এক ঝিঁ ঝিঁ ডাকা মোহময়ী সন্ধ্যায় চাঁদ একটু উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে গোপন প্রেমিকার মতো, হাতের মুঠো গলে তার একটুকরো ভবিষ্যতের স্বপ্ন, সূর্যাস্তের হলুদ খামে করে ওড়ে ওড়ে আসে আমার অদিকে। অসীম সবুজে ছাওয়া মাঠে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে মহাকাল, আমি এক তুচ্ছাতিতুচ্ছ বুদবুদ আছি শুয়ে। শুয়ে আছি বুদ্বুদসম জীবনকে এক বিশাল রিলেরেসের মাঠ জেনে দৌড়ে জিতে যাওয়ার বাসনায়।
হঠাৎ কাছে কোথাও পুলিশের তীব্র বাঁশি, হৈ চৈ, বুটের থপ থপ আওয়াজ। গগন বিদীর্ণ করে বন্দুকের ঠা ঠা। করুণ গোঙানির সুরে জীবনের নিষ্পন্দ হবার শেষ শিঙ্গা। সম্মিলিত ফিসফাসে ভয়াবহতার আতঙ্কিত বিদীর্ণতা। কেউ কী চিৎকার করে বলে, সুবোধ তুই পালা, স্বপ্ন নয় দুঃস্বপ্ন আসছে ধেয়ে সুনামী উঁচু ঢেউয়ের মতোন। আসছে তছনছ করে দিতে স্বপ্নসকল, আসছে ঔই চাঁদের নরম জোছনা মাখা রাতের অপেক্ষা মোড়া সূর্যোদয়ের সকল আয়োজন গিলে খেতে, সুবোধ পালা,সুবোধ পালা,পালা সুবোধ পালা, সময় এখন তোর অনুকূলে নয়……।
আমি পিছু ফিরে তাকাই, কী তাকাই না। কী ঘটে, কী ঘটবে? বুঝি, কী বুঝি না, আমি দৌড়াই……দৌড়াই। কেবল কীট-পতঙ্গ সম বেঁচে থাকার বাসনায় দৌড়াই। ন্যায় কী অন্যায় ফিরে দেখা জীবনের উদ্দিষ্ট নয়, মনুষ্য জীবনের সার্থকতা নয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধে, কেবল স্বার্থপর জৈবিক জীবনে বেঁচে থাকাই বাসনা তার। আমি দৌড়াই, আমি দৌড়াই!
আমি থামি, হাঁফাই, হাঁফাতে হাঁফাতে থামি এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস ছুটে প্রশ্ন হয়ে হয়ে, কতোদিন থেকে পালাচ্ছি আমি? কতোদিন? যখন অসীম দূরত্বে মানবিক বোধের হাতছানি,।চোখ রাঙানো নেই, শিক্ষা-রুচির দায়বোধে গড়া কোনো বিমূর্ত বিবেকের। সামনে এক বিস্তীণ প্রান্তর, দৃষ্টি মেলে দেখতে চাই আদিগন্ত প্রান্তরের। দৃষ্টি থেমে যায় এক ঘন বসতির লোকালয়ে, থেমে যায় এক নিরবিচ্ছিন্ন ধুলা ওড়া পথে, দৃষ্টি থেমে যায় বাজ পড়ে জ্বলে যাওয়া কিছু তাল গাছের সারিতে। কোথায় যাবো আমি, কোথায়? বসতি ঘিরে দারিদ্র্য আর অভাব। ক্লান্ত হাটুরে মানুষের সারিতে হুমড়ি খায় দৃষ্টি আমার। হুমড়ি খায় অতর্কিতে ঝলসে যাওয়া বাবুইয়ের নীড়ে। পথ পাইনা খুঁজে, কোনদিকে যাবো আমি? কোনদিকে?হঠাৎ
-মা ডাকে বাপ আমারে লইয়া যা বাপ……..।
-মা……মা………।
-সোহানা ডাকে, স্যার…..স্যার…….।
হঠাৎ কেউ ডাকে, কড়া নাড়ে স্মৃতির কয়েদখানায়…..।
রোদে পোড়া কৃষক আমার বাপ। স্থানীয় ভাষ্যে যাকে বলে গিরস্থ। গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরুর খাঁটি গিরস্থ বাপ আমার। নিজের হাতে কুপিয়ে মাটিতে প্রাণ জাগাতেন অক্লান্ত। সে হাত বড়োই নির্দয় ছিলো আমার মায়ের পরির মতো পবিত্র সুন্দরে। উন্মাদ যুবক পিতা আমার। যখন সে পিতা হয় নাই আমার, নাওয়া-খাওয়া ভুলা এক মজনু। দিন কাটে তার আমার মাতার অপেক্ষায়। যখন সেও মাতা হয় নাই আমার। বসতবাড়ি আড়াল করা বাঁশঝাড়ের ঝোঁপে, সন্ত্রস্ত লাল পিঁপড়ের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে গায়ে, বিষাক্ত দংশনে লাল ফুলে ফুলে ওঠে অনুরক্ত অপেক্ষা তার, কখন সে দেখে একটুখানি ছায়া, স্বর্গের পথ ভুলা এক রূপবতী পরির। যে রূপের ছটায় পুড়ে যায় যুবকের স্বাভাবিক দিন, তেতে ওঠে দুর্বহ রাত।
আহা মা, বর্ষার ঘনায়মান মেঘের মতো দীঘল চুল ছড়ানো মা আমার, ঘোর বর্ষনে বিজলী চমকের মতো গিরস্থের ঘরে ঝলসে ওঠা রূপের বন্যার মা আমার। এই রূপের দোহাই, জানে সে, জানে আমার বাপ আর, সাক্ষী চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা। এই রূপের দোহাই, উন্মাদ যুবককে ফেরায় ঘরে আমার মাতার রূপ। যে রূপে উন্মাদ আত্মভোলা মজনু সে ছিলো একদা, সেই মজনু কেমনে ঘরে ফেরে! লাঙল-জোয়াল নেয় কাঁধে! তার পরিশ্রমে ফিরে কিছু বৈভব। দিনের প্রবল সফল গিরস্থ রাতে এক রূপবতীর কাছে নতজানু।
আহা মাতা বলতেন, কী সুখের দিন ছিলো তার, যেনো রূপকথার অন্তের মতো….। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো। আহা, আহা যদি রূপকথার শেষের মতো হতো শুরু থেকে শেষ, শেষ থেকে শুরু! হতেই পারতো। লক্ষন ছিলো সুস্থিত। রাত গভীর হলে পরীর মতো এক রূপবতীর কাছে বড়োই আদর কাতুরে শিশু যেনো পিতা আমার।
মাতা আমার অষ্টম মাসের পোয়াতী তখন, পেটের ভেতরে হাত পা ছুড়ি আমি। মা ব্যাথায় নুইয়ে যান, মাতৃত্বের গৌরবে চকচক করে তার মোম মসৃণ পেট – পিতার হাতখান তার উপর রাখেন মাতা!
-পরি
-তুমি!
-পরি তোর চোখমুখ এত হুকনা লাগতাছে ক্যারে? খাইছস না?
-তোমার লাই¹া বইয়া রইচি, তুমি আইলে এক লগে খাইমু।
-পাগলি বউ আমার!
-আইচ্চা পরি ক চাইন, পোলা অইবো না ফুরি অইবো?
-তুমি কও।
-আমি কইমু? আমি গিরস্থ, আমার বাপ গিরস্থ, তার বাপ আছিল গিরস্থ, তার বাপ, তার বাপ……… কয় পুরুষ ধইরা যে আমরাগিরস্থ জানিনা। আমিতো চাইমু আমার মতই গিরস্থ হোক আমার ফুলা। আমার থাইক্কাও বাড়ন্ত অউক তার গুলা।
-আর যদি ফুরি হয়?
-ফুরি?
-হয়, আমার মত, ঠিক তোমার পছন্দ মত দীঘল কালো চুলের সোনার বরণ কইন্যা। তোমার মত মজনু তারে ঘরে তুলবো। তোমার মত সোহাগে ভালোবাসায় রাজ-রানী কইরা রাখবো।
-দূর কিতা যে কস, তোর মত রাজ কইন্যা আমার ঘরো আইলে তারে কিতা আমি আমার মতো মাটি কোপাইন্যা গিরস্থের সাথে বিয়া দিমু না কিতা? তার লাই¹া ঠিক অই আরেকটা রাজপুত্র খুইজ্জা আনমু।
-শোন যে জামাইয়ে মন-প্রাণ দিয়া ভালোবাসে ঘরের বউরে, বউয়ের কাছে সেই রাজপুত্র। মাথাত তাজ পইরা সিংহাসনে বসে যে রাজপুত্র সে বাইরের দুনিয়ার। বউয়ের কাছে রাজপুত্র হইলো জামাইয়ের মন।
-ফসলের ভারে ভইরা উঠছে গোলা আমার, তোর কিতা চাই ক চাইন!
-একট কতা দিবা কও!
-হ,
-পুলা হোক বা ফুরি ! কওচাইন একটা সোনার নেকলেস বানাইয়া দিবায়!
-এ আর কিতা আকাশ কুসুম আব্দার তোর পরি, ভাবছিলাম তরে চমকাইয় দিতাম, আগেই চাইয়ালাইলে!
হায় স্বপ্ন, নারীর স্বপ্ন। রূপবতীর গৌরব অঙ্গে গাথা কিংবা বৈভবের অহংকারে ডুবে থাকা অথবা দারিদ্র্যের দীনতার সাথে লড়াই করা শুধুই নারী, স্বপ্নদৌড় তার পৌঁছায় না একখানা নেকলেসের উর্দ্ধে তার, কপালেও নামে ভূত চতুর্দশীর মতো ভূতুড়ে অন্ধকার। চারদিকে থৈ থৈ নববর্ষার জলের মত ক্রমাগত ফেঁপে ওঠা সুখের মাঝে হঠাৎ কোন ভূত দেখে পিতা আমার। মায়ের মায়াবী আঁচলে সে প্রবল বিষাদে আবিষ্কার করে সন্দেহের হুতাশন। নিঃশব্দে হারিয়ে যেতে থাকে আকর্ষন কিংবা প্রেমময় চিহ্ন সকল।
অথবা প্রচন্ড-প্রবল হয় সেই আকর্ষন আর প্রেম, যার ভার বইতে জানেনা মাটি কোপানো বাপ আমার। ঘরে সুন্দরী বউকে ঘিরে তীব্র তুমুল অনিরাপত্তার তপ্ত-হুতাশনে জ্বলে সে, যে তাপের জন্ম তার অন্তরেই অথচ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অর্পিত হয়নি তার শিক্ষা রুচি কিংবা বিবেচনায়।
স্পষ্ট মনে পড়ে, স্পষ্ট মনে পড়ে আমার। গর্ভের নিরাপদ কুঠুরীতে কান পেতে আমি শুনেছি যে সোহাগের আবেগী পংক্তিমালা আর পেয়েছি যে স্পর্শের উষ্ণতা, পৃথিবীর আলো হাওয়ায় আমি অপক্ক দৃষ্টিতে দেখি পিতামাতার অকারণ নিশ্চল যুদ্ধ।ঘরে ঢুকে মায়ের রঙীন শাড়িতে সে দেখে ভ্রম, যেনো বাহারী পুস্প আহবান করে প্রজাপতি।মায়ের লক্ষী চরণযুগলে সে খুঁজে কূলভাঙা কলঙ্কিনীর পদছাপ। বিনাকারণে হাতের নাগালে সহজলভ্য চেলিকাঠ ভাঙে সে মায়ের স্নেহময় মোলায়েম পিঠে….।
বাকী অংশ আগামী পর্বে…
১৯৭০ সনের ০৭ মে হবিগঞ্জে জন্ম। জেলা শহর থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে লেখালেখির মাধ্যমেই হাতেখড়ি। শুরুটা আরো অনেকের মতোই কবিতা দিয়ে। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘নির্বিশঙ্ক অভিলাষ’। এরপর ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন মঞ্চনাটকে। রচনা করেন কমলাবতীর পালা, বিভাজন, জ্যোতি সংহিতা ইত্যাদি মঞ্চসফল নাটক। অভিনয়ও করেন। মঞ্চে নাটক রচনার পাশাপাশি নিরব অন্তঃসলিলা স্রোতের মতো বহমান থেকেছে গল্প লেখার ধারাটি। জীবন ও জগতকে দেখা ও দেখানোর বহুস্তরা এবং বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার উৎসারণ ঘটেছে ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলন ‘ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি’তে। ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’ প্রন্থভুক্ত গল্পগুলোতে সে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে আরও নির্মোহ, একবগগা, খরখরে কিন্তু অতলস্পর্শী ও মমতাস্নিগ্ধ। গল্প লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ ইতোমধ্যে পেয়েছেন বৈশাখী টেলিভিশনের পক্ষ থেকে সেরা গল্পকারের পুরস্কার, ফেয়ার এন্ড লাভলী সেরা ভালোবাসার গল্প পুরস্কার। ২০১৪ সাথে মঞ্চনাটকে অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘তনুশ্রী পদক’। বর্তমানে সক্রিয় রয়েছেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্র-পত্রিকা, লিটলম্যাগ এবং বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রকাশিত অন্তর্জাল সাহিত্য পোর্টালে লেখালেখিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী অনিরুদ্ধ কুমার ধর ও যমজ সন্তান অদ্বিতীয়া অভীন্সা পদ্য ও অদ্বৈত অভিপ্রায় কাব্যকে নিয়ে হবিগঞ্জে বসবাস করছেন।
মঞ্চে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা থিয়েটার প্রবর্তিত, ফওজিয়া ইয়াসমিন স্মৃতি পদক,থিয়েটার প্রবর্তিত জাকারিয়া পদক।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৫টি। নাটক ২ টি ও মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস সহ প্রকাশিত গ্রন্থ ৯টি।