Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,sir-john-woodruff-the-famous-tantrik-who-once-was-chief-justice-of-calcutta-high-court

Sir John Woodruff: ইংরেজ বিচারপতির তন্ত্র সাধনা

Reading Time: 3 minutes

কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি। কিন্তু তাঁর নাম বাংলা তথা ইওরোপের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে সম্পূর্ণ অন্য কারণে। জন্মসূত্রে ইংরেজ এই আইনজ্ঞ ছিলেন এক তন্ত্রসাধক। ভারতীয় তন্ত্র সাধনা ও দর্শনকে ইউরোপের সঙ্গে পরিচয় করানোর কাজটি তিনিই করেছিলেন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। তিনি স্যর জন উড্রফ।

জন জর্জ উড্রফের জন্ম কলকাতা শহরে ১৮৬৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর। বাবা জেমস টিসডাল উড্রফ ছিলেন কলকাতা হাই কোর্টের এক জন সফল ব্যারিস্টার। ১৮৯৯ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত তিনি বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন। মা ফ্লোরেন্স হিউম ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট জেমস হিউমের কন্যা। জেমস হিউম আবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমের ভাই।

১৮৭৮ সালে জন উড্রফ ও তাঁর ভাই ফ্রান্সিসকে ইংল্যান্ডের সারেতে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁরা উবার্ন পার্ক নামের এক ক্যাথলিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৮৮ সালে জন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। পরের বছর তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বাবার সঙ্গে আইন ব্যবসায় যোগ দেন। অচিরেই তিনি ভারতীয় আইনে তাঁর দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন।

১৮৯৭-এ জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁকে ‘টেগোর ল প্রফেসর’ হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯০২ সালে ভারত সরকারের স্ট্যান্ডিং কাউন্সেল হিসবে তিনি নিযুক্ত হন। ওই বছরই এলেন এলিজাবেথ গ্রিমসন নামের এক পিয়ানো বাদিকাকে বিয়ে করেন জন। এলেন ছিলেন ভারতীয় দর্শনের অনুরাগী। সেই সঙ্গে তিনি থিওসফির চর্চাও করতেন।

১৯০৪ সালে জন কলকাতা হাই কোর্টে যোগ দেন। হাই কোর্টের সংস্কৃত ভাষার বিশেষজ্ঞ হরিদেব শাস্ত্রী তাঁর সঙ্গে তাঁর গুরু শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের পরিচয় করান। শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব ছিলেন সেই সময়কার নামজাদা তান্ত্রিক। তন্ত্রশাস্ত্রের আকর গ্রন্থ ‘তন্ত্রতত্ত্ব’-এর রচয়িতা।

উড্রফ ১৯০৬ সালে বারাণসী যান। সেখানে শিবচন্দ্রের আশ্রমে গিয়ে ওঠেন। শিবচন্দ্র উড্রফের মধ্যে তন্ত্র সাধনার উপযুক্ত লক্ষণগুলি দেখতে পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। তিনি উড্রফকে তন্ত্র মতে দীক্ষিত করেন। কিন্তু উড্রফ তখনও নিঃসংশয় হতে পারেননি। শিবচন্দ্রই তাঁর প্রকৃত গুরু কি না, তা নিয়ে তিনি দোলাচলে ভুগতে থাকেন।

শিবচন্দ্র উড্রফকে বলেন, তিনি প্রকৃত গুরুর সন্ধান করে দেখতে পারেন। উড্রফ হরিদেব শাস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে হৃষিকেশ, হরিদ্বার, গুপ্তকাশী এবং দার্জিলিং ভ্রমণ করেন। বিভিন্ন মার্গের যোগী এবং বৌদ্ধতান্ত্রিক সাধকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা প্রত্যকেই জানান, শিবচন্দ্রই তাঁর প্রকৃত গুরু। উড্রফের যাবতীয় সংশয় দূর হয়।

উড্রফ সস্ত্রীক তন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করেন। পরে জয়কালী দেবী নামের এক ভৈরবীর কাছে তিনি তন্ত্রের উচ্চতর সাধনা অভ্যাস করেছিলেন বলে জানা যায়। উড্রফের বন্ধু সে যুগের বিখ্যাত আইনজ্ঞ সৈয়দ আমির আলি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, আদালতের কাজ শেষ হলে উড্রফ বাড়ির ছাদে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করতেন।

এই সময়েই ভারতীয় চিত্রকলার নবজাগরণ শুরু হয়। উড্রফের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় ঘটে। ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর ওরিয়েন্টাল আর্ট প্রতিষ্ঠার পিছনে উড্রফের যথেষ্ট অবদান ছিল।

১৯১৩ সালে উড্রফ ‘আর্থার অ্যাভালন’ ছদ্মনামে তন্ত্রগ্রন্থ অনুবাদ শুরু করেন। এই কাজে তিনি তাঁর বন্ধু অটলবিহারী ঘোষের অকুণ্ঠ সহযোগিতা লাভ করেন। অনেকে মনে করেন ‘আর্থার অ্যাভালন’ উড্রফ ও অটলবিহারীর যৌথ ছদ্মনাম। যাই হোক, উড্রফের এই বিশেষ ছদ্মনামটি গ্রহণের পিছনে কিছু রহস্য রয়েছে।

ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি রাজা আর্থার সংক্রান্ত বিভিন্ন গাথাকাব্যে অ্যাভালনের উল্লেখ রয়েছে এক জাদু দ্বীপ হিসেবে। প্রসঙ্গত, রাজা আর্থারকে ‘কিপার অব দ্য গ্রেল’ বলা হয়। জিশু তাঁর শেষ নৈশভোজে যে পানপাত্র ব্যবহার করেছিলেন, সেটিই ‘হোলি গ্রেল’ নামে পরিচিত। কিংবদন্তি অনুসারে এই পানপাত্র ‘অমরত্ব’-এর সন্ধান দিতে পারে। এই সব কিছুই অবশ্য প্রতীকী। (সঙ্গের ছবিটি ১৯২০ সালে বার্ন জোনস অঙ্কিত ‘লাস্ট স্লিপ অফ আর্থার ইন অ্যাভালন’)।

তন্ত্র অধ্যয়ন করতে গিয়ে উড্রফ বুঝতে পারেন, এই শাস্ত্র ও আচারের মধ্যেও দিব্যজীবন লাভের সন্ধান রয়েছে। ইওরোপে সেই সময় আর্থার সংক্রান্ত গাথাগুলির অর্থোদ্ধার এবং হোলি গ্রেল নিয়ে চর্চা তুঙ্গে। উড্রফ তাঁদের সামনে রহস্যবাদী দর্শনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর এই ছদ্মনাম অবশ্যই কাজে আসে। ইওরোপীয় সমাজ ভারতীয় তন্ত্রের প্রতি ব্যাপক ভাবে আকৃষ্ট হয়।

আদালতের কাজের পাশাপাশি উড্রফ তন্ত্র তথা শাক্ত ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা করতে শুরু করেন। তন্ত্র যে কোনও উদ্ভট বুজরুকি নয়, তা এক সমৃদ্ধ দর্শন— এ কথা তিনি প্রচার করতে শুরু করেন। আর্থার অ্যাভালন নামেই তিনি তন্ত্র বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে শুরু করেন।

তন্ত্রের বিভিন্ন আকরগ্রন্থ অনুবাদ করতে শুরু করেন উড্রফ। গুরু শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের লেখা ‘তন্ত্রতত্ত্ব’ তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কুণ্ডলিনী তন্ত্র সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘দ্য সার্পেন্ট পাওয়ার’ পাশ্চাত্যের বিদ্বজ্জন মহলে রীতিমতো সাড়া ফেলে।

১৯১৫ সালে জন উড্রফ নাইট উপাধি লাভ করেন এবং সেই বছরই তিনি কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে উন্নীত হন।

তন্ত্রের অনেক গ্রন্থেরই অনুবাদ করেছেন উড্রফ। লিখেছেন বেশ কিছু তন্ত্রগ্রন্থের অনুবাদের ভূমিকা। তবে তাঁর সব থেকে উল্লেখযোগ্য কাজ হল ‘মহানির্বাণতন্ত্র’ অনুবাদ। ১৯১৮ সালে তিনি স্বনামে প্রকাশ করেন ‘শক্তি অ্যান্ড শাক্ত’ নামে একটি গ্রন্থ।

১৯২২ সালে উড্রফ হাই কোর্টের কাজ থেকে অবসর নেন। ইংল্যান্ডে ফিরে যান এবং সেখানে বেশ কিছু তন্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ করেন।

১৯২৩ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত সময়ে উড্রফ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় আইন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩০-এ কাজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি ফ্রান্সে চলে যান।

জীবনের শেষ ক’টা বছর উড্রফ নিরলস ছিলেন তন্ত্র সংক্রান্ত গবেষণা, অনুবাদ ও তন্ত্রগ্রন্থের সম্পাদনায়। ১৯৩৬ সালের ১২ জানুয়ারি তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু তান্ত্রিক অটলবিহারী ঘোষ (পাশের ছবিটি তাঁরই) মারা যান। এর চার দিন পরেই ১৬ জানুয়ারি ফ্রান্সের মন্টে কার্লোর কাছে বিউসলিউ নামের এক শহরে উড্রফ প্রয়াত হন।

আজও জন উড্রফের অনুবাদে ভারতীয় তন্ত্রগ্রন্থগুলি সারা বিশ্বেই আদৃত। বহু তন্ত্রগ্রন্থের ভূমিকা হিসেবে লিখিত তাঁর রচনা ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে পশ্চিমী মূল্যায়নের ইতিবাচক দিকটিরই সাক্ষ্য দেয়। আর্থার অ্যাভালন নামের আড়াল অনেক দিনই আর নেই। কিন্তু জন উড্রফ অমর হয়ে রয়েছেন তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞা নিয়ে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>