| 25 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

অনুবাদ ও রূপান্তরের ভূমিকা । আতাউর রহমান

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

বিশ্বসাহিত্যে অনুবাদ ও রূপান্তরের বিরাট ভূমিকা অনস্বীকার্য। সাহিত্য ও কাব্যের ক্ষেত্রে অনুবাদ ও রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। আমাদের এই গ্রহে ভাষা ও উপভাষার পরিসংখ্যান দেওয়া দুরূহ, যেহেতু সংখ্যার দিক থেকে তা অগণিত। মহাকবি হোমার রচিত আদি মহাকাব্য ‘ইলিয়ড’ ও ‘ওডিসি’ প্রাচীন গ্রিক ভাষায় রচিত। আমরা আজকের পাঠকেরা তার এক বর্ণও বুঝতাম না, যদি গ্রন্থগুলো ইংরেজিতে অনূদিত না হতো। এ দুটো মহাকাব্য বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। ‘মহাভারত’, ‘রামায়ণ’-এর মতো দুই মহাকাব্য যদি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত না হতো, আধুনিক যুগের পাঠকরা এ দুই মহাগ্রন্থের কাছে ঘেঁষতেও পারত না। রাজশেখর বসু যে সহজ ও সংক্ষিপ্তভাবে আমাদের কাছে ‘মহাভারত’ গ্রন্থ হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন, তার তুলনা বিরল। বুদ্ধদেব বসুর মতো বাংলা সাহিত্যের বহুপ্রভা লেখকের কল্যাণেই আমরা আজ বোদলেয়ার ও হোল্ডারলিনের কবিতা বাংলা ভাষায় পড়তে পারছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তার ঝড়হম ড়ভভবৎরহমং-এর জন্য, যে গীতিকাব্য সংকলনকে আমরা ঘরে ঘরে জানি ‘গীতাঞ্জলি’ শিরোনামে। বিশ্বব্যাপী এই অনুবাদ ও রূপান্তরের তালিকা প্রস্তুত করা হবে প্রায় এক অসম্ভব এবং অনিঃশেষ প্রয়াস। আমার বলতে বাধা নেই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাছাই করা কয়েকটি বিশ্বজয়ী কবিতা, ইংরেজিভাষী মানুষের কাছে সহজে পৌঁছত না, যদি কেতকী কুশারী ডাইসনের অসাধারণ ইংরেজি ‘আই ওন্ট লেট ইউ গো’র মতো অনুবাদ গ্রন্থ আমরা না পেতাম। হুমায়ূন কবীর সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ সংকলনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য ব্যতিক্রম। কারণ তার বিপুল সাহিত্যসম্ভার পৃথিবীর অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আমরা বাঙালিরা যেহেতু ইংরেজি পড়া, লেখা ও বোঝার মতো জানি, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় মূলত ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে হয়ে থাকে। মওলানা রুমি, কাহ্‌লিল জিবরান ও ওমর খৈয়ামের অনন্য কাব্যপ্রতিভার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই। নিশ্চিতভাবে অনুবাদে মৌলিক ভাষার স্বাদ ও ধার অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো ছাড়া বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমীদের আর কোনো উপায় থাকে না। এভাবে চায়নিজ, জাপানি, রাশিয়ান, জার্মান, স্প্যানিশ, ফরাসি, আরবি, ফারসি, উর্দুসহ বিশ্বের অগণিত ভাষা ও উপভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে। ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষায় রচিত বেশ কিছু সাহিত্য সৃজন ও সমৃদ্ধ এবং সেই সাহিত্যসম্ভারের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় ঘটে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে। দ্বীপপুঞ্জের দেশ ব্রিটানিয়া এক সময় পৃথিবীর অগণিত দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। বলা হতো ‘ব্রিটানিয়া রুলস দ্য ওয়েভ’। সাগরের ঢেউকেও ওই দেশ শাসন করত। আমাদের মতো পৃথিবীর বহু দেশ কোনো না কোনো সময়ে গ্রেট ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল এবং সে দেশের নাগরিকরা ব্রিটিশদের সেবকই ছিল; প্রায় ক্রীতদাসের মতো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের সুবাদে ইংরেজি বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে; কারণ এই ভাষাটি বিশ্বের সব দেশের মানুষই কম-বেশি বোঝে। ইংরেজি ভাষা বর্তমানে ভাবের আদান-প্রদান ও যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্রকৃষ্ট ভাষা হলেও সর্বোত্তম নয়। আমার ব্যক্তিগত ধারণায় পাশ্চাত্যের ভাষাগুলোর মধ্যে ফরাসি, স্প্যানিশ এমনকি জার্মান ভাষাও ইংরেজির তুলনায় সমৃদ্ধ ভাষা। আমাদের বাংলা ভাষা একটি অনন্য ভাষা, যে ভাষায় রচিত হয়েছে কালজয়ী উপন্যাস, গল্প ও কবিতা। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, রবীন্দ্র-পরবর্তী নূ্যনপক্ষে আরও সাতজন বাঙালি কবি-সাহিত্যিকের নাম করা যায়, যারা নির্দি্বধায় সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হতে পারতেন। অনস্বীকার্য যে, ইংরেজি অনুবাদে অথবা ভাষার রূপান্তরে মূলের অন্তর্নিহিত ভাব অনেকটাই হারিয়ে যায়। যাহোক, আমরা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র মতো বহুভাষী পণ্ডিত নই, সুতরাং ভিনদেশীয় সাহিত্য ও কাব্যসৃজনের রসাস্বাদনের জন্য আমাদের ইংরেজি ভাষার ওপরেই নির্ভর করতে হয়।

একটি প্রসঙ্গের অবতারণা এই পরিসরে করা যায় যে; পৃথিবীর সব ভাষাই কালস্রোতে পরিবর্তিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ষোড়শ শতকের শেকস্‌?পিয়র বা জন ডানের ইংরেজি আমাদের অনুধাবনের বহির্ভূত থাকত, যদি সে ভাষার আধুনিকীকরণ করা না হতো। কালিদাস, সুদ্রক, ভাস প্রমুখ সংস্কৃত ভাষায় নাটকসহ অপূর্ব কাব্য ও সাহিত্য রচনা করেছেন, কিন্তু আমরা তা মূল ভাষায় বুঝি না; বঙ্গানুবাদে রসাস্বাদন করতে পারি। এমনকি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলা রচনাও আমরা তেমন একটা বুঝি না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমেই বাংলা সাধু ও কথ্যভাষা আধুনিকতা খুঁজে পেল। পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষা আধুনিকতর হলো সমকালীন লেখক ও কবিদের কলমে। কাব্য-সাহিত্য ও সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনলেন। তিনি যেমন ছন্দ গড়লেন, আবার ছন্দ ভাঙলেনও। তিনি যথার্থই ছিলেন ছন্দের জাদুকর। জাদুকর ছাড়া ভাঙা-গড়ার খেলায় নামা যায় না। তারই পথ ধরে সমকালীন লেখকরা পথ খুঁজে পেলেন। ভাষা স্রোতের মতো, তা নিরন্তর পরিবর্তনশীল। মূল ভাষাকে সমৃদ্ধ করার জন্য আঞ্চলিক ভাষারও একটা ভূমিকা আছে। আঞ্চলিক ভাষার শব্দ, বাক্যবিন্যাস ও ঝঙ্কার মূল ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। বর্তমানে, আমাদের দেশে বাংলা ভাষা কথন আধুনিকতার নামে নামাভাবে নষ্ট হচ্ছে। আধুনিকতা ভাষায় বিকৃতি গ্রহণ করে না, ভাষার সুষমা ও উন্নতিই কেবল প্রত্যাশা করে। নিত্যদিনের আধুনিক বাক্‌চারিতায় প্রমিত ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ শ্রুতিকটু হয়ে থাকে। অবশ্য বাচনিক ভাষায় শব্দ-নির্বাচন, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, ধ্বনি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ মঞ্চ নাটকের জন্য একটি সুর্বণ দ্বার উন্মোচন করল। ১৯৭৩-এ দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাট্যচর্চা শুরু হলো সারা দেশে। ঢাকা; রাজধানী শহর নাট্যচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল। পাকিস্তানি আমল থেকে বাংলাদেশে নুরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, আনিস চৌধুরী, আসকার ইব্‌নে শাইখের মতো নাট্যকারেরা ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নব উদ্যোগে আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীনেরা গভীর ও মঞ্চসফল নাটক রচনা শুরু করলেন। এদের সঙ্গে পরে যুক্ত হলেন দেশের বহুপ্রভা লেখক সৈয়দ শামসুল হক; পরবর্তীকালে তরুণতর মান্নান হীরা, আবদুল্লাহ্‌ হেল মাহমুদ, রবিউল আলম প্রমুখ নাট্যকারের সারিতে যুক্ত হলেন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোর নাট্যকারেরা। মৌলিক নাট্য রচনার পাশাপাশি বিদেশি নাটকের অনূদিত ও রূপান্তরিত নাট্যরূপ ঢাকার মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের মঞ্চে অভিনীত হওয়া শুরু হলো। ধারণা করি, এর পেছনে দুটো অভিপ্রায় কাজ করেছে। যথেষ্ট সংখ্যক মৌলিক নাটকের অভাব যেমন অনুভূত হলো, তেমনি দেশের নাট্যকর্মীরা মনে করল, বিভিন্ন ভাষায় রচিত সারা পৃথিবীর সব সুলিখিত ও সফল নাটকের উত্তরাধিকার বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদেরও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডিএল রায়, বাদল সরকার, মনোজ মিত্র, উৎপল দত্ত প্রমুখের নাটককে বাংলা ভাষায় রচিত আমাদের নিজেদের নাটক হিসেবে গণ্য করা হলো। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্যসম্ভার থেকে বেছে নেওয়া নাটকের মঞ্চায়ন সংখ্যা ঈর্ষণীয়।

বাংলা ভাষার বাইরে, ভিন্ন ভাষায় রচিত ভারতীয় নাট্যকার গিরিশ কার্নাড ও বিজয় টেন্ডুলকারের নাটক আমাদের দেশের মঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোতে উদ্ভাসিত হলো। জার্মান নাট্যকার বের্ট্রল ব্রেশ্‌ট বাংলাদেশের মঞ্চালোকে উদ্ভাসিত হলো সাড়ম্বরে। এই নাটকগুলোর মধ্যে ‘দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা’, ‘মোহনগরী’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘গ্যালিলিও’, ‘হিম্মতি মা’, ‘ধূর্ত উহ’, ‘বিধি ও ব্যতিক্রম’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই নাটকগুলোর কোনোটি ছিল অনুবাদ, কোনোটি ছিল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ রূপান্তর। এই সফল রূপান্তরের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূর কৃত বের্ট্রল ব্রেশ্‌টের ‘দেওয়ান গাজীর কিস্‌সা’ ও তারিক আনাম খান কৃত মলিয়ঁয়ের-এর ‘কঞ্জুস’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশ্বখ্যাত নাট্যকার সফোক্লিস, মলিয়ঁরের, হেনরিক ইবসেন, আলবেয়ার কামু, জাঁ পল সার্ত্রে, আবউইল শ, এরিয়েল ডর্ফম্যান, আন্তন চেখভ, তৌফিল আল হাকিম প্রমুখ নাট্যকার বাংলাদেশের মঞ্চে হয় অনুবাদে, না হয় রূপান্তরে স্থান করে নিয়েছিল। বাংলাদেশে সর্বকালের সেরা নাট্যকার শেকস্‌পিয়রের নাটক বহু দিন আগে থেকেই মঞ্চায়িত হয়ে আসছে। শেকস্‌পিয়রের নাটক অথবা নাট্যকাহিনীর চলচ্চিত্র-রূপ কি মঞ্চ-রূপ বহুকাল থেকে সমগ্র বিশ্বকে আন্দোলিত করে আসছে। সৈয়দ শামসুল হকের শেকস্‌পিয়র সফল অনুবাদ দেশের মঞ্চকে আলোকিত করল। এই নাটকগুলোর মধ্যে ‘ম্যাকবেথ’, ‘টেম্পেস্ট’, ‘ক্রয়লাস ও ক্রেসিদা’ এবং ‘হ্যামলেট’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শেকস্‌পিয়রের নাটকের মুক্ত অনুবাদের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন স্বনামধন্য অধ্যাপক ও লেখক মুনীর চৌধুরী, যার ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’ টেলিভিশনের দর্শকদের বিপুলভাবে আলোড়িত করেছিল। শেকস্‌পিয়রের নাটকের কাতারে বাংলাদেশের মঞ্চে অভিনীত ‘ওথেলো’, ‘করিওলেনাস’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ‘এ মিড সামার নাইটস ড্রিম’, ‘রোমিও জুলিয়েট’, ‘জুলিয়াস সিজার’-এর রূপান্তর ‘গণনায়ক’ বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।

উপসংহারে বলব, এ কথা মেনে নিতেই হয়, নাটক, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ এমনকি চারু ও নৃত্যশিল্পের সব শাখায় অনুবাদ, ভাষান্তর ও রূপান্তরের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

 

লেখক

অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক

প্রাবন্ধিক

 

 

কৃতজ্ঞতা: কালেরখেয়া

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত