| 8 অক্টোবর 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

হোসে গরোস্তিসার মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথের গল্প । রাজু আলাউদ্দিন

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

গত শতাব্দীর বিশের দশকে মেহিকোর কাব্যজগতে ‘সমসাময়িক’ (contemporaneos) নামে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার প্রধান তিন কাব্যব্যক্তিত্ব ছিলেন কার্লোস পেইয়িসের, হাবিয়ের বিইয়াউররুতিয়া এবং হোসে গরোস্তিসা। ইস্পানো-আমেরিকার বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক এবং সাহিত্যের ইতিহাসবিদ এনরিকে এন্দার্সন ইম্বার্তের ভাষায় ‘হোসে গরোস্তিসা (১৯০১-৭৩) এ প্রজন্মের কবিতার ঘনীভূত রূপদানকারী শ্রেষ্ঠতমদের একজন।’ (E. Anderson Imbert, Historia de la literatura Hispanoamericana, Vol-11, Fondo de cultura Economica, 2000, P-153)

অক্তাবিও পাস তার বিখ্যাত গ্রন্থ El Laberinto de la Soledad-এ মৃত্যু ও জীবনের ভেদরেখা মোচনকারী গরোস্তিসার অসামান্য কাব্যগ্রন্থ Muerte sin fin-এর অনন্যতাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছিলেন :

‘আমরা লাতিন আমেরিকার অধিবাসীরা নিজেদের চোখ ধাঁধানো স্বচ্ছতার প্রতি পক্ষপাতের যে সত্যিকারের আধুনিক চৈতন্যকে ধারণ করি, হোসে গরোস্তিসার অন্তহীন মৃত্যু কবিতাটি সম্ভবত তারই সর্বোচ্চ সাক্ষ্য। কবি একই সঙ্গে প্রাঞ্জল ও উত্ত্যক্ত, নিজের নিরাবরণতার ধ্যানের লক্ষ্যে অস্তিত্ত্বের সামনে নিজের মুখোশ খুলে ফেলতে চাইছেন।’

(Octavio Paz, El laberinto de la soledad, Fondo de Cultura Economica, 1998, p-25)

গরোস্তিসা সম্পর্কে এ দুটি মন্তব্য ও মূল্যায়ন তুলে ধরার কারণ এই যে মেহিকোর এ কবি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা তো নেই-ই, এমনকি এ কবি যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্পর্কে তার ধারণা প্রকাশ করেছিলেন তাও আমাদের কাছে ছিল পুরোপুরি অজানা। রবীন্দ্রনাথকে মেহিকোর একজন অগ্রগণ্য কবি কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা রবীন্দ্রনাথকে বোঝার জন্য যেমন, তেমনি তাকে ঘিরে সেখানকার সাহিত্যিক পরিমণ্ডলটিকে বোঝার জন্যও আমাদের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ।

গরোস্তিসা কেবল মেহিকোর প্রধান কবিই ছিলেন না, ছিলেন শিক্ষাবিদ এবং কূটনীতিবিদ। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন ছাড়াও যৌবনের শুরুর দিকে দেশী-বিদেশী সাহিত্য নিয়ে লিখেছিলেন সুগভীর সমালোচনা। মাত্র একুশ বছর বয়সেই সেনোবিয়া কামপ্র“বি দে হিমেনেথের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গল্পের সংকলন Los Cuentos de Tagore-এর একটি ভূমিকা লেখার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯২২ সালে মেহিকোর Cultura প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এ ভূমিকাটি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা, তেমনি গরোস্তিসার পরবর্তী কাব্য বিবর্তনের ইতিহাসটা বুঝার জন্যও এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

‘এই ভূমিকা লেখার আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি জানতেন এবং তার দ্বারা অনুপ্রাণিতও ছিলেন। দেশীয় সাহিত্যের পাশাপাশি বিদেশি সাহিত্যের প্রতি, বিশেষ করে প্রাচ্যের ও মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ জন্মেছিল লেখালেখির শুরু থেকেই। তার লেখালেখির প্রথম পর্বের ইতিহাসটির দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব-

গরোস্তিসার প্রথম দিককার সাহিত্যকর্ম প্রধান কিছু প্রভাবের দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বিশ শতকের অন্য কয়েকজন লাতিন আমেরিকার তরুণ কবিদের মতোই তার ওপর দারিও এবং অন্যান্য আধুনিকতাবাদীদের প্রভাব মোটেই অনুপস্থিত নয়।

লোপেস বেলার্দের এক নির্ভুল ছায়া তার ওপর রয়েছে। অধিকন্তু ওমর খৈয়ামের বুবাইয়াৎ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যপাঠে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাচ্যের মরমীবাদের প্রতি গরোস্তিসার গভীর আগ্রহ তার প্রথম দিককার লেখাকে ধর্মীয় অনন্যতায় সিক্ত করে দিয়েছে।’

Verity Smith, Encyclopedia of Latin American Literature, Fitzroy Dearborn publishers, 1977, p-380 )

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত সেই ‘ভূমিকা’র তাৎপর্য বুঝানোর জন্য মেহিকোর উত্তরকালের লেখিকা মারসেলা দেল রিও রেইয়েস ‘সমালোচক হিসেবে তরুণ হোসে গরোস্তিসা’ (El joven JosÄ Gorostiza, como crÊtico)

নামে যে প্রবন্ধটি লেখেন তাতে তুলে ধরেন সাহিত্যবিষয়ক গরোস্তিসার ‘সার্বজনীন’ বোধ আর রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি উপস্থিতিকে। তার ভাষায় :

‘পরের বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিবেদিত ‘কুলতুরা’র (cultura) একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় যেখানে বিশ্ব জনীন বিবর্তনের তত্তের সঙ্গে এ সম্পর্কের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন :

‘সবগুলো গল্পই মোটামুটি তীব্রভাবে একটা বিরোধকে প্রকাশ করে। এর ন্যায়সঙ্গত সমাধানটি অনিবার্য এবং আমরাও সবসময় তা-ই চাই, যদিও সাহিত্যিক অস্বাভাবিকতার সঙ্গে জড়িত বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অনেক।

আমার বিশ্বাস কারোর অজানা নয় যে, ন্যায্যতার এ ধারণাই সঙ্গী হয়ে আছে শিল্পকর্মে, তারচেয়েও বেশি এই জীবনে। পাথর থেকে বৃক্ষ, বৃক্ষ থেকে মাংস, মাংস থেকে আত্মা, একইভাবে মহৎ সবকিছুই অনুসরণ করে ন্যায্যতার সৃষ্টিকর্ম।’

আমরা আরও পরে, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলা এ ধারণারই সৃষ্টিশীল প্রতিধ্বনিকে অন্যরূপে তার বিখ্যাত কবিতা অন্তহীন মৃত্যুতেও ছড়িয়ে পড়তে দেখব।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত আলোচনাটিতে তিনি মূলত সংকলিত গল্পগুলোর শৈলী ও শিল্পকৌশল নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু এসব আলোচনা করতে গিয়েই আবার তিনি প্রাচ্যচিন্তার বৈশিষ্ট্য এবং এর দার্শনিক প্রবণতাকে পাশাপাশি রেখে বুঝতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সত্তার আবেদনকে।

গল্পগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন :

‘শিল্পকৌশলের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো ইউরোপীয়দের থেকে ভিন্ন কিছু নয়। স্বাভাবিকভাবেই শৈলীটা প্রত্যেক লেখকেরই আলাদা, তবে কোনো এক শিল্পকৌশলের মধ্যেই লেখক বিকশিত করেন নানা ধরনের শৈলী। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কালে গল্প লিখতে গিয়ে প্রচলিত ধরনে কোনো কিছু যেমন যুক্ত করেন না, তেমনি এ ধরন থেকে কোনো কিছু বর্জনও করেন না। তার কোনো কোনো গল্প যে কোনো দেশেই লিখিত হতে পারত।

রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য গল্প থেকে ‘মাশি’ একটু আলাদা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার অনুপ্রবেশে এটি মূলত উচ্ছল ও অশান্ত সংলাপের এক পরম্পরা। আমার ধারণা রবীন্দ্রনাথ এটাকে একটা নাট্যকর্ম হিসেবে ভেবেছিলেন, কিন্তু লেখার সময় এ উদ্দেশ্যকে খানিকটা বদলে ফেলেছেন যদিও, হতে পারে, লেখার মধ্যে এ অনুপ্রবেশগুলো হাল্কা মন্তব্যের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তবে গল্প ও উপন্যাসের নাটকীয় বৈশিষ্ট্যে উত্তরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের নৈকট্য নতুন কিছু নয়। পশ্চিম থেকে আলাদা ধরনের রীতি ও ধারণার প্রতিফলন এ অদ্ভুত কল্পনার (Fantasia) ফসল রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো আমাদের বিস্মিত করে। উদ্ভট ধরন থেকে দূরবর্তী এ গল্পগুলোর এমন এক সরলতা, প্রফুল্লতা আর স্বাভাবিকতা রয়েছে যা আমাদের কুহকের মতো টেনে নিয়ে যায় তার ধারণাগুলোর কাছে। কোনো কোনো ইউরোপীয় লেখকের জটিল আর উদ্ভট ধর্মতত্ব এখানে দেখি না, বরং দেখা যায় এমন সব ভাবনারাশি যা নিজের ঝর্ণা থেকে পান করছে বিশুদ্ধতাকে। এগুলো গুহ্য মতবাদের পৃষ্ঠাগুলোয় দিন যাপনের ফল নয়, বরং এগুলো হচ্ছে ২৫ বছর গঙ্গার কল্লোলে ভেসে থাকার ফল।’

(Jose Gorostiza, Poesia y Prosa, edited by Miguel Capistran, Siglo Xxi editores, p 240-241)

সেনোবিয়া হিমেনেথকৃত অনুবাদে কেবল এ গল্পগুলোই নয়, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি আগে থেকেই জানতেন, এবং জানতেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরও বহু মূল্যায়নও। এমনকি এসব গল্পের উৎস ও পটভূমিও তিনি যে জানতেন তা ‘গঙ্গার কল্লোলে ভেসে থাকার’ উল্লেখ দেখেই আমরা বুঝতে পারছি। রবীন্দ্রনাথের গল্পের কলাকৌশল ও সারাৎসারের তাৎপর্যকে তিনি কেবল একক কোনো ভাষায় সৃষ্ট সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, বরং গল্পগুলোর স্বাতন্ত্র্য ও সাযুজ্যকে চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি অন্য ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে, মূলত ইউরোপীয় সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের কৃতীকে শনাক্ত করার দুরূহ পথে হেঁটেছেন। তুলনামূলক বিচারে তিনি রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের অনন্যতাকে চিহ্নিত করতে গিয়ে আরও বলেন :

‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম আমাদের কাছে আরও একটি শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরে : ভারতকে আমাদের উপলব্ধি থেকে দূরবর্তী বা আমাদের জ্ঞানের কাছে রুদ্ধদ্বার কোনো দেশ হিসেবে ভাবা উচিত নয়।

রবং উল্টোটাই সত্য : ধর্মের কৃপায় ভারত থেকে আমরা পেতে পারি সত্যভাষণ: ‘সকল সত্ত্বার মধ্যে যে নিজেকে দেখতে পায়, সকল সত্তাকে যে নিজের মতো করে ধারণ করে সেই-ই জানে সত্যকে।’

(Jose Gorostiza, Poesia y Prosa, edited by Miguel Capistran, Siglo Xxi editores, p-241)

লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে হোসে বাসকনসেলোসের মতোই গরোস্তিসাও রবীন্দ্রনাথের কৃতীকে উচ্চতর মর্যাদায় গ্রহণ করেছিলেন মেহিকোতে বা বলা যায় গোটা স্পানঞল জগতে। স্পানঞল জগতে রবীন্দ্রনাথের অন্য মূল্যায়নকারীদের মধ্যে গরোস্তিসার একটা বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যিক পরিচয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন। গরোস্তিসার এ মূলায়নের আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কবি ও ভাবুক পরিচয়ের প্রাধান্যই ছিল সর্বত্র। রবীন্দ্রনাথের গল্পকার পরিচয়টি যে কোনোভাবেই গৌণ নয় তা গরোস্তিসার আগে, সংক্ষেপে কিন্তু তুল্যমূল্যের তাৎপর্যে আর কেউই বলার কৃতিত্ব অর্জন করেননি।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত