রক্তাক্ত শ্রীলঙ্কা, লাগাতার বিস্ফোরণের বলি অন্তত ২১৫, ফিরল এলটিটিই যুগের দুঃস্বপ্ন

Reading Time: 3 minutes

সকাল পৌনে ৯টায় থেকে শুরু হয়ে পরপর ছ’বার। কেঁপে উঠল তিনটি গির্জা আর তিনটি পাঁচতারা হোটেল। তার ছ’ঘণ্টার মধ্যেই আরও দু’টো। সব মিলিয়ে মোট আটটা বিস্ফোরণে একেবারে তছনছ হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার ইস্টার রবিবার।

 বিস্ফোরণে এখনও পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা অন্তত ২১৫। তাঁদের মধ্যে আছেন এক মহিলা-সহ মোট চার জন ভারতীয়। শ্রীলঙ্কার বিদেশসচিব রবিনাথ আর্যসিংহে জানিয়েছেন, বিস্ফোরণে অন্তত ৩৫ জন বিদেশি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। জখম পাঁচশোর কাছাকাছি মানুষ। আহতদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, আমেরিকা, মরক্কো এবং বাংলাদেশের পর্যটকেরা রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে একটি সূত্রে। আপাতত কোনও গোষ্ঠী এই ধারাবাহিক বিস্ফোরণের দায় না-নিলেও সন্দেহভাজন সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গোটা ঘটনায় একটি গোষ্ঠীরই হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

আজ সকাল পৌনে ৯টা নাগাদ কলম্বোর কোচিকাডের সেন্ট অ্যান্টনিস চার্চ, পশ্চিমের উপকূল শহর নেগোম্বোর সেন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চ, এবং পূর্বের বাত্তিকালোয়া শহরের জ়িওন চার্চে পরপর বিস্ফোরণ ঘটে। তখন সব গির্জাতেই প্রার্থনা চলছিল। আচমকা বিস্ফোরণে সেন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চের ছাদটাই উড়ে যায়। এই ছাদের ভাঙাচোরা কাঠামোর ছবি ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরে এই গির্জার ফেসবুক পেজে লেখা হয়, ‘‘আমাদের গির্জায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখানে এসে দেখুন, যদি আপনাদের স্বজন কেউ থাকেন।’’ প্রথম বিস্ফোরণটি যেখানে ঘটে, সেই সেন্ট অ্যান্টনিস চার্চ অত্যন্ত জনপ্রিয় গির্জা। সেখানে ভিড়ও ছিল অনেক
বেশি। বিস্ফোরণের পরে সেখানকার মাটিতে পড়ে আছে শুধু ভাঙা কাঠ আর  কাচের টুকরো। দেওয়াল জুড়ে রক্তের ছাপ আর ছিন্নভিন্ন দেহাংশ। সেন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চে প্রাণ হারিয়েছেন ৭৪ জন। প্রত্যক্ষদর্শী দোকানি এন এ সুমনপালা বলেছেন, ‘‘চোখের সামনে রক্তের স্রোত। বরফের মতো উড়ছে ছাই।’’ ফাদার এডমন্ড তিলকরত্নে জানান, এ দিন অন্তত এক হাজার মানুষ এসেছিলেন গির্জায়। বিস্ফোরণের কিছু ক্ষণ পরেই  কলম্বোর সর্বত্র ইস্টার প্রার্থনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

• প্রথম বিস্ফোরণ কলম্বোর কোচিকাডে সেন্ট অ্যান্টনিস চার্চে
• দ্বিতীয়টি নেগোম্বোর সেন্ট সেবাস্টিয়ান চার্চে
• তৃতীয় আঘাত বাত্তিকালোয়া শহরে জ়িওন চার্চে
• ওই সময়েই কলম্বোর পাঁচতারা হোটেল শাংগ্রি লা-য় বিস্ফোরণ
• আত্মঘাতী বিস্ফোরণ দ্য সিনামন গ্র্যান্ড হোটেলের রেস্তরাঁয় (প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের কাছে)
• এর পরে বিস্ফোরণ দ্য কিংসবেরি হোটেলে
• এর ছ’ঘণ্টার মধ্যে কলম্বোতেই ফের দু’টি বিস্ফোরণ
• দুপুর ২টো ২৬-এ কলম্বোর দক্ষিণ শহরতলিতে দেহিওয়ালা চিড়িয়াখানার কাছে ট্রপিক্যাল ইন হোটেলে
• দুপুর ২টো ৫৩-য় কলম্বোর উত্তরে শহরতলি ওরুগোদাওয়াত্তায় তল্লাশির সময়ে একটি বাড়িতে আত্মঘাতী হামলা

গির্জা ও হোটেলে বিস্ফোরণের ছ’ঘণ্টার মধ্যেই আরও দু’টো বিস্ফোরণের খবর আসে। কলম্বোর দক্ষিণ শহরতলিতে দেহিওয়ালা চিড়িয়াখানার কাছে সাত নম্বর বিস্ফোরণটি ঘটে। ‘ট্রপিকাল ইন’ নামে একটি ছোট হোটেলে প্রাণ হারান অন্তত দু’জন। আর অষ্টম বিস্ফোরণে প্রাণ হারান তিন জন পুলিশ অফিসার। উত্তর শহরতলিতে কলম্বোর দেমাতাগোদা জেলার ওরুগোদাওয়াত্তায় একটি দোতলা বাড়িতে তল্লাশি অভিযানের সময়ে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে বলে দাবি। বোমারু নিজেকে ওড়ানোর পরে ওই বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ে পুলিশের উপরে। আত্মঘাতী বিস্ফোরণের এই নমুনা তৈরি করে এক সময়ে পথ দেখিয়েছিল তামিল গেরিলারাই। পরে পশ্চিম এশিয়ার জঙ্গিরা অনুসরণ করা শুরু করে সেই পথ।

এ দিন আট নম্বর বিস্ফোরণের খবর মিলতেই সন্ধে ছ’টা থেকে আগামী কাল ভোর ছ’টা পর্যন্ত গোটা দেশে জারি হয়েছে কার্ফু। যার মেয়াদ পরে আরও বাড়ানো হতে পারে। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে প্রধান সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইট এবং মেসেঞ্জার। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার— সব বন্ধ। আগামীকাল ও মঙ্গলবার সব সরকারি স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ সব বিশ্ববিদ্যালয়ও।

প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনা শান্তির আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় আমি শোকস্তব্ধ।’’ প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহে ধারাবাহিক এই বিস্ফোরণকে ‘কাপুরুষোচিত কাজ’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘‘এই বিপর্যয়ের মধ্যে সব নাগরিককে বলছি, একজোট থাকুন। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।’’

সারা দেশের সব ধর্মীয় স্থানের আশেপাশে কড়া পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলম্বোর আর্চবিশপ কার্ডিনাল ম্যালকম রঞ্জিত বলেছেন, ‘‘সরকারকে অনুরোধ, নিরপেক্ষ এবং যথাযথ তদন্ত করুন। দোষীদের নির্মম শাস্তি দেওয়া হোক। তবে শ্রীলঙ্কার মানুষদের বলছি, আইন হাতে তুলে নেবেন না। দেশে শান্তি, সৌহার্দ্য বজায় রাখুন।’’

২০১৮ সালে ২৩ লক্ষ বিদেশি পর্যটক পা ফেলেছিলেন শ্রীলঙ্কায়। তাঁদের মধ্যে সাড়ে ৪ লক্ষ পর্যটক এসেছিলেন শুধু ভারত থেকেই। এ বছর ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যাটা ১০ লক্ষ ছোঁবে বলে আশা ছিল সরকারের। কিন্তু এ দিনের ধারাবাহিক বিস্ফোরণে পর্যটন ব্যবসা ভাল রকম ধাক্কা খাবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>