| 19 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

অন্য আলোয় দেখা শহর (পর্ব-৩)

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

বেশ কয়েক বছর আগের কথা।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি ।
একটু আগেআগেই বেরিয়ে গেছি ।
মধ্য মুম্বই এর মাহিমে একটি খুব বিখ্যাত বাঙালী মিষ্টির দোকান আছে , আমি যে অঞ্চলে থাকি সেখানে সেই সময় বাঙালী মিষ্টির দোকান ছিল না তাই বিশেষ কোনো দিনে বা পার্বণে অফিস ফেরৎ মাহিমের সেই দোকানটিতে যেতাম মিষ্টি কিনতে।
সেদিনও তেমনি মিষ্টি কেনাকাটা করে দেখলাম , লোকাল ট্রেনের অফিস টাইমের বাড়ি ফেরার ভিড় শুরু হতে এখনও বেশ সময় বাকি আছে ।
ভিড় বেশী হলে মুশকিল , ভিড়ের চাপে মিষ্টি গুঁড়ো হয়ে আবার ছানা হয়ে যাবে । কিন্তু এখনও রাশ আওয়ার শুরু হয়নি , ট্রেনে গেলে সময় অনেক কম লাগে , তাই কাছাকাছির দাদার স্টেশনে পৌছলাম। একখানি ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে প্লাটফর্মে, তাতে ধীরে সুস্থে চেপে বসলাম ।

খানিক পরে একজন ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রী ও বছর নয় দশের ছেলেকে নিয়ে সেই কম্পার্টমেন্টে উঠলেন । ।
চল্লিশের কাছাকাছি বয়স ভদ্রলোকের, লম্বা ক্ষয়াটে চেহারা , রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং। টেরিকটের ফুলশার্ট, ট্রাউজারে না গুঁজে পড়া । হাতা গোটানো।
স্ত্রী কে দেখে বেশ রুগ্ন মনে হলো । বাচ্ছা ছেলেটি আর স্ত্রী আমার পাশে এসে বসলো ।

ভদ্রলোক বাংলায় ছেলেকে বললেন ,
মাকে দেখিস , আমি পাশের কামরায় আছি ।
এই বলে লেডিস কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে চলে গেলেন।

তাঁতের শাড়ি , হাতে শাখাপলা আর সিঁথির সিঁদুরে ক্লান্ত অথচ ভারি মায়াময় ঘরোয়া চেহারা ভদ্রমহিলার । মধ্য ত্রিশ বয়স হবে ।

হঠাৎ চোখে পরলো , ভদ্রমহিলার হাতে একখানি প্লাস্টিকব্যাগ , ভেতরে কাগজপত্র।
কোচবিহারে যে শহরে আমি বড় হয়েছি , সেখানকার এক বিখ্যাত শাড়ির দোকানের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ।
মনে মনে ভাবলাম ,
আহা তার মানে আমার নিজের জায়গার সাথে এদের কোনো যোগাযোগ রয়েছে।
নিজে থেকেই আলাপ করলাম ।
ঠিকই ধরেছি এরা কোচবিহার থেকেই এসেছেন । একেবারে শহরের নয় তবে কাছাকাছি একটি জায়গার ।
আমি বাঙালী তায় আবার একেবারে ওনাদের জায়গার মানুষ জেনে বেশ খুশী ভদ্রমহিলা ।
কথায় কথায় জানতে পারলাম,
ভদ্রমহিলার নিজের চিকিৎসার জন্য এসেছেন মুম্বাইতে।

কয়েক দফায় চিকিৎসা চলছে, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এলেন। বাড়িতে ছেলেকে দেখার কেউ নেই , তাই তাকে নিয়েই বারবার আসতে হচ্ছে। স্বামীর ব্যবসা , তাও ক্ষতির মুখে পরছে তবু না এসে উপায় নেই ।
আগেরবার হসপিটালের কাছে একটি লজে ছিলেন , এবারে এক পরিচিত মানুষের বাড়িতে উঠেছেন। তাতে খরচ বাঁচছে খানিকটা ।

আগামী সপ্তাহে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে ।

টাটামেমোরিয়াল ক্যান্সার হসপিটালে।
কেমোথেরাপি শুরু হবে।

মনটা ভার হয়ে গেল । আহা সবে গড়ে ওঠা সংসার, তাতে কিনা এই রোগ থাবা বসিয়েছে।

ভদ্র মহিলা বলে চলেন,
– `জানো ভাই , খুব সাধ ছিলো বিয়ের পর বোম্বে বেড়াতে আসবো , বড় বড় তারকাদের বাড়ি দেখবো , অমিতাভ বচ্চন , শাহরুখ খান , ফিল্মের স্টুডিও দেখবো,তিনি বলেছিলেন দাঁড়াও ব্যবসা একটু দাঁড়াক তারপর যাবো।
সেই বোম্বে এলাম , দু দুবার , কিছুই দেখা হলো না ।
গলায় বিষন্নতা ঝরে পড়ে ।’

পরক্ষণেই গলায় আশা ভরিয়ে তুলে বলেন –
`ডাক্তার অবশ্য বলেছে, সুস্থ হতে আর খুব বেশী দিন লাগবে না ।
ফাইনাল চেক আপে আসবো যখন সেবার উনি বলেছেন গোটা বোম্বে শহর ঘুরিয়ে দেখাবেন।
পুজো দেব সিদ্ধিবিনায়ক মন্দিরে , এত বড় রোগ থেকে গণপতি আমায় বাঁচিয়ে তুলবেন, পুজো তো দিতেই হয় বলো । ’

শেষের দুটি লাইন খুব স্পষ্ট শুনতে পাই না আর , চলন্ত ট্রেনের শব্দ আর ওনার গলার হতাশায় ডুবে ক্ষীণ হয়ে যায় কথাগুলি।

প্যাকেট থেকে সন্দেশ বের করে দেই , ভদ্রমহিলা নেন না , বাচ্ছাটি নিতে লজ্জা পায় ।
ভদ্রমহিলা ছেলেকে বলেন
-`নে পিসি দিচ্ছে ।’
নিজে নেন না বলেন ,
-`তোমার দাদা আর আমি বাড়ি ফিরে একসাথে চা খাবো।’

কয়েক মুহুর্তের পরিচয়ে আমাকে সম্পর্কে বেঁধে নেন ।

এরপর আমার স্টেশন চলে আসে , আমি উঠে পড়ি ,
বলি,
– চলি , ভালো থাকবেন , খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

হঠাৎ করে মহিলা আমার দুটো হাত জড়িয়ে ধরেন,
মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন
– আমি ঠিক হয়ে যাবো বলো ? তোমার কি মনে হয়?
গলায় আকুলতা ।

মানুষ যখন আশা আর অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে যায় তখন সবখানেই আশার আলো খোঁজে। ভরসা খোঁজে।

আমি ডাক্তার নই, জ্যোতিষ নই, ওনার রোগের কোন স্টেজ তাও জানি না তবু জোর দিয়ে বিশ্বাসী গলায় বলি,

– নিশ্চয়ই , এখন সবাই সুস্থ হয়ে যায়। কত ভালো ট্রিটমেন্ট হয় আজকাল।

উনি বলে চলেন ,
– `আসলে আমি মা তো , ছেলেটাকে রেখে শান্তিতে যেতেও পারবো না গো ’

কিছুই বলতে পারি না , আমি নিজে মা , তাই মনে মনে ভাবি সত্যি মায়েরা বেঁচে থেকে সব রোগ জ্বালা কষ্ট সয়ে নেয় সন্তানের মুখ চেয়ে কিন্তু সন্তানকে ছেড়ে শান্তিতে মরতেও পারেনা ।

শুধু বলি ,

আপনি এবারেই একদম ঠিক হয়ে বাড়ি ফিরবেন । এরপর যখন মুম্বই বেড়াতে আসবেন ঠিক আপনার সাথে দেখা হবে আমার ।

আমি ট্রেন থেকে নেমে যাই।

হঠাৎ মনে হয়, এ বাবা ওনাকে তো বলা হলো না , ট্রেনে ক্যান্সার পেশেন্ট দের জন্য আলাদা কামরা থাকে তাতে ভিড় কম হয়। আরামে বসা যায়।
পরক্ষণেই মনে হয় যাক না বলে ভালোই হয়েছে , যে মানুষটি এত আশা বুকে বেঁধে রেখেছে তাকে নাই বা মনে করলাম যে সে একজন ক্যান্সার পেশেন্ট । উনি তো ভালো হয়েই যাবেন।

এরপর এতগুলি বছর কেটে গেছে।

কখনো আমার মনে পড়লে ভাবি হয়তো কোনোদিন এই জনসমুদ্রে ওদের সাথে মুম্বাই এর কোনো এক স্টেশনে দেখা হয়ে যাবে যেদিন ওরা তিনজন মিলে এই স্বপ্নের শহর ঘুরে দেখতে বেরিয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত