আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট 
বড়ই ছোট পৃথিবী তার। আগামুড়োয় যাই বলতেই শেষ। ক্লাস নাইনে ওঠা-বসায় নির্ভাবনা। সব ভাবনা ভাববে কেন সে? – হাত পা যেন এমনই খোলামেলাভাবে ছড়ানো।
এখন টানের দিন শুরু হয়েছে। সংসারের হাঁড়ীতে টান। বর্ষা যেন যেতেই চাইছে না। এমনই একটা দিনে তাদের পঞ্চম একক অভীক্ষা। দশ নম্বরের পরীক্ষা, মৌখিক নেওয়া হবে। একই দিনে সব বিষয়ের হেস্তনেস্ত। আলগা আলগা পড়াশুনার মজা সরস্বতীতে নম্বর পাইয়ে দিয়ে স্রোত বওয়ানোর চেষ্টা আর কি!
পরীক্ষা শুরু হলে সে বেতালাভাবে এই ক্লাসরুম ওই ক্লাসরুম করে বিভিন্ন বিষয়ের পরীক্ষা দেয় । শেষপর্যন্ত বাংলা দিদিমণির ঘাটে এসে ভেড়ে তার ডোবে-ডোবে নৌকো। একেই বর্ষা, তার উপর এই ভাদ্রমাসে নিম্নচাপের কারণে চারদিনের বৃষ্টির ছ্যাবলামো তার অসহ্য লাগছে।
– ” সালমা, তুমি ‘ফ্যান’ কবিতাটির দশ পংক্তি মুখস্থ বলো।”
সকালবেলা দাদি বললো – “পেনশনের টাকা শেষ। অথচ মাস শেষ হতে এখনো এগারো দিন বাকি।” একথা শুনেই মা খেপে উঠলো। যদিও তার কোনো কারণ ছিলো না।
– “চুপ করে আছো কেন, বলো?… কবিতাটা কি তুমি মুখস্থ করোনি?”
সালমার ঠোঁট বুড়বুড়ি কাটে। কাঁকড়ার ডিমের মতো কিছু ফেনা যেন দিদিমণির চোখে পড়ে।
…মাকে সে বলেছিলো, “মা আজ ইস্কুল যাবো। পরীক্ষা আছে। ভাত রাঁধবে না? ”
মা উত্তর দিয়েছিলো , “আমি কোন চুলোয় যাবো বলতে পারিস? – দেখে নে গা যা, কোথায় গিয়ে ফ্যান চাটবি!”
শব্দটা শুনেই মাগুর মাছের মতো তার মন ঘাই মেরে উঠেছিলো। দিদিমণি এই কবিতাটাই মুখস্থ ধরবেন বলেছিলেন যেন! কিন্তু তার তো ভালো মুখস্থ হয়নি! প্রত্যেক লাইনের প্রথম শব্দ বলে দিলে থুতড়িয়ে বলতে পারে হয়তো- ওই দু/এক লাইন। এখন এখনই দিদিমণির প্রশ্নেও কথাটা তার মনে ধাক্কা দিলো। আর তাতে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠলো সালমা। এই মুহূর্তে একটু ফ্যান পেলে সে সত্যিই হয়তো চেটে খেতো। তার ক্লাস নাইন বলে দিদিমণিদের তার খিদের কথা বলতে লজ্জা পায় সে। বললেই হয়তো মিড-ডে মিল থেকে একটু ভাতের ব্যবস্থা করে দেবেন, কিন্তু ভিখিরিপনায় কোথায় যেন তার বাধে।
পেটে দুটে ভাত পড়লে কবিতটার কিছু লাইন মনে উঁকি দিলেও দিতে পারে, কিন্তু এক কণাও খাবার সকাল থেকে না খেয়ে কিছুতেই তা সম্ভব নয়। জেদি ঘাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। চোখেমুখে ক্লান্তির পোঁচ। দিদিমণি বুঝেছেন যে, ছাত্রী কবিতা মুখস্থ করেনি।
-“তোমাদের একটাই কবিতা – তার থেকে দশটা লাইন পরীক্ষায় ধরবো বলেছি, তাও তোমরা করোনি? ” দিদিমণির গলা থেকে যেন আক্ষেপ ঝরে ঝরে পড়ে।
– আবার বলেন, “ঠিক আছে, কবিতা থাক। “পরিবেশ দূষণ” গদ্যটা বাড়ীতে পড়েছ তো একটু? -” উত্তর নেই।
ছাত্রীর শুকনো মুখ দিদিমণির মনে কিছু যেন প্রতিক্রিয়া তৈরী করে।
-” বলো, দূষিত পরিবেশ বলতে কী বোঝায়?”
জানি দিদিমণি, জানি। – মনে মনে বলে সালমা। আমাদের বাড়ী যাবেন, দেখবেন কাকে বলে দূষিত পরিবেশ। সকালে মা-দাদির তরজা চলছে, তার দিদি তখন সর্ণা দিয়ে নিখুঁত করে জাগিয়ে তুলছে ভুরু। “কোন্ নাগরের সঙ্গে যাবি লো, ছেমরি?”… মা দিদিকেও ছাড়লো না। তারপর কপাল-মাথা চাপড়ে দাওয়ায় থপাস করে বসতে গিয়ে ফাঁসলো মায়ের পিছনের দিকের কাপড়। কাউকে ছাড়বে না সে রায়বাঘিনী। দিদাকে, দিদিকে, তাকে সে আঁচড়েছে কামড়েছে কথায়, অশ্লীল শব্দে।
দিদিমণি তাড়া দিচ্ছেন, “এই যে,সালমা খাতুন! তুমি কি বোবা? কথা বলতে পারছো না?”
নিরুত্তর সালমা জেরবার – জেরবার। এদিকে দিদিমণির আরও অনেকের পরীক্ষা নেওয়া বাকি। এমন বোবা মেয়েকে সামনে দাঁড় করিয়ে সময় নষ্ট করার মানে হয় কোনো? তবু আরও একটু সুযোগ দিতে চান তিনি। – “ঠিক আছে, অন্য প্রশ্নের উত্তর দাও।”
কথার পিঠে কথায় কীভাবে উত্তর দিতে হয় সালমা ভালো করেই জানে। মন-মেজাজ ভালো থাকলে পেছনের বেঞ্চের মেয়েদের সঙ্গে সেও মজা করতে পারে। দিদিমণি কী জিগ্যেস করছেন দেখা যাক। সে চোখ স্থির রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন মজা পাচ্ছে! বাংলা দিদিমণি বলছেন,
– “বলো তো সালমা, সমুদ্রের জল কীভাবে দূষিত হয়?”
মুহূর্তে নরম হয়ে আসে সালমার চোখের দৃষ্টি।
সমুদ্র? তাদের পাড়ার আমিনা আর ওর ভাই সাজাদ ওদের আব্বার সাথে দীঘা গিয়েছিল বেড়াতে। গ্রাম থেকে মঞ্জুর সাহেব বাস ছেড়েছিল। অনেকেই গিয়েছিল। আমিনা ইস্কুল আসার সময় সমুদ্রের গল্প বলেছিল। জল – আর জল! ঢেউ – আর ঢেউ! আকাশ নাকি সমুদ্রে মিশে থাকে। আর কী বাতাস কী বাতাস! মনে মনে সে-ও চলে গিয়েছিল সমুদ্দুরে। যেন শুনতেও পেয়ে গিয়েছিল সমুদ্দুরের গর্জন।
বড়ো শখ তার সমুদ্দুর দেখতে যাবার। তার তো আর বাবা নেই যে তাদের বেড়াতে নিয়ে যাবে দীঘা? একটা ভাই-ও না, দাদাও না। শুধু দাদি, মা, দিদি আর সে। চারজন মেয়ে। ও’ পাড়ার খালেদ ভাই রোজ বিকেলে পাড়ায় আসে। দিদির সঙ্গে চোখ মটকে হাসে। তখন দিদির চোখে দুরন্ত বাতাস ছটফট করে। খালেদভাই কি দিদিকে সমুদ্দুর দেখাতে চায়? তাদের কি শুধু সমুদ্দুরের গল্প?
হঠাৎ চিন্তার পর্দা ছিঁড়ে যেন বহুদূর থেকে ভেঙে ভেঙে কতকগুলো শব্দ ভেসে আসছে। সম্বিতও ফিরে আসে। বুঝতে পারে দিদিমণি বলছেন –
– “বলো, কী কী ভাবে সমুদ্রের জল দূষিত হয়ে থাকে?”
মনে পড়ে সালমার, ক্লাসে দিদিমণি যেন জাহাজের কথা বলেছিলেন। বড়ো বড়ো তেল বওয়া জাহাজ থেকে নাকি তেল ছড়িয়ে পড়ে অনেক সময় সমুদ্রের জলে। সে কখনও জাহাজ দেখেনি। খুব ইচ্ছা চেতায় তার মনে। অস্ফুটে জাহাজ শব্দটা মুখ থেকে বের হয়ে যায় অজান্তে। দিদিমণি অমনি লাফিয়ে ওঠেন। আশা জেগে ওঠে,
– “বলো বলো, যা বলছো -… ” যেন কুংফু-জুডোর রিঙের ভেতর রিঙমাস্টার লাফিয়ে পড়েছেন।
দিদিমণির হঠাৎ অমন জোস এলো কেন সে বুঝতে পারে না। একটু অবাক হয় সে। সত্যি সত্যিই জাহাজের তেল কি দূষণের কারণ ? কে জানে? কী কী কারণে দূষণ হয়? বইটা তো পড়ে মাঝে মাঝে। কিন্তু কিছুই তার মনে থাকে না। খুব খিদে পেলে শুয়ে শুয়ে পা নাচায়। তার মনে হয় কোথাও একটা চলে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে? রায়পুকুরে গিয়ে অনেক সময় জলে গা ডুবিয়ে বসে থাকে। পুরো পুকুর ফাঁকা। হয়তো কেউ ঘাটেও নেই। উঁচু পাড়ে কিছু তালগাছ, এক কোণে একটা শ্যাওড়া গাছ। তাদের ছায়া পড়েছে শান্ত গভীর জলে। সাঁতরে সে সেই ছায়ার ভেতর ঢুকে পড়ে। মাঝে মাঝে জলে ডুবে সেই ছায়াকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু ধরতে পারে না। শুধু উপর থেকে হালকা আলোর আভাস টের পায়। তাতেকিছু দেখা যায় না। কোনো উষ্ণতাও নেই সেই আলোর। কিন্তু তার ভালো লাগে। চিৎ হয়ে ভেসে থাকে জলে। পাড় ভেদ করে বাইরেটায় চোখ যায় না। তখন কী নির্জন সব। সে তখন কত একা! এক্কেবারে একা! ভয় লেগে যায়, এত একা থাকা বেশিক্ষণ সহ্য হয় না তার। তখন উঠে আসে জল থেকে। এছাড়া কোথায়ই বা তার যাবার জায়গা আছে? গেলেই খেতে পাবে কি? তার মা হিন্দু পাড়ায় কাজ খুঁজতে গিয়েছিল বাড়ীতে ঝগড়াঝাঁটি করে। ফিরে এলো হাঁড়ি মুখে। মা বলল, “মুসলমান মেয়েকে গ্রামে কে কাজ দেবে, বাছা?”
সালমার বুক থেকেও বেড়িযে আসে দীর্ঘশ্বাস। সে চলে এসেছে ইস্কুলে। মাঝদুপুর পার, সে শুধু এ ক্লাসরুম ও ক্লাসরুম ঘুরেছে। কী শিখেছে এই দেড়-দু’মাসে তারই পরীক্ষা আজ।
দিদিমণি একটার পর একটা প্রশ্ন করেন, তাকে কথা বলার অবস্থায় নিয়ে আসতে চান। সালমা খাতুন মনে মনে বলে চলে কথা। সে জানে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ নেই বললেই চলে। না-হলে কেন তার দমবন্ধ লাগে? সে জানে মাটি দূষণ কী। কিন্তু কারণগুলো গুছিয়ে বলবার ক্ষমতা নেই তার। থাকবার দরকারই বা কী? তাদের জমি নেই, মাটি নেই। তাই দূষিত হলেই কী আসে তার? তাদের ঘরের খোড়ো চাল উড়ে গেল কালবৈশাখীতে। বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় দাওয়ার মাটি গলে গর্ত গর্ত হয়ে গেল। মাটিকে বৃষ্টির জল কীভাবে ক্ষইয়ে দেয় সে জানে। শুধু তার প্রতিকার সে জানে না।
দিদিমণি শেষ প্রশ্নের দিকে এগোন এবার।
– “আর সময় দেওয়া যাচ্ছে না, সালমা। এটাই শেষ প্রশ্ন। বলতে পারো কিনা দেখো, বসুন্ধরা শীর্ষ বৈঠক কবে কোথায় হয়েছিল?”
বসুন্ধরা মানে তো পৃথিবী। পৃথিবী কি খুব বড়ো?… কত বড়ো?… শীর্ষ বৈঠক কেমন জিনিস সে জানে না। তবে এটা সে জানে- পৃথিবী কাকে বলে। আগামুড়োয় বড়োজোর পনের হাত। শুধু খুব খিদে পেলে সে তার ঠাহর পায় না।
– “একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিলে না তুমি। উত্তর দেওয়া দূরে থাক, মুখে কুলুপ এঁটে থাকলে। কী হয়েছে তোমার, সালমা? মুখটা শুকিয়ে আছে কেন? বাড়ী থেকে খেয়ে এসেছিলে? ”
দিদিমণির নরম কথাগুলো শুনতে শুনতে সালমার চোখে এতক্ষণে একটা নোনা সমুদ্র ঘনিয়ে আসে। ঠোঁট কেঁপে ওঠে। অচেতন হয়ে পড়ে যেতে যেতে তার ছোট্ট পৃথিবী মুছে যায় তার চোখ থেকে।

পূর্ব বর্ধমানের দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের অজ পাড়াগাঁয়ের ধুলোবালিতে জীবনের অনেকটা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। শিক্ষকতার বৃত্তি। কবিতা প্রথম প্রেম। প্রকাশিত কবিতার বই এখনও পাঁচটি। গদ্যের বই তিনটি গদ্যগ্রন্থের মধ্যে ‘দক্ষিণ দামোদর জনপদ’ উপন্যাস, যেটি সাম্প্রতিক কালে ‘সাজি’ পত্রিকা কর্তৃক অজিত রায় স্মৃতি সম্মাননা লাভ করেছে।
bhison sundar