সুখ অথবা পায়রা ওড়ার গল্প
এই সাত সকালে বেড়ালের বাচ্চার মিউ মিউ শব্দ বাজছে কানে। চাঁদনী খুব বিরক্ত হয়, খুব। সারারাত ঘুমাতে পারেনি। শেষরাতে একটু চোখ লেগে এসেছে আর এখন শুরু হয়েছে এই ট্যা ট্যা-চিউ চিউ-ম্যা,ম্যা! চাদনী চায় না এই ঘুম-ঘুম আরামের স্বপ্নআঠা খুলে যাক তার। ঝুলে থাকুক এই আরামসুখ আরো বহুক্ষণ। ওই তো হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে পায়রা, গন্ধভাসছে নাকে, পরী হাসছে, আসছে আলাদীনের দৈত্য। কী অদ্ভুত কণ্ঠ তার
– বলো হে মালকিন কী চাই তোমার?
– একটা টিনের ঘর নিজের।
– আর?
– একটিন বিস্কুট।
– আর?
– ওই যে টিভিতে দেখা যায় ওইরকম একটা পশম-পশম শীতের জামা।
– তথাস্তু
হায় হায় তিনটাতেই শেষ, স্বপ্নেও চাদনীর আফসোস বাড়ে। আহারে আহারে আরো কত কী চাওয়ার বাকি তার! এই ঘোরলাগা রাতের এই হাম্বুরা দৈত্য ছাড়া কেউ কখনো তাকে বলেছে ‘ বল হে চাঁদনী কী চাই তোমার’ বলেনি। চাঁদনী নিজেই লিস্ট গোছায়
কাপড়-চোপড় রাখার একটা বড় ট্রাঙ্ক, বড়লোকের মেয়েদের মত বসার একটা বেতের চেয়ার, আর পাশের ঘরের রেশমার জন্য ছাপা প্রিন্টের শাড়ি।
আবার ট্যা ট্যা।
ইস চোখ টেনে খুলতে পারে না। ঘুমে এত আরাম। পায়ের কাছে জমিয়ে রাখা সস্তা কম্বলটা টানে। নাহ চোখ খুলবে না সে। স্বপ্নটাকে টেনেটুনে আরেকটু লম্বা করতে হবে। দৈত্যটাকে খুঁজতে হবে ভালো করে। পালালে হবে না বাছা। চাঁদনীকে ফাঁকি দেয়া কি এত সোজা!
আবার ট্যা ট্যা ট্যা।
ভালো ব্যারাম দেখি।
অতঃপর তাকে এই সকাল-সকাল স্বপ্ন মাখা আদুল চোখ খুলতেই হয়। হায় কোথায় কী। ঐ পাশে গার্ড মনের সুখে হুইশেল বাজাচ্ছে প্যা প্যা প্যা। ওদের মতো যারা আছে তাদের চলে যাওয়ার ওয়ার্নিং। ধুর মরা ভোরের আলোইতো ফুটল না এখনো ভালে করে। চাঁদনী চোখ ডলে। ওর গতরাতের উপার্জন সর্বমোট দুশো ষাট হয়েছে, গুণে দেখেছে সে। চাঁদনী বিড় বিড় করে। নাহ তার এক্ষুনি কেটে পড়া উচিৎ। আলো ফুটলে খবর আছে। কতজনের বখরা। নিজের জামা কাপড় দেখে সে। ছিহ কী নোংরা! শালা সব ছুঁচো মাস্তান, বস্তির মাতাল, ময়লা গেঞ্জির লোকজনই তার জোটে, কেউ পয়সা দেয়, কেউ দেয়না। সবকয়টার ফাও খাওয়া আর লাগানোর ধান্দা। চাদনী থুক করে থুতু ফেলে। গার্ড এসে কানের কাছে আবার হুইশেল বাজায় জোরে
– ওঠ মাগি ওঠ
উফ কেন যে চাঁদনী বাহাস করতে জানেনা, টুটি চেপে ধরতে পারতো এই বুড়ো শালার। পার্কে এখন মানুষ আসবে। ভদ্দরলোকের দল তাদের দেখলে নাকি নাক সিটকাবে। পার্কের ত্রিসীমানায় থাকা যাবে না দিনেরবেলা। ওরা ছাড়া পৃথিবীর বাকি সব ফিরিশতা। ওইতো দুজন দুজন করে আসা শুরু হয়েছে। চাদনীর মাথা গরম হয় খুব। গা ঘিনঘিন করে ওইসব ভালো মানুষদের চিন্তায়। এখনই শুরু হবে ডলাডলি-হাতাহাতি। ওরে ভালোমানুষরা আমি বেশ্যা না তোরা বেশ্যা। বেশ্যা, বেশ্যা, বেশ্যা। চাঁদনী বোঝে দুনিয়ায় সে ই সবচেয়ে ভালো কিন্তু আর কেউ তা বোঝে না। তাকে দামও দেয়না। দেখতেই পারে না কেউ; অবশ্য চাঁদনীও কাউকে দেখতে পারে না। শোধবোধ। রোদ উঠছে। গাছের ছায়ায় ছায়ায় নড়ে উঠছে মানুষের অর্ধসঙ্গোমের মাথা। চাঁদনী পুলক অনুভব করে। কর কর সব ভাসায়া দে।
ওপাশের কোনায় বসে আছে ছোট-ছোট দুটো কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে। ইউনিফর্ম পরা। এই সাত সকালেই ছাতা নিয়ে এসেছে। মেঘ নাই, রোদ নাই তবুও আড়াল। চাঁদনীর দীর্ঘশ্বাস আসে, আহা ওকে কেউ এইভাবে ঢেকেঢুকে ভালোবাসতো। ওর কত কত লোভ মানুষের এইসব ভালোবাসাবাসি পাওয়ার অথচ কোনকালেই কেউ জোটেনি দরদ দিয়ে কিছু বলার। ওর পাশের ঘরের রেশমা তার পাশের ঘরের দোলন ওদেরও কেউ না কেউ আছে শুধু তারই নেই। ধুর কী সব ভাবছে সে। মানুষের জাত কুত্তাসব। দিনের আলোয় ওদেরকে দেখলেই দুর দুর করে তাড়ায়, ফিরতি ঘেউ ঘেউ করার বিদ্যা জানলে চাঁদনী দেখিয়ে দিত খ্যাকখ্যানি কারে কয়। ঠাটা পড়ুক সব ভালো মানুষের মাথায়।
পার্কের হকারি করা ছেলেটার কাছ থেকে এককাপ চা নিয়ে আয়েশ করে বসে চাঁদনী, বাঁশি বাজছে বাজুক। গরম ধোঁয়ায় ফুঁ দিতেই মাথা ঠান্ডা হয়ে আসে। হায় এতক্ষণ কেন শুধু শুধু মানুষজাতরে বকলো! এইতো এখনি তার মায়া হচ্ছে তাদের জন্য, কান্নাও পাচ্ছে। আহা মানুষেরা তোমরা ভালো থাকো, সুখে থাক তোমরা। চাঁদনী, পাগল-ছাগল মানুষ ওর কথায় দোষ নিও না। দোষ নিও না। চাঁদনী এবার নিজের দিকে তাকায়, ধরতে গেলে সে তো সুখেই আছে। সালমা খালা বস্তিতে তারে একটা ঘর দিয়েছে। একদম নিজের ঘর। গতমাসে একটা পুরনো রঙিন টিভিও যোগার করছে সে। দিনের বেলা পেটে দুইটা দানাপানি জুটলেই সিনেমা নিয়ে বসে, বাংলা সিনেমা দেখে, দেখে হিন্দি সিরিয়াল! ওদের কত দুঃখ, কত যন্ত্রণার পাহাড়। চাঁদনী চোখ মোছে না থাক আমার নিজের মানুষ, না থাক সংসার, সুখ তো আছেই। একবেলা রান্না করলে দুবেলা খাওয়া যায়। ভাত পুড়লে কেউ খ্যাক করে বলেনা ‘কাম জানস না আবার ভাতার চাস ক্যান লো মাগী!
আলুঝালু ভাবনা ছেড়ে পথে নামে চাঁদনী। জায়গায় জায়গায় পড়ে থাকা চিপসের প্যাকেট, পানির খালি বোতল থেকে কয়েকটা তুলে নেয় হাতে। কেজি দরে বিক্রি করবে। এক অর্থে এগুলোও পয়সা। সারা গায়ে সস্তা প্রসাধনীর উৎকট গন্ধ আর বহু পুরুষের ছিন্নভিন্ন কামড়াকামড়ি আদর গায়ে নিয়েও হাঁটতে তার খারাপ লাগছে না। দু-টাকার বাদাম কেনে শখে। ভাজা বাদামের সুগন্ধী গন্ধে হঠাৎ করে তার মনে পড়ে যায় শেষরাতে শুনতে পাওয়া ট্যা ট্যা কান্নার আওয়াজ। পার্ক ছেড়ে কিছুটা হাটলেই মূল সড়কপথ। মিনিট দশেক এগুনোর পর বস্তির গলি। অতদূর যাওয়ার আগেই আবার কানে আসে সেই বিড়ালের ডাক। ট্যা ট্যা চিঁ চিঁ। চাঁদনী প্রথমে ভাবে তার মনের ভুল,পরে শব্দের তীব্রতায় থমকে দাঁড়ায়। ভুত প্রেত না তো? পাপী মুখে আল্লাহ-খোদার নাম নিতেও ভয় পায় তবু কৌতূহল দমাতে পারেনা, আগায়। ওমা ওর পাশেই ময়লার ভাগাড়টায় চকচকে লাল পয়সার মতো কাঁথায় শুয়ে আছে একটা বাচ্চা শিশু। ইস একটা চোখ পিঁপড়ে না যেন ইঁদুর খেয়ে ফেলেছে এরমধ্যেই। চাঁদনী বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। হন্ত-দন্ত হয়ে ময়লা সরিয়ে বাচ্চাটা কোলে নেয়। আরেকটা চোখ আছে, আছে তো। আহা কী পবিত্র সুন্দর একটা চোখ। হাত,পা নাক, কান, ঠোঁট সব খুঁজে দেখে, আছে পুরোটা, কী সুন্দর। কী সুন্দর নরোম বাচ্চা। চাঁদনীর বুক কাঁপে দুরু দুরু। হায় এটা কার বাচ্চা। চাঁদনী কোলে নেয়ায় নিস্তেজ বাচ্চাটার কান্না থামে, তৃষ্ণায় মুখ বাড়িয়ে দুধ খোঁজে ঠোঁটে। বাচ্চাটার নড়াচড়ার চাঁদনীর শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। এ এমন করছে কেন? এটা কী তার নিজের বাবু। হাহ কত পুরুষ ঘাটে তাকে রোজ তবু ঠিকঠাক মাসিকই হয় না আবার বাচ্চা। না না এই বাচ্চা তারই হবে। এইতো ছোট ছোট আঙুলগুলো মুঠি করে ধরে রেখেছে ওর শাড়ির আঁচল। বাচ্চাটার চুল চুপসে আছে। চাঁদনি কাছে যায় আরো। তার নাক এগিয়ে দেয় বাচ্চাটার মুখের কাছে। কী সুন্দর গন্ধ! চাঁদনী উসখুশ করে কী করবে সে এখন! এই বাচ্চাটার নাম কী। ইস কত সুন্দর বাচ্চা, কেউ আবার নিয়ে যাবে না তো কেড়ে। চট করে চাঁদনী ঢেকে ফেলে বাচ্চার মুখ। নাহ চাঁদনী দেবেই না। হোক এক চোখ কানা, প্রাণটা তো আছে। বড় হলে ওর নাম দেবে সে মোটা কেহেরমান। আলিফ লায়লার ঐ একচোখা দৈত্যর কথা মনে পড়তেই ফিক করে হেসে ওঠে সে। ও এতক্ষণে বুঝতে পারে চাঁদনী মধ্যরাতে আলাদিনের দৈত্যর কাছে কত কিছু চেয়েছে সে শুধু একটা জিনিসই চায়নি, কী বিস্মরণ! এই লাল টুকটুকে কেহেরমান চাওয়া হয়নি তার এখনো। ঠিকই তো দিল সে। চাঁদনী অদৃশ্য কাকে যেন থ্যাংকু জানায়, পুটলি কোলে নেচে-নেচে আগায়। একটু আগায় আবার একটু বাচ্চাটার গা শোকে। কেমন কাঁচা কাঁচা উঁহু ভাজা বাদামের গন্ধ! অদ্ভুত তার গা থেকেও সুবাস পাচ্ছে সে। হুহু চাঁদনী বুঝে যায় সে কাঁচা পাতা আর পুটলির বাবুটা তার বুড়ো ধনিয়ার গুঁড়া। সে আদা দেয়া রং চা আর বাবুটা চানাচুর। চাঁদনী হাসে খল বাতাসে ওড়ায় প্রেম, পায়রার সুগন্ধ।

কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ৫ জানুয়ারি, ১৯৮৩; চাঁদপুর। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষে “কথাসাহিত্যে” পিএইচডি করছেন। পেশায় শিক্ষক। সহকারী অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত বই : অলকার ফুল [গল্পগ্রন্থ, বাঙালি, ২০১৭] যূথচারী আঁধারের গল্প [গল্পগ্রন্থ, জেব্রাক্রসিং, ২০১৮] (এই বইটির জন্য কথাসাহিত্য বিভাগে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৮ পেয়েছেন।), পুরুষপাঠ [গল্পগ্রন্থ,ঐতিহ্য,২০১৯]
আওলিয়া খানম says:
গল্পটি হৃদয়ছোয়া । পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আদিম পেশায় এখনো নারীরা অসহায়ের মত হাত বাড়িয়ে থাকে । করে এ থেকে মুক্তি মিলবে ?