| 20 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প নাটক সাহিত্য

ন বৃত্তীয় (শেষ পর্ব)

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

আগের তিনটি পর্ব পড়তে

প্রথম পর্বঃ

https://irabotee.com/story-8/

দ্বিতীয় পর্বঃ

https://irabotee.com/story-10/

তৃতীয় পর্বঃ

https://irabotee.com/story-12/

সোহানার দৃষ্টিতে বিস্ময়বিমূঢ়তা। নিজেকে নিজে অবিশ্বাস করার অধিক অবিশ্বাস। একটু আগেই উষ্ণ প্রেমের স্পর্শে যে হাত লিখছে প্রথম নারী হয়ে ওঠার আখ্যান, সেই আখ্যানে ঢেলে দেয়া প্রতারণার তপ্ত সীসায় পুড়ে তার আবেগে আর্দ্র বিশ্বাস, নবীন বিশ্বাসে তার বুড়ো বয়সী পাতা ঝরে শীতের রুক্ষতায়, অথচ সে এসেছিলো তুমুল বর্ষায় ফলবতী হবার আশায়

কাল কী পত্রিকার পাতায় দেখবো গণ ধর্ষনে যুবতীর মৃত্যু! আমি কী বিউটিসাজনা, সহস্র মুখের মাঝে সনাক্ত করতে পারবো প্রেমিকার মৃত মুখ! পরাজিত মুখ? কাপুরুষদের প্রেমিকা সম্বোধনের যোগ্যতা থাকে?

প্রাণ, এক বোধ বুদ্ধিহীন চলমান চেতনা, কেবল টিকে থাকার বাসনায় প্ররোচিত করে বারংবার। আমি আবার দাঁড়াই। আবার হাঁটি। আবার বাঁচতে চাই……..

বাঁচার জন্যই কেবল মায়ের আর্তচিৎকার আর সোহানার আকুল প্রেম অগ্রাহ্য করে সূর্যের মতো কিছু আশা বগলদাবা করে আমি আবার হাঁটি

পকেটে মোবাইল বাজে, অনেক অনেক দিন পর মায়ের কণ্ঠস্বর শুনি

বাপ…….কেমন আছস বাপ……….মা আমার মোবাইল নম্বর পেয়েছে শেষপর্যন্ত

আমারে বাঁচা বাপ……আমি আর পারি না বাপ…… আমি আর পারি না বাপ

ফোনটা কেটে দেই

নিজে বাঁচি না। কেমনে তারে বাঁচাই আমি! অস্বীকার করি গর্ভের দায়। আজ আর ফিরতে ইচ্ছে করে না মেসের অস্বাস্থ্যকর দায়ে ঠেকা বসতি তে। শহরের শেষ মাথায় উন্মুক্ত মাঠে শুয়ে থাকি তবু বেঁচে থাকার বাসনার পুনরুজ্জীবনে। মাথার উপর ধীরে ধীরে রঙ বদলানো আকাশ উপুড় করে দেয় রাতের আঁধার……থেমে যায় নীড়ে ফেরা পাখিদের কলরব, ঝিঁঝিঁপোকারা তবু সামান্য আলো মেলে ধরতে চায় হতাশার আঁধার গ্রাস করে…….ঠিক তখন কানের কাছে তীব্র হুইসেল বাজায় আমার মোবাইল। অচেনা নাম্বার

স্যার,জ্বী স্যার

কালই স্যার। সব নিয়ে আসবো স্যার

জ্বী স্যার ভুল হবেনা স্যার

আনন্দে ঝড়ের ঘুর্নির মতো চক্কর খাই

আমার চাকরি হয়েছে। চাকরি! সকালে ইন্টার্ভিউ অফিস থেকে ডেকেছে আমাকে

সকাল সকাল, নিজেকে সাজাই পরিপাটি। একমাত্র ইস্ত্রি করা শার্ট, ধার করে আনা টাই, সেলাই করা সু, বিন্দুমাত্র অবহেলা করি না নিজেকে।তবু কী হয়। প্রথম দিনেই চেয়ার থেকে ওঠে বস ঘুরে ঘুরে দেখে আমাকে। হাত কচলে পরখ করে শার্টের কাপড়ের মসৃণতা, উঁচু করে আমার নীল রঙের টাই…..পছন্দ নাকি অপছন্দে ¦ন্দ্বে পড়ে যাই……একসময় উবু হয়ে বসে দেখেন জুতাজোড়া।  বিব্রত আমি মাথা নীচু করে থাকি যেনো  পাথরের ভাস্কর্য। গভীর পর্যবেক্ষণ শেষে অতপর তিনি স্বচেয়ারে উপবিষ্ট আদেশ করেন, কাল থেকে খুব সিম্পল পোশাকে অফিসে আসবেন

সিম্পল পোশাক। সিম্পল পোশাক

দু চারদিন যেতেই টের পেতে থাকি, এই চকিত চাকরি, সিম্পল পোশাকের কল্পনার অতীত রহস্য। মাল সাপ্লাই দিতে আমাকে দৌড়াতে হয় ব্যস্ত নগরীর এমাথাওমাথা, আর গন্তব্য সব পুঁতিগন্ধময় অন্ধকার। আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে দেয় চাকরির নামে বহন করে চলেছি এক ভয়াবহ অন্ধকার….ধোয়াচ্ছন্ন, জাতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা বিধ্বংসী নেশাচাকরির নামে, হাতে নিয়েছি আমি মৃত্যুর পরোয়ানা। প্রতিদিন রাতে ফেরার পথে নেশায় চুর অমানুষগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে জানতে ইচ্ছে করে সোহানা কই? আমার সোহানা? পারিনা। মেরুদন্ড শক্ত করে জিজ্ঞেস করতে পারি না

 আবাসে ফিরে নিজের দর্পণের সামনে দাঁড়াই নিজে। সব সোহানারা কী বেওয়ারিশ মৃতদেহ হয় আমারই মতো সুবোধের কাপুরুষতার কারণে? আমার কাপুরুষ চেহারা সনাক্ত করেই কী প্রকৃতি কর্মফলে আমার হাতে ধরিয়ে দেয় বিধ্বংসী ধ্বংস? এই হাওয়ায়,পাতায়,বৃক্ষে,ডালে,আকাশে,পাতালে কোথায় ছাপাকৃত হয়ে আছে আমার যাবতীয় কাপুরুষতা?

কী হয় পরদিন, অফিস গিয়ে বড়কর্তার সামনে দাঁড়াই, এক রূপান্তর প্রক্রিয়ায়। টের পাই পিঠের দিকে এক শক্ত অনমনীয়, গোঁয়ারতুমির অবস্থান

স্যার এই চাকরি আমি আর করবো না

এই প্রস্তাবের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত বড়কর্তা ঘাবড়ে যাওয়া  নিমিষে সামলে নিয়ে হো হো হাসেন

হো হো হো। চাকরিতে প্রবেশ করা যায়। বের হওয়া যায় না। হো হো হো

কাল থেকে আমি আর আসবো না

অলৌকিক বাণীর মতো কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে আমি নির্ভার হাঁটি সেই বিশাল প্রান্তরমুখী

 

কেউ একজন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে থামে আমার নিঃশ্বাসের কাছে। বাঁচান আমারে বাঁচান…….ভাই আমারে বাঁচান…..

তাকে বাঁচানোর নয়, তাগিদ পাই নিজেকে বাঁচানোর …….ঠিক তখন কাছে কোথাও পুলিশের তীব্র বাঁশি, হৈ চৈ বুটের থপ থপ দৌড়ানোর আওয়াজ…….. কেউ কী চিৎকার করে বলে, সুবোধ তুই পালা…………., স্বপ্ন নয় দুঃস্বপ্ন আসছে ধেয়ে সুনামী উঁচু ঢেউয়ের মতোন। আসছে তছনছ করে দিতে স্বপ্নসকল,আসছে এই চাঁদের নরোম জোছনা মাখা রাতের অপেক্ষা মোড়া সূর্যোদয়ের সকল আয়োজন গিলে খেতে, সুবোধ পালা  পালা সুবোধ পালা,সময় এখন তোর অনুকূলে নয়……

মায়ের আকুতি বাপ আমাকে বাঁচা বাপ…….

হঠাৎ গগন বিদীর্ণ করে বন্দুকের ঠা ঠা, করুণ গোঙানির সুরে জীবনের নিস্পন্দ হবার শেষ শিঙ্গা। তীব্রতর পুলিশের হুইসেল, সম্মিলিত ফিসফাসে ভয়াবহতার আতঙ্কিত বিদীর্ণতাতখন

আমি পিছু ফিরে তাকাই কী তাকাই না, কী ঘটে, কী ঘটবে বুঝি কী বুঝি না, আমি দৌড়াই……দৌড়াই…….কেবল কীট পতঙ্গ সম বেঁচে থাকার বাসনায় দৌড়াই। যেনো এই গুলির ঠা ঠা ন্যায় কী অন্যায় ফিরে দেখা জীবনের উদ্দিষ্ট নয়, মনুষ্য জীবনের সার্থকতা নয় প্রতিবাদ প্রতিরোধে, কেবল স্বার্থপর জৈবিক জীবনে বেঁচে থাকাই বাসনা তার….

আমি দৌড় থামাই……. চেনা এক মনুষ্য চোখের আকুতি ভেতরে জন্ম দেয় এক অন্য আমার, অচেনা আমার……. আমি ঘুরে দাঁড়াই, বাঁচবো না বাঁচবো না এই কীট পতঙ্গের জীবন। বেঁচে থাকাই যদি দুঃসাহসের প্রতিনাম হয়, তবে সে বেঁচে থাকা হোক মানুষের মতো। মেরুদন্ড আর মস্তিস্ক সোজা করে বাঁচার নাম

আমি ঘুরে দাঁড়াই, দৌড়াই সেই গোঙানির উৎসমুখে। তীব্র হয় পুলিশের হুইসেল, দৌড়াদৌড়ি……… আমি পৌঁছাই কাছাকাছি

একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ……..উর্দিধারীরা ব্যস্ত ইয়াবা সাজাতে……কেউ একজন একটা জং ধরা রাইফেল ধরিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ দেহটির হাতে

আমি সাক্ষী হই, দেখি আমার ভয়াবহ রূপান্তর, আমি বদলে যাচ্ছি……মৃত লোকটির চেহারায় অবিকল আমার চেহারা……

কেঁপে ওঠে অন্তরাত্মা। না মরবো না আমি, বাঁচার জন্য বাঁচবো। কাল প্রকাশ করে দেবো জনারণ্যে, মৃত লোকটির হাতে অস্ত্র ছিলো না। ট্যাবলেট গুলো তার পকেটে ছিলো না……..

ব্যবস্থার ফাঁদ আর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই যখন মিলে যায় একবিন্দুতে তখন মানুষ টেবলেটগুলো নেয় হাতে, হাতে নেয় নিষিদ্ধ অস্ত্র

তোমরা খুলে রাখো ব্যবস্থার ফাঁদ, রুদ্ধ করে রাখ আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যসব দ্বার, তারপর তারপর রাইফেল তাক করো মস্তিস্কে? সব অস্ত্র তাক করো হৃৎপিন্ডে?

কিন্তু আমার? আমি তো সব ত্যাগ করে এসেছি। ট্যাবলেট আমার হাতে ছিলোনা। অস্ত্রটা আমার হাতে ছিলোনা

 

 

(রচনাকালমে/২০১৮)

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত