সই

Reading Time: 3 minutes
জানালার গরাদ ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে ইন্দুলেখা। গ্যাসের আলো আর চাঁদের আলোয় শহরের    রাস্তা আজ বড়ো উজ্জ্বল।বেলফুলওয়ালা চলেছে, হাঁক
দিয়ে –“বেলফুল চাই “। বকুলের  বড়ো পছন্দের ছিল  এই বেলফুলের মালা। মনটা ছটফট  করছে ইন্দুর।
বকুলের জন্য বড়ো চিন্তা হচ্ছে। বিকেলে সুরো নাপতানি বলেছিল যে-শরীরটা খুব ভালো নেই বকুলের।একছুটে  চলে যেতে ইচ্ছে করছে  বকুলের কাছে।
—ইন্দু !
চমকে  উঠে  ইন্দুলেখা দেখে সমরেন্দ্র থমথমে মুখে  বলছেন, চলো ।
—কোথায়?
 কোনো কথা না  বলে    সমরেন্দ্র  ইন্দুর হাত ধরে   ছাদের  কোনে সেই দরজার সামনে  এলো। আলতো টোকা  দিতেই ওপাশ থেকে  দরজা  খোলার  শব্দ। দরজা  খুলতেই দেখে,  জ্যাঠাইমা আর  ন’ভাসুর ঠাকুর। ইন্দু ঘোমটাটা আরো  টেনে  নিয়ে  তিনজনকে অনুসরণ করে  নীচে  নামতে  থাকে। ঘরের  সামনের বড়ো বারান্দাতে  সমরেন্দ্র  আর ন’ভাসুর ঠাকুর  থেমে যান।
    জ্যাঠাইমা তাকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢোকেন। বিছানাতে  যে শুয়ে আছে প্রদীপের আলোতে  তাকে  দেখে ইন্দুর চোখে  জল  এলো।বিছানার সাথে  মিশে যাওয়া একটা  কঙ্কালসার  দেহের বুকের   ওঠানামাটুকুই জীবনের  প্রমাণ দিচ্ছে শুধু। জ্যাঠাইমা সামনে গিয়ে  বারকয়েক তাকে ডাকতেই চোখ  মেলে বকুল। বার দুয়েক চেয়ে  আবার  চোখ  বন্ধ করে  ফেলে। তারপর , প্রদীপের  কাঁপা  আলোতে তাকে দেখে বকুল। চিনতে পেরে  অশক্ত  হাত তুলে  স্পর্শ করতে  চাইলো তাকে।জলভরা চোখে  বকুলের  আঙুল  ছোঁয়  সে।দুজোড়া ঠোঁটে আজ  কোনো শব্দ  নেই, শুধু  দুজোড়া চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। শব্দেরা আজ স্পর্শ আর চোখের          জল হয়ে  ঝরে পড়ে।
  কয়েক মুহূর্ত পরে হঠাৎই মুদে আসে বকুলের চোখ,  বারকয়েক  কেঁপে  নিস্পন্দ হলো  বকুল।
ডুকরে  উঠলো জ্যাঠশাশুড়িমা। নাহ্,  ইন্দুর চোখে জল নামলো না।ফ্যালফ্যাল চোখে  তাকিয়ে  আছে  নিস্পন্দ বকুলের দিকে, বুকের  ভেতর  কেমন একটা  কষ্ট হচ্ছে তার।তার চোখের সামনে,কতো কাছে আজ তার বকুল  শুয়ে আছে,অথচ তাকে ছেড়ে  কতোদূরে চলে গেল  সে। বুকের চাপা কষ্টটা নিয়ে  দ্রুত  ঘর ছাড়ে সে।
   ছাদে  দাঁড়িয়ে আছে ইন্দু। খিড়কির  এই পথটা  দিয়ে  একটু  এগোলেই  মা গঙ্গার পাড়ে শ্মশান যাবার   রাস্তাটা।তাদের এই ছাদ থেকেই   দেখা যাচ্ছে শ্মশানে চলছে বকুলের  শেষকৃত্য।
     চন্দন কাঠের চিতাতে সাজানো সতীলক্ষ্মী বকুলের  দেহের  ভস্মীভূত  ছাইয়েরা  যেন তার আর বকুলের  স্মৃতিকথার ছবি আঁকছিল   ইন্দুর চোখে।
১৯৫০ সালে  গ্রামের মেয়ে এগারো বছরের  ইন্দুলেখা  পালকি করে  কলকাতা শহরের এই শ্বশুরবাড়িতে   এলো।এখানে বিত্ত আর প্রাচুর্যে  সরল-সাধাসিধা ইন্দুর চোখে  তাক লেগে গেল। হকচকিত ইন্দুর  দিকে তখন  বন্ধুত্বের  হাত বাড়ালো তার জ্যাঠতুতো ভাসুরের বউ বিধুবালা। প্রায় তার সমবয়সী সে। বকুল ফুল সাক্ষী রেখে  সই হলো তারা দুজনে।
     তারপর —  বড়ো ভালো  সময় কাটতো তাদের। আচার – বড়ি পাহারা দিতে, নাপতিনীর কাছে আলতা পরে খোপা বাঁধতে, বারমহলে   যাত্রা -কবিগান  শুনতে চিকের ফাঁকে,  দূর্গা-মণ্ডপে  পুজোর  যোগাড়ে, সর্বত্র   দুই সই একসাথেই  থাকতো। মনে পড়ছে পালকি করে গঙ্গাস্নানে  ঠানদিদির সাথে  যাওয়ার কথা। প্রথমদিন বড়ো ভয়ে ভয়ে  ছিল সে। গ্রামের মেয়ে  পুকুরে  দাপিয়ে  সাঁতার কেটেছে। পালকিশুদ্ধ  ডুবানো হবে শুনে তার কী ভয়!  সেদিন  তার হাতে  হাত রেখে  সারাটা পধ গেছিলো বকুল। অভয়ের  স্পর্শ অনুভব করেছিল  ইন সেই হাতে। সেই হাতে হাত রেখে সুখের  সময় কাটিয়েছিল তারা। কিন্তু  সুখ চিরস্থায়ী  নয়, একটা দীর্ঘশ্বাস  বুক ঠেলে বেরিয়ে এল, ইন্দুর । যেদিন বন্ধুত্বের আকাশে ঝড়  উঠলো। পারিবারিক  ব্যাবসা নিয়ে  খুড়শ্বশুর আর জ্যাঠশ্বশুরে তুমুল  বিবাদ  বিবাদের জেরে সম্পত্তি নিয়ে  কোর্ট-কাছারি হলো। ফলস্বরূপ  পাঁচিল উঠলো বাড়িতে। একটা বাড়ি  দুই বাড়িতে  পরিণত  হলো।উঠোনে  পাঁচিল  তুলে  দুভাগে ভাগ হলো।আর বড়ছাদ আর ছোটছাদে যাওয়ার পথে পাঁচিল তুলে,  দরজা বন্ধ  করা হল দুদিকেই।
 দেখাশোনা– কথা- সব কিছুর মাঝেই পাঁচিলের নিষেধাজ্ঞা । দুই সখীর
একে অপরের  কাছে  যাওয়ার  আকূল  প্রচেষ্টা বিফল হতো ।শুধু জানালার   খড়খড়িতে চোখ  রেখে পরষ্পরকে দেখার  ব্যর্থ  প্রচেষ্টা চলতো।দরজার  দুইদিকে দুটো  মন গুমরে  মরতে থাকলো যাদের সাক্ষী রইল  তাদের অসহায়
স্বামীরা। পিতার বিরুদ্ধাচরণ করতে পারলোনা কেউই । দুই সখীর মধ্যে  একমাত্র  যোগাযোগের  মাধ্যম সুরভী  নাপতানি । সে বিকেলে  দুই বাড়িতে মেয়েমহলে আনাগোনার মাঝে দুই  সখীর  খবর দেওয়া নেওয়া  করতো।এমনি  একদিন সে  বিকেলে খুশির খবর আনলো, ইন্দুর  কাছে।তার বকুল  আসন্ন-প্রসবা।  খুশিতে  ইন্দু  তাকে একজোড়া  দুল উপহার  দিল।
    গতদুদিন আগে  একটি ফুটফুটে  মেয়ের জন্ম দিয়েছে  বকুল,  কিন্তু  সূতিকারোগে আক্রান্ত  হয়ে  আজ …
 আকাশে উড়ে  আসা  ধোঁয়াতে আজ তার বকুল  তাকে স্পর্শ করে যাচ্ছে  বারবার।আর সাক্ষী থাকছে ডুবে  যাওয়া  ক্ষয়াটে চাঁদ, আর ঐ একই জ্বলজ্বলে  তারা।
.

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>