যে কোনো সভ্যতা তখনই পরিপূর্ণতা পায় যখন তা এক নদীর স্পর্শ পায়। আর আমাদের কারোরই অজানা নয় নদীমাতৃক সভ্যতার কথা, কলকাতাও বলতে গেলে একটি নদী কেন্দ্রীক নগর সভ্যতা। বাণিজ্যের কারণেই এই শহর কলিকাতা ও গঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বহুঘাট। যার অবশিষ্ট কিছু আজ স্থানীয় মানুষের অবহেলার সাথে লড়াই করে কোনোভাবে বেঁচে আছে, আর কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে অনেক বহু ঘাট। যাদের নাম ও ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এই শহর কলকাতার জীবনস্রোতের সাথে। অষ্টাদশ শতকের কলকাতায় একদিকে যেমন শহর গড়ে উঠেছিল, পথ-ঘাট, রাস্তা তৈরি হচ্ছিল তেমনই ভাগীরথীর তীরে ঘাট সমূহ নির্মিত হয়েছিল। এই সকল ঘাট হয় সরকারি ব্যয়ে অথবা কোনো বিত্তশালী ব্যক্তির অর্থানুকূল্যে তৈরি হয়েছিল। সরকারি ব্যয়ে বোধহয় মাত্র দুটি ঘাট নির্মিত হয়েছিল, একটি কেল্লার ঘাট (যা থেকে কয়লাঘাট ষ্ট্রীট নামের উৎপত্তি হয়েছে) আর অন্যটা হচ্ছে বাগবাজারের পুরানো বারুদখানার ঘাট। উচ্চ ও নিম্ন সকল শ্রেনীর মানুষ এই ঘাট ব্যবহার করত। মেয়েরা সেযুগে ছিল কট্টর অসূর্যম্পশ্যা (যে স্ত্রীলোক সূর্যের মুখ পর্যন্ত দেখে না) যে জন্য সাধারণ ঘরের মেয়েরা গঙ্গাস্নান সেরে সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘরে ফিরত। আর অভিজাত সম্প্রদায়ের মেয়েরা পালকি করে গঙ্গা স্নানে আসত, পালকি বাহকরা অরহিনী সমেত পালকিকে জলে ডুবিয়ে দিতেন, আরহিনী পালকির ভিতরে থেকেই স্নান ও পোষাক পরিবর্তন করতেন।
গঙ্গার তীরে গড়ে উঠেছে কলকাতা, অথচ আমরা, এই তিলোত্তমা কে ভুলতে বসেছি, ভুলতে বসেছি এই পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীকে। কংক্রিটের এই শহরে দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় আজ গঙ্গার কোনো স্থান নেই, তার কথা মনে পরে শুধু প্রতিমা বিসর্জনে, শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে, পিণ্ডদান বা তর্পণে অথবা ভূপেন হাজারীকার গানে “গঙ্গা আমার মা…” ইত্যাদিতে। যদিও এমন হবার কথা নয়, ঠিক যেমন লন্ডনের মূলস্রোতে মিশে আছে টেমস, প্যারিসের জীবন যাত্রায় বেঁচে আছে স্যেন নদী, মিশরের সাথে নীলনদ। ঠিক তেমনই কলকাতার জীবন যাত্রায় গঙ্গাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে এখন ।
এই সেজে ওঠার অন্যতম আকর্ষণ গঙ্গা বক্ষে নৌকা ভ্রমণ। শনি ও রবিবার ছুটির দিন বেশ ভালোই রোজগার করেন এই পেশায় নিযুক্ত মানুষরা। সারাদিন নৌকা চালিয়ে এদের সংসার চলে, এক ঘন্টা গঙ্গার বুকে নৌকায় ঘোরার জন্য আপনাকে দিতে হবে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, অনেকে খুশী হয়ে ৫০-১০০ টাকা বেশীও দেয়। একদিন সপ্তগ্রাম ছিল ব্যবসা কেন্দ্র, নদীপথ মজে যাওয়ায়, এবং অনুকূল পরিবেশের কারণে সপ্তগ্রাম থেকে ব্যবসাকেন্দ্র সরে এসে বাগবাজারে শুরু হয়। এই বাগবাজারেই সুতো ও নুটির ব্যবসা হওয়ায় স্থানটি নাকি নাম পেয়েছিল সুতানুটি।
তবে সব ঘাট ব্যবসার জন্য তৈরী হয়নি, বিভিন্ন কারনে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তা তৈরী হয়েছিল, তৎকালীন ধনী লোকেরা স্নানার্থীদের সুবিধার জন্য বহু ঘাট তৈরী করে দিয়েছিলেন। এইরকম ঘাটের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিছু ঘাটে পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে ব্যবহার করতেন, আবার কিছু ঘাট কেবলই পুরুষ দের জন্য, যেমন নিমতলায় রাধামাধব বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাট। আবার কতকগুলো ঘাট ছিল কেবলই মহিলাদের জন্য, যেমন গিরীশচন্দ্র বসুর ঘাট। আর কিছু ঘাট বড় বড় ব্যবসায়ীরা তাদের মালপত্র ওঠানামা করানোর জন্য ব্যবহার করেন। ব্যবসার কারনে তৈরী হওয়া ঘাট গুলিতে শুধু দেশীয় বণিকরা নয়, সাহেব ব্যবসা দারেরাও ব্যবহার করত, পরে তারা পয়সা খরচ করে নিজেদের ব্যবসার জন্য ঘাট তৈরী করেছিলেন। যে সকল ছোটো ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত ঘাট ছিল না, তাদের জন্য ছিল অন্যত্র কিছু আলাদা ঘাট। এই সকল ঘাট ঠিকা নিত মাঝিরা, এদের বলা হত ঘাট মাঝি। এরা ব্যবসাদার দের সকল প্রকার সহায়তা করতেন, এরকম অবস্থায় বহু ঘাটমাঝিও প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বিত্তশালী হয়ে উঠেছিল, খিদিরপুরে এক ঘাট মাঝির নামে রাস্তা রয়েছে – ‘ নাজির মহম্মদ ঘাটমাঝি লেন’ বর্তমানে শুধু ঘাটমাঝি লেন।
এক সময় প্রিন্সেপ ঘাটের চত্বর ও ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা, সাপ, জোঁক, শেয়াল, বাদুড়ের রাজত্ব কায়েম ছিল। তবে এখন আর তা নেই। প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাবুঘাট অবধি এখন রঙ্গিন আলোতে সাজানো সন্ধ্যা। সন্ধে নেমে এলেই জ্বলে ওঠে সব রঙ্গিন আলো। আর রয়েছে রং বে রং এর ফুল ও গাছ। সবথেকে বড় কথা কলকাতায় ভিড়, জ্যাম, উৎসবের মাঝখানেই প্রিন্সেপ ঘাট একদম ব্যতিক্রমী, বিকেল হলেই ভিড় জমে যুবক-যুবতীদের। প্রিন্সেপ ঘাটে স্নানের জন্য একটা আলাদা বাঁধানো ঘাট করা হয়েছে। সেই ঘাটের আবার আলাদা নাম আছে, জাজেস ঘাট। মাঝিমল্লা স্থানীয় বিক্রেতারা যেমন এখানে স্নান করেন, তেমনই পার্বণে পুণ্যার্থীরাও এখানে স্নান করতে আসেন। এখানে সেখানে পোষাক পরিবর্তন না করে, পোষাক পরিবর্তনের জন্য আলাদা জায়গা সিড়ি লাগোয়া একটি ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমস্ত পরিবর্তন হয়েছে গঙ্গাতীরের অতীত ঐতিহ্য কে মাথায় রেখে, যার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুড়িওলা বড় বড় বট ও অশ্বত্থ গাছগুলো। তা ছাড়া গোয়ালিয়র মনুমেন্টের কথা বলতেই হয়, নতুন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে এই স্মৃতি সৌধটিকে। যা নির্মাণ হয়েছে ভারত স্বাধীনের একশো বছর আগে (১৮৪৭ সালে ) ইসলামিক ও ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর মেলবন্ধনে তৈরী হয়েছিল এটি।
তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সে প্রিন্সেপ ঘাট হোক বা বাগবাজার ঘাট, গঙ্গার ঘাট আজ অতীত থেকে অনেক আলাদা। যদিও প্রিন্সেপ ঘাটের মত সেজে ওঠেনি বাগবাজার ঘাট। গঙ্গার ধারে আরও যে সব অগুনিত ঘাট আছে আগামী দিনে তারাও নতুন কলেবরে সেজে উঠবে, হয়ে উঠবে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেল বন্ধনে নতুন এক শহর গড়ে উঠবে কংক্রিটের এই জঙ্গলের মাঝে। তখন তিলোত্তমার চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গঙ্গার ঘাটগুলি আমরা পাব আমাদের কাঙ্খিত চেহারায়, কুমারটুলি ঘাট, নিমতলা ঘাট, রুস্তমজি ঘাট বা মিল্ক ঘাট সেজে উঠতে চলেছে নতুন আঙ্গিকে। এদের এবং এদের পাশপাশি আরও কিছু ঘাট আছে যাদের শুধু নামটাই বেঁচে আছে হারিয়ে গেছে ঐতিহ্য, হারিয়ে গেছে ইতিহাস।
ওল্ড পাওডারমিল ঘাট
পুরানো বারুদ কারখানার ঘাট, ইংরেজদের কলকাতা বাসের অদিপর্বে এখানে একটি মস্তবড় বাগান ছিল, নাম পেরিন সাহেবের বাগান। পেরিন সাহেব ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন তাঁরও ও কিছু জাহাজ ছিল। এই বাগানে ইংরেজ সাহেবরা এলেও ১৭৪৬ নাগাত তা বন্ধ হয়ে যায়, কেন তা জানা যায়নি। পরবর্তীকালে বাগানটি পরিত্যক্ত হয়ে ১৭৫২ সালের ১১ই ডিসেম্বর নিলামে ওঠে, কলকাতার জমিদার হলওয়েল সাহেব ২৫০০ টাকায় বাগানটি কেনেন।
ওল্ড পাওডার মিল রোডের নামই পরে বাগবাজার স্ট্রিট হয়। বাগানকে ফার্সিতে “বাগ” বলে, আবার পেরিন সাহেবের বাগানকে বলা হত পেরিনের বাগ, এই পেরিনের বাগ থেকেই বাগবাজার নামের উৎপত্তি বলে আমার মনে হয়।
রূস্তমজীর ঘাট
রূস্তমজী ছিলেন পার্সি, এনার পুরোনাম রূস্তমজী কাওয়াসজি বানাজি। এনার জন্ম মুম্বাইতে, ব্যবসার জন্য তিনি কলিকাতা আসেন, তিনি এখানে স্থাপন করেছিলেন একটা জাহাজের সাম্রাজ্য। তিনি চীন দেশের সাথে অফিমের ব্যবসা করতেন, খিদিরপুর ডক টিও তিনি কিনে নেন। কাশিপুরের দিকে রূস্তমজীর একটি বাষ্পীয় জাহাজ তৈরির কারখানাও ছিল, পরে সেই ঘাটটি রুস্তমজীর ঘাট বলে মনে করা হয়। এছাড়াও তিনিই প্রথম ভারতীয় যাকে ১৮৭৪ সালে কলকাতার শেরিফ পদ দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
বাবুঘাট
জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্র মার ১৮৩০ এই ঘাটটি তৈরি করে দেন, লোকে এই ঘাটকে নির্মাতার নাম বাদ দিয়ে শুধু বাবুঘাট বলে।
অন্নপূর্ণা ঘাট
১৮৫২ – ১৮৫৬ সালের কলকাতার ম্যাপে প্রথম অন্নপূর্ণা ঘাটের নাম পাওয়া যায়, চিৎপুর থেকে বাগবাজারের মধ্যে অবস্থিত এই ঘাট। রাধারমন মিত্রের মতে, রঘুমিত্রের ঘাটের নাম হয় পরবর্তীকালে অন্নপূর্ণা ঘাট। বাগবাজারের বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী, হেস্টিংসের আমলে কলকাতার আমিন নিযুক্ত হয়, হেস্টিংস বিলেতে যাওয়ার সময় তাঁকে ৫২ বিঘা জমি দান করেন, আর তিনিই ১৭৭৩ সালে মতান্তরে ১৭৭৬ সালে তিনি ঐ জমিতে অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, মন্দির থেকে কিছু দূরে ঘাট থাকায় ঘাটটির নাম হয় অন্নপূর্ণা মন্দির। আবার সুকুমার সেন মনে করেন একসময় এই ঘাট চাল (অন্ন) আমদানি রপ্তানির কেন্দ্র থাকার জন্য এমন নাম পেয়েছে।
কুমোরটুলি ঘাট
কুমোরটুলি নামেই বোঝা যায় কুমোরদের পাড়া, টোলা বা টুলি শব্দের অর্থ কোনো জীবিকা বা কাজের জন্য অস্থায়ী, অ-পোক্ত আবাস, অর্থাৎ ঝুপড়ি, কুঁড়ে ঘর । কলকাতার যে সব অঞ্চলে একটু নিম্নস্তরের জীবিকা অবলম্বন কারীদের অস্থায়ী আস্তানা বা কুঁড়েঘর সারিসারি থাকত সেই অঞ্চলের নাম হত “টুলি” দিয়ে, টোলা হল অস্থায়ী বড় ঘর, আর টুলি হল অস্থায়ী ছোটো ঘর। এই কুমোরটুলি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ১৮ শতকের মাঝামাঝি তৈরী হয়েছিল, আর এই কুমোরটুলির সামনে অবস্থিত ঘাটটি তার নাম পায় কুমোরটুলি ঘাট।
নিমতলা ঘাট
এখন যেখানে আনন্দময়ী কালীর মন্দির আছে আগে নিমতলা শ্মশান ঘাট সেখানেই ছিল। তখন মন্দির তৈরী হয়নি। এই শ্মশান তৈরী হয় ১৮২৮ সালে, ১৭-০৩-১৮২৮ থেকে এখানে শবদাহ আরম্ভ হয়, বাবু রাজচন্দ্র মার এখানে একটি ঘর করে দেন, মূলত যাদের মৃত্যু হয়নি, তবে মৃত্যু আসন্ন, তাদের গঙ্গার ঘাটে এনে রাখা হত, জোয়ার এলে তাদের খাট সহ জলে রাখা হত, এমনই চলতে থাকে যত দিন না তাদের মৃত্যু হয়। গঙ্গাপ্রাপ্তি যাত্রী দের জন্য এই ঘাট নির্মাণ করেন বাবু রাজচন্দ্র মার।
তথ্যসূত্র
কলির শহর কলকাতা- হরিপদ ভৌমিক
কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত – বিনয় ঘোষ
কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা – মহেন্দ্রনাথ দত্ত
কলিকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র
শ্রীপান্থের কলকাতা – শ্রীপান্থ
● WIKIPEDIA
●https://web.archive.org/web/20120423164312/http://kolkata.clickindia.com/tourism/ghats.html