আনুমানিক পঠনকাল: 12 মিনিট
প্রচন্ড একটা রাগ, দুঃখ আর অভিমান মিলেমিশে যেন একটা ভীষণ চিৎকার হয়ে আমার গলা দিয়ে বের হলো, ‘আপনি কি কখনই আমাকে একটু আমার মত থাকতে দেবেন না? কি চান আপনি? আমি আবার একটা বিয়ে করে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে আপনার ভালো লাগবে? তাহলে তাই করবো!’- দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে বাইরে বের হয়ে এলাম।
মাঝে মাঝে মনে হয় আর পারবো না। লড়াই করার সব শক্তি আমার শেষ হয়ে গেছে।পরতে পরতে শুধু মানিয়ে চলা নিজের এই অদ্ভুত জীবন নিয়ে মাঝে মাঝে আমার দিশেহারা লাগে। হিমেল আমাকে এ কোন জীবনের মধ্যে রেখে চলে গেল সেটা ভেবে আমার চোখ এখনো, আজ এত বছর পরেও মাঝে মাঝে ঝাপসা হয়ে আসে।
বাইরে এসে ড্রাইভারকে গাড়ী বের করতে বললাম। কোথায় যাবো জানি না কিন্তু এই মহিলার সামনে থেকে অন্তত এই বেলার জন্য হলেও বের হয়ে যেতে হবে আমাকে, এক্ষুণি!
ড্রাইভার গাড়ি সামনে নিয়ে আসতেই গাড়িতে উঠে ওকে বললাম ‘উত্তরার দিকে যাও।’ মায়ের বাসাতেই যাবো ভাবলাম, সন্ধ্যার মধ্যে আবার ফিরতেই হবে আজকে। শুভ আর শ্রুতি সন্ধ্যার মধ্যেই ওদের ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরবে, তখনই ফিরবো নাহয়। ওরা ছাড়াতো আমার এই পাগলা গারদে ফেরার আর কোন কারণ নেই। তাছাড়া কালকে আমার পাঁচ দিনের আর্ট ক্যাম্প শুরু হবে, গোছগাছও বাকী রয়ে গেল অনেক। ভেবেছিলাম সারাদিন ধরে আমার প্রয়োজনীয় সব কাজ সেরে ফেলবো। তা আর হলো কই!
বাসা থেকে বের হতে না হতেই জ্যাম। এই শহরেও আমার আর থাকতে ইচ্ছা করে না। কত কিছুই যে আর ইচ্ছা করে না তবুও ঠেলে ঠুলে সব করে যেতেই হচ্ছে। নিজের জীবন আর রাস্তার ঠেলাঠেলি সব যেন একাকার হয়ে গেছে। কোন কিছুই মসৃণ না। জীবনটা কি শুধু এই অন্তহীন ঠেলাঠেলি? জানি না।
গাড়ীটা কিছুদূর এসে বিজয় স্মরণীর এ্যারোপ্লেনটার কাছে এসে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। থাক দাঁড়িয়ে! আমার আর কোন তাড়া নেই আজ। চোখ বুজে সিটে হেলান দিলাম। আমার কান, মাথা এখনও ঝাঁ ঝাঁ করছে। হিমেল যদি এত তাড়াতাড়ি চলে না যেত জীবনটা এত কঠিন হয়ে যেতো না আমার, এই মনে হওয়া থেকে এখনও বের হতে পারি না আমি।
গুণে গুণে একদম একুশ বছর আগে হিমেলে’র সাথে শুরু করা জীবনটা মাত্র ১০ বছরের মাথাতেই ফুটো বেলুনের মত চুপসে গিয়েছিল। টগবগে তরুণ ছেলেটার অসুস্থতা আমাদের জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিল। অথচ তার বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যাবসাগুলো পার্টনারদের সাথে মিলে তার হাতে আরো ফুলে ফেপে উঠছিল।
বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই ওর অসুস্থতা বুঝতে পারি আমি। তার মধ্যেও খুব ব্যস্ত থাকতো ব্যবসা নিয়ে। অসুস্থতা আর ডাক্তারের চেম্বার আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল একদম। এরমধ্যেই একে একে শুভ আর শ্রুতি এলো কোল জুড়ে। নিজের পড়াশুনা চালিয়ে, বাচ্চাদের দেখভাল করে, আর প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়া হিমেলের দেখাশোনা করতে করতে কিভাবে জীবনের ঐ সময়গুলো কেটেছে ভাবলে এখন আমি অবাক হই।
এতসব কিছুর মধ্যেও হিমেল যখন একটু সুস্থ থাকতো সময় পেলেই আমরা নানা জায়গায় ঘুরতে চলে যেতাম। নিজে ঘুরতে খুব একটা পছন্দ না করলেও আমার আগ্রহে কখনই আপত্তি করতো না হিমেল। মাঝে মাঝে শরীর খারাপের সময়টুকু ছাড়া সুখেরই ছিল সে দিনগুলো। ছন্দ পতনটা মাঝে মাঝে শুধু হতো হিমেলে’র মায়ের আমাদের নানা বিষয়ে অতিরিক্ত খবরদারিতে। হিমেল সেগুলো খুব অপছন্দ করলেও আমি বরং সেগুলো সামাল দিয়ে চলতাম যেন সংসারের শান্তি বজায় থাকে।
চারুকলার পড়াশুনাটা শেষ করার বেশ আগেই বিয়েটা হয়ে গিয়েছিলো আমার। এত বড় ব্যবসায়ী পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব, ছেলেও ভালো, মা-বাবা আপত্তি করার কোন কারণ খুঁজে পায়নি। কিন্তু ঝামেলাটা বাধঁলো যখন বিয়ের পরেও লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে চাইলাম। পারিবারিকভাবে সব জেনেশুনেই বিয়ে হলো অথচ চারুকলা’য় পড়ি সেটা চলাফেরায়, পোশাক-আসাক এ খুবই আধুনিকা আমার শ্বাশুড়ির ভালোই লাগে না। হিমেলের সম্মতি থাকাতে সে কোন সুবিধাও করে উঠতে পারেনি। তবুও তখন আমাদের সম্পর্ক ভালোই ছিল। হিমেল ব্যবসার কারণে বেশী ব্যস্ত থাকতো বলে শ্বাশুড়ী মা বরং তার যাবতীয় কাজ, সামাজিকতা সবকিছুই আমাকে সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে করতো। আমি খুশী মনেই তাকে সঙ্গ দিতাম। আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, বন্ধুদের সান্নিধ্য বাদ দিয়ে আমি আমার স্বামী’র মাকে খুশী করতেই পার করেছি আমার তরুণী জীবন।
মাঝে মাঝেই আমার ক্লাস দুপুর দুটোর মধ্যে শেষ হওয়ার সাথে সাথেই দেখতাম গাড়ী নিয়ে সে হাজির। আমি ভাবতাম আমার প্রতি খুব কেয়ারিং কিন্তু এখন বুঝতে পারি আসলে তার চাওয়া ছিল, আমি যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি, বাইরের সংস্পর্শে কম থাকি আর তার যত ফরমায়েশ সব হাসিমুখে পালন করে যাই।
দিনে দিনে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আগের সুরটা একদম কেটে গেল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে স্বপন দা’র দোকানে বসে চা-সিঙাড়া খাওয়া আর বন্ধুদের সাথে বকুলতলায়, চারুকলা’র পুকুরে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প, সবকিছুই একটা একটা করে জীবন থেকে খসে পড়ে গেল। ক্লাসের পরেও নানা ধরণের মজার কাজের মধ্যে আমার বন্ধুরা যখন ডুবে থাকে আমি তখন শ্বাশুড়ির সাথে বাসায় ফিরে সংসারের নানা কাজে তাকে সঙ্গ দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বাচ্চাদের দেখভালের পাশাপাশি শখের বশে ছবি আঁকি আর সন্ধ্যা হলেই হিমেলের জন্য অপেক্ষা করে থাকি কখন ফিরবে বাসায়।
একদিন সন্ধ্যায় খুব বেশী জ্বর আর মাথাব্যথা নিয়ে বাসায় ফিরেছিল হিমেল। ব্যবসা সামলানোর পাশাপাশি দেশে বিদেশে সব ধরণের চিকিৎসা তাে চলছিলই। আমার দেবর শিশির এর লিভারের অংশ হিমেলের শরীরে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হলো। দেশে, বিদেশে কত ডাক্তার, কত কি! কিন্তু কিছুতেই আর কিছু হলো না। একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছিল লিভার সিরোসিস।
মাত্র দশ বছরের সংসার আমার! মনে হয়েছিল জীবনটা একদম শেষ হয়ে গিয়েছে। ছোট দুটো বাচ্চা। একা কিভাবে কি করবো ভেবে শুধু কাঁদতাম তখন। এতদিন টাকা পয়সার কোন সমস্যা ছিল না কিন্তু হিমেল চলে যাওয়ার পর মুহূর্তেই যেন আমার শ্বাশুড়ীর কাছে আমি সুয়োরাণী থেকে দুয়োরাণীতে পরিণত হলাম।
‘ম্যাডাম, জ্যাম এ অনেকক্ষণ বইসা আছি, সামনের কি অবস্থা অহনও বুঝতাছি না, সামনে পাম্প আছে, তেল নিয়া লই?’ আলী’র কথায় সম্মতি দিয়ে গাড়ীর জানালাতেই চোখ লাগিয়ে বসে থাকি বটে কিন্তু মন যেন আজকে আমার কোথায় কোথায় ভেসে বেড়াচ্ছে। বাইরে তাকিয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু সারি সারি গাড়ী আর অসংখ্য মোটরসাইকেল দেখা যাচ্ছে। যে কোন কারণেই হোক জ্যামটা আজ অস্বাভাবিক।
রাস্তার এক পাশে তিনটা ছোট ছেলে গলাগলি করে হাসছে। লিকলিকে শরীরের একজন কারো ফেলে দেয়া একটা ডাব কুড়িয়ে নিয়ে ভেতরে কিছু আছে কিনা হাত ঢুকিয়ে উকিঁঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, অন্য বাচ্চা দুটোও তাকিয়ে আছে সেদিকে, কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখছে। তবুও ওদের মুখের হাসিটা বন্ধ হচ্ছে না। আমার ইচ্ছা হলো নেমে গিয়ে ওদেরকে পেট ভরে ডাব খাইয়ে আসি কিন্তু এই জ্যাম পার হয়ে রাস্তার ওপাশে যাওয়াটা বাস্তব সম্মত মনে হলো না। জীবনটাই তো এমন! মনের মধ্যে ইচ্ছা হয়ে পাখা মেলে কত কিছুই, আর তার কত অল্পই না বাস্তবে রুপ নেয়!
সংসারে হিমেলের মায়ের সর্বময় কতৃত্ব নিয়ে আমার কোন অসন্তোষ ছিল না বরং সাংসারিক কোন ঝামেলা দেখতে হয় না বলে খুশিই ছিলাম। পারিবারিক ব্যবসার পার্টনাররা টাকা পয়সা আগের নিয়মেই দিয়ে যেতে লাগলো। আমার দেবর আস্তে আস্তে সেসব বুঝে নিতে লাগলো।
প্রথম ধাক্কা খেলাম যখন মারা যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই শ্বাশুড়ী হিমেলে’র ভাগের সম্পত্তির ‘পাওয়ার অফ আটর্ণি’ দিয়ে দিলো আমার দেবরকে। হিমেল বেঁচে থাকতে শ্বাশুড়ীর ছায়ায় ছায়ায় থাকা আমি পুরোপুরি স্থানচ্যুত হলাম। শুণ্যস্থান পূরণ হলো দেবরের বউকে দিয়ে। এ যেন এক খেলা!
আগের মতই দুহাত ভরে শ্বাশুড়ী সব খরচ করতে লাগলো শুধু আমার হাতে আর কোন টাকা আসে না। বাচ্চাদের সব খরচ প্রয়োজনের চেয়ে বেশীই দিতো শুধু আমার বেলায় সব শুকিয়ে গেল। অথচ হিমেলে’র চিকিৎসার জন্য ব্যাগ ভরে ভরে টাকা দিয়েছে আমার হাতে। আমার কাছে থাকা অবশিষ্ঠ কয়েক লাখ টাকা সব ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তাকে। ভেবেছিলাম সে তো আমার হাত খরচের টাকা আমাকে দেবেই। কিন্তু ছেলের অনুপস্থিতিতে ছেলের বউ এর যে কোন অস্তিত্বই আর থাকে না সেটা বুঝতে একটুও সময় লাগেনি আমার। এমন অবস্থায় পড়তে পারি তা কখনই ভাবিনি। প্রয়োজনের আগেই হিমেল সব হাজির করেছে আমার সামনে আর সে মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরীর কথা ভাবতে হলো!
‘কেন তুমি চাকরী করবা? তোমার কিসের অভাব সব কিছুই তো ভালোমতো চলছে।’ তার হিসাবে সব ভালোই চলছিল। আমার স্যানিটারী প্যাডও সে নিজের হাতে কিনে আনে। একটার জায়গায় দুইটা লাগলে বলে, ‘এত লাগে কেন?’- এমনই ভালো চলছিল।
তাই আর কোন কিছুই আমাকে একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র লেকচারার হিসাবে যোগ দেয়া থেকে টলাতে পারলো না। পরিচিত এক সূত্র ধরে অনেক দৌড়াদৌড়ি করে চাকরীটা আমি পেয়ে গিয়েছিলাম।
হিমেল চলে যাওয়ার কয়েক মাসের মাথাতেই শুরু হয়েছিলো আমার এক অন্যরকম জীবন। এ এক অদ্ভুত, একই সাথে প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় সম্পর্কের এক জীবন আমাদের। মনে নিয়ে নয়, কষ্ট করে মেনে নেয়া এক সম্পর্ক। ভালোবাসা, মমতা নেই এই সম্পর্কে। আছে শুধু হিসাব নিকাশ, পারস্পরিক প্রয়োজন। তাকে আমার দরকার কারণ আমার দুটো সন্তান আছে। পারিবারিক সম্পত্তির এক বড় অংশের ভাগীদার আমি ও সন্তানেরা। আমাকে তার প্রয়োজন না হলেও নাতিদেরকে তার প্রয়োজন। তাদেরকে সে তার অস্তিত্বের অংশ মনে করে।
একটা এ্যাম্বুলেন্স তারস্বরে হর্ণ বাজাতে বাজাতে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল জ্যাম ঠেলে ঠেলে। এতক্ষণে কাকলি’র মোড়ে এসেছি। জ্যামের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবি, এই জ্যাম কত অগুণতি মানুষের কত অগুণতি দুর্ভোগের জন্য যে দায়ী তার কোন ইয়ত্তা নেই। চাকরীতে ঢোকার প্রথম থেকেই গাড়ী পাওয়ার সুবিধা একদম তুলে নিলো আমার শ্বাশুড়ী। নানা ছুঁতোয় গাড়ী ব্যস্ত রাখতো যেন কোনভাবেই বাসার গাড়ী আমি না পাই। কতদিন বাসায় ফিরে দেখেছি ড্রাইভার পায়ের উপর পা তুলে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে অথচ আমাকে বলা হয়েছে গাড়ী ডিউটিতে আছে। তখনও পর্যন্ত ‘উবার’ আর ‘পাঠাও’ না আসা এই শহরে, সারাদিন একটার পর একটা ক্লাস, মিটিং শেষ করে ক্লান্ত আমি সিএনজি বা রিক্সা খুঁজতে খুঁজতে মাইলের পর মাইল জ্যাম পার হয়ে, ঘন্টাখানেক ধরে রাস্তায় কাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছি।
এই শহরের জ্যাম আর চরম নিকৃষ্ট গণপরিবহন ব্যবস্থা আমার মত আরো বহু মানুষের প্রাণশক্তি খুব তাড়াতাড়ি অর্ধেকে নামিয়ে আনে তা অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই। নুন্যতম কোন ভদ্রস্থ গাড়ি ঘোড়া না থাকা এখানে নিজের একটা বাহন থাকা তাই রীতিমত মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে বলেই আমার মনে হয়। হাতে একটু টাকা পয়সা আসার পর একটুও দেরী না করে তাই প্রথমেই একটা ব্যাংক লোন নিয়ে এই ছোট প্রুশিয়ান ব্লু রং এর টয়োটা ভিটজ গাড়িটা কিনে ফেলেছিলাম।
অসহনীয় জ্যামটা এখন আর ততটা খারাপ লাগছে না বরং এই যে অনেকদিন বাদে নিজের মনের অলিতে গলিতে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াচ্ছি সেটা বরং বেশ উপভোগই করতে শুরু করেছি এখন। গাড়ীর ভিতরে মৃদু শব্দে আমজাদ আলী খান সরোদ বাজাচ্ছেন। আলী জানে গাড়ীতে বসে কখন আমি কি শুনতে পছন্দ করি। কোন ফাঁকে জানি সিডিটা ছেড়েছে। আমি এত মগ্ন হয়ে নানান কথা ভাবছি যে খেয়ালই করিনি।
সকালের চড়া রোদটা মিলিয়ে গিয়ে কেমন একটা মেঘলা মেঘলা চেহারা নিয়েছে, তাতে বরং চোখের একটা আরামও হচ্ছে। ভাবছি মায়ের ওখানে যেয়েই বা কি করবো! ‘কি হলো আবার তোদের! ধৈর্য্য ধর, সবকিছু একসময় ঠিক হয়ে যাবে।’ এইসব শুনতে শুনতে বরং আমার আবারো মেজাজ বিগড়াবে। মা জানে সমস্যা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখান থেকে খুব একটা কিছু আর করার নেই, তবুও মা এগুলো বলে, এই পচে যাওয়া সমাজে মায়েদের এমন বলতে হয় বৈকি!
তবে মাঝে মাঝে আমি অবাক হয়ে ভাবি এমনকি আমার বাবা-মাও কেন আমাকে কখনো আবার বিয়ে করার কথা একবারও বললো না? হিমেল যখন চলে গেল আমার বয়স মাত্র ত্রিশ। কি মনে করেছে আমাকে এরা? দুটো বাচ্চা আছে বলেই আমার জীবনটা হিমেলে’র সাথে সাথে শেষ হয়ে গেল? ত্রিশ বছরের এই আমি একজন মৃত মানুষ আর তার সম্পত্তির হিসাব করেই জীবনটা কাটিয়ে দেবো? জীবিত হিমেলকে আমি ভালোবেসে সুখী হতে চেয়েছিলাম কিন্তু একজন জীবিত রক্তমাংসের মানুষ কি একজন মৃত মানুষের স্মৃতি আঁকড়ে এভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে? হিমেল মারা যাওয়ার পর অনেক বছরের মধ্যে আবার বিয়ে করার কথা আমারও মনে আসেনি কিন্তু এখন আমার মনে হয়, ভাবা উচিত ছিল, খুব উচিৎ ছিল।
ইদানিং আমার সহ্যশক্তিটাও একদম কমে গেছে মনে হয়। কয়েকদিন আগেও এমন একটা ঘটনা ঘটলো যে সেটা মনে হলে এখনও ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠে। সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে দেখি আমার অয়েল পেইন্টিং গুলো সব ছাদের ঘরে তুলে রেখেছে আমার শ্বাশুড়ী। মাথায় যেন আগুন ধরে গেল আমার। জিজ্ঞাসা করতেই, ‘আমার বাপু তেল এর গন্ধ বিশ্রী লাগে, তুমি বরং ছাদের ঘরে গিয়েই এসব কাজ করো।’ একমুহূর্তও দেরী না করে লোকজন ডেকে সব পেইন্টিং নামিয়ে তক্ষুণি মায়ের বাসার দিকে রওনা দিয়েছি।
বছর খানেক আগেই বাবা মারা যাওয়ার পরে ভাইবোনদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগের ফলাফল হিসাবে তিনটা ফ্ল্যাট পেয়ে গেলাম আমি। যেখান থেকে একটা ভালো অংকের ভাড়া পাই। একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া না দিয়ে ফাঁকাই রেখেছিলাম যেন সেখানে আস্তে আস্তে আমার একটা স্টুডিও করতে পারি। এই ঘটনার ফলে সেই কাজটাই তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। আমাকে শায়েস্তা করতে গিয়ে বরং একটু উপকারই করে ফেললো সে। ঐদিনই আমার ইজেল, ক্যানভাস, রং তুলি, ছবি আঁকার নানারকম সরঞ্জামসহ সবকিছুই আমি এখানে নিয়ে এসে স্টুডিওটা গুছিয়ে ফেললাম। এখনতো প্রায়ই দুনিয়া ভুলে নিজের কাজ নিয়ে স্টুডিওটাতে পড়ে থাকি, কেউ বিরক্ত করে না। মা অন্তত সে আরামটা আমাকে দেয়। সম্ভব হলে এখানে একেবারেই চলে আসতাম, ছেলেমেয়েদের কারণেই সেটা করতে পারছি না।
আগামী কাল থেকে শুরু হতে যাওয়া আর্ট ক্যাম্প এর আগে বিশ্রামটা আজ আমার খুব দরকার ছিল। একটানা নিজের মত ছবি আঁকতে আঁকতে কয়েকদিনের জন্য আর্ট ক্যাম্পে যাওয়াটা একটা দারুণ আউটিং হয়ে ওঠে সবার জন্যেই। নানা রকম শেয়ারিং এর পাশাপাশি অগ্রজ শিল্পীদেরকে খুব কাছে থেকে আঁকতে দেখা বা সেটা থেকে নিজের শেখার একটা অনন্য অভিজ্ঞতা ঘটে। যে জায়গাগুলোতে আমরা ক্যাম্প করি সেটাও আমার অন্যতম আকর্ষণের বিষয়, প্রকৃতি আর মানুষ সেখানে যেন কয়েকদিনের জন্য মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। প্রতিবার ক্যাম্প শেষে মনে হয় সংসারের সব ক্লেদ ঝেড়ে ফেলে যেন এক শুদ্ধ মানুষ হয়ে ফিরেছি। মুখিয়ে থাকি সবাই আবার কবে আরেকটা ক্যাম্প শুরু হবে সেদিকে।
এবার বেশ কিছুদিন পরেই আবার একটা ক্যাম্প শুরু হতে যাচ্ছে। শিল্পী মনিরুল ইসলাম এবার ক্যাম্পে আমাদের সাথে থাকছেন, সেজন্য আমি আরো বিশেষভাবে উত্তেজিত। ‘এবারের আর্টক্যাম্প কিন্তু মিস করো না, রেবেকা। অনেক নতুন নতুন কাজের প্ল্যান আছে।’ চারুকলা’য় কয়েকদিন আগেই স্যার এর সাথে দেখা হওয়াতে বলেছিলেন।
তার মতো এত বিখ্যাত একজন শিল্পীকে কাছ থেকে মগ্ন হয়ে ছবি আঁকতে দেখবো সেটা ভাবতেই আমার উত্তেজনার পারদ উঠে যাচ্ছে। আজ সকালে এই খুশীই হয়তো আমার সবকিছুতে ফুটে বেরুচ্ছিল যা শ্বাশুড়ীর চোখ এড়ায়নি। অভ্যাসমত তাকে যাওয়ার কথা বলতে গিয়েই গোলটা বাধলো। আমি বাড়ির বাইরে থাকবো শুনলেই তার মাথা খারাপ হয়ে যায়।
‘কেন তোমার বাইরে যেয়ে ছবি আঁকার কি দরকার? ওখানে আর কে কে থাকবে? তোমার সাথে কে থাকবে?’ তার একটার পর একটা প্রশ্নে নাজেহাল হয়ে যাই আমি।অকথ্য সব কথা চলতেই থাকে, ‘আমার বাড়িতে থেকে এত ফুটানি কোথা থেকে আসে তোমার? তোমার এইসব হাবিজাবি আঁকা ছবি ধুয়ে পানি খাবো আমরা?’
আজ আর সহ্য হয়নি আমার। কেন তাকে এত উত্তর দিতে হবে আমাকে? আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। একটা প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এতকাল পড়িয়েছি। সেখানে কত মানুষের সাথে আমাকে চলাফেরা করতে হয়! আমি তো চাইলে কত কিছুই করতে পারতাম। তাতে তাদের তথাকথিত সন্মান একটুও বাড়তো না, এটা বোঝার ক্ষমতাই তার নেই।
নিজের ছবি আঁকার পেছনে আরো সময় দেয়ার চিন্তা থেকেই মূলত চাকরী ছাড়ার কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম। ইউনিভার্সিটির দশ বছরের চাকরিটা আমি সত্যিই উপভোগ করেছি। জীবনের কঠিন এক সময়ে এই কাজটার মধ্যেই আমি সব ধরণের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু ইদানিং চাকরীটাও আমাকে অনেক ক্লান্ত করে ফেলছিল আসলে। এত সময় বেঁধে জীবন কাটাতে মন আর সাই দিচ্ছিল না। এত রুটিন কাজ আর উপভোগ করতে পারছিলাম না। সকাল থেকে সন্ধ্যা সারাটা দিন নানা কাজের চাপ…বাসায় এসেই পরের দিনের ক্লাসের প্রস্তুতি, ডিপার্টমেন্ট পলিটিক্স এসবের মধ্যে যেন হাসফাস লাগছিল আমার।
‘অনেক হয়েছে, এবার থামো রেবেকা’ নিজেকে বলা শুরু করেছিলাম আমি। চাকরি ছেড়ে ছবি আঁকার পেছনেই আরো বেশী সময় দেয়ার সিদ্ধান্তটা তাই নিয়েই নিলাম। যখন চাকরীতে ঢুকেছিলাম তখনও আশেপাশে একটা না, না রব ছিল। ‘কেন করবা, বাচ্চারা ছোট। তোমাদের তো টাকার অভাব নেই!’ কত কথা! আর যখন ছাড়তে চাইলাম তখনও অনেকেই সেই না, না রব তুলেছে। আমার বন্ধুরা, কলিগরা; ডিপার্টমেন্ট হেড তো রাগে কিছুদিন কথাই বললেন না। কিন্তু শুধু আমি একাই জানি আমার জীবনের জন্য কি প্রয়োজন। নিজের মনের কথা শোনাটাই সঠিক বলে মনে হয়েছে আমার।
তবে আরো একটা ব্যাপারও আমার মনের মধ্যে কিছুদিন ধরেই দানা পাকিয়ে উঠছিলো আর সেটা হলো বাচ্চাদের সাথে আমার যথেষ্ট কোয়ালিটি সময় কাটানোর প্রয়োজনীয়তা। শুভ’র বয়স ষোলো প্রায়।শ্রুতিও চৌদ্দ ছুঁই ছুঁই। একেবারেই উঠতি বয়স। আমার যতটা সান্নিধ্য ওদের প্রয়োজন সেটা ব্যস্ততার কারণে আমি দিতে পারি না। আমি থাকতেও দাদির কাছেই মূলত ওরা বড় হয়েছে। কিন্তু এরমধ্যে ঘটে যাওয়া বেশকিছু ঘটনায় আমি একটু চিন্তিত। প্রায়ই শুভ গাড়ী নিয়ে ওর বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন রেঁস্তোরাতে যেয়ে খাওয়া দাওয়া করে, বাইরে সময় কাটায়। ওর দাদি যেয়ে পুরো বিল মিটিয়ে দিয়ে আসে, যে ধরণের প্রশ্রয় এই বয়সের বাচ্চাকে দেয়া উচিত না সেটাই সে করে। আমি ব্যাপারগুলো পছন্দ করি না। ওদের দাদির তাতে কোন মাথাব্যথা নেই। সে এভাবেই জীবন কাটাতে অভ্যস্ত।
আবার গতমাসেই শ্রুতি’র জন্মদিনে চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিলো। মূলত আমাদের ভাগের টাকাগুলোই সে আমার ছেলেমেয়েদের পিছনে অপব্যয় করছে আমার হাতে কোন টাকা না দিয়ে।
আমি যে এগুলো পছন্দ করছি না সেই কারণে ছেলেমেয়েরা আবার আমাকেও পছন্দ করছে না। ওদের সাথে আমার দূরত্ব তৈরী হতে শুরু করেছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি যে ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, ওদের বয়সে এটাই স্বাভাবিক। শুধু খাওয়া পরা, ভোগবিলাসের বাইরেও জীবনের নানা দিক সম্পর্কে ওদেরকে বোঝানো বা দেখানোটা মা হিসাবে আমার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই এখন মাঝে মাঝেই ওদেরকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়ে যাই আমি। নানা ধরণের প্রদর্শনিতে নিয়ে যাই, ওরাও উপভোগ করে ব্যাপারগুলো। বলা যায়, এই অল্প সময়ের মধ্যেই আমার উদ্দেশ্যটা অনেকটাই সফল হয়েছে।
চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে একদম ছবি আঁকার মধ্যে ডুবে গেলাম। মনে হলো ‘ফ্রিদা কাহলো’র জীবন তো আমার থেকেও অনেক অনেক কষ্টের। তারপরেও সে যদি এক জীবনে এমন এমন ছবি একে যেতে পারে আমি অন্তত নিজের ভালোলাগার জগতের মধ্যে ডুবে তো থাকতে পারবো। টাকা পয়সার চিন্তা যদি না করতে হয় তাহলে আর কেনইবা এই চাকরবৃত্তি। এর থেকেও অর্থপূর্ণ কিছু করা আমার বাকী রয়ে গেছে যে!
পুরনো কয়েকজন বন্ধুদের সাথে মিলে তিন চারটা গ্রুপ এক্সিবিশন করে এর মধ্যেই ভালো সাড়া পেয়েছি। আমার জীবনটা যেন একটা মুক্ত বাতাসের সংস্পর্শে এসেছে বহুকাল পর। এখন শুধু অপেক্ষা! কবে একটা একক প্রদর্শণী করতে পারবো। শুধু মাঝে মাঝে মনের কোথায় যেন একটা ‘কি যেন নেই’ ধরণের শূণ্যতা তৈরী হয়। ফয়সালের কথা মনে হলো। অনেকদিন ধরে বলছে দেখা করার কথা। আমার সময়ই হচ্ছে না। নাকি আমি সময় বের করতে চাই না ওর জন্যে সেটাও বুঝতে পারি না।
‘আফা, ঐযে বিশ ট্যাকা দেখা যায়, আমাগো দুজনরে দশট্যাকা দশট্যাকা কইরা দ্যান’- চোখ ফিরিয়ে দেখলাম গাড়ীর জানালার বাইরে ১০/১১ বছরেরে বাচ্চা দুইটা মেয়ে। ওদের পাশে আরো একজন চুপ করে দাঁড়িয়ে দুই হাতে দুটো দোলন চাঁপা’র তোড়া ধরে আছে। শ্যামলা মেয়েটার আঙুর রঙা চোখজোড়া ভারী মন কাড়লো। আলী জ্যামটা ছাড়ার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা দেখার জন্য নেমে একটু সামনে গেছে। তাকিয়ে দেখলাম ব্রেক এর পাশে সত্যিই বিশ টাকার একটা খুচরা নোট, আলীই রেখেছে হয়তো। ওরা গাড়ীর গ্লাস এর বাইরে থেকে ভিতরটা পুরো রেকি করে ফেলেছে এইটুকু সময়ের মধ্যে কিংবা কতক্ষণ ধরে দেখছে আমিতো সেটা খেয়ালই করিনি। গ্লাস খুলে টাকাটা দুজনকে দিতেই ওরা দৌড়ে চেলে গেল ।
আলী এসে গাড়ী চালু করে গজগজ করতে করতে বলে, ‘অহনে ছাড়ছে জামটা… আর বেশিক্ষণ লাগবো না।’ আমি তাড়াতাড়ি আঙুর রঙা চোখের মেয়েটার কাছ থেকে ফুলের তোড়া দুটো নিয়ে ওর টাকাটা দিয়ে দিলাম।
দোলন চাঁপা’র গন্ধে গাড়ীর ভেতরটা মৌ মৌ করে উঠলো। হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, আজকের দিনটা আমি শুধু নিজেকেই দিই না কেন? নিজে যা ভালেবাসি তাই করবো আজকে। সবরকমের দায়িত্ব মেনে চলা, মানিয়ে চলা সবকিছুকেই আজকে একদম ছুটি দিয়ে দিই। শুধু আমার কথাই না হয় ভাবি আজকে।
কি মনে হতে ফয়সালকে একটা ফোন দিলাম, আজকে ও আমার কোনো পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আজকে একমাত্র ফয়সালই আমাকে একটু শান্তি দিতে পারে। হঠাৎ ইচ্ছা হলো দিনটা ওর সাথেই কাটাই না কেন! এই ইচ্ছেটাকে চাপতে চাপতে তো প্রায় মেরেই ফেলেছি। কিন্তু কেন নিজেকে এত বঞ্চিত করা! আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে, আকস্মিক এই ইচ্ছা যেন প্রবলবেগে ভিসুভিয়াসের লাভার মত ছিঁড়ে ফুঁড়ে বের হয়ে আসতে লাগলো কোন এক অতল গহ্বর থেকে।
রিং টোন বাজছে… ‘কেন মেঘ আসে হৃদয়ও আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয়না…. মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না… ‘ফোনটা ধরবে জানি। আরো জানি, হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও আমার জন্য ঘন্টা দুই সময় বের করতে ওর কোন সমস্যা হবে না।
চারুকলার জীবনের বন্ধু আমরা। সেই তখন থেকেই আমার প্রতি ভালোলাগা গোপন করেনি কখনও। দুজনের জীবন তারপর চলে গিয়েছিল দু’দিকে। বেশ কয়েক বছর আগে শিল্পাঙ্গনে এক প্রদর্শনীতে আবার দেখা, তারপর থেকেই আবার যোগাযোগ, কিন্তু বন্ধুত্বের বাইরে কিছু ভাবতে চাইনি আমি। ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে অনেক আগেই। আমাদের দুজনের জীবন দুজনের মত করেই কাটছে এখনও। কিন্তু যখন মনে হয় আমার বলার মত অনেক কথা জমে গেছে, একটুও সংকোচ হয় না ওকে ফোন দিতে।
ফোনটা ধরলো।
কথা শেষ করে আলীকে বললাম গাড়ীটা ঘুরিয়ে কারওয়ান বাজারের দিকে যেতে। জ্যামটা এখন একটু কম এই দিকে।
হোটেল লা ভিনচি’র সাত তলায় যেয়ে উইন্ডো সাইডের একটা টেবিলে বসে দুটো ‘মোহিতো’ দিতে বললাম। দোলন চাঁপা’র তোড়াটা রাখলাম ওর জন্যে টেবিলের উপর। খুব মৃদু লয়ে ‘কিটারো’র বাঁশি চলছে। ওর অফিস কাছেই, হাঁটা পথ। একটু পরেই স্লাইডিং গ্লাসটা ঠেলে ঢুকলো। হাল্কা নীল হাফ হাতা শার্ট আর ডেনিম জিনস পরা লম্বা মানুষটা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। বসতে বসতেই দোলন চাঁপা’র তোড়াটা ধরে গন্ধ নিতে নিতে জোড়া ভ্রুটা একটু উঁচিয়ে কৌতুহল নিয়ে তাকালো আমার দিকে,’ ‘কি ব্যাপার এত জরুরী তলব?’
‘হঠাৎ খুব ইচ্ছে হলো!’ ওর চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে বললাম!
ওয়েটার ছেলেটা দুটো ‘মোহিতো’ দুজনের সামনে দিয়ে গেল, সাথে ছোট একটা পোর্সেলিন এর বোল ভর্তি চিনাবাদাম। ‘মনে হলো তোমার সাথে অনেকদিন লম্বা একটা সময় কাটানো হয় না।’ বললাম ওকে।
‘হুমম! আমারওতো অনেকদিন থেকেই এরকম মনে হচ্ছে। আচ্ছা, চলো তাহলে হঠাৎ দেখা হওয়াটা আগে টোস্ট করি,’ বলে হাসতে হাসতে আমার দিকে ওর গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরলো। সারাদিনে এই প্রথম আমারও একটু হেসে ওঠার সুযোগ হলো। হেসে বললাম, ‘চিয়ার্স।’
জন্ম যশোর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক সংস্থায় কাজ করেছেন দীর্ঘদিন, সেই সূত্রে বাংলাদেশের বির্স্তীর্ণ গ্রামীণ ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংস্পর্শে যাওয়ার ও তাদের জীবনকে নানাভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। এক দশকের বেশী সময় ধরে বাংলাদেশ বেতারে সংবাদ পরিবেশনার সাথেও যুক্ত আছেন। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির সাথে জড়িত থাকলেও দীর্ঘ বিরতি দিয়ে বর্তমানে ছোটগল্পের মাধ্যমে আবারও লেখালেখির জগতে বিচরণ করছেন। ভ্রমণ করতে এবং ভ্রমণ নিয়ে লিখতেও ভালোবাসেন। বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত তার ছোটগল্প ও ভ্রমণকাহিনী প্রকাশিত হচ্ছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ, ‘সমুদ্রের কাছে দুঃখ জমা রাখি’।