Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

নটী

Reading Time: 5 minutes
অর্জিতা কখনো সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখেনি।দেখেনি মানে দেখেইনি। ঢাকা শহরটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়া হাজারো পথ গলিপথগুলোর কোনটা কোথায় কোন বাঁকে কেমন সব অট্টালিকা দালানগুলোয় ভরে গেলো সব তার চোখের সামনে। তেমনি ভুঁইফোড় কতো সিনেপ্লেক্স গাজালো শহরের এধার ওধার, তাও সে কখনো গেলো না। গেলো না তো গেলোই না, মানে যেতে পারলোনা আরকি। তাতে কারইবা কী এলো গেলো!  
মধ্য পঞ্চাশের অর্জিতা,  সাদা কালো আর ধুসরের ছকে বাঁধা চুন মরিচ চুলে যাকে কেতাদুরস্ত ভাষায় সল্ট এন পেপার বলে, ঠিক সেইরম চুলে  বার্গান্ডি কি ব্লন্ড ডাই করতে না পারা অর্জিতা৷ হাঁটু ছাপানো একঢাল কাঁচাপাকা চুল আর  থৈথৈ কাজ নিয়ে রোজ জেরবার হতে হতে নারী জন্ম পার করে দেয়া অর্জিতা। এক ছোট্ট ছিমছাম মফস্বলি গন্ধে বুঁদ শহরের মেয়ে ছিল যে অর্জিতা, হঠাৎই রাজধানীর বাসিন্দা হয়ে কেমন শহরের কেতার সঙ্গে কেতাদুরস্ত চাল রপ্ত করতে করতে দিনগুজরানো এক মধ্যবয়সী নারী। 
অর্জিতা ভাবে, আর ভাবে। এযেনো সেই জাদুকর পিসি সরকারের ভেলকি। ছিল রুমাল হয়ে গেলো বেড়াল! এইসব সিনেপ্লেক্স, হোম থিয়েটার, মুভি থিয়েটার আসবার আগে এদেশে সিনেমা হলের যুগ ছিল। আধা শহর কি মফস্বলি মানুষের জীবনে একটুকরো আকাশের মতো দম ফেলবার, প্রেম করবার শিরশিরে নিষিদ্ধ আনন্দে বুঁদ হবার জায়গার নাম ছিল সেসব। স্কুল পালানো কিশোরীর বাছুরে প্রেমের সাক্ষী ছিল সেইসব সিনেমা হল। থরথরে শিহরণ জাগিয়ে আলতো করে প্রেমিকার হাত ছুঁয়ে যখন নতুন প্রেমিক নিতো প্রেমের হাতেখড়ি, সেইসব দিনগুলোতে আশ্রয় হতো সিনেমা দেখার নেহাৎ একটা ছুতো। আর একান্নবর্তী পরিবারের ঊনকোটি চৌষট্টি রকমের কাজ সেরে বাড়ির মেয়ে বউরা হুড তোলা রিকশ করে সিনেমা দেখতে যেতেন। এখনকার মতো উবার না, তখন সাইকেল রিকশার চল ছিল। 
অর্জিতা রেডিওর বিজ্ঞাপন তরঙ্গ শুনতো, বিজ্ঞাপনে কন্ঠদাতার অদ্ভুত মাদকতাময় কন্ঠে ডুবে যেতো। বহু পরে সেই মানুষটাকে দেখেছিল তার স্বামীর সঙ্গে এক পার্টিতে। নাজমুল হুসেইন, কেবলই একজন কন্ঠ ছিলেন একটা সময় ধরে। গা ছমছমে শিহরণ নিয়ে সব বয়সের সব নারী মোহাচ্ছন্ন হয়ে তাঁর কন্ঠে ছায়াছবির বিজ্ঞাপন শুনতেন। রোজ রোজ কতো রকমের সিনেমার গান শুনতো তারা সব তুতো বোনেরাও। আর নিজেরাও  গুনগুনাতো। দুপুরের ম্যাটিনি শো’তে মায়ের সঙ্গে বসে সিনেমা দেখতো। বড় হবার দিনগুলোতে সিনেমা দেখার নেশা লাগানো সময় পার করলো তারা বলা চলে । 
কখন যে সেইসব দিনগুলো অতীত হয়ে গেলো, জানে না। চট্টগ্রামের নেভি হলে সিনেমা দেখে না সে বহুকাল, বহুকাল হলো মায়ের গায়ে গা লাগিয়ে বসে আজগুবি গল্পের সিনেমায় গল্পের গরুকে গাছে উঠতে দেখে অবাক হতে ভুলে যাওয়া মেয়ে আর সে নাই। বহুকাল হলো বনানী হল, বদলে বদলে গেছে। বহুকাল হলো অর্জিতা কিশোরী, তরুণী, যুবতী সময় পার করে বিগতযৌবনা অতি প্রৌঢ় নারী হয়ে গেছে। সত্যি সত্যি কী কোন নারী বিগত যৌবনা হয়?!  জানে না, ভাবেও না অর্জিতা। নিজের সব বয়সের সব রকমের চেহারাই তার প্রিয়। কিন্তু লোকে যখন বলে পঁয়ত্রিশ মানেই বহু ফসল তোলা জমি তখনও সে হাসে৷ কতো আগে ফেলে এসেছে ঐ বয়স!  শরীর কী খুব কিছু বদলেছে!  
নিজেকে মাঝেসাঝে এক আধবার নিসুতা শরীরে ঘুরেফিরে দেখে নেয় অর্জিতা!  দেখে কতোটা বদলালো সে, ভিতরে বাইরে!  বংশের কারু ব্রেস্ট ক্যান্সারের ইতিহাস নেই বটে, তবুও নিজে নিজে সেল্ফ ব্রেস্ট একজামিন করতে করতে নিজের সুডৌল স্তনের সবটা ভালো করে দেখে আয়নায়। পঞ্চাশ পেরুনো বয়সে এসে, নিজের প্রথম জীবনের প্রেমিকের কথা মনে পড়ে যায়। মাজা মাজা গায়ের রঙ অর্জিতার আর বক্ষ জুড়ে যেনো স্থলপদ্ম ফোঁটা। প্রেমিক প্রবর যার নাম রেখেছিলেন সোনার পাথরবাটি!  
ঐসব সলমা জরীন দিনগুলো জীবন থেকে ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেছে কবেই। বিবাহিত জীবনে স্বামী হিসেবে এক পুরুষকেই পেয়েছিল অর্জিতা, প্রেমিক সে ছিল না। প্রেমিক সে হয় নাই বা হতে চায়ও নাই৷ এক নারীকে রোজ রোজ আবিষ্কার করবার ধকল সেই পুরুষ কেনইবা বইবেন!  স্বামী হিসেবে তার শরীরের পাওনা মিটলেই তিনি পাশ ফিরে ঘুমোতেন। আর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও তাতে সায় দিতে হতো অর্জিতার। এতোটুকুও ছাড় ছিলো না, একটু অমতেই শুনতে হতো অকথ্য গালাগালি। রাতের আকাশ যেমন চিড়ে যায় রাতচরা পাখির ডাকে তেমনি ঘুমন্ত পড়শিদের কানে চলে যেতো  শীৎকারের বদলে  উৎকট কন্ঠে নটিমাগি, ছিনাল মাগি শব্দের চীৎকার। 
দুটো বাঘ যেমন একসাথে বসবাস করলেও তাদের ছানা হয়, তেমনি তাদেরও হলো৷ সংসারের আরো দশটা কাজের মতো রতিখেলাও কেবলই একটা দাম্পত্য কর্তব্য হয়ে রইলো, রোজকার রান্নার থোর বড়িখাড়ার মতোই রোজকার মিনিট পাঁচেকের রুটিন মৈথুন!  কখনোবা আরো কম!  অর্গাজম নামের শব্দটা৷ সঙ্গে পরিচয় হতে হতে হলোনা অর্জিতার আর। 
অর্জিতা সংসার করেছে, সংসারে সঙ সেজে সক্কলের মনোরঞ্জন করেছে। সেই সময়ে বাঙালির এমন নানান ছাঁদের প্যাকেজ ট্যুরের চল ছিল না যে তারা জোড়ে বেরুবে অন্তত লোককে দেখাতে হলেও। এখনকার মতো ফেবু ট্রেন্ডও ছিলোইনা যে তারা চেক ইন দেবে আর সব বেড়িয়ে বেড়াবার ছবি এ্যালবাম করে কিংবা ডিপিতে দেবে। বেড়ানো মানে ঐ বড়জোর শিশু পার্ক কী বোটানিক্যাল গার্ডেন৷ পরে পরে এক আধবার কক্সবাজার। জায়া আর পতি মানে দম্পতির আর নিজেদের জীবন বলে কিছু রইলোনা। কর্তার তবুও বাইরের কাজ রইলো, ছেলেমেয়ে বড় হতে অর্জিতার রইলো হেঁশেলের কৌটোবাটার সঙ্গে কথা কইবার ফুরসত। বছরে মৌসুম বুঝে আচার, বড়ি দেবার নিয়ম। আর বছরে একবার পুজার সময় সম্বচ্ছরকার কাপড় কেনা আর বাড়ি গিয়ে সেই সংসার সামলানো৷ 
জীবনের সময়টা যেতে যেতে ইদানিং আর ভাদ্র মাসে কড়কড়ে রোদে নিজের বিয়ের গাঢ় লাল  কড়িয়াল  বেনারসি মেলে দেয় না। বিয়ের লাল  শাড়িতে ভুল করেও আর কালো সুতোর ফোঁড় খোঁজে না অর্জিতা। জীবনের কী অর্জন, কী পেলো, কী আর কী আর কী তার হলো না তার সমীকরণ মেলাতে বসে না আর সে। জীবন সবাইকে সব দেবে এমন দিব্যি কবে কখন কাকে করেছিলো? তাই হিসেবের খেরোখাতায় হাজারটা গোঁজামিল, জোড়াতালি বিস্তর  আছে তার সে জানেই। কিন্তু, ঠিক কবে থেকে সিনেমা দেখার ইতি ঘটলো?  সেই যেবার দিদার বড় অসুখ করলো, সেবার?  বাবার রোজগারে টান পড়লো, যখন থেকে?  
নাকি, সেই যেবার ছোটকা বিয়ে করে ভিন্ন হয়ে গেলো!?  
ওহ না না, সেই যেবার সালমান শাহ নামের এক ভীষণ সুন্দর নায়কটা আত্মহত্যা করলো। আর তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে, তাঁর ভক্তকূল অস্হির হয়ে গেলো। চট্টগ্রাম আর সিলেটের মানুষের আজীবনের মধুর সম্পর্কে ফাটল ধরার সেই কি শুরু?  এইসব টানাপোড়েনের মাঝে লুসি বিউটি পার্লারে খদ্দের কি কিছু কম হলো?  ব্যবসা কি কমলো কিছু ওদের সৌন্দর্যের দেখেনেপনা আর বেসাতির! কেইবা জানে!
অর্জিতার পিসতুতো বোন সীমা, সে তখন সালমানের তুঙ্গ সাফল্যে কম্পমান ভক্ত। রাতদিন চলে সেই নায়কের নানান রকম ভিউকার্ড, পোস্টার সংগ্রহ। হাহহহহ, ঐ বোকাদের যুগে নায়ক নায়িকার ভিউকার্ড কেনার চল ছিল টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে। প্রিয় নায়কের স্বপ্নে বিভোর বালিকা কিশোরীরা লুকিয়ে জমাতো এসব, গোপনে রাখতো। কিনতো বটে পোস্টার, কিন্তু সেটা কারো দেয়ালের শোভা বাড়াতে কমই সুযোগ পেতো। 
সেই সীমা, বোকার বোকা গেলো মরতে। প্রিয় নায়কের মৃত্যুর খবরে নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছা গেলো ভুলে। সীমার মা নেই, তিনিও আত্মহত্যা করেছিলেন। এবার সীমার সেই চেষ্টা  ব্যর্থ হলেও সেটা বেশ বড় ঝড় তুললো সারা পরিবারে। মোটামুটি কড়াকড়ি আইন জারি হলো সিনেমা দেখার উপরে। যে যার জীবনে ব্যস্ত, সময়েরও বদল ঘটতে লাগলো বড় দ্রুত। বাড়ি বাড়ি কেবল লাইন, ছাদে ছাদে ডিশ অ্যানটেনার দৌরাত্ম দেখে সিনেমা হল গুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো, একা, ক্লান্ত চেহারায়। 
এরপরে ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের যুগে কচিকাঁচা নাতি নাতনি সংসার সামলাতে সামলাতেই অর্জিতা ভাবে কী রঙিন ছিল সেইসব দিন। সাদাকালো পর্দাতেও কী ভীষণ জীবন্ত ছিলেন সেই যুগের নট নটিরা। রঙিন যুগের কতো জানা অজানা কুশীলব সিনেমার।দিন এখন অনেক অনেক অনেকই বদলে গেছে। স্বর্ণযুগের সেইসব নায়ক, গায়ক, অনেকেই গত হয়েছেন। পর্দা কাঁপানো সুন্দরী নায়িকারা বোরকার আড়ালে নিজেদের বয়স্ক চেহারা ঢেকেছেন কেউবা বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। জমজমাট সেই নায়কদের মতো বিজ্ঞাপন কন্ঠের মালিকেরাও আজ দাড়িওয়ালা সম্মানিত হাজ্বি সাহেব। বয়স সকলকেই কেমন বদলে দিতে পারে। 
দিন বদলের পালায় সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটে গেছে বাংলাদেশ নামের দেশটাতে, বাঙালির মনটাতেও। যদিও দিন এখন এমন যে,চাইলে ঘরে বসে সব যুগের, সব সিনেমাই দেখা চলে৷সঙ্গে মুখরোচক চাট, খাদ্য, কি পানীয় সবই হাতের নাগালে আজ। লোকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, বেড়েছে অনেক। কিন্তু মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের মানসিকতার, মনের জটিলতা কিছু কি কমেছে!  সেকথাও নাহয় উহ্য রইলো, হিসেব থাকুক মুলতবি। কিন্তু সেইসব সখিদের, কোথাও কি সন্ধান মিলবে!  যাদের সাথে প্রাণের মিল, আত্মার আরাম ছিল। ছিল ভিউকার্ড লেনদেন, পুতুলের বিয়ে,  দুপুর জুড়ে জলপাইয়ের আঁচার, মুড়িমাখা কি বরই, মুজির ভর্তা খাওয়ার ধুম!  
একটা জন্ম পার করে দিয়ে অর্জিতার হাতে এলো না, সেই প্রাণের মানুষটি।যাকে বলা যাবে, আজকে সিনেমা দেখতে যাবে?  চলো চলো যাই, দেখে আসি আজ সবাই মিলে একদম আনকোরা অভিজ্ঞতার নতুন সিনেমা। চলো দেখি, আমাদের রাউজানের সেই নদীটার নাম নিয়ে বানানো হালদা। যেমন বহু বহু আগে দুই গোলাপের শ্যুটিং করেছিল ফয়’স লেকে। চলো দেখি, দইজ্জার কূলের মাইয়াফোয়া ক্যামনে বলে, ন ডরাই!  জানে বললেই খাস উত্তরবঙ্গের টানে জীবনসঙ্গীটি বলে উঠবেন  উসব জাগায় সিনেমা দেখতে নটীরা যায়। ভদ্দরঘরের বেটিছাওয়া উটি যায়না৷ অর্জিতার মতো নারীদের চারপাশে কেবল হাত বাড়ানোই সার, মুঠো খুললে কেবলই হা হা করে অট্টহাসি দিয়ে উঠে শূন্যতা। 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>