‘তোমাকে শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে’! কথাকটি শুনেই স্নিগ্ধা ভিডিও কলটা কেটে দিল। সে বিরক্ত হোল না খুশি তা বোঝার কোন সুযোগই পেল না অনিকেত। একটা অজানা আশংকায় তাঁর মনের ভিতরটা তোলপাড় হতে থাকলো। ভিডিও কলটা যে স্নিগ্ধা কেটেছে তাতে নিশ্চিত হতে অনিকেত বেশ কয়েকবার তাঁকে ফোন করলো। প্রথম প্রথম রিং হবার পরেই ব্যস্ততার টোনে লাইনটা কেটে গেল! শেষমেশ টেলিফোনের মিষ্টি কণ্ঠ জানান দিল ‘এই নাম্বারের কোন অস্তিত্ব নেই’! অর্থাৎ স্নিগ্ধা অনিকেত কে ব্লক করেছে না হয় নিজের নাম্বারটাকেই ডিঅ্যাক্টিভেট করেছে। এরপর ব্যাপারটা শুধু ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপেই সীমাবদ্ধ থাকলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জার থেকেও স্নিগ্ধা অনিকেতকে মুছে ফেললো।
সারারাত অনিকেতের ঘুম এলো না। চারিদিকে একটা শূন্যতার চাদর পেতে কে যেন তাঁকে এক ধাক্কায় মূল্যহীন করে দিল। স্নিগ্ধাকে তো সে পেয়েই ছিল এইসব সামাজিক মাধ্যমের ভিতর। এর বাইরে তাঁর বাড়ির ঠিকানাও অনিকেতের জানা নেই। কোনদিন সামনা সামনি স্নিগ্ধাকে দেখেওনি সে। তাহলে সবকিছুই কি মরীচিকা! নাকি স্বপ্ন! নিজেকে চিমটি কেটে দেখলো, জেগেই আছে অনিকেত!
শাড়িতে সুন্দর লাগে কথাটায় কি ভুল ছিল। হাজার ভেবেও কোন কুল কিনারা পেল না সে। রাত এখন তিনটে। চারিদিকে কৃষ্ণপক্ষের নিবিড় অন্ধকার। বাইরে কয়েকটা রাতজাগা পাখির কিচির মিচির। একটা কোকিল সবাইকে ছাপিয়ে এই বর্ষাতেও বসন্তের গান গাইছে। কিন্তু অনিকেত এর জীবনে সবকিছুই যেন হেমন্তের ঝড়া পাতা। স্নিগ্ধাকে ছাড়া কাল থেকে কি ভাবে বাঁচবে সে!
ভোর হতেই বিছানা ছাড়লো অনিকেত। গত রাতের স্মৃতি কিছুতেই যেন শেষ হচ্ছে না। বাঙালী মেয়েদের শাড়িতে সুন্দর লাগবে আর ছেলেদের ধুতিতে এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ এই সামান্য কথাতেই স্নিগ্ধা এইভাবে সরে গেল কেন। শাড়ির ভিতর কি এমন রহস্য আছে তা না জানলে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না অনিকেত। এইদিকে সকাল বেলায় এখন অফিস যাবারও তাড়া নেই। কোভিড-১৯ তার জন্য লকডাউন। প্রায় তিনমাস হতে চললো শুধু অফিস কেন কোনকিছুই সেইভাবে চলছে না। এই কঠিন সময়ে স্নিগ্ধা তার জীবনে আলো হয়ে ছিল।
স্নিগ্ধাকে হারিয়ে সামান্য টুকটাক অফিসের কাজেও অনিকেত এর মন বসছে না। দিনরাত একটাই অপেক্ষা সবুজ আলো জ্বালিয়ে স্নিগ্ধার ফিরে আসার। তখন আবারও একাকী দুপুরের মিঠে রোদ্দুর গায়ে মেখে তাঁরা দুজনে অফুরন্ত জীবনের কথা বলতে পারবে। এই বছর অর্থাৎ ২০২০ সালেরই মার্চে ফেসবুকে স্নিগ্ধার সঙ্গে অনিকেতের আলাপ। স্নিগ্ধাই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। কেন সে হাত বাড়িয়ে পাঠিয়ে ছিল বন্ধুত্বের আহ্বান অনেকবার চেষ্টা করেও তা জানতে পারেনি অনিকেত। স্নিগ্ধার ছবি দেখার পর তাঁর আর কোন তথ্য না দেখেই তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিল সে। তারপর সময়ের স্রোতে দ্রুত তাঁরা খুব কাছে চলে এসেছিল। যদিও সবটাই ছিল ভার্চুয়াল। ফোন আর অন্তর্জালের মায়াবী দুনিয়ায়। ভিডিও কলেও তাদের দেখা হোত মাঝে মধ্যেই। তবে চাক্ষুস দেখা এই করোনা আবহে তাদের আর হয়ে ওঠেনি। মৃত্যু ভয় কেটে গেলে তাঁরা দুজন দুজনকে সামনা সামনি দেখবে এমন ইচ্ছে ছিল তাদের দুজনেরই।
অনিকেতের এখন আফশোষ হচ্ছে স্নিগ্ধার সবকিছু ভালো করে না জানার জন্য। স্নিগ্ধার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার বেশিটাই দুপুরেই হোত। স্নিগ্ধা বলেই দিয়েছিল রাত আটটার পর কিংবা ছুটির দিনে যেন ফোন না করা হয়। আর ভিডিও কল একমাত্র তখনই হবে যখন স্নিগ্ধা করবে। অনিকেত সব শর্তই মেনেছিল। তাদের দুজনের মধ্যে নানা বিষয় নিয়েই কথা হোত। নারী পুরুষের শরীর নিয়ে সেরকম কথা তাঁরা আজ পর্যন্ত বলেনি। তবে গলার স্বর আর আবেগের মোহময়তায় দুজনেই বেশ বুঝেছিল কাছে আসা শুধুই সময়ের অপেক্ষা!
এর মধ্যে বেশ কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে। স্নিগ্ধার কোন খবরই পায়নি অনিকেত। স্নিগ্ধার সঙ্গে তাঁর কোন কমনফ্রেন্ডও নেই যে তাদের ওর কথা জিঙ্গেস করবে। ঐদিকে লকডাউন উঠিয়ে দেবার জন্য আনলক পর্ব শুরু হয়েছে। নিয়ম মানা ও না মানার খেলায় আস্তে আস্তে সব কিছুকেই স্বাভাবিক করার চেষ্টা হচ্ছে। রোজ দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের রাজ্যও তার বাইরে নয়। ছুটতে থাকা সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে মানুষের চোখের দিকে তাকালে একটা ভয় ও আতংকের ছবি পরিষ্কার দেখতে পায় অনিকেত। সাধারণ মানুষ একটু চিকিৎসা পাবার জন্য দিশেহারা। জীবন জীবিকা কোন কিছুই আর মানুষের হাতে নেই। যেমন স্নিগ্ধা নেই অনিকেতের জীবনে। ভালোবাসাহীন এই ভাবে মৃত্যু ভয়কে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য অনিকেতের খুব কান্না পেতে লাগলো! লকডাউনের জন্য সে এতদিন তাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরতে পারেনি আর এখন ফেরার সুযোগ থাকলেও সে ফিরবে না। অন্তত ততদিন যতদিন না স্নিগ্ধার কোন খবর সে পাচ্ছে!
অনিকেত চোখ বন্ধ করলেই তাঁর সামনে ভেসে উঠছে সেই শেষ দিনের ইতিহাস। ভিডিও কলটা কাটার আগে স্নিগ্ধা সেদিন হাসতে হাসতে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল ‘যদি আমাকে ভুলে যেতে বলি, পারবে ভুলতে? অনিকেত ব্যাপারটা কে অত গুরুত্ব দেয়নি তাই সোজা বলে দিয়েছিল ‘নিজের আত্মাকে কি কেউ ভুলতে পারে? তুমি ছাড়া আমি যে শুধুই শূন্য! তাছাড়া এসব কথা আসছেই বা কেন’! খিল খিল করে হেসে উঠেছিল স্নিগ্ধা। ‘এত রাগ করছো কেন? আমিতো আজকেই তোমাকে ভুলতে বলছিনা। প্রথম যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হবে সেদিনই না হয় তোমাকে বুঝিয়ে বলবো, কেন আমায় ভুলে যেতে হবে’! অনিকেতের এইসব কথা ঠিক বিশ্বাস হয়নি তার উপর এই ধরনের আলোচনা তাঁর ভালোও লাগছিল না। স্নিগ্ধা সেদিন একটা কালো শাড়ি পড়েছিল। শাড়ির সারা গায়ে সাদা রংয়ের নানা আঁকিবুঁকি। খুব সুন্দর লাগছিল তাঁকে। তাই প্রসঙ্গ ঘোরাতে অনিকেত বলে ফেলেছিল ‘তোমাকে শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে’! সেই শেষ দেখা বা কথা হয়েছিল তাদের দুজনের।
শেষমেশ স্নিগ্ধার খবর অনিকেত কি পেয়েছিল নাকি আর্ন্তজালের মায়াবী খেলায় সে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলেছিল স্নিগ্ধাকে? এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে খবরের কাগজের একটা সংবাদ পড়ে অনিকেত চমকে উঠলো। ‘হোটেলের বদ্ধ ঘরে যুবতীর ঝুলন্ত দেহ’! তারপর বিস্তারিত খবরে যা লেখা ছিল তার মূল কথা হল, এই লকডাউনের সময়ে ফেসবুকে দুজন যুবক – যুবতীর মধ্যে আলাপ হয়। যুবকের বয়স ৩৫ এর কাছাকাছি আর যুবতী বছর ২৫শের হবে। তাদের সেই আলাপ ক্রমেই গাঢ় হয়ে ওঠে। কিন্তু লকডাউনের জন্য কেউ কারোর সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। এখন লকডাউন এর নিয়ম একটু শিথিল হতেই তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে গত দুদিন ধরে দীঘার একটি হোটেলে এসে থাকছিল। সঙ্গে একটি চার পাঁচ বছরের বাচ্চাও ছিল। গতকাল সকালে রুম পরিষ্কারের জন্য অনেক ডাকাডাকিতেও যখন কেউ দরজা খুললো না তখন হোটেল কতৃপক্ষ পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে যুবতীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে! যুবতীর শরীরে কোন পোশাক ছিল না। শাড়ির ফাঁসেই মেয়েটি ঝুলছিল। আর ছোট্ট বাচ্চাটি তখনো বেঁচে ছিল। হাসপাতালে তাকে ভর্তি করলে জানা যায় যে বাচ্চাটিকেও ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। পুলিশ এখন সেই যুবকের খোঁজে চারিদিকে তল্লাশি চালাচ্ছে।
খবরটা পড়ার পর থেকেই মাথার ঠিক নেই অনিকেতের। শাড়িতে সুন্দর লাগে কথাটায় কেন স্নিগ্ধা রেগে গেল। কি রহস্য ছিল শাড়িতে? সব প্রশ্নের উত্তর যেন দীঘার হোটেলের সেই ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে। যে শাড়ির ফাঁসে সিলিং থেকে মেয়েটি ঝুলছিল সেই শাড়িটা যে অনিকেতের বড্ড চেনা! তাই দীঘায় খুন হওয়া মেয়েটা কে? কি তাঁর পরিচয়? এসব জানার জন্য পাগলের মতো ছটফট করতে থাকে অনিকেত। সারাদিন টিভির সামনে বসে বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে সে, যদি কোথাও কোন সূত্রের নাগাল পাওয়া যায়।
বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেল ও পরের কয়েকদিনের সংবাদ পত্র থেকে যা জানা যায় তাতে সারা শরীর শীতল হয়ে ওঠে অনিকেতের। মেয়েটির স্বামী ও একটি পুত্র সন্তান আছে। স্বামী একটি সরকারী স্কুলের শিক্ষক। মেয়েটিও প্রথমে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতো। যদিও বর্তমানে একমাত্র ছেলেকে ঠিকঠাক দেখাশোনার জন্য সে বাড়িতেই থাকতো। বড় সুখের সংসার ছিল তাদের! তাহলে মেয়েটিকে খুন হতে হল কেন? যতটূকু জানা যাচ্ছে তাতে পরিষ্কার মেয়েটির বিবাহ বহির্ভুত কিছু সম্পর্ক ছিল। ফেসবুকে আলাপ থেকে সেই সম্পর্ক আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে উঠতো। এখন মেয়েটির ফোনের কল লিস্ট ছাড়াও শেষ কয়েকদিনের ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার- হোয়াটসঅ্যাপও চেক করে দেখা হচ্ছে। যাতে কোন একটা সূত্র পুলিশের হাতে আসে।
অনিকেত বার বার নিজের মোবাইল ফোন চেক করলো। ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার- হোয়াটসঅ্যাপও ঘেটে দেখলো কিন্তু কোথাও স্নিগ্ধার সঙ্গে তাঁর এতদিনকার সম্পর্কের বিন্ধুমাত্র হদিশও সে পেল না! সব জায়গা থেকেই সব কিছুকে কে যেন পরম মমতায় মুছে দিয়েছে। স্নিগ্ধার সেদিনের রেগে যাওয়া এবং তাঁকে ‘ফোন–টোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার’, সবকিছু থেকেই মুছে ফেলার জন্য এই প্রথম অনিকেত মনে মনে খুব খুশিই হলো। পরের দিন সকাল হতেই সে বেরিয়ে পড়লো গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে! সেখানে শাড়ির আঁচল পেতে অধীর অপেক্ষায় বসে আছেন মা।