আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
বাইরে প্রবল প্রলয়। দেবদারু, জাম গাছের ডালপালা উলোট পালোট করা ঝড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে বুক। অফিসের কোয়ার্টারে একাই থাকে নিশিথ। একটাই ঘর।চৌকি,এক কুঁজো জল।একটা টেবিল,সাথে কিছু বই।এই তার সংসার। বিছানায় শুয়ে বই পড়ছে নিশিথ,ব্যাটারির আলোয়;না পর্যাপ্ত আলো নয় ঠিকই,তারুন্যের চোখের জ্যোতি সামলে নিচ্ছে।রহস্য তার পছন্দের।বাইরের ঝড়ের ঝাপটায় কেঁপে উঠছে টিনের চাল।এমন ঝড় এযাবৎ কালে হয়নি। তবে ভয় পাওয়ার বান্দা সে নয়।
কোনো অন্য শব্দ নয়,শুধুই মড়মড় করছে। অকস্মাৎ আধখোলা দরজা দিয়ে,দুটো ছায়া,বেশ লম্বা,চওড়া কম,ঘরে ঢুকলো। অন্ধকারের যদি অবয়ব হয়,এটা ঠিক তেমন। ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।ঘরের মধ্যিখানে দাঁড়ালো। কিছু বলতে চাইছে।মুখ বলে কিছু নেই শুধু অন্ধকার গহ্বরের মতো শূণ্য কিছু একটা।সাহসী নিশিথ শুকিয়ে যাচ্ছে কি! কিন্তু সে স্থির। এগিয়ে আসতে আসতে,খুব কাছে মূর্তি দুটি। যেন নিজেদের মধ্যে গভীর কোনো আলোচনা করছে। একবার মনে হলো যেন বসবার ভঙ্গিমায় চৌকিতে! এবার ওকে মধ্যিখানে রেখে চক্রাকারে ঘুড়ছে ওরা। নিশিথ যেন ভয়ে ফুরিয়ে আসছে।কাউকে কি ডাকবে সে! কিন্তু ওর ডাকে সাড়া দেবে না কেউ,এখন।’এরা কি তবে,অন্যলোকের!’যে লোকের সাথে ওর কোনো সংযোগ হওয়া অসম্ভব। এরাই কি তবে সূক্ষ্ম দেহী অশরীরী। এদেরও কি মুক্তি হয় নি,নাকি হয়েছে,অপার শান্তি লোকের নাগরিক এরা।ওকে কি নিয়ে যেতে এসেছে,লোকান্তরে!মুক্তি না পাওয়ার কষ্ট নিশিথ বোধহয় জানে কি?
চোখে আলো পড়লো যেন।ধড়পড় করে উঠে বসলো বিছানায় নিশিথ। ভয়ার্ত হৃদপিন্ড যেন ছুটি চায়,ভয়ে জড়সড়। সেঁধিয়ে গিয়েছে পাঁজরের কোনো কোণায়। ‘স্বপ্ন এমনও হয় নাকি?বিদঘুটে স্বপ্ন! বাপের জন্মে এত ভয় পাই নি,উফ!’খাটের ডানপাশে ছোটো টেবিলটায় হাত বাড়ায়,কিছু অন্যমনস্ক হয়েই। গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে আছে। শূন্যে হাতটা ঘুরপাক খায়।’একি,ঠিক মনে আছে, এখানেই তো রাখি জলের বোতল টা,গেলো কই? ‘ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় চোখ কচলে। ‘একি টেবিলটা কই?বই র্যাক? বিছানার চাদর টা নেই!এই রঙেরই ছিলো?’ নাঃ এ রঙ তো তার না পসন্দ্! ঘরের রঙটাও তো ঠিক!আলমারি টা কোথায় গেলো? যতদূর মনে পড়ছে,দরজার বাঁ পাশেই ছিলো আয়না!
আমার কি স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে? ডাক্তার দেখানো উচিৎ? সুতপাও বলে না,তুমি বড্ড আনমনা! কিন্তু কে সুতপা? হঠাৎ এ নাম কোথা থেকে মাথায় এলো? কেন কিছু মনে পড়ছে না,ঠিক ঠাক।’সবকিছু ধুমায়িত লাগছে ওর।’মা,মা কই..’খুব অসহায় লাগছে ওর।কষ্ট, বলে বোঝানোর নয়।অদ্ভুত একটা পরিচিতি সংকটে নিভে আসছে নিশিথ।ছিটকে বেরোয় ঘর থেকে।ওর শোবার থেকে বেরিয়েই ডাইনিং স্পেস কাম হল।’কিন্তু পাথরের ফায়ার প্লেস টা কোথা থেকে এলো।’কোন মিস্ত্রি পাথরের ওপর গ্রিক মূর্তি খোদাই করলো? মা কবে করালো,আমি জানলাম না? আমি কি অসুস্থ ছিলাম,কোনো দুর্ঘটনায় কোমায় ছিলাম।সব কিছু অচেনা লাগছে কেন?এ বাড়ি কার? উফফ এত শীত কেন? মা, মা ‘চিৎকার করছে নিশিথ।কিছু পর,সুদৃশ্য কিচেনের দরজা খুলে,বেরিয়ে এলেন,বছর তিরিশের এক মহিলা।টকটকে গায়ের রঙ।দীর্ঘদেহী ভদ্র মহিলা।পিছন পিছন দুটি ফুটফুটে মেয়ে,ততোধিক উজ্জ্বল বর্ণ।’এঁরা কারা? নির্ঘাত বিদেশি,ইউরোপিয়ান তো বটেই!আমার অজান্তে মা কাদের বাড়িতে এনে জুটিয়েছে? মা ছাড়া আর কে কে থাকে আমার সাথে?’সমস্ত নৈমিত্তিক স্মৃতির পুরো ফাইলটাই উড়ে যেতে বসেছে মন থেকে।ভদ্রমহিলার সামনে গিয়ে চিৎকার করছে নিশিথ।’হু আর ইউ? হ্যোয়ার আর ইউ কামিং ফ্রম?’বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলেন না মহিলা।যেন নিশিথের স্বর পৌঁছালোই না ওঁর কান পর্যন্ত! যে ঘর থেকে নিশিথ বেরিয়েছিল,একটু আগে, ভদ্রমহিলা সেই ঘরে ঢুকলেন,খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমা। নিশিথও ছুটলো।পিছনে।আফটার অল,একজন অপরিচিত, তাও এই বয়সী মহিলা হুটপাট শোবার ঘরে ঢুকে পড়বেন,কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে,এ কেমন কথা!’ঘরে ঢুকে নিশিথ যা দেখলো,তা না দেখলেই ভালো হত কি? যে বিছানা ত্যাগ করে নিশিথ উঠে এসেছিলো,সেখানে খুব নিশ্চিন্তে এলোমেলো ভাবে অন্য কেউ।গভীর ঘুমে।নিশিথেরই বয়সী,তবে কিছুটা লম্বা।আর ইউরোপিয়ান এ আর বলে দিতে হয় না।নিশিথের খুব কান্না আসছে।এ কী হচ্ছে ওর সাথে।মা কে মনে পড়ছে।কিন্তু মা এর মুখটা নয়,একটা অনুভূতি বোধ হচ্ছে। কী মনে হতে অকস্মাৎ ঘরের কোণে রাখা আয়নায় সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নিশিথ।ভদ্রমহিলা ছেলেটির কপালে চুমু খেয়ে ঘুম ভাঙাচ্ছে।নিশিথকে খেয়ালই করছে না।ছেলেটি চোখ খুলেই মেয়েটির পেটে আলতো চুমু খেলো।এতক্ষন লক্ষ্য করে নি নিশিথ,মেয়েটি সন্তান সম্ভবা।স্ফিত উদর সে ইঙ্গিতবহ। আয়নায় চোখ রাখে নিশিথ।চমকানোর চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার পালা। আয়নার প্রতিবিম্বে,নিশিথ নয়,ভেসে উঠেছে একটা ভ্রুণ।মাস ছয়েকের এক মানব ভ্রূণ।রক্ত মাংসের সজীব এক মানব চিহ্ন।এ কী দেখছে ও।তবে কী?তবে কি ও,ওর সমগ্র অস্তিত্ব,কালের চক্রব্যূহে, সময়-সরণির অন্ধগলির গোলক ধাঁধায় হারিয়ে যেতে বসেছে ক্রমশ?’এও কি সম্ভব?’
ছিটকে বাড়ির বাইরে আসে নিশিথ।বাড়ির সামনে এশীয় কোনো ঘিঞ্জি গলি তো নেই।কার্পেট এর মতো যত্নে লালিত একটা মাঠ।সেখানে অনেক বাচ্চারা খেলছে।আকাশ টা খুব নীল।সচরাচর এত নীল আকাশ কি দেখেছে নিশিথ! পরিচিতি সংকটের,সত্য আমি, মিথ্যে আমির এক অদৃশ্য লুকোচুরি খেলায় হাঁপিয়ে উঠছে নিশিথ।’আর পারছি না!’ইহলোক পরলোকের মধ্যিখানে ত্রিশঙ্কু হয়ে আছে কি সে?হাজারো অস্বস্তি তে অস্থির হচ্ছে মন।
‘আচ্ছা,এমনও তো হতেই পারে,কোনো স্বপ্নই দেখছি!’তাড়াতাড়ি চোখ বন্ধ করে নেয় নিশিথ। ছয় মাস পরে ওর ঘুম ভেঙেছিলো বোধহয়,ঘর আলো করে!
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর।বর্তমানে পেশাগত ভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। ভালোবাসেন পড়তে।চেষ্টা করেন লিখতে।বেশি ভালোবাসেন হারিয়ে যেতে,যদি খুঁজে পাওয়া যায় কবিতা।