কি বলিস ! চুপ কর। 
কাজে ঢুকে বছর দুয়েকের ভেতর মুকুন্দ তাই একদম বোবা হয়ে গেছে। অনেক জিনিস জেনেও সে রা কাঁড়ে না। বলে কি হবে । তাকে দেখলেই চেপে ধরার নেশা পেয়ে বসে সবার। কি রে মুকুন্দ–এ যে দেখছি নতুন স্যাণ্ডেল পায়ে দিয়েছিস–কোথায় পেলি ? 
মুকুন্দও সেয়ানা। সে মুখের ওপর বলে, রাজভবনে নেমতন্ন ছিল ।
 ওঃ ! তাই বল–
হ্যাঁ। রাজ্যপালের স্যাণ্ডেলজোড়া পছন্দ হয়ে গেল। চুরি করে পায়ে দিয়ে চলে এলাম । 
তাই বুঝি ? তা তোর স্যাণ্ডেলজোড়া ? 

সেই স্যাণ্ডেল পারে রাজ্যপাল ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

এসব বলে থোতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েও ওদের একটুও থামাতে পারেনি মুকুন্দ। ওকে দেখলে– কী বাবু- -কী সাহেব– কী তার কাজের সঙ্গী সাথীরা–তাকে পারলে পিষে ফেলার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে । 

অথচ অফিস নামে এই নিষ্ঠুর জায়গাতেই কাজের ফাঁকে বেঞ্চিতে বসে মুকুন্দ কাচের জানলা দিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে একটা গির্জার মাঠে সুন্দর পান্থপাদব গাছ বেয়ে মাধবীলতার ফুল গায়ে ওপরে ওঠা দেখতে পায়।

এ শহরে এখন ফেমিলি আনা কঠিন । জায়গা নেই। থাকলেও বেদম ভাড়া । তার সাধ্যের বাইরে। দেশের লোকের মোতিহারি তামাকের কারবার। বৈঠকখানায় তার গোলায় শোয় মুকুন্দ। রবিবার পড়লে গোলার বস্তাগুলো রোদে দেয়। বউকে পোস্টকার্ড ফেলে আর চিটেগুড়ের কলসীর কানাৎ থেকে ডাঁই পিঁপড়ে তাড়ায়। কোন কোন শনিবার বিকেলেই কেষ্টনগরের গাড়ি ধরে । সোমবার শেয়ালদায় নেমেই সিধে অফিসে চলে আসে মুকুন্দ।


আরো পড়ুন: শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প : শিয়ালদা কেমন আছে?


বর্ষার ভেতরে শুক্রবার কী একটা ছুটি ছিল। কাল বউয়ের চিঠি এসেছে। বেলঘরিয়ায় দিদির বাড়ি একবার ঘুরে এসো। 
কলকাতায় এসে কারও বাড়ি কোনদিন যায়নি মুকুন্দ । তার বড় শালী বড় ভায়রা থাকে বেলঘরিয়া। ছুটির দিন বলে লেবেলক্রসিং পার হয়ে বাস থেকে বেলঘরিয়ায় গিয়ে নামল মুকুন্দ। এখন সকালবেলা। আগেকার ছোট জায়গা লোক বেড়ে এখন বড় জায়গা । 
সেই বিয়ের সময় দেখা হয়েছিল একবার। মুকুন্দ তবু খুব মাখামাখি গলায় বলল, কী বড়দা ? চিনতে পারেন। 
সুরকি ঘেঁষের পুরনো বাড়ির বারান্দা। মোটা দেওয়াল। বুড়ো মত একজন রুগ্ন লোক–একগাল সাদা দাড়ি ভুলভুল করছে–বাড়ির গায়েই কাঁচা ড্রেনে থকথকে পাকা-পচা ময়লার গন্ধ-চোখ কুঁচকে তাকাল – ইজিচেয়ারে শোয়া অবস্থাতেই। সরু রাস্তায় অবিরাম সাইকেল রিক্সা। দাঁড়াবারও উপায় নেই। 
‘মনে পড়ছে না তো–‘
মুকুন্দ নিভে গেল। ভুল ঠিকানায় আসিনি তো। ঠিক এই সময় বড় শালী বারান্দায় বেরিয়ে এল। ও মা ! কী ভাগ্যি ! 
যাক। মুকুন্দ সাহস করে বারান্দায় উঠল। 
তোমার বড়দা তো জর বাঁধিয়ে হপ্তা দুই ঘরে বসে। ছুটি পেলেই এ দিঘি সে দিঘিতে ছিপ ফেলতে চলে যায়। কোত্থেকে আবার হারপিস বাঁধিয়েছে পিঠে-
সেটা কি জিনিস ? 
মুকুন্দর বড় শাল তার স্বামীর পিঠের দিকটার ফতুয়া তুলে ধরল। 
ওই ফোস্কা মতন ? 

হুঁ। কোন গাছের নিচে বসেছে তার ঠিক নেই। সারছেই না।

গোড়ায় যাকে খিটকেল লেগেছিল মুকুন্দর–সেই বড় ভায়রাকে বিকেলের দিকে বড় ভাল লাগল মুকুন্দর। জ্বরে হারপিসের ব্যথায় কুথে কুথে কথা বললেও –আটকুড়ে মানুষটা তাকে দু’হাত ধরে বলল, রাতটা থেকে যাও না ভাই। 
আমরা তো মোটে দুটি প্রাণী। ভালই কাটবে। কেউ আসে না এদানী–
উপায় নেই বড়দা । আবার আসব আমি। পরের গোলায় শুই। না ফিরলে দোর খুলে বসে থাকবে। 
বেরোবার সময় ঘরের কোণে দাঁড় করানো গুচ্ছের ছিপ থেকে একখানা তাকে উপহার দিল তার বড় ভায়রা। আর বউকে ডেকে বলল, মুকুন্দ যদি পারে তো ধরবে গিয়ে মাছ–দাওনা টিকিটখানা–
কিসের টিকিট দাদা ? 
বড় শালী এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার বড়দার শখ। যেখানে পারে ছিপ ফেলার টিকিট কেটে রাখে আগাম- – 
আমি তো ওভাবে টিকিট কেটে ছিপ ফেলিনি কোনদিন দাদা। চার জানি না। কলকাতায় এসে ইস্তক কোন ছিপও নেই আমার। 
এইতো ছিপ দিলাম। টিকিট পেলে । লালদিঘির টিকিট। কালই গিয়ে বসবে। কালই তো শনিবার | 
এ ছিপ নিয়ে বাসে উঠতে দেবে ? 

ভাঁজ করা যায় ভাই। জাপানি ছিপ। সুতোও জাপানি–

বড় শালী বলল, আয়োজনে কোন ক্ৰটি নেই ভাই ! এখন বয়সটা বেড়ে গিয়ে কিছু অসুবিধায় পড়েছেন তোমার দাদা। 
সন্ধেবেলা এক অপরিচিত তৃপ্তির স্বাদ মনের ভেতর টের পেতে পেতে শেয়ালদায় এসে নামল মুকুন্দ। কলকাতায় এসে ইস্তক এমন আদর আপ্যায়ণ কোনদিন পায়নি মুকুন্দ ।
বৈঠকখানার মোড়ে গিয়ে দেখল-কয়েকটা দোকানে বড়শি, সুতো, ছিপ আর নানান চারের আয়োজন। মুকুন্দ প্রথমে টিকিটখানা বেচার চেষ্টা করল। 
সুবিধা হল না। এক দোকানী গিয়ে বলল, কাল তো লালদিঘিতে গিয়েই বেচে দিতে পারেন। খদ্দের পেয়ে যাবেন। 
তিরিশ টাকার টিকিট। কম করেও বিশটা টাকা তো পাওয়া যাবেই। বড় ভায়রা তো আর দেখতে আসছে না। 

তখন সে ছিপটা বেচতে গেল। পর পর চারজন দোকানী বলল, কেনে যারা তারা নতুন কেনে ।

নালশে পিঁপড়ের থলথলে জ্যান্ত বাসার চার, ভাজা মেথি, বোলতার চাক মিশে এক অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছিল দোকানগুলো থেকে। বড়শি তিরিশ রকমের। তাদের খদ্দেরও হরেক কিসিমের। সেই সঙ্গে সুতো হুইল লাগানো বাহারি সব ছিপ। মুকুন্দর নিজেকে বড় দীন-হীন লাগল। সে তো কেঁচো দিয়ে মাছ গেঁথেছে দেশে। নয়তো স্রেফ কেঁচোর টোপ গেঁথে মাছ তুলেছে। কিন্তু এ যে অন্য জগৎ। এমনকি এক দোকানে একটা পাঁচ-ছ কেজির রুই মাছের ফটো টাঙানো রয়েছে। প্রমাণ সাইজের। একদম জ্যান্ত যেন তাকেই দেখছে । 
এক দোকানী বলল, শুধু শুধু দামী ছিপটা বেচবেন কেন ? টিকিট রয়েছে যখন–কালকের জন্যে চার নিয়ে যান। বানিয়ে দিচ্ছি এমন জিনিস–গন্ধে গন্ধে মাছ মানুষ সবাই ফিরে তাকাবে দেখবেন। 

রীতিমত অনিচ্ছায় গাদাগুচ্ছের চার কিনে গোলায় ফিরল মুকুন্দ। তখন গোলার ভেতরটা লোডশেডিংয়ে অন্ধকার । তোলা উনুনে ভুগ ভুগ করে ভাত ফুটছে।

পরদিন সকালে রীতিমত আনাড়ির কায়দায় সবার আগে লালদিঘির ঘাসে ঢাকা ঘাটে গিয়ে বসলো মুকুন্দ। না আছে চৌকি—না আছে হাত দা কিংবা কোন নাকাল। সামনে টেলিফোন ভবন। পেছনে রাইটার্স। ডানপাশে জি পি ও। মাথার উপর ভাদ্র মাসের মেঘলা আকাশ। দশ বারো হাত অন্তর আরও সব নেশাডু মাছমারা এসে একে একে বসল। আজ আর অফিস যাওয়া হবে না মুকুন্দর। ভেতরে একটা খুতুখুতুনি থেকেই গেল তার। 
ভাগ্যিস গোলার ফাই ফরমাস খাটা ছেলে নবকে সঙ্গে এনেছিল মুকুন্দ। নবই দাঁতে কেটে ফাৎনার ঝুল ছেটে দিল। চার মাখল গোল্লা গোল্লা করে। তামাকের বস্তা এনেছিল কয়েকটা । তারই একটা ভাঁজ করে বসতে দিল মুকুন্দকে। পাশে মেলে ধরল মুড়ির ঠোঙা। উল্টোদিকে টেলিফোন বাড়ির ঘাটলায় জলের ফোয়ারায় আলাদা একটা ছবি হয়ে আছে। পুকুরের চারদিক দিয়ে বাস মিনিবাসের চক্কর চলছে তো চলছেই। তারপর মানুষ । ট্রাম ।

মোটরগাড়ি । কত কি।

জলের দিকে তাকাল মুকুন্দ। বেশ ভারি। কালো আর গম্ভীর। হাত তিনেক ডুব দিলেই ঝাঁঝি শ্যাওলার মাথা হাতে পাবে মনে হল মুকুন্দর। দিঘির কানাৎ ঘেঁষে টোকা পানার ছাট । 
ফাৎনা ডুবতেই টান দিল মুকুন্দ। ভাগ্যিস হুইলের গাট খোলা ছিল । ঝাঁকুনি দিয়ে গলগল করে সুতো টানতেই লাগল মাছটা। উঠে দাড়াল মুকুন্দ । অন্তত পাঁচ ছ’ কেজির পাকা মাছ হবে। সুতো কেটে বেরিয়েও যেতে পারে । 
দিঘির চারদিকে থেকে সবাই তার বেঁকে যাওয়া ছিপের মুখে তাকিয়ে । নব তো লাফাচ্ছে । 
ধমকে উঠল মুকুন্দ। একটা বস্তার মুখ খুলে নাকাল বানা তো
নাকাল ? 

তাও জানে না। শুধু লাফালেই চলবে?–এবার সুতোয় একটু টান রেখে অদেখা মাছটাকে দিঘির বুকে শুয়ে শুয়ে জিরোতে দিল মুকুন্দ। তারপর নবকে বলল বস্তার খোলা মুখে নারকেল দড়ির জালি বানিয়ে দু’ধারে করে বাঁধো। তারপর মাছটাকে তুলে ওর ভেতর ভরে জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে না! কতক্ষণ বসতে হয় তার ঠিক কি ।

প্রায় ঘণ্টাখানেক কসরতের পর মাছটাকে তুলল মুকুন্দ। শ্যাওলা পড়া আট ন’ কেজির এক কাৎলা। গাঁথা বড়শির কষে সিঁদুরে রক্ত জলে ধুয়ে যাচ্ছিল। মুখে খানিকট মাটি। গোত্তা খেয়ে মাছটা যে দিঘির বুকে গিয়ে যন্ত্রণায় মুখ ঘষেছে–তাতে আর কোন সন্দেহ থাকল না মুকুন্দর। 
এখন ঘাট ভেঙে পড়েছে মানুষে । ভবঘুরে, ফিরিঅলা, দাঁড়ানো গাড়ির ড্রাইভার, পানউলি–কে নয় ? এমনকি সাহেবসুবো প্যাটার্নের কিছু ভদ্দরলোকও তাকে আর মাছটাকে খুব সন্ত্রমভরে দেখছে। 
মুকুন্দ অন্যরকম হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। যেন কতকাল ধরে সে দুনিয়ার ঘাটে ঘাটে শুধু রাঘববোয়ালই ধরে আসছে। এ মাছটাতো সে আন্দাজে পু’টি। হাতের আঙুলে ফাঁদ বানিয়ে নারকেল দড়ির জালি কেঁদে নব বস্তার মুখে তা ভাল করে বসিয়েছে। এবারে তার ভেতরে দু’জনে ঠেলে ঠুলে মাছটাকে ভরল। ভরা কি যায়। যেন জ্যান্ত এক খোকা! হাজার হোক সরকারি লালদিঘিতে চরে বেড়ানো মাছ। বাস মিনিবাসের ঘর্ঘর শুনে বেড়ে উঠেছে। একেবারে বাবুর বাড়ির ছেলে। বস্তা সুদ্ধ জলে ডুবিয়ে দিয়ে বস্তার মুখ শক্ত দড়িতে বেঁধে একটা মুখ ঘাটের গায়ে পড়ে থাকা এক লোহার চাকায় কষে বেঁধে দিল নব। 
ফিরে বলল, মেসো আর তো বস্তা অনিনি–

বেশ করেছ। এবার চার মাখো। মেথিটা বেশি দিস–

ছিপের মাথা ঝাঁকিয়ে বেশ দূরে ফাৎনা ভাসাল মুকুন্দ এবার। ভাসিয়ে দিয়ে চিন্তা হল — আবার যদি এমন মাছ পড়ে তো রাখবে কোথায় ? নাকাল বানাবার আর তো বস্তা নেই। মাছ ধরার সরঞ্জাম আর তো কিছুই নেই। বড়জোর আর একটা মাছ ওই মাছটার সঙ্গে বস্তায় ভরা চলতে পারে । 
ভাবতে না ভাবতেই আবার ফাৎনা ডুবল। যা ভেবেছে। এবারো তেমনি টান সুতোয়। তবে আগেরবারের মত অত সময় নিল না এবারের মাছটা । পোয়া ঘন্টার ভেতর মুকুন্দ সমান সাইজের একটা পাকা মৃগেলকে ঝটাপটির ভেতর এক ঝটিকায় একদম ঘাসের ওপর তুলে দিল । 
সঙ্গে সঙ্গে ঝুকে পড়া মানুষের ভিড়টা ভেঙে গিয়ে ফের গোল্লা পাকিয়ে ঝটাপটি যাওয়া মাছটাকে ঘিরে ধরল। 

সবুজ ঘাসে মৃগেলটার মুখ থেকে লাল রক্ত ঝরে পড়ে মেখে যাচ্ছিল। মাছের চোখে ভাঙা ঘাসের মাথা, মাটি । মতলব করেই মাছটাকে পাড়ে তুলেছে মুকুন্দ । আর তো ডুবিয়ে রাখার জায়গা নেই। ভাঙায় ঝাঁপাঝাঁপি করে মারা গেলে তবে মৃগেলটাকে ঘাসের সিড়িতে শুইয়ে রাখবে ভেবেছে।

কড়কড়ে রোদ উঠল। ঘেমে জামা খুলে ফেলল মুকুন্দ। খালি গা। হাতে ছিপ। পরনে একটা প্যান্ট। তাকে ঘিরে অন্তত শ’খানেক মানুষ । এমনকি রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দোতলায় রেলিং ধরে মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। তাকে দেখবে বলে । 
মুকুন্দ সারা ভিড়টাকে চমকে দিয়ে নবকে এক দাবড়ি দিল। চার মাখবে কে ? মৃগেল নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে । 
সে দাবড়িতে সবাই তটস্থ হয়ে গেল। কারো দিকে না তাকিয়ে মুকুন্দ ছোট খোকা কোলে নেবার কায়দায় মৃগেলটাকে দু’হাতে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বুঝল, আর দাপাবে না–মরে এসেছে–

এখন যদি এই ভিড়ে তার অফিসের কেউ থাকত তো কী ভালই হত । দেখে যেত কেশেডাঙার মুকুন্দ রানা একজন কেউকেটা লোক। ছিপ ফেলছে –আর মাছ তুলছে। মাছ বলে মাছ। সব ক্লাশ ওয়ান টুয়ের বাচ্চা। ঠিকের বাস বোঝাই দিয়ে যেমন কিনা গুঁড়োগাড়া স্কুলে যায় সকালে।

বেলা বারোটা বাজতে না বাজতে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল ঝমঝম করে। মৃগেলটা এখন নিথর ঠাণ্ডা। ডুবিয়ে রাখা বস্তাসুদ্ধ কাতলাটা দাপিয়ে উঠছে মাঝে মাঝে । এখন মুকুন্দকে ঘিরে হৈ হৈ হচ্ছে। জমাট ভিড়ে কথা একটাই। না জানি কী মাছ ওঠে এবারে–ভাজা মেথির সঙ্গে পাউরুটি, কচি বোলতা, থকথকে পিঁপড়ের ডিম সব এক করে মেখে গোল্লা পাকাচ্ছে মুকুন্দ নিজেই। খোলা গায়ে জায়গায় জায়গায় ঘামের ফোঁটা। বিড়ি আনতে গেল নব এইমাত্র–
এরপরেই যা শুরু হয়ে গেল তাকে কী বলবে মুকুন্দ । 
একেবারে কেলেঙ্কারি । স্রেফ কেলেঙ্কারি । 
ছিপ ফেলে আর ফাৎনা ডোবে সুতোয় ঢিলে। খানিকক্ষণ খেলানো। তারপর টান রেখে রেখে ছাড়া। শেষে নব জলে ঝাপিয়ে পড়ে কোলে তুলে নিয়ে ঘাটে উঠে আসে। পাছে সুতো ছিঁড়ে পালায় ।
বেলা চারটে নাগাদ পুলিস এসে ঘাটে দাঁড়াল। দু’জন পুলিশ মিলেও ভিড় সামলাতে পারছে না। হাতের রুল চালিয়ে ভিড়ের ফেঁপে ওঠা জায়গাগুলো ঠেসে চেপে দিতে লাগল পুলিশ । 
বিড়ি ধরাবার জন্যে একবার মুকুন্দ পেছন ফিরে দলা পাকিয়ে রাখা শার্টের পকেট হাতড়াতে গিয়ে ওপর দিকে চাইল । রাইটার্স বাড়ির দোতলায় রেলিং ধরে মানুষের গাদি। নিজের অফিসের যেসব ভদ্রলোককে সে মনে মনে বড় বাবু কিংবা সাহেব বলে–তারাই কাতার দিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ান। তখন খাটের সিঁড়িতেও মাছের গাদি। একটার গায়ে আরেকটা । রুই, কাতল, মৃগেল। সব ছ, সাত, আট কেজি সাইজের । 

ইস, আজ যদি অফিসের সঙ্গী সাথীরা-বাবুরা তাকে এ অবস্থায় দেখতে পেতো। তাহলে ?

 জিপিওর মাথায় একখানা চ্যাপ্টা মেঘ। কোথায় যে বৃষ্টি ঝরাবে বুঝতে পারল না মুকুন্দ। সুর্যের আলো গঙ্গার দিকটায় আর সাদা নেই। রীতিমত রঙিন। লম্বা দিন। সন্ধে হতে অনেক দেরি। দাবড়ে উঠল মুকুন্দ। চার কোথায় ? মাখিসনি? 
নব এক গাল হেসে তাকাল। সেও যে এই বিজয় উৎসবের একজন ছোট খাট বরকন্দাজ। আর কোথায় ?
মানে ?
ফুইরে গেল যে মেসো!
ফুরিয়ে গেছে ? আর নেই ?
নাঃ।|
ঘাটে বসে পড়ল মুকুন্দ। আধখানা চাঁদ হয়ে তাকে ঘেরা উপছে পড়া ভিড় থেকে আফশোসের হা হুতাশ উঠল।
ইস এখনো ঘণ্টা দুই ছিপ ফেলা যায়।
কেউ বলল, এই ছেলেটাই যত নষ্টের গোড়া। বেশি বেশি করে চার ছড়িয়েছে এতক্ষণ ।
মুকুন্দ পরিষ্কার শুনল, একজন লোক তার পাশের সবাইকে শুনিয়ে বলছে –উনি তো কম্পিটিশনে মাছ ধরেন। ইণ্ডিয়ার হয়ে যত কান্ট্রিতে গেছেন – কাগজে ছবিও থাকে–
বাকি কথাগুলোর সব শুনেও বুঝতে পারল না মুকুন্দ । চোখ তুলে তাকাল লোকটার দিকে। অল্পবয়সী। রোগাভোগা তার অফিসে ক্যাশের ভাউচার বাবুর মত দেখতে অনেকটা । মুকুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে লোকটা চোখ নামিয়ে নিল। সম্ভমে । সোজাসুজি তার চোখে তাকিয়ে থাকতে পারল না ।
সঙ্গে সঙ্গে খুব রুক্ষ গলায় হাক দিল মুকুন্দ। এই নবা–
নবও চমকে উঠল। মুকুন্দ মেসো তো তাকে কোনদিন এই গলায় ডাকে না। নবর মুখ শুকিয়ে গেল। সে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে বস্তায় ডোবানো কাতলাটার আন্দাজ নিচ্ছিল। বকের মত টক করে উঠে এসে সিঁড়িতে দাড়াতেই মুকুন্দ বলল, কেঁচো তোল–
কেঁচো ?
হ্যাঁ, কেঁচো, কেঁচো গেঁথেই মাছ লাগাবো–
ভিড়ের ভেতর থেকে একটা চাপা ধন্য ধন্য রব উঠল । রবের ভাষাটা অবিশ্যি অন্যরকম। এই যেমন–
কত বড় মাছমারা দেখেছ। শেষে হুইল ছিপে কেঁচো গেঁথেই- –
বড় প্লেয়ার তো। ওদের বসিয়ে দিলেই হল। এ দিঘি ওদের কাছে চৌবাচ্চা।
একটা লাঠি। কিছু কেঁচো। আর একটা আলপিন বাঁকিয়ে দিলেই হল।
নব বলল, দা শাবল–কিছুই যে আনিনি মেসো
হাত দিয়ে তোল বাবা । জলের গা ঘেঁষে–মাটি তো নরম এখন । 
এমনই কপাল–কেঁচোতেও কেজি দেড়েকের একটা রুই উঠে এল । সবে লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। ততক্ষণে দুজন পুলিশের পক্ষে ভিড় সামলে রাখা আর সম্ভব হচ্ছিল না। 

সদ্য সদ্য অক্কা পাওয়া ধাড়ি ধাড়ি মাছগুলোর মাঝখানে পড়ে দেড় কেজির রুইটা সামান্য ঝটপট করেই ঠাণ্ডা মেরে গেল ।

তখন মাছমারাদের প্রায় সবাই মুকুন্দর ঘাটে এসে ঝুঁকে দাঁড়ান। বড় ডাকঘরের গোল টাকে গঙ্গার ওপার থেকে সুৰ্য আলো ফেলছে। মুকুন্দ হুইলে ঢিলে দিয়ে এক্ষুনি কেঁচোর টোপ সমেত বড়শিটা যতদূরে পারে ফেলবে। লালবাড়িতে তো মুখ্যমন্ত্রী বসেন। এইটুকু পথ মাত্র। নেমে এসে একবার যদি বলতেন–একি করেছ মুকুন্দ — 
বলার মত একজন সাক্ষী থাকত তাহলে। এইসব ভাবতে ভাবতে তন্ময় মুকুন্দর কানের কাছে কে যেন খুব চাপা গলায় কী বলে উঠল। 
মুকুন্দ চমকে উঠল। সে ভাবতেই পারেনি–লালবাড়ি থেকে সত্যি সত্যিই মুখ্যমন্ত্রী নেমে আসবেন । হাত থেকে ছিপখানা খসে পড়ে যাচ্ছিল। মুখখানা যতটা বিনীত করা যায়–তাই করে কোনরকমে পেছনে ফিরে তাকাল মুকুন্দ। 
কোথায় ! 
কাঁচা পাকা দাড়ি ভর্তি একটা লোক। মুখ ভর্তি হাসি। এত মাছ নিয়ে ফিরবে কি করে ভাই । অফিসটাইম। এখন তো গাড়ি পাবে না —
– ঠিক তো, এটা তো ভাবা হয়নি। মুখে বলল, তাহলে – 
খানিকবাদে অন্ধকার হয়ে যাবে ভাই–
শুনতে শুনতে মুকুন্দ ভাবল, এ-কথা বলতেও লোকটা হাসে কেন ? এমনকি চোখ অব্দি হাসছে। 
কোন গাড়িও তো কাছাকাছি দাড়াতে দেবে না পুলিশ। অফিস ছুটির পর এদিকটায় ট্যাক্সিও কমে আসে । 
নব সব শুনছিল। সে ফস করে বলল, আমি আর মেসো মাথায় করে নে যাব ৷ 
লোকটা বলল, পারলে ভাল !–বলেই পিঠ ফিরে চলে যাচ্ছিল । 
মুকুন্দ নবকে ধমকাল। একই সঙ্গে লোকটাকে বলল, তাহলে ?
এবারে সেই লোকটা আবার ফিরে তাকাল। মুকুন্দ ভিড়ের গায়ে যতটুকু একবারে দেখল— তা হল–গায়ে খাকি হাফসার্ট – নিচে পাজামা, পায়ে নাগরা–কাঁধে ঝাড়ন মত ।
তাড়াতাড়ি মাছ তোল দু’জনে। আমার ট্যাক্সি মিনিবাসগুলোর ঠিক উল্টো দিকে– বলেই পাজামার দডি বাঁধতে বাঁধতে লোকটা চলতে শুরু করে দিল।
মুকুন্দ হুইলে সুতো গোটাতে গোটাতে জানতে চাইল, হ্যারে নব–টাকা আছে তোর কাছে ?
গোলায় গিয়ে চেয়ে দিও ড্রাইভারসাহেবকে।
যদি কেউ দেবার না থাকে।
ছোট রুইটাই দিয়ে দিও মেসো। ড্রাইভারসাহেব নাচতে নাচতে নে যাবে।
মুকুন্দ দেখল ছেলেটার হাসির ভেতরেও সুর্যের লালচে আলোর কুচি চুকে পড়ছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত