আজ ৩১ অক্টোবর কথাসাহিত্যিক শ্যামলী আচার্য’র শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
শান্তু এই সময়েই বাজারে আসে রোজ। এই সময়টা ওর চেনা। এই সময়ে বুম্বাদের বাড়ির পাশে রাস্তার কলে জল পড়ার শব্দ। মুনিয়া গলা সাধে। কালীজেঠুর বাড়িতে এই সময় রেডিওতে বাংলায় স্থানীয় সংবাদ। কালীজেঠুর এখনো সেই প্রাচীন আকাশবাণী। খবরের টান। এই সময় চারিদিকে চেনা শব্দ, চেনা ছবিতে তেমন হোঁচট লাগে না। ও গুনে গুনে পা ফেলে। রাস্তার ধার ঘেঁষে সাবধানে হেঁটে আসে বাজার অবধি। বাজারের মুখেই বাঁদিকে মনাদা। তারপর ডানদিকে ঘুরে তিন-চার পা এগোলেই কাঁচালংকা-ধনেপাতা নিয়ে এক বুড়ি মাসি। ডানদিকে না গিয়ে বাঁদিকে ফিরলে পঞ্চুর ফুলের দোকান।
শান্তু দেখে দুটো পঞ্চু। পাশাপাশি। দু’জনেই খুচরো পয়সা গুছিয়ে রাখল। দু’জনেই প্লাস্টিক প্যাকেটে ভরছে দূর্বা-কুচো ফুল-বেলপাতা। দু’জনেই সুতো কেটে রজনীগন্ধার মালা নামিয়ে দিল বাঁশে ঝোলানো দড়ি থেকে। একজন পঞ্চু। যাকে ও চেনে। অন্যজনও পঞ্চু। কিন্তু তার কানদুটো নেই। শান্তু দাঁড়িয়ে দেখে। পঞ্চু একবার চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, ফুল দেব নাকি? শান্তু ঘাড় নাড়ে। নাঃ থাক। ওর ডানদিকে যেমন এখন দু’জন মনাদা বসে আছে। দু’জনের সামনে বাটখারা। দু’জনের হাতে খবরের কাগজ। দু’জনেই একসংগে জানতে চায়, কতটা আলু? দু’জনকেই উত্তর দেয় শান্তু, ঐ এক কিলোই দাও। বরাবরের চেনা মনাদার পাশে আরেকজন মনাদা। শুধু তার বাঁ হাতটা অনেক ছোট ডান হাতের চেয়ে।
মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি এসে দাঁড়াল। ভ্যাট থেকে ময়লা তুলবে। একটা গাড়ি। বড়। বিশু সাইকেল নিয়ে পাশ কাটাল। একটা সাইকেল কিন্তু দুটো বিশু। চেনা বিশু। ট্যারা বিশু। শান্তু চোখ বন্ধ করে ফেলে। বড্ড ভিড় বাড়ছে।
বাজারের সময়টা এইরকম। প্রত্যেকে দু’জন। বেলা বাড়লে দু’জন মানুষের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। শান্তুর তখন ডান চোখে খালের পাড় ধরে পূবদিকে চলে যাওয়া গলিরাস্তা। একই সঙ্গে বাঁ চোখ দিয়ে ও তখন পশ্চিমের বড় ফ্ল্যাটবাড়ির কালো গেট দেখতে পায়। অথচ কিছুদিন আগেও তো এমন ছিল না। আর পাঁচটা সহজ স্বাভাবিক মানুষের মতোই চোখে দেখতে পেত শান্তু। ঠিক কী যে হোল। লরির ধাক্কায় শান্তুর বাইক উল্টোল। ওর হেলমেট অক্ষত। কোমরে আর পায়ে চোট। তা’ও মারাত্মক কিছু নয়। অল্পের ওপর দিয়েই ফাঁড়া কেটেছে। বড় কিছু ঘটতেই পারত। ঘটেনি। প্রাণে বেঁচে ফিরে অ্যাক্সিডেন্টের অভিঘাত বুঝতে সময় লেগেছে। কিন্তু একটা বিষয় জলের মত পরিষ্কার। শান্তুর মাথায় কোনো চোট লাগেনি।
কিন্তু গণ্ডগোল শুরু হোল ক’দিন পরে। বিছানায় শুয়ে টিভির দিকে তাকিয়েছিল শান্তু। শান্তুর স্ত্রী, রিমি টিভি সিরিয়াল দেখছে। আওয়াজ কমানো। শান্তু দেখছে, দু’জন পুরুষ। একই রকম হুবহু। একই পোশাক, চুলের স্টাইল, জামার রঙ—তাকানোর ভঙ্গি – কথা বলা— সব এক। প্রথমে ভাবল, ডবল রোল। তারপর যেই একটি মেয়ে, বেগুনি শাড়ি পরা, এলোচুল—না, একা তো নয়। দু’জন। একদম এক। মাথার চুল থেকে………। উফ। চোখ বন্ধ করে শান্তু। আবার তাকায়। না। কোনো ভুল নেই। ওই তো দু’জন। রিমিকে ডেকে জিগ্যেস করবে একবার? রিমি ব্যস্ত। টিভি সিরিয়ালে সেঁটে আছে। কোনো কথা শুনবে না। শান্তু বিছানা থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানদিকে দেখে সোফায় রিমি বসে আছে। দু’জন রিমি। পাশাপাশি। সোফায় একটা পা তোলা। শাড়িটা উঠে গেছে একটু। পায়ের ফর্সা গোছ। দুজন। শান্তু আঁতকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলে। গায়ে কাঁটা দেয়। খুব জোরে চিমটি কাটে একবার। নাঃ। ভুল নেই কোথাও। দুটো। সব ডবল। সমস্ত মানুষ। টিভিতে, সোফায়, দরজার পাশে, জানালার বাইরে, বাজারের রাস্তায়, বাড়ির পাশের গলিতে, ট্রামে-বাসে-ট্রেনে-অটোতে সব মানুষ দুটো করে। যেন একটা নিলে একটা ফ্রি-এর অফারের মতো সেঁটে রয়েছে গায়ে গায়ে। একজন তাকালে, অন্যজনও। একজন ডাকলে আরেকজনেরও ঠোঁট নড়ে। দু’জোড়া চোখে সকলে দেখছে ওকে।
অথচ আর সব ঠিকঠাক। যা কিছু নিষ্প্রাণ। যা কিছু না-মানুষ। একটাই পুষি মাছের কাঁটা খেতে আসে রোজ দুপুরে। একটাই কাক এসে বসল জানালার কার্নিশে। একটাই কুকুর ঘুমোচ্ছে ফুটপাথে। ভাল করে খেয়াল করে দেখেছে শান্তু শুধু মানুষের বেলাতেই এমন হয়। সকালের বাজারে এমনিতেই ভিড়। তার ওপর সর্বত্র দু’জন। দুটো copy। সমরদা’র পাশে বিজন এসে দাঁড়ায়। দু’জন সমর আর দু’জন বিজনের চারজোড়া চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় শান্তু। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক কি কথা বলবে, ঠাহর করতে পারে না।
কিন্তু বেলা বাড়লে রাস্তাঘাটে বাইরের অচেনা মানুষগুলো দুদিকে সরে যেতে থাকে। তখন ডানচোখে দেখে রাজু চলে গেল বাইক চালিয়ে। আর ঠিক সেই একই সময় বাঁ চোখ দিয়ে শান্তু দেখছে কেষ্টদা মুদির দোকানের ঝাঁপ খুলছে। রাস্তার দুই প্রান্তে দুদিকে দুটো লোক—একইসঙ্গে। আর তাকে কষ্ট করে ঘাড় ঘোরাতে হচ্ছে না ডানদিক বাঁদিক। এভাবেই অফিস। বাসের ভিড়। কন্ডাকটরের কাছে টিকিট কাটা।
ক’দিনের মধ্যে আত্মীয়-পরিজন বন্ধু-বান্ধব জেনে যায় অনেকেই। অ্যাক্সিডেন্টের পর আসলে ওর মাথাটা বিগড়েছে। চোট লেগেছিল হয়ত। বোঝা যায়নি।
গত সপ্তাহে তিনজন ডাক্তার দেখিয়েছে। আসলে তিনজন। শান্তু’র কাছে ছ’জন। প্রতিটি চেম্বারে দু’জন বসে আছেন। দু’জনের একই প্রশ্ন। শান্তুর একই উত্তর। ঠাণ্ডা ঘরে প্রথমজন স্মিত হাসেন। চোখের ডাক্তার। শান্তু দেখে দু’জন। একজনের নাকটা টিয়াপাখির মত বাঁকা। যেন সবসময় সতর্ক। গন্ধ শুঁকছেন কিছুর। সন্দেহজনক। শান্তু বুঝতে পারে। স্বাভাবিক নাকের ডাক্তারবাবুর চোখের দিকে তাকিয়েই ওকে কথা বলতে হবে।
চোখের দৃষ্টিতে সমস্যা নেই কোনও। কাছে-দূরে সব স্বাভাবিক। তা’হলে ও দুটো দেখছে কেন? ডাক্তার সস্নেহে জবাব দেন, অনেক সময় বাই-অকিউলার ভিশানের একটা সমস্যা হতে পারে। মাথায় চোট লাগলে হয় ওরকম। আবার অনেক সময় নিজে থেকে ঠিক হয়ে যায়।
কিন্তু ওর তো কোনো চোট লাগেনি।
দ্বিতীয় ডাক্তার ব্রেন স্ক্যান করালেন। এম আর আই। সব ঠিকঠাক। কোথাও কোনো গোলমাল নেই।
দ্বিতীয়জনের কানদুটো সামান্য ছুঁচলো। কথা বলার সময় খাড়া, টানটান। মাঝে মাঝে নড়ে। শান্তু তাঁর সামনে বেশিক্ষণ বসে না।
নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারবাবু অনেক প্রশ্ন করেন। শান্তু দেখে, দু’জন মানুষ একসংগে প্রশ্ন করছেন তাঁকে। সস্নেহ প্রভু যীশুর মতো চোখ-মুখ। জ্যোতি বেরোচ্ছে কি? মাথার পিছনে? ভাল করে দেখতে গিয়ে থতমত খেয়ে যায়। ও কী খুঁজতে এসেছে? ডাক্তারের অন্য চেহারা না নিজের সমস্যার সমাধান?
সমস্ত প্রশ্ন থেকে শেষ পর্যন্ত উত্তর একটাই। ভুল হচ্ছে শান্তুর নিজের। ভুল দেখছে সে। হ্যালুসিনেশান। কল্পনা। কিন্তু শান্তু নিজে জানে, কোথাও কোনো ভুল নেই। ও দুজন দেখতে পাচ্ছে। সামান্য আলাদা তারা। একজনকে ও চেনে-জানে অথবা সে স্বাভাবিক মানুষেরই মতো। কিন্তু অন্যজন ডিফারেন্ট। আলাদা। সামান্য হলেও আলাদা। আর সেই আলাদা বৈশিষ্ট্যটুকুই বড্ড চোখে লেগে থাকছে। চোখ বন্ধ করলেও গেঁথে বসছে মাথার মধ্যে।
রিমি রাতে খেতে বসে জিগ্যেস করে, হ্যা গো, তুমি কি এখনো আমায় দুটোই দেখছ?
শান্তুর ভারি মায়া হয়। মিথ্যে করে বলে,— না না, এই তো এখন আবার সব ঠিকই লাগছে।
রিমি খুশি হয়ে ওঠে। যাক বাবা। একদম ঠিক হয়ে যাবে দেখো। ডাক্তাররাও সকলে বলছেন তো। মনের ভুল তোমার। অতবড়ো একটা ফাঁড়া কাটল। কাল সকালে বটতলার কালীবাড়িতে একটা পুজো দিয়ে আসব ভাবছি।
রিমির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে শান্তু। ভারি ভাল লাগে। ওর পাশে আর একটা রিমি। তার চোখদুটো দিঘির জলের মতো শান্ত। জোড়াভুরুর ওপর যে কোনো মুহূর্তে যেন এসে বসবে একটা উজ্জ্বল নীল মাছরাঙা। কী অসম্ভব প্রশান্তি। রিমির মধ্যে এত ধৈর্য, এত গভীরতা আগে তেমন করে খেয়ালই করেনি শান্তু।
অফিসে কারো দিকে এই ক’দিন আর ভাল করে তাকাচ্ছে না। অস্বস্তি হয়। পাশে একটা এক্সট্রা লোক। ফাউ। তার দিকেই চোখ চলে যায় বারবার। কোথায় যেন কি একটা আলাদা কিছু দেখে ফেলছে সে। দেখতে চাইছে না। তবুও। কোনো শারীরিক অসংগতি। কোনো অসুবিধেজনক অনুভূতি। অ্যাকাউন্টস সেকশনের জয়রামবাবুর দাঁতদুটো—একেবারে ড্রাকুলার মতো ঝুলে নেমে এসেছে যেন। অফিসের দরোয়ান, মাড়ি হাঁ হয়ে আছে। ফুটো ফুটো জালের মতো। সেখান থেকেই খৈনির গন্ধ। হেডক্লার্ক অসীমের ঘাড়টা লতপত করছে মাথার ওপর। বড়সাহেব দীপেনবাবুর মাথার চুলের ফাঁকে বাঁকানো শিঙের আভাস। কেয়াদি’র কপালের বড় টিপ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে কালকেউটের ফনা। সুবোধদা’র চোখদুটো এমন মরা মাছের মতো নিষ্প্রভ, নিষ্প্রাণ হয়ে গেল কবে থেকে?
কেন এরা এরকম? কেন? আর যদি হয়ও বা, শান্তুর মতো একজন ছাপোষা, মধ্যবিত্ত, নিঃসন্তান, সাতে-পাঁচে না থাকা অতি সাধারণ মানুষ একাই কেন দেখতে পাচ্ছে তাদের? নিজের কাছ থেকে রোজ পালাতে চায় শান্তু। কেউ সামনে এসে দাঁড়ালে চোখ বন্ধ করে মাথা ধরার ভান করে। কোনোরকমে বাজারটুকু সেরে ঘরে আসে। অফিস যাবার পথে বাসে বসে ঘুমোনোর চেষ্টা। যতক্ষণ পারে চোখ বন্ধ করে রেখে এই ডবল রোলের চক্কর থেকে পালাতে চায় সে।
শুধু অনেক রাতে, রিমি যখন ঘুমিয়ে পড়ে, শান্তু পা টিপে টিপে বাথরুমে যায়। শোবার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দিনে তিনবেলা নিজেকেই দেখতে পায় সে। অসংগতিহীন। স্পষ্ট। স্বাভাবিক। কিন্তু রাত বাড়লে, ঘরে আলো না জ্বালিয়ে, বাথরুমের মধ্যে বেসিনের ওপরে লাগানো ছোট্ট দেওয়াল আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। ওর নিজের মুখের পিছনে ঝাপসা হয়ে ফুটে উঠছে আর একটা মুখ। খুব ধীরে। তার কচি গাল। হালকা গোঁফের রেখা। কপালের ওপর কোঁকড়ানো চুল। উদাসীন দৃষ্টি আয়না ভেদ করে চলে যায় কোন গ্রহান্তরে।
মাধ্যমিক পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ডে এই ছবিটাকেই বরাবর দেখেছে সে।