| 16 জানুয়ারি 2025
Categories
এই দিনে গল্প সাহিত্য

রংকলের মাঠ – শ্রীজাত

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

আজ ২১ ডিসেম্বর কবি ও কথাসাহিত্যিক শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের শুভ জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।


 

কে যাবেন ভাই রিকশা?
কোথায় যাবেন?
রংকলের মাঠ। চেনেন তো?
হ্যাঁ, তিরিশ টাকা লাগবে।
তিরিশ টাকা? এখান থেকে রংকলের মাঠ? কবে হল?
কুড়ি টাকা তো দু’বছর ধরেই আছে। এখন জল হচ্ছে, তাই দশ টাকা বেশি। যাবেন তো বসুন।
চলুন, কী আর করব। আপনারা যখন-তখন ভাড়া বাড়িয়ে দেন, কিছু বলার নেই।
রাস্তার অবস্থা দেখবেন, তারপর বলবেন। মাঝে ঘোষপাড়ার ওখানে নেমে গাড়ি ঠেলতে হচ্ছে, এই এত কাদা। তারপর যখন-তখন জল ঢালছে। দিনে ক’বার ভিজছি জানেন?
ঠিক আছে, ঠিক আছে, চলুন এখন। তিরিশ টাকাই নেবেন।
নিন, ধরে বসুন, সামনেই রাস্তা কাটা।
এই অবস্থা হল কবে? এরকম তো ছিল না?
আপনি এসছেন আগে?
হুঁ… অনেকবার।
লাস্ট তিন-চারবছরে এই হাল হয়েছে। তার মধ্যে আর আসেননি তা হলে।
নাহ, তিন-চার বছরে আর…আমি বোধ হয় বছরদশেক পরে এলাম।
অ বাবা! তা হলে চারপাশে কিছু চিনতে পারেন কিনা দ্যাখেন একবার!
তা… খারাপ হয়েছে না ভাল হয়েছে?
সে বলতে পারব না। কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বাড়িঘর উঠছে, দুই পার্টির ঝামেলা লেগে আছে, তাই তো রাস্তাঘাটের উন্নতি
কিসু হয়নি। একটা জিনিসই পালটায়নি, আমাদের অবস্থা।
ও মা! এখানে একটা পুকুর ছিল না…
ঘাট বাঁধানো?
আপনার মনে আছে দেখছি। হ্যঁা, ছিল। লোকে বলত রায়বাড়ির পুকুর।
মনে থাকবে না? কত চান করেছি, সাঁতার কেটেছি… বেলা গড়ালে বাবা এসে টেনে নিয়ে যেত, আবার একটু বড় বয়সে, মনখারাপ হলে পুকুরের ধারে বসেও থেকেছি… কী আশ্চর্য! বাড়ি হল কবে?
নয়-নয় করে চারবচ্ছর হল। প্রোমোটার, পার্টির লোক … কে ‘না’ করবে? এখানে নাকি বাইরে থেকে এসে লোক থাকবে। গাছ কাটা পড়ল কত, মাইতিপাড়ার বাঁশবাগান…
সে কী? সেটাও নেই নাকি?
পুরো সাফা হয়ে গিয়েছে। দু’দিনে। নাকি নতুন বাজার হবে। এদিকে কারখানাগুলো যে…
ওখানে আমরা লুকোচুরি খেলেছি কত! সন্ধে হয়ে এলে ভয়-ভয় করত একটু… ঝিঁঝিঁ ডাকত খুব। মনে আছে, একদিন লুকোচুরি খেলতে-খেলতে লুকিয়েছি, বন্ধুরা খুঁজে না পেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। আমি আর বেরোনোর পথ খুঁজে পাই না। কী কান্না কেঁদেছিলাম সেদিন! শেষে লন্ঠন নিয়ে বাবা এসে খুঁজে বের করেছিল…
কদ্দিন ছিলেন এখানে?
হ্যাঁ?
এইখানে থাকতেন আপনারা?
হ্যাঁ, পুরো ছোটবেলাটাই তো এখানে কেটেছে। তারপর এখন… অনেকদিন বাইরে। বললাম যে, দশ বছর আসিইনি।
ও… তা এখন কোথায় থাকেন? কলকাতা?
এখান থেকে কলকাতাতেই চলে গিয়েছিলাম, তারপর এখন বছর সাত-আটেক হল কাজের জন্য বিদেশে থাকি। লন্ডনে। ছুটিতে এসেছি।
তাই বলুন। লন্ডন আমি শুনেছি। খুব সুন্দর জায়গা। কলকাতাও তো শুনেছি এখন নাকি লন্ডনের মতো হয়ে গিয়েছে? আমি যাইনি কোনও দিন।
এখনও হয়নি, দেরি আছে।
সে হতে কতক্ষণ… দেখেছেন, কেমন মেঘ করে এল, এইবার ঢালবে। এমনি কি আর কেউ দশ টাকা বেশি চায়, বলুন?
হ্যাঁ, আগে মেঘ করে এলে আমাদের পাড়াটা কী অদ্ভুত সুন্দর যে দেখাত… সবক’টা একতলা বাড়ি, আর অনেকখানি আকাশ তাদের উপরে। অত আকাশ আমি কলকাতায় কখনও দেখিনি। কালো করে আসত যখন, আমরা খেলা বন্ধ করে মাঠে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি নামার অপেক্ষা করতাম, ভিজব বলে। আর মন্টুদের বাড়িটা ছিল সাদা। আকাশ কালো করে এলে ওর যে বাড়ির রং নিয়ে কী গর্ব হত…
কোন পাড়ায় থাকতেন আপনারা?
রংকলের মাঠের ধারেই তো। পশ্চিমদিকের প্রথম বাড়িটাই আমাদের ছিল। একতলা। ঘিয়ে রংয়ের দেওয়াল, সবুজ জানালা দরজা। ভাড়া বাড়ি, কিন্তু বাবা সাধ করে নাম রেখেছিলেন নন্দিনী। রবীন্দ্রনাথ থেকে। মনে-মনে আমরা সকলে বাড়িটাকে নন্দিনী বলেই ডাকতাম।
আমাদের বাড়ির দু’চারটে বাড়ির পরেই ছিল রেল কোয়ার্টার। বিলু আর দুলের বাবা রেলে কাজ করতেন… আমার মনে আছে।
আপনার তো দেখছি অনেককিছু মনে আছে। এমনিতে কী হয়, এসব জায়গা থেকে যারা শহরে যায়, আর ফেরে না। ভুলেও যায়। আপনি দেখছি ভোলেননি। এবার একটু ধরে বসবেন, সামনে পুরো কাদা।
আমি নামব?
এ কী কথা! আপনি নামলে আমার মান থাকবে? তা হলে আর দশটাকা বেশি নিচ্ছি কোন মুখে? ধরে বসুন!
আপনারা এখানকার বাসিন্দা? না বাইরে থেকে আসেন?
আমাদের অনেকে বাইরে থেকে আসে, আমি তিন পুরুষ এখানকারই।
কোথায় বাড়ি?
আমার ওই চালপট্টি। গার্লস ইস্কুলের পাশেই।
ভগবতী গার্লস স্কুল? আমি তো ওই স্কুলেই পড়তাম, টেন অবধি পড়েছি।
আমিও পড়েছি এইট অবধি।
তারপর আর পড়লেন না কেন?
বাবা ছিল রংকলের মিস্ত্রি, এক ভাই ছিল। রংকল বন্ধ হল, বাবা আর কোথাও কাজ পেল না। শরীরটাও বসে গেল। ভাই কাটা পড়ল রেলে। ব্যস, ওই এইটেই শেষ। নানা কাজ করেছি, এখন তিনবচ্ছর হল এই রিকশা চালাচ্ছি, তাও মালিকের গাড়ি।
জায়গাটা কেমন পালটে গেল, না?
তার চেয়েও বড় কথা হল মানুষগুলোই পালটে গিয়েছে, জায়গার আর কী দোষ!
রংকলের ধারে-ধারে বাড়িগুলো আর তেমন নেই, না?
সব ভাঙা পড়েছে, ফ্ল্যাটবাড়ি হবে নাকি। দু’একটা বাড়ি এখনও আছে, রেল কোয়ার্টারটাও আছে। তবে ওইটা ভাঙতে হবে না, নিজেই কোনদিন ভেঙে পড়বে। মাঠটা আছে, কাজিয়া চলছে, প্রোমোটার এখনও দখল পায়নি… তবে পেয়ে যাবে। তারপর মাঠটাও থাকবে না আর।
রংকলের মাঠ… থাকবে না?
কিছু কী থাকছে? আপনি বলুন না…
তা ঠিক।
তবে আপনাদের ওই হলুদ একতলা বাড়িটা আছে এখনও। জানালাগুলো সবুজ নেই আর, বাড়িওয়ালা দু’বছর আগে নীল রং করিয়েছে।
আপনি… আমাদের বাড়িটা চেনেন?
অ্যাই, স্ট্যান্ড এসে গিয়েছে। নিন, নামুন। জল শুরু হল বলে। এই আপনার রংকলের মাঠ।
হ্যাঁ, এই তো। দাঁড়ান, এই ব্যাগটা আবার…আচ্ছা, বললেন না তো?
কী?
আপনি আমাদের বাড়িটা চেনেন?
মানুষ যে কী চেনে না আর কী চেনে, তার কি কোনও হিসেব আছে? আমি এই টাউনের লোক, রিকশা চালিয়ে খাই, চিনতে তো হবেই।
সে তো পথঘাট চিনবেনই। কিন্তু… আগে কি কখনও আমাকে নিয়ে এসেছেন?
আপনি দশ বচ্ছর পর এলেন, আমি তো রিকশা চালাই তিনবচ্ছর। সেটা কথা নয়। এবার এগোই, জোর আসছে। আপনি এই পাশে স্ট্যান্ডেই ফেরার রিকশা পেয়ে যাবেন।
আচ্ছা… আমার কাছে না…পঞ্চাশের নোট, সরি, ওঠার সময়ে বলা উচিত ছিল। কুড়ি টাকা হবে আপনার কাছে?
একটা কথা বলি? যদি কিছু মনে না নেন…
হ্যাঁ, বলুন?
আপনার নাম আফসানা আলম তো?
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি আমার…
আপনি কলেজের স্যার আনিসুদ্দিন সাহেবের মেয়ে?
হ্যাঁ..
আপনার স্কুলের বাইরে একটা রোগামতো ছেলে রোজ দাঁড়িয়ে থাকত, মনে পড়ে?
স্কুলের বাইরে… দাঁড়ান-দাঁড়ান… হ্যাঁ-হ্যাঁ… সে তো একবার আমাকে একটা চিঠিও দিয়েছিল হাতে-হাতে… মুক্তোর মতো হাতের লেখা, কিন্তু নিজের নাম লেখেনি। তার পরেও তাকে দেখেছি বেশ কিছুদিন… তারপর তো আমরাই… এক মিনিট! আপনি কি…
নাম থাকলেই পালটে যাওয়ার সমস্যা। এই যেমন রংকলের মাঠ, শুনছি প্রোমোটার পেলে নাম পালটে কী একটা কমপ্লেক্স নাম রাখবে। কিন্তু মাঠের ধারে আপনাদের বাড়িটা ভাবুন, আনিসুদ্দিন সাহেবের মনে-মনে রাখা নাম… তাকে পালটায় কার সাধ্যি।
ইশ! কী লজ্জার ব্যাপার বলুন তো, এতক্ষণ আপনার রিকশায়! আমি একদম বুঝতে পারিনি।
আরে লজ্জা পাবেন না। সেই ছোটবেলার সাধ ছিল জানেন, আপনার সঙ্গে ইস্কুল থেকে বাড়ি অবধি যাই, দরজায় পৌঁছে দিই আর কী। সে এতদিনে হল। আসি এবার। টিপটিপ করে চালু হয়েছে, জোরে নামল বলে…
কী মুশকিল, এবার যে আপনাকে ভাড়া অফার করব…
ও থাক। এমন প্যাসেঞ্জারও তো আমি আর পাব না। এলাম।
বেশ… কিন্তু আপনার নামটা…
মনে-মনে রেখে দেবেন কিছু একটা। পালটাবে না কোনওদিন… আসি…

 

 

 

 

কৃতজ্ঞতা: উনিশকুড়ি

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত