পুজা পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। তবুও কোথায় যেন আজো তার রেশ লেগে আছে। জার্মানি থেকে সেখানকার পুজা নিয়ে ইরাবতীর পাঠকদের জন্য লিখেছেন সৌম্যজিৎ দত্ত।
শরৎ কালটা জার্মানিতে একটু অন্যরকম। ঠিক যেমনটা আমরা আমাদের ওখানে দেখি মানে কখনো মন ভালো করা আকাশ আবার কখনো হঠাৎ বৃষ্টি , শিউলি ফুলের গন্ধ ঠিক তেমনি নয়। আমার দিদা বলতেন “শরৎ রানী পান খেয়েছে। এই হাসে সে এই কাঁদে” । কেনো পান খেতে গিয়ে কাঁদলো সেটা আর জিজ্ঞেস করে ওঠা হয় নি।
এই সময়টা এখানে পাতা ঝরা শুরু হবার সময় তাই গাছে গাছে রঙ পাল্টানোর প্রস্তুতি চলে যেন। সাথে দোসর প্যাচপ্যাচে বৃষ্টি। সেজন্য সকালে উঠে প্রথম কাজ হলো পুজোর দিনগুলোর weather forecast দ্যাখা। কপাল গুনে যদি বৃষ্টি না থাকে তাহলে তো পোয়া বারো। তবে হ্যাঁ এর মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যায় কাশ ফুল যেটা দেখলে মোটামুটি পুজোর ফিলিংস এসেই যায়। জার্মানিতে পুজো মোটামুটি দিনক্ষণ মেনেই হয়। আমেরিকার মত উইকএন্ড ফাঁকিবাজি নয় এটা বলে ওখানকার বন্ধুদের খোঁচাতে ছাড়ি না তাই। এর আগে জার্মানিতে অন্যান্য বেশ কিছু পুজো দেখেছিলাম আর এবার যেহেতু ব্রেমেন এ আছি তাই এখানকার পুজো মিস করার কোনো মানেই হয় না। হামবুর্গের থেকে প্রায় ১০০ কিমি দূরে ছোট্ট রাজ্য ব্রেমেন। এর পরিচিতি মূলতঃ সৌন্দর্য্য, সংগীত প্রেম আর জাহাজ বানানোর কারখানার জন্য।
নির্দ্বিধায় বলতে পারি অন্যান্য শহরের পুজোর থেকে যেটা একটু আলাদা মনে হল সেটা হল আন্তরিকতা। ৩৯ বছরের পুরনো এই পুজোটা বাঙালিয়ানার গন্ডি ছাড়িয়ে মোটামুটি ভারতীয় উৎসবের চেহারা নিয়েছে। আর তার ক্রেডিট যায় অবশ্যই এখানকার সমস্ত প্রবাসী ভারতীয়দের । বাঙালি, পাঞ্জাবী, বিহারী, কন্নর, তামিল কে নেই এতে।
গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত এই পুজোর পুরোহিত একজন তামিল ব্রাহ্মণ যাঁর নাম ড. সুন্দর রাজন। নিয়ম নিষ্ঠায় অনেক বাঙালি পুরোহিত কে উনি মোটামুটি যাকে বলে দাঁড় করিয়ে গোল দেবেন দেখলাম । এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রীমতী চিত্রা বাচার এবং ওনার স্বামী শ্রী জগবন্ধু বাচার যারা মোটামুটি ব্রেমেনের ভারতীয় diasporar সবার সার্বজনীন কাকু কাকিমা। বকলমে এই পুজো এখন কমিটি করে চালানো হলেও আদতে এটা এখানকার ভারতীয় দের বাড়ির পুজো। তাই এনারা কোনো স্পন্সরশিপ ছাড়াই নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী এই পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন শুরু থেকেই। চতুর্থী তে ঠাকুর নিয়ে আসা থেকে দশমীতে আবার পরের বছরের জন্য গুছিয়ে রাখা অব্দি এঁদের কারুরই দম ফেলার সময় নেই। ১৯৮০ সালে প্রথম পুজোর সময় থেকেই শ্রী প্রদীপ পাল , শ্রী মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক এবং শ্রী সংগ্রাম শান্তি দত্ত এই পুজোর সাথে একাত্ম হয়ে আছেন । তাই যত্নটা ঠিক বাড়ির মেয়ের বাড়ি আসার থেকে কোনো অংশে কম করেন না ওনারা। ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী ৪ দিন ধরে গড়ে প্রায় ২০০ জনের ২ বেলার প্রসাদের ব্যবস্থা করেন এনারা যার পুরোটাই রান্না করেন সমস্ত পরিবারের মহিলারা মিলে । এমনিতে ভাষাগত কারণে জার্মানরা একটু ইতস্তত বোধ করেন অন্য দেশের লোকের সাথে মিশতে কিন্তু যখন দেখলাম হাত দিয়ে মেখে ভাত ডাল তরকারি খাচ্ছে জার্মান বাচ্চারা বা পরিপাটি করে বেনারসি শাড়ি পড়ে অঞ্জলী দিচ্ছেন Mrs. Angelika,Mrs. Barbell তখন সত্যিই অবাক হচ্ছিলাম ।
দুর্গাপূজার সর্বজনীন সত্তার কোনো খামতি হতে দেননি এখানকার আয়োজকরা। ষষ্ঠী,সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী প্রতিদিন সন্ধেবেলা থাকে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যা মূলত এখানকার বাসিন্দারাই করে থাকেন। অষ্টমীর দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হামবুর্গের ভারতীয় দূতাবাসের কনস্যুলার জেনারেল শ্রী মদনলাল রাইগড় এবং ওনার স্ত্রী। অনুষ্ঠানের শেষে প্রত্যেক কলাকুশলীদের সাথে এক এক করে কথা বলে উৎসাহ দিতে দেখলাম ওনাদের। মনে হচ্ছিল প্রোটোকলের বাইরে বেরোতে পেরে যেনো ওনারাও খুশি। অফিসের চক্করে দশমীর ভোর বেলায় মিউনিখ রওনা হতে হওয়ায় পুজোকে এবার আগেই বিদায় দিতে হলো কিন্তু মনে মনে বলে এলাম “আসছে বছর আবার হবে।”
সাথে থাকলো এই ৪ দিনের পুরো অনুষ্ঠানের কিছু কিছু মুহুর্ত