| 28 মার্চ 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

করোনার ঢেউ

আনুমানিক পঠনকাল: 10 মিনিট

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

নিত্যদিনের আহার্য সংগ্রহের পাশাপাশি  জীবনযাপনের আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ সংক্রান্ত ভাবনারাশি মাথায় জড়ো হলে আব্দুল বাতেন প্রতিদিনই শ্রম বেচতে যাওয়ার তাড়না অনুভব করে।এ অনুভূতির নিচে লুকিয়ে থাকে দিনযাপনের নানাবিধ ঘর্মাক্ত ক্লেদ, গ্লানি। সময়কে খুব দ্রুত এগিয়ে নিয়ে সামনে বসে থাকা কাঙ্খিত কিছু পাওয়া বা পেছনে রেখে আসা অতৃপ্তি আর অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে বর্তমানের প্রতিটি ক্ষণকে উৎরে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা । তার সহযাত্রী মোখলেছ এমনই ভাবে, ভাবে সহযাত্রী আলাউদ্দীন আর ফকির আলীও। তাই হয়তো নিজেদের অসুখ, যন্ত্রণা, ক্ষুধা আর নিয়তির নির্মম পরিহাসগুলো তাদের কথাবার্তায় প্রায়ই ওঠে আসে। তখন হয়তো তারা নিজেদেরকে আবিষ্কার করে শূন্যে ভেসে থাকা অবস্থায়। এর ফলে তারা আতঙ্কিত হয়, ভীত হয় আর নিজেদের অক্ষমতাগুলো আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়ে বিদীর্ণ হয় নির্মমভাবে। তখন সমব্যথী হয়ে একে অপরকে সান্তনা দেয়ার বদলে বরং অন্যের চেহারায় নিজের চেহারার বিকৃত রূপ ফুটে উঠতে দেখে নির্বাক হয়ে পড়ে। এই মৌনতার সাথে চুন, জর্দা সমেত গালভর্তি পান আর নাসির গোল্ড বা সস্তা দামের অন্য সিগারেটের রসায়ন তৈরি হয়। চারজনে চারটি সিগারেট কিংবা কখনও একটি বা দুটি সিগারেট চারজনে ভাগ করে  ফুঁকে ধোঁয়ার যে কুণ্ডলী   তৈরি করে তা ভেদ করে পা এগিয়ে দেয় পাকা সড়কের দিকে যেখান থেকে সিএনজি অটোরিক্সা বা লেগুনায় চড়ে তারা চলে যাবে শহরে।

সূর্যোদয়ের অব্যবহিত পরের সময়ের সাথে মিতালী পাতার পর বহুদিন গড়িয়েছে।বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ফলে তার সামনে বিকল্প নানা সম্ভাবনা হাজির হলেও সেগুলোর একটিও গ্রহণ করতে না পারার কারণে সে সরলরৈখিক পথ থেকে নেমে আসতে পারেনি। তার এ পথে সূর্যের আলো নিয়ত প্রতিফলিত হয়েছে, রাতের অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে থোকায় থোকায় বসে থেকেছে, শীতের হিমেল হাওয়া বয়ে গেছে , বর্ষার পানি প্রবাহিত হয়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। কিন্তু তার চোখে পড়ে না অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় কোন চুক্তি বা মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ লিখিত ভাষ্য। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক বা  আইএমএফ এর উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত নানান রূপরেখা ও নীতি নির্ধারণে ব্যবহৃত কূটনৈতিক শব্দসমূহের ঘোরানো অর্থ তাকে দূরে ঠেলে রেখেছে বা তার সামনে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে। মোখলেছ, আলাউদ্দীন এবং ফকির আলীও তার সাথে এ ধোঁয়াশার ভেতরে থেকে আশা নিরাশার দোলাচলে দোলতে দোলতে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। ফলে ভোরবেলায় যৌথ পথচলায় প্রকৃতির মেলে ধরা মায়াবী স্নিগ্ধতা বা এদিক-ওদিক থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক বা চেখেমুখে লাগা মোলায়েম বাতাস আব্দুল বাতেন বা তার সঙ্গীদের কাছে ভিন্ন কোন তাৎপর্য নিয়ে আসে না।

প্রকৃতির এসব মনোলোভা আয়োজন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে  পেছনে পড়ে থাকে যখন আব্দুল বাতেন চাল, ডাল, মাছ, শুটকী বা শাক-সবজী সংগ্রহের নিমিত্তে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে।এটাই একটা পাটাতন নির্মাণ করে যেটা ভঙ্গুর হলেও অন্তত দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়। তাই চাল, ডাল, পেঁয়াজ বা অন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়ে তার ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেলে, তাতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য সম্পর্কে বিভিন্ন কথাবার্তা শোনা গেলেও, এসব তার আয়ত্ত এবং জানাশোনার বাইরে বলে সে  এ বিষয়ে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে  বরং এগুলো কিনতে পারার জটিলতা নিয়ে চিন্তামগ্ন হয়। চলমানতার সাথে  তৈরি হওয়া বৈপরিত্যের কারণে ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে গেলে তার চেহারায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ ঘনীভূত হয়। অবশ্য রাতে স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করতে এগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আগের মতো শরীরের প্রতিটা কোষ আলোড়িত না হলেও অভ্যাসবশত স্ত্রীকে কাছে টেনে নেয়, তা না হলে যেন অতৃপ্তিজনিত একটা বোধ  থেকে যায়। 

কিন্তু আব্দুল বাতেন এখন সম্পূর্ণ অননুমেয়, জটিল, দুঃসহ এক অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।জীবনের সাথে দ্বন্দ্বে মেতে উঠেছে জীবিকা। এটা তার অভিজ্ঞতায় যেমন নেই তেমনি নেই প্রায় সমবয়সী  মোখলেছ, আলাউদ্দীন বা ফকির আলীরও। এমনকি সময়, মানুষ ,সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে যারা প্রবীণত্ব লাভ করেছেন তাদের স্মৃতিতেও এরকম কোন বাস্তবতার ছবি ফুটে ওঠে না। তাই  অনিশ্চয়তা নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠলে সকলের মনে আতঙ্ক ঘনীভূত হয় আর ঘরবন্দি থাকার সময়টাকে করে তোলে আরও অসহনীয়। আয়হীন হয়ে থাকার সময়টা আর কত দীর্ঘ হবেএরকম প্রশ্ন সকলের মতো তার মনের ভেতর ঘুরঘুর করলেও কোন উত্তর আসে না।প্রশ্ন জিজ্ঞাসা ও উত্তর খোঁজার চেষ্টার মাঝে বরং ঢুকে পড়ে তার নাগালের আওতার সীমাবদ্ধতা আর অসহায়তার বোধ।

এতদিন ধরে ঘরে বসে থেকে থেকে  সে কেবল তার আশেপাশে  শূন্যতার প্রসারতা অনুভব করেছে। হাতের টাকা  শেষ হওয়ার মাধ্যমে সেই কবেই শূন্যতার পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। কতই বা আর হাতে থাকে। কাজ করে দিন শেষে পুরাতন বা নতুন যে ধরনের নোটই আসুক না কেন এগুলো পাওয়ার তৃপ্তি মেলাতে না মেলাতেই দ্রুত চলে যায় মাছ বা সবজির বাজারে কিংবা আশ্রয় খোঁজে নেয় মুদি দোকানের টাকা রাখার ড্রয়ারে। এসবের ফাঁক গলে অল্প যে কয়টি টাকা শেষ পর্যন্ত রয়ে যায় সেগুলো টুকটুাক খরচ আর কাজহীন দিনের চাহিদা মেটাতে চলে যায়।তাই হয়তো সঞ্চয় সংক্রান্ত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের স্কিম তার কাছে কোনদিনই পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। ব্যাংকে একটা সঞ্চয়ী আ্যকাউন্ট আছে বটে- কোন এক ভাতা পাওয়ার জন্য মেম্বারের পরামর্শমতো খুলেছিলঐ পর্যন্তইভাতাও পাওয়া হয়নি অ্যাকাউন্টেরও আর দরকার পড়েনি।পরে আকাউন্ট খুলতে যে কিছু টাকা বেরিয়ে যায় তার জন্য আফসোস করেছে। তাই এ সময়ে যখন অনেকেই নিজের জমানো টাকার উপর আপাত নির্ভরতা খোঁজে নিচ্ছে তখন তাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের উপর উদাস দৃষ্টি মেলে রেখে দিন কাটাতে হচ্ছে।

আব্দুল বাতেনের এখন একমাত্র ভরসা হলো সরকারি বা বেসরকারি পর্যায় থেকে প্রাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সংক্রান্ত  সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করেই আরও অনেকের মতো সে-ও মানুষের জটলার অংশ হয়ে যায়  চাল-ডাল ভর্তি একটি ব্যাগ পাওয়ার আশায়।ঘরের দাওয়ায় বসে বা বাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা পাকা সড়কের ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে যখন তার মাথায় পেটে খাবার দেয়ার চিন্তা জড়ো হয় তখন চোখ ঐ ধরনের ব্যাগগুলোর উপর ঘুরে আসে। ব্যাগে যে পরিমাণ খাবারই থাকুক না কেন, এই বিপদের সময়ে এগুলো যে পেয়েছে তা-ই তো অনেক। যদি তা-ও না পাওয়া যেত তাহলে ইতোমধ্যে কয়েক বেলা উপোস থেকে ক্ষুধার যে যন্ত্রণা তারা সম্মিলিতভাবে ভোগ করেছে তা নিশ্চয় আরও দীর্ঘ হতো। প্রাপ্ত খাদ্যের মান নিয়েও তার মনে কোনও প্রশ্ন ওঠে না এ কারণেই। অনেকের মাঝে যে খাবার দেয়ার আন্তরিকতার চেয়ে নানান ভঙ্গিতে ছবি তোলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মপ্রচারের প্রবল আকাঙ্খা থাকে তা-ও তার চোখ এড়িয়ে যায়। ক্ষুধার্তের কাছে খাবার ছাড়া আর কি-ই বা চেখে পড়বে? এছাড়া বিভিন্ন ব্রান্ডের নানা ধরণের স্মার্ট ফোন, এগুলোতে থাকা ক্যামেরার পিক্সেলের রকমফের, ফেসবুক ইত্যাদি তার জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু হিসেবে তাকে কখনো ভাবায়নি ।  যোগাযোগের জন্য কেবল একটি মোবাইল ফোনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হলে তার সাথে কাজ করা এক শহুরে শ্রমিকের কাছ থেকে কম দামে একটি পুরনো চাইনিজ সেট কিনেছিল। পরে তিনবার ঠিক করতে হলেও এটা দিয়েই তার চলে যায়।

টর্চ লাইট, চার্জ লাইট বা এরকম প্রয়োজনীয় আরও কিছু জিনিস যেগুলো চাইনিজ বলে সে, মোখলেছ, আলাউদ্দীন বা ফকির আলী সস্তায় কিনতে পারে। তবে চীনে উৎপন্ন  নতুন ভাইরাসটি যে সস্তা নয় তা আর কারও বুঝতে বাকি নাই।সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের খবরে তো আছেই। এছাড়া দিনে কয়েকবার মাইকিং হয় এর ভয়বহতা বর্ণনা করে। শুধু এ দেশেই মানুষ মরছে না , সারাবিশ্বেই হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে  এর থাবায়। এই যে কর্মহীন হয়ে তার ঘরে বসে থাকা তা তো এই ভয়ংকর ভাইরাসের কারণেই। লোকজনের চলাফেরা কমে গেছে, কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, ব্যবসাপাতি বন্ধ হয়ে গেছে, গাড়ির চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে এর কারণেই । পৃথিবীর সব দেশ ও অঞ্চলে নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। বিভিন্ন কৌশলে সাজানো আমেরিকার যুদ্ধায়োজন থেমে গেছে, বাণিজ্য বিষয়ে বিভিন্ন্ দেশ ও সংস্থার শলা-পরামর্শ ও কূটকৌশল মন্থর হয়ে গেছে, বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজারে বিরাজ করছে বিনিয়োগকারীদের তীব্র হাহাকার, দামী হোটেল ও  রেস্তোঁরাগুলোর আলো ঝলোমলো পরিবেশের বদলে বিরাজ করছে নিবিড় শূন্যতা।

তার মতো মোখলেছ, আলাউদ্দীন বা ফকির আলীও জেলরোডের মাথায় গিয়ে কাজ পাওয়ার আশায় বসে থাকতে পারে না। কলেজ রোডের মোড়ে বা শিশুপার্কের গেটের পাশে যারা তাদেরই  মতো কোদাল, ঝুড়ি হাতে নিয়ে দিনশেষে দ্রুত পারিশ্রমিক পাওয়ার আশা নিয়ে সকালের শহুরে নীরবতাকে সঙ্গী করে বসে থাকত তারাও এখন নিজেদের বসবাসের চৌহদ্দীতে আটকে থাকছে।আটকে থাকছে অফিস, আদালত, কারখানাতে কাজ করা লোকজন। এখন বিরোধী দল কিংবা পরিবহন শ্রমিক বা মালিকদের ডাকা কোন ধর্মঘট  নেই তবু রাস্তায় নামছে না গাড়ি। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে যেগুলো রাস্তায় নামে সেগুলো চলে জরিমানা ও মামলার ভয় সাথে নিয়ে।

একদিন খাবার শেষ হয়ে গেলে আব্দুল বাতেন চলাচলের বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে গ্রামের বাজারে যায়। ক্ষুধার্ত পেটে কত আর বসে থাকা যায়? বাজারের মতিন খানের মুদি দোকানের দীর্ঘ দিনের ক্রেতা সে।শহর থেকে কেনাকাটা করে না আসলে এ দোকানেই সাধারণত ঢুকে। ছোট এই বাজারের সব দোকানদার পরিচিত হলেও এখান থেকে জিনিসপত্র কিনতেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। টাকা না থাকলে কখনও কখনও বাকিতে জিনিস কিনে। তাই পকেট ফাঁকা  হলেও শূন্য পেটের চাহিদা মেটাতে সে মইন খানের দ্বারস্ত হয়- কিছু চাউল, ডাইল আর আলু নিমু। ট্যাকা পরে দিলে অইবনি ?

বাকিতে এখন কিছু বেচি না।

আমার ত এখন কোন রোজগার নাই। ঘরে খাওনও নাই।

আমি ট্যাকা ছাড়া বেচতাম না। অইন্য দোকানে খোঁজ কইর‌্যা দেখ।

আব্দুল বাতেন অতীতে জিনিস কিনে টাকা পরিশোধের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আরও কয়েকবার অনুরোধ করলেও মতিন খান নিজের কথায় অটল থাকে ।তাই সে আশা নিরাশায় দুলে অন্য দোকানগুলোতেও একে একে  খোঁজ  নেয়। কিন্তু সবাই-ই মইন খানের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে বলে সব দোকান থেকেই তাকে খালি হাতে  বেরিয়ে আসতে হয়। ভাইরাসজনিত রোগের থাবায় সবকিছু এখন অনিশ্চিত, সবচেয়ে বড় কথা জীবনই যেখানে অনিশ্চিত- রোগে ধরলে বাঁচা মরার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়অনেকে সেরে উঠলেও মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে-সেখানে ঝুঁকি এড়িয়ে নগদ টাকা ছাড়া কিছু বিক্রি করাটা অস্বাভাবিক নয় হয়তো। বাজার থেকে ভগ্নমনে বের হতে হতে তাই কারো কাছে টাকা পাবে কিনা এ নিয়ে ভাবতে থাকে।কিন্তু মাথায় আসতে থাকা ভাবনাগুলো নিজেই আবার বাতিল করে দেয়। যাদের নাম মাথায় আসে তাদের অনেকেই হয়তো এখন তার মতোই হন্য হয়ে খাবার খোঁজছে। যাদের হাতে টাকা আছে তারাই বা দিবে কেন? এখন চলতে পারলেও কাজ ও আয়ের আপাতত কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বলে কিছুদিন পর কি হবে তা নিয়ে আশংকা থেকেই যাচ্ছে। ফলে সবারই নিজের সম্বলটুকু আঁকড়ে ধরে থাকার কথা। এসব যুক্তি তার মাথায় আসছে বটে কিন্তু ক্ষুধার কাছে সেগুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে।  তাই কয়েকজনের কাছে যায় ধার পাওয়ার আশা নিয়ে । কিন্তু তার অনুমান মতোই সবাই অপারগতা প্রকাশ করলে শূন্য হাতেই ফিরে আসতে হয়। পরপর চারবেলা অভুক্ত থেকে, মুখ ফোঁটা হয়ে গেলে কিংবা বাচ্চাদের কান্না অসহনীয় উঠলেও তাই অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকে না। পরে অনাকাঙ্খিতভাবে অচেনা দুইজন লোক এসে হাতে খাবারের ব্যাগ তুলে দিলে তাদেরকে ফেরেশতা বলে তার মনে হয়।

আব্দুল বাতেনকে এরপর দৈনিক খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিতে হয়। এটাও বলে দেয় যে এখন কেউ একা একা বিচ্ছিন্নভাবে খেতে পারবে না। সবাইকে একসাথে বসে খেতে হবে। খাবার নিয়ে কখনও এভাবে কথা বলতে হয়নি বলে নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই অপরিচিত লাগে, হয়তো অপরিচিত লাগে অন্যদের কাছেও । তার কথা শুনে নির্বাক হয়ে যাওয়া মা স্ত্রী ও  ছেলেমেয়ের কাছে বিব্রত হয় সে; এমনকি নিজের কাছেও।

স্বামী-স্ত্রী, মা, চার ছেলে মেয়েসাতটি মুখের খাবার যোগাতে যখন  অন্যের সাহায্যের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল তখন একটু কঠোর না হওয়া ছাড়া উপায়ই বা কি। আর কোন বিকল্প না থাকায় তার কথামতোই এখন পাতে খাবার যায়। কিন্তু এ পরিমাণ খাবার যে কারো জন্যই পর্যাপ্ত হয় না তা সবার চোখের ভাষাই যেন বলে দেয়। বাচ্চারা কখনও একটু বেশি খাওয়ার আবদার জানালে  চিরায়ত প্রথা অনুযায়ী বড়দের ভাগ থেকে কমাতে হয় নইলে গলা একটু উঁচিয়ে বলে দিতে হয়এখন বেশি খাইলে পরেরবার কম খাইতে অইব।মেঝু ছেলের খাবার আবদার একটু বেশি। গ্রামের দোকান থেকে এটা ওটা খাওয়ার জন্য বাবার কাছ থেকে প্রায়ই টাকা চেয়ে নেয়। কিন্তু বাবার রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে কয়েকদিন টাকা চেয়ে , টাকার পরিবর্তে কড়া ধমক পেয়ে হয়তো ধরে নিয়েছে এখন আর টাকা পাবে না। তাই তিনবেলা মায়ের দেয়া ভাত খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাকে।

এমন দৃশ্যসকল আব্দুল বাতেনের মনকে বিক্ষিপ্ত করলে কোন আশা নেই জেনেও কাজ পাওয়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ভেতর থেকে তাগিদ এলে রাস্তায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম, পুলিশের টহল দলের পথরোধ করে দেবার ভয় উপেক্ষা করে এদিক-ওদিক যেতে চায়।মোখলেছের সাথে দেখা হয় না কয়েকদিন হয়ে গেল। আলাউদ্দীন এবং ফকির আলীর সাথেও অনেকেদিন ধরে দেখা হয় না। তাদের সাথে দেখা হলে কি কাজের কোনও সন্ধান পাওয়া যেতে পারে? মনে হয় না পাওয়া যাবে। তারাও হয়তো তার মতোই এ অচল অবস্থা কেটে যাওয়ার জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। কেউ জানে না কবে কাটবে এই দুঃসময়? কবে তারা কাজে ফিরে যেতে পারবে? কবে খাবারের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে না? কবে ছেলেমেয়েদের আর অভুক্ত থাকতে হবে না? কবে তাদেরকে বলতে পারবে তোমরা এখন ইচ্ছামত খাও? কেউ শোনাতে পারছে না কোন  আশার বাণী। তাই অপেক্ষার দিনগুলো হয়ে উঠছে তীব্র যন্ত্রণাবহ।

আরও কয়েকদিন কেটে গেলে আর যন্ত্রণা সইতে না পেরে  সকল ভয়, উদ্বেগ সাথে নিয়েই আব্দুল বাতেন বাজারে যায়। এ বাজার মূলত বিকালে জমে। কিন্তু এখন বিকালে দোকানপাট বন্ধ  রাখার জন্য সরকারি নির্দেশ রয়েছে বলে লোকজন সকালেই তাদের বাজার সংশ্লিষ্ট কাজ সেরে নেয়। তাই লোকজনের সাথে  দেখা হওয়ার আশায় সকালেই বাজারে এসে সে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে।পরিচিত কয়েকজনের সাথে দেখাও হয়। কিন্তু কথা বলার চেয়ে নিজের কাজ শেষ করে দ্রুত বাজার ত্যাগের তাড়নাই যেন বেশি। এর ভেতরেই দু একজনের সাথে কাজ পাওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে কথা হয় কিন্তু কেউই তাকে নূন্যতম সান্ত¦নাও দিতে পারেনি বরং কিছুদিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দেয়। সে এখানে মূলত এসেছিল শূন্য থেকেই যদি কিছু ধরা যায় এই আশা নিয়ে। কিন্তু শূন্য থেকে কিছু ধরা কি এতই সহজ? স্বাভাবিক সময়েই তা খুব কঠিন। আর এখন তো তা দূরুহ। কেননা এখন চারপাশে কেবল শূন্যতা আর হাহাকার। ঘরবন্দি মানুষের দীর্ঘশ্বাসগুলো এলোমেলো ভেসে থেকে আবার ফিরে আসে আরেকটি দীর্ঘশ্বাসের উৎস হয়ে। তবু আরও কিছু সময় ঘুরে , কোন সম্ভাবনা না দেখতে পেয়ে ফিরে আসতে হয় শূন্য হাতে। ফলে চলমান অনিশ্চয়তার বোধ  আরও ঘনীভূত হয়ে  জাপটে ধরে।

কোন বিশেষ কাজে আব্দুল বাতেনের পারদর্শিতা নেই। কাজ বেছে নেয়ার সুযোগও আসলে তার নেই।দেহের শক্তিতে যা কুলায় তা-ই করে। নিজের  গ্রামে বা আশেপাশের গ্রামে  যখন তার কাজের পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল তখন ধানকাটা, লাকড়ি তৈরি, গাছের ডাল কাটা সহ যেসব কাজ তার সাধ্যের ভেতর পরেছে সেগুলো করেছে।  সেসময়ে পাশের গ্রামের মোখলেছের সাথে এত ঘনিষ্ঠতা তখন ছিল না। এলাকার মানুষ হিসেবে  দেখা হলে কিছু কথা হতো- এই যা। তবে সে যে শহরে কাজ করতে যায় তা অবশ্য জানা ছিল। ঘটনাক্রমে তার সাথে কিছুদিন একসাথে চললে আব্দুল বাতেন  শহরের কাজের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নিয়ে তাকে সাথে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। নিজের দুরবস্থা বর্ণনার সাথে গ্রামে যে কাজের ক্ষেত্র কমে গেছে Ñ গ্রামের মানুষ মোখলেছেকে তা  বলার দরকার না হলেও- নিজের করুণ অবস্থাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য  ফেনায়িত করে বলে। এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলে একদিন আব্দুল বাতেনকে মোখলেছের সাথে শহরে কাজ করতে যেতে দেখা যায়। জেলরোডে সমবেত হওয়া আরও অনেকের সাথে সে-ও যোগ দেয়। অতঃপর সে দেখতে পায় শ্রমিক নিতে আসা লোকজনের সাথে আলোচনা করছে কয়েকজন। কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলে শ্রমিকরা দুই দলে ভাগ হয়ে দুজন লোকের সাথে চলে যায়। এক দলে মোখলেছের সাথে আব্দুল বাতেনও থাকে। হাঁটতে হাঁটেতে সে জানতে পারে এদের কাজ হলো একটি ভবন নির্মাণের জন্য মাটি টানা। এ কাজ মোটেও নতুন নয় তার কাছে। গ্রামে কতদিন কতজনের ভিটায় মাটি  এনেছে, জমিতে মাটি কেটেছে। পার্থক্য শুধু পরিবেশের ভিন্নতা আর সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটি তা হলো এখানে কাজ শেষে যে টাকা হাতে পেল তার পরিমাণ গ্রামের কাজের মজুরির চেয়ে বেশি। এরপর থেকে গ্রামের কাজ কমিয়ে দিয়ে মোখলেছ, আলাউদ্দীন আর ফকির আলীর মতো সে-ও শহরের কাজের সাথেই জড়িত হয়ে গেল বেশি করে।

এখন যে নিজের ঘরে থাকার জন্য যে বারবার বলা হচ্ছে, তা খাবেটা কি? একটাই  কেবল ভরসাত্রাণ। সেটাই বা কদিন চলবে? বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের তৎপরতা কমে গেছে।তারাও হয়তো তাদের সীমাবদ্ধতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। আর সরকারি ত্রাণের সামগ্রী চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়মিতই ঘটে চলেছে। তাদের পাশের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ধরা পড়েছে ত্রাণ চুরির ঘটনায়। তাদের ইউনিয়নেও কিছু আলামত টের পাওয়ায় কানাঘুঁষা চলছে এ বিষয়ে কিন্তু এখনও কেউ ধরা পড়েনি। হয়তো কোনদিন শোনা যাবে তাদের চেয়ারম্যান বা মেম্বারও ধরা পড়ে গেছে। শুধু চেয়ারম্যান মেম্বার নয় কোন কোন জায়গায় স্থানীয় নেতার  খোঁজও পাওয়া গেছে যারা আব্দুল বাতেন, তার স্ত্রী,  ছেলেমেয়ে বা তাদেরই মতো অন্য কারো খাবারের চাল ডাল কিংবা তেল নিজের মনে করে সরিয়ে দিয়েছে।  অথচ তা না হলে অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও তো আয়হীন মানুষদের শঙ্কা কমিয়ে রাখতে পারত। আব্দুল বাতেনকে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে এত কড়াকড়ি আরোপ করতে হতো না। অথচ চোররূপী এই জনপ্রতিনিধিরাই তো জনগণের সেবার নাম করে ভোটে দাঁড়িয়েছিলমানুষের হাতে  মুখে ধরে তাদের নামের পাশের  প্রতীকে সিল দেয়ার জন্য  ভোটের আগে বারবার অনুরোধ করেছিল।কিন্তু এখন করছে কি? যখন মানুষের পাশে থাকা সবচেয়ে বেশি দরকার তখন নিজের আখের গোছাতে অত্যধিক তৎপর হয়ে উঠেছে। তাই আব্দুল বাতেন যতটুকু বুঝতে পারে তাতে করে এখন তাদেরকে মানুষ বলে মনে করতে পারে না।

কাজ এবং আয়ের চিন্তার পাশাপাশি রোগাক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়ার ভয়ও মাথায় আসে কখনও কখনও।কিন্তু মরে যাওয়ার  চেয়ে খাবার চিন্তাই যেন বেশি আসে মাথায়। মরলে তো শেষই, কিন্তু যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তো খাবার দিতে হবে মুখে। এসব চিন্তা যেন রাতের নিস্তব্ধতায় এসে আরও বেশি করে হানা দেয়। তাই হয়তো ঘুম আর আগের মতো দ্রুত আসে না। তবে ভোরে ওঠে যাওয়ার অভ্যাসটা যায়নি। ঘুম থেকে ওঠেই চা খেয়ে শরীরকে সতেজ করে তোলে। কিন্তু কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ঘরে  চায়ের সরঞ্জাম যেটুকো ছিল তা শেষ হয়ে গেলে আর আনা যায়নি বলে এরপর থেকে চা খাওয়া বন্ধ রয়েছে, বন্ধ রয়েছে সিগারেট টানা। রাস্তায় বের হলে ধূমপানরত পরিচিত কাউকে দেখলে তাদের কাছে চেয়ে দু তিনটা টান দেয় বটে কিন্তু তাতে কি আর চাহিদা মেটে? সুখানুভূতির অভাব থেকেই যায়। দীর্ঘদিনের এই অভ্যাসগুলোতে হয়ে হঠাৎ করে  ছেদ পড়ে গেলে অস্বস্তি লাগে ভীষণ। কিন্তু নিরুপায় হয়ে এটা মেনে নিতেই হচ্ছে।

রাস্তায় প্রতিদিনই মাইকে সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, ইত্যাদি সম্পর্কে বলছে।শব্দগুলো কানে আসে তাই আব্দুল বাতেন শুনে। এগুলো সে কম বুঝে বলে তার কাছে  কোন  গুরুত্ব তৈরি করতে পারে না। তাই এগুলো না শুনলেও তার ক্ষতি নেই বলে সে মনে করে। মাইকে এসব না বলে বরং যদি বলত  কোন কোন জায়গায় গেলে  কাজ পাওয়া যাবে তাহলেই যেন খুশি হতো সে। না, এধরনের কোন ঘোষণা আসে না তাকে খুশি করতে। অনেকে আবার বলাবলি করছে যে রোগের প্রকোপ কমে গেলেও  কাজ পাওয়া কঠিন হ  বে। এসব কথা তাকে আরও বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। তাহলে কি করবে সে? ভাবতে ভাবতে কোনও কূল পায় না। ভাবনার ঘূর্ণিপাকের মধ্যে একদিন হঠাৎ করেই তার মাথায় আসে যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে একটি পথই  খোলা থাকবে তাহলো চুরি করতে নেমে যাওয়া। এমন ভাবনায় সে চমকে উঠে। নানান সময়ে বিভিন্ন বিপদ গেলেও এমন অদ্ভত কিছু তার মাথায় আসেনি। বেশ সময় সে এ ভাবনার ঘোরে থেকে যায়। এ ঘোর থেকে বের হয়ে গেলে তার মনে এসব কথাও ভেসে উঠে যে তার বা তার মতো আরও অনেকের খাবার  যেখানে চুরি হয়ে যাচ্ছে সেখানে  সে যদি খাবার পাওয়ার জন্যই চুরি করে তাহলে অপরাধ কোথায়? এখন যদিও তার কাছে এটা অস্বাভাবিক কাজ বলে মনে হচ্ছে, বলা তো যায় না সময়ের পরিক্রমায় এটাকেই স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নেবে মন।

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত