| 29 মার্চ 2024
Categories
গল্প ধারাবাহিক

রাজকন্যা ও দস্যুরাজ (পর্ব-১)

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট

 

বলছি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতবর্ষের কথা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে গোটা দেশ। মসনদে রানী ভিক্টোরিয়া। মিউটিনি পরবর্তী সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে শাসন দণ্ড রানীর হাতে আসার পরও ভারতবাসীর মানুষের উপর অত্যাচার অনাচার চলছেই।  ভারত ব্রিটিশদের অধীনে থাকলেও সে সময় প্রায় পাঁচশত স্বাধীন রাজ্য সমান্তরাল ভাবে নিজেদের ক্ষমতায় বিভিন্ন অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা জারি রেখেছিলো। এই সব রাজত্ব ব্রিটিশদের প্রভুত্ব স্বীকার করে নি। ব্রিটিশরাও এদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করা শক্ত মনে করেছিল। কিছু বার্ষিক অনুদান নেয়া ছাড়া এই রাজত্ব গুলোর উপর ব্রিটিশ শাসকদের আর কিছু প্রত্যাশা ছিল না। এ রকমই এক পাহাড় ঘেরা রাজ্যে চাকুরি নিয়ে উপস্থিত হয় এই গল্পের প্রেমাহত নায়ক। পর্বতসম অভিমান ও দুঃখ নিয়ে তার এবং তার প্রিয়তমার শহর ছেড়ে। তার প্রিয়তমার সাথে প্রেম যাপন শুরু হয় চিঠি লেখার মাধ্যমে। না! সেই চিঠি ডাক এ পাঠানোর জন্য লেখা নয়। নিজের কাছে যত্নে রেখে দেওয়ার জন্য লেখা। আশ্চর্যজনক ভাবে প্রেমিক যখন দূর দেশ থেকে চিঠি লিখে প্রিয়তমার সাথে কথোপকথন শুরু করে ঠিক সেই সময়েই তার হদিস না জানা তার প্রিয়তমাও একই ভাবে পত্র লেখা শুরু করে এই আশায় যে, আবার কখনো তাঁদের দেখা হবে এবং তখনই এই চিঠি গুলো তাকে দেবে। প্রেমিক ও তার প্রিয়তমার পোশাকি নাম বা পরিচয় থাকলেও একে অপরকে বিশেষ নামে ডাকতেন। একে ওপরকে এই ভালোবাসার নাম প্রদানের সুনির্দিষ্ট কারণও ঘটেছিলো যা পাঠক যথাসময়ে অবগত হবেন। এই অদ্ভুত প্রেম-কাহিনী পত্রের মাধ্যমে অতিবাহিত হতে থাকে। এই আশ্চর্য প্রেম-কাহিনী বিচ্ছেদ প্রসবিত। বিচ্ছেদ সত্ত্বেও একে ওপরের প্রতি অগাধ ভালোবাসাই এই প্রেম-কাহিনীর পটভূমি। এই প্রেমকাহিনীর পরিণতি কি হবে, ‘রাজকন্যা’ ও তার ‘দস্যুরাজ’ এর মিলন কি দৈবনির্দিষ্ট? পত্র ক্রমে প্রকাশিত হোক এই প্রহেলিকা।

 

চিঠিমালা –

প্রিয়তমা রাজকন্যা,
শেষ পর্যন্ত শহর ছাড়লাম আপনার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য। দৈবক্রমে একটি চাকরি ও জুটে গেলো জানেন! সুন্দরগড় রাজ্যের হিসাব রক্ষকের প্রয়োজন ছিল আর আমার প্রয়োজন ছিল আমাদের স্মৃতি বিজড়িত শহর থেকে দূরে কোথাও জীবিকা নির্বাহের। ঈশ্বরের করুনার দৃষ্টি হয়তো প্রথমবার পড়লো আমার উপর। সংবাদপত্রে ইস্তেহার দেখে আবেদন করা ছিল আগেই। আরও দশ জন আবেদনকারীর মধ্যে আমাকেই পছন্দ করে আমার যে কী অশেষ উপকার করেছেন তা ওনারা নিজেরাই অবগত নন।

আজ শেষ বেলায় পৌঁছেছি সুন্দরগড়ে। স্টেশন এ নায়েব মশাই খান চারেক পেয়াদা নিয়ে আমার অপেক্ষায় ছিলেন। প্রথম দর্শনে মনে হলো নায়েব মশাই শৌখিন মানুষ। চিকন শুভ্র মুখমন্ডলে একটা সন্তর্পণে ছাঁটা সরু গোঁফ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো তৈলাক্ত চুল, ধোপদূরস্ত ধুতি, গলাবন্ধ কোট আর পালিশ করা বুট জুতো সেটা প্রমাণ করছে। আমার এরকম এলোমেলো বেশভূষা, দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তির ছাপ চোখে মুখে নিয়ে ওনার সামনে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুতই লাগছিল। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী নায়েব মশাইয়ের বয়স আন্দাজ করা মুশকিল তবে মুখের বলিরেখার উপস্থিতি বলে দিচ্ছে পঞ্চাশোর্ধ তো হবেনই। পেয়াদাদের দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছিলাম জানেন! এক ঝলকে দেখে মনে হবে একই মানুষের চারটি মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। একই রকম বলিষ্ঠ অবয়ব, একই উচ্চতা, একই রকম মোচড়ানো গোঁফ, একই রকম, নিষ্পলক চাহনি, এমনকি বল্লম ধরা হাতে একই রকম বিশালাকার আংটি। মনে হচ্ছে এরা যেন যমজ সহোদর একই রকম বেশভূষায় মানুষ কে বিভ্রান্ত করতে বেরিয়েছেন। ট্রেন বিস্তর দেরিতে পৌঁছলেও নায়েব মশাইয়ের হাসি মুখের আন্তরিক অভিবাদনে আমি মুহূর্তে আপন মনে করতে শুরু করলাম তাঁদের। “সুন্দরগড় রাজ্যে স্বাগত হে বন্ধু“ বলে জড়িয়ে ধরেছিলেন নায়েব মশাই। এ দেশের সব মানুষই কি এমনই অতিথিবৎসল? আর রাজা? যাঁর কোষাধ্যক্ষের প্রধান সহকারী হিসেবে আজ আমার এই দেশে পদার্পণ।  তিনি কেমন? তিনি কি দাম্ভিক ? নাকি এদের মতোই অতিথিপরায়ণ? আমি অবশ্য এই দেশের অতিথি নই। রাজসভার সামান্য চাকুরে মাত্র। আমার সঙ্গে হয়তো রাজার সামনাসামনি কখনো দেখাই হবে না।

এই চাকরিটা আমার প্রয়োজন ছিল খুব জানেন। আপনার থেকে, আপনার শহর থেকে, যা কিছু একান্তই আমাদের ছিল,সেই সবকিছু থেকে দূরে যাওয়াটা খুব প্রয়োজন ছিল। স্মৃতিরা যেন আমাকে কালো মেঘের মতো ঘিরে রেখেছিলো অষ্টপ্রহর। এখানে পৌঁছেও আপনাকেই যে চিঠি লিখছি তাতে হয়তো বুঝতেই পারছেন, বা আপনি চিরকালই জানেন আপনার থেকে দূরে যাওয়া হয়তো এই জন্মে সম্ভব হবে না আমার। আর ক’দিনের মধ্যেই আপনার বিবাহ। নিশ্চয়ই তার তোড়জোড় চলছে জোর কদমে। এই চিঠি আপনার কাছে পৌঁছবে না কোনো দিন। আপনার বিবাহিত জীবনে বিড়ম্বনার কারণ হতে চাই না আমি। এই চিঠি গুলো আমার কাছেই থেকে যাবে। এই চিঠি গুলোর মাধ্যমেই আপনার সাথে কথা বলবো আমি।

স্টেশন থেকে টাঙ্গায় চড়ে আসার ঘন্টা দুয়েক সময়ে নায়েব মশাইয়ের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেলো। তিনি এই সুন্দরগড়ের অনেক গল্প করলেন। রাজা-রানী, দুই রাজপুত্র এবং এক রাজকন্যার গল্প। এই দেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া রায়ডাক নদীর সৌন্দর্য্যের কথা আর বললেন দস্যু সর্দার ‘পৃথ্বী’র কথা। দেশের দারোগা পেয়াদাদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো এক দস্যুর কথা, যে কিনা দস্যুবৃত্তি করে শুধু মাত্র গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয় লুঠপাটের সামগ্রী। আজ পর্যন্ত কোনো প্রাণ নাশের খবর নেই তার এবং তার দলের কারো হাতে। শুধু মাত্র অতি বিত্তশালীদের গৃহেই হানা দেয় এই দস্যুর দল। রাজাও নাকি এই ব্যাপারটা অবগত। নায়েব মশাইয়ের ধারণা রাজা কিছুটা প্রশ্রয়ের চোখে না দেখলে দস্যু সর্দার পৃথ্বী অনেক আগেই ধরা পড়ে যেত। ‘রাজকন্যা’ আর ‘দস্যু সর্দার’ এই দুটো নাম এসে থমকে দিলো আমার চরাচর। আপনি যে আমার রাজকন্যা আর আমি যে আপনার দস্যুরাজ একথা যতই ভুলে যেতে চাইবো এদেশের রাজকন্যা আর দস্যু সর্দার ততই আমাকে আমাদের ফেলে আসা জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

পাহাড়ে ঘেরা এই সুন্দর দেশে এসে থেকেই একটা ভালো লাগা কাজ করছে মনের মধ্যে। যা অনেক দিন এর মন খারাপের আস্তরণের উপর আলতো পায়ের ছাপ রেখে এগিয়ে চলেছে। আমার মনে হয় এই ভালোলাগার রেশটা বৃদ্ধি পাবে উত্তরোত্তর। পাথর বিছানো মসৃণ রাজপথের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় একটা বাঁক নিতেই অনতিদূরে পাহাড়ের উপর রাজপ্রাসাদ চোখে পড়লো। গোধূলি আলো মেখে অদ্ভুত মায়াবী লাগছিল তাকে। প্রাসাদ এর মাথায় বিভিন্ন নিশান হাওয়ায় উড়ছে। নায়েব মশাই বললেন হলুদ নিশানটা আমার জন্য। যখনই কোনো ভিন দেশের মানুষ দেশে পদার্পণ করেন তার জন্য এই নিশানটি তোলা হয়। একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিল আমার মধ্যে তখন। একজন সাধারণ মানুষের জন্য কত সম্মান এর ব্যবস্থা এ দেশে।
পাথরের তৈরী কর্মী আবাসন এর ঘর গুলো ছোট হলেও আলো হাওয়ার অবাধ যাতায়াত। একাধিক ঘি এর প্রদীপ রয়েছে কক্ষে। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই একজন দাসী এসে সেগুলি জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। এই আবাসন এ শতাধিক কক্ষ রয়েছে, আর তাতে রয়েছেন রাজ কর্মচারী, শ্রেণীনায়ক প্রভৃতি মানুষজন। আমার কক্ষটি ছোট হলেও আরামের কোনো ত্রুটি হবে না বলেই মনে হয়। শরীরে ক্লান্তির উৎসব চলছে এখন। আজ তবে এখানেই থামি। কাল থেকে আমার নতুন দেশে, নতুন মানুষদের সাথে, নতুন কর্মজীবনে শুরু হতে চলেছে।প্রার্থনা করবেন অভিজ্ঞতা যেন সুখকর হয়।
আপনার, সাত জন্মের শত্রু

দস্যুরাজ

 

আর অপর পাশে? রাজকন্যাও  লিখে চলেছেন চিঠি বেদনার অক্ষরে। তিনি লিখছেন…

আমার দস্যুরাজ,
হ্যাঁ আমি খুব ভালো আছি, থাকবো নাইবা কেন? সে রকমই তো কথা ছিলো। আমাদের সে রকমই তো কথা ছিল, যদি চলাচলের পথ কখনও সমান্তরাল চলতে শুরু করে আমাদের নিজস্ব যাপনে কখনো তার ছায়া পড়বে না। এমনটাই তো কথা ছিল যে, আমরা ভালো থাকবো। আমি তাই ভালো আছি। আমি তাই খুব ভালো আছি …।

প্রতিদিনের মত আজও গঙ্গার ঘাটে ভট্টাচার্য মশাইয়ের মেঘ ডমরু স্বরে

“ওম জবাকুসুম সঙ্কাশং, কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্, ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্ন
প্রনতহোস্মি দিবাকরম্।”

শুনে ঘুম ভেঙ্গেছে আপনার রাজকন্যার। অন্যদিকে বাড়ির গোটা উঠোনটা ঝাট দিয়ে, গোবর জল দিয়ে ধুয়ে মুছে ঝাঁ চকচকে করছে অন্নদা মাসি যেন গত রাতের সমস্ত পাপ স্খালন হচ্ছে। যেন এই গোবর জলের সঙ্গে মুছে যাচ্ছে পাপগুলো একটু একটু করে। চুপ করে শুয়ে সেই ধোয়া মোছা দেখলো আপনার রাজকন্যা। ওদিকে চক্রবর্তী কাকু চেঁচিয়ে ডাকছে তার ভাইপোকে। কিছু গাঁদা ফুলের মালা এসেছে চৌপথিতে সেখান থেকে নিয়ে আসার জন্য। আজ তো প্রচুর ফুল দরকার। সরকার বাড়ির একমাত্র কন্যাকে ভাবি শ্বশুরবাড়ি থেকে আশীর্বাদ করতে আসবেন ওঁরা। এখন সরকার বাড়িতে সাজো সাজো রব। চক্রবর্তী কাকুর ভাইপো গঙ্গাধর, যে নাম, ডাকের সুবিধের জন্য ছোট হয়ে এখন শুধু গঙ্গায় ঠেকেছে, এই বাড়ির বাইরের ফাই ফরমাসের জন্য নতুন বহাল হয়েছে। আমি বাইরের ঘরের জানলা ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, গঙ্গার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম সে এক অসীম শূণ্যতা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কী জানি কেন, আমার মনে হল গঙ্গা জানে আমার এই ভালো থাকার ইতিহাস। হ্যাঁ দস্যুরাজ আপনার রাজকন্যা খুব ভালো আছে। সব তো চলছে নিজের মতই, শুধু এই শহরের বাতাস থমকে আছে, শুধু পাখি আর গাছের পাতাদের প্রেম আটকে গেছে গাছের শাঁখায়, শুধু ভট্টাচার্য মশাইয়ের ডাক শুনেও সূর্য নেমে আসেনি আজ এই শহরে। এ শহর থমকে গেছে, শুধু আপনি নেই বলে।কাল সন্ধ্যায় দিঘি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল ভোরের দিকেই আপনি চলে গেছেন শহর ছেড়ে। কোথায় গেছেন কেউ জানে না। খবরের অভিঘাতে, ঘটনার আঘাতে দিঘিকে একটি চড় মেরেছিলাম।সেই দিঘিকে যে অন্নদামাসির সঙ্গে দেশে চলে গেলে আমি কেঁদেকেটে একাকার করি। সেই দিঘিকে মেরেছিলাম। যাকে আস্তাকুঁড়েতে কুড়িয়ে পাওয়ার পর অন্নদা মাসি আমাদের কাছেই নিয়ে এসেছিল।সেই থেকে দিঘি এখানেই। ওর নামটা যে আমারই দেয়া সেজন্য আপনি কত মজাই না করেছেন একটা সময়। সেই একান্ত সহচরীকে আমি চড় মেরে দিলাম। না আপনার রাজকন্যা কাঁদতে পারেনি স্তব্ধ হয়ে গেছিল শুধু!  চুপ করে বসেছিল কিছুক্ষণ। কতক্ষণ জানিনা, সম্বিত ফেরে মায়ের ডাকে। কোলে তখন দুটো খোলা চিঠি। একটি আপনাকে দিঘির হাতে পাঠানো আমার চিঠি, আর একটি আপনার শোয়ার ঘরের টেবিলে রাখা ছিল এমন এক চিঠি যা কারো উদ্দেশ্যে লেখা নয়। যার ওপরে নাম নেই, বাইরে ঠিকানা নেই, কিন্তু যেন এক অবধারিত প্রেরক তার অবশ্যম্ভাবী অদৃশ্য ঠিকানার জন্যই লিখে রেখে গেছেন শুধু একটি শব্দ, ‘এলাম…।’

মা ডেকে গেছিলেন, সন্ধ্যারতি শুরু হবে সারদা মায়ের ঘাটে,আমি যেন তৈরী হয়ে ওখানে চলে যাই।
আপনি বলুন দস্যুরাজ আমার কী করা উচিৎ ছিল? সেজেগুজে হাসি হাসি মুখে মায়ের ঘাটে গিয়ে বসা? কী করে যেতাম বলুন,ওই ঘাটে যে আমাদের এক পৃথিবী স্মৃতি। আমাদের বন্ধুত্ব বন্ধনে পরিণত হওয়ার ইতিহাস জানে এই সারদা মায়ের ঘাট,আমাদের প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা জানে এই ঘাট, আমাদের প্রথম পরস্পরের ঠোঁটে আশ্রয়ের ইতিহাস জানে এই সারদা মায়ের ঘাটে, আমাদের অনেক প্রথম জানে এই গঙ্গার ঘাট। সেখানে আপনি নেই,আমি কী করে গিয়ে বসি হাসিমুখে আপনিই বলুন দস্যুরাজ।
এবার আমার ডাক এসেছে, যেতে হবে। আপনি অবশ্য সামনে থাকলে আদুরে বকুনি দিয়ে বলতেন ‘যেতে হবে আবার কী কথা, বলুন আসি।’
আপনাকে এই চিঠি কবে পৌঁছে দিতে পারবো জানি না, তবে একদিন পৌঁছে দেবোই। হ্যাঁ আমি জানি না আপনি কোথায় আছেন। আমি আপনার ঠিকানা কখনো খুঁজে পাবো কিনা জানি না তবু কিছু অবধারিত সত্য থাকে যার প্রকাশ বড় ম্লান করে পারিপার্শ্ব। তেমনই এক অবধারিত সত্য আপনাকে এই সম্বোধন। দস্যুরাজ! একজন আপাত ভদ্রলোক কিছু দস্যিপনা করেই এই নাম পেয়েছেন এটা যেমন অবধারিত সত্য, তেমনই আপনার নামের সঙ্গে ‘প্রিয়’ বা ‘প্রাণাধিকেষু’ লেখাতেও আমার আপত্তি কারণও সেই অবধারিত সত্য। আপনি আমার প্রিয়তম অলঙ্কার আমার শ্বাস প্রশ্বাস। চিঠির শুরুতে সেসব লিখে একে আর ম্লান নাই বা করলাম। আবার আমি এও জানি এই চিঠি আপনাকে লেখা একে ছোঁয়ার অধিকার শুধু আপনার। একদিন ছুঁয়ে দেখবেন আপনি ঠিক এই চিঠির শরীর। যত দূরেই থাকুন আপনি আমার কাছেই আছেন। আজ আসি।

আপনার রাজকন্যা

 

চিঠিমালা -২

প্রিয়তমা রাজকন্যা,
নতুন দেশে, নতুন কর্মে আজ আমার একটি গোটা সপ্তাহ অতিবাহিত হলো। ইতিমধ্যেই কোষাধক্ষ্য এর সহকারীর কাজকর্ম অনেকটাই রপ্ত করতে পেরেছি। কোষাধক্ষ্য পৌঢ় উমাপতি সিংহরায় মহাশয়। রাজ কোষাগার দেখা শোনা করছেন ২৫ বছরেরও বেশি। স্থূল খর্বকায় হলেও ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারা। বেশ ভুষায় অত্যন্ত মার্জিত রুচির ছাপ। দুই কানের কাছে অল্প কিছু শ্বেত শুভ্র কেশ অবশিষ্ট মাত্র। শশ্রু গুম্ফহীন গোলগাল মুখ। মোটের উপর সম্ভ্রম আদায়কারী চেহারা। অতিশয় গুরুগম্ভীর এবং বদরাগী মানুষ হলেও আমাকে যে কিছুটা স্নেহের চোখে দেখেন সে ইঙ্গিত আমি পেয়েছি। তার একটি কারণ আমার কর্মনিপুণতা সেটাও বুঝতে অসুবিধা হয় না। দিনান্তের কর্মবিরতীতে আমাদের বেশ কিছুক্ষণ বাক্যালাপও হয় আজকাল। ওনার সহধর্মিনী অন্নপূর্ণা দেবীর হাতের উপাদেয় ভোজনও করার সুযোগ হয়েছে এর মধ্যেই। আমার প্রতি স্নেহের দৃষ্টি থাকলেও কাজে ত্রুটি বা অমনোযোগী হলে তিরস্কার করতে কখনোই ব্যর্থ হোন না উমাপতি মহাশয়। একবার হাতে কলম নিয়ে হিসেবের খাতার দিকে অমনোযোগী হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে “সারাদিন মন কোথায় পরে থাকে?” শুনে সম্বিৎ ফিরে পাই। মন যে উত্তর কলিকাতার সরকার বাড়ির এক রাজকন্যার কাছেই রয়ে গেছে, সুন্দরগড়ের রাজ কোষাগারে শুধু যে আমার শরীর উপস্থিত হয়েছে সে কথা কি করে কাউকে বোঝাই। জমিদার বাড়ির হবু বঁধূমাতাটির বাগদানের আড়ম্বরে কোন ত্রুটি ছিলনা নিশ্চয়ই। আমার রাজকন্যা বাস্তবিকই রাজকন্যার যাপনে থাকুন। এর অধিক চাইবার মত বিশেষ কিছু ছিলনা আমার কোনদিনই। যে পুতুল স্বপ্নে দেখে মধ্যরাতে ঘুম ভাঙ্গার পর জ্যাঠা, দাদা কাকারা তখনই সেই স্বপ্ন হাতে তুলে দেওয়ার সংকল্প করতেন। সরকার বাড়ির সেই চোখের মণিটিকে নিজের অস্বাচ্ছেন্দ্যের যাপনে এনে কষ্ট দিলে, সে হাসিমুখে মেনে নিলেও আমি সেটা সহ্য করতে পারতামনা। একজন চালচুলোহীন মানুষের জীবনে আপনার প্রবেশ, অকল্পনীয়ের আখ্যান হত। আপনার অভিভাবকরা যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কলকাতা ত্যাগ করার পূর্বে এই কথাগুলো বলবো ভেবেই যে চিঠি লিখবো ঠিক করেছিলাম, শেষ পর্যন্ত শত চেষ্টা সত্ত্বেও সেই চিঠি লেখা হয়ে উঠলো না। শুধু একটি শব্দের শেষ চিঠিতে বিদায় নিয়েছিলাম। সেই চিঠি আপনার কাছে পৌঁছেছে কিনা জানা নেই ।

রাজকন্যা, আপনাকে রায়ডাক এর কথা শোনাই এবার। পর্বত থেকে অবরোহন করা এক উচ্ছল কিশোরী যেন সুন্দরগড় উপত্যকার মধ্যে দিয়ে নবযৌবনের উৎকর্ষ ও ছলা কলা নিয়ে বয়ে চলেছে। পূর্ব উপগত নয় এরকম কোনো স্থানে পৌঁছে আমি যে এরকম অতীত-আর্ত হয়ে পড়ব তা আমার কাছে অকল্পনীয় ও আশ্চর্যজনক ছিল। রায়ডাক এর ফেনীল ফিরোজা বর্ণের জলরাশির দিকে কিছুক্ষণ মনোমুগ্ধ অবস্থায় চেয়ে থাকতে থাকতে ইন্দ্রজাল এর মতো আমি যেন আমাদের সারদা মা এর ঘাটে উপস্থিত হলাম সেইদিনে যেদিন আপনি প্রথমবার আমার সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। আপনার রূপের প্রশংসা কোনোদিনও আমি করিনি, বরং সর্বসমক্ষে ব্যঙ্গ বিদ্রূপই করতাম নিয়ত আর আমার বিশ্বাস আমার ওপর কপট রাগ দেখালেও আমার চোখের মুগ্ধতা আপনার দৃষ্টিগোচর হতোই। সেইদিন গোধূলি আলোয়, হাল্কা ধূসরবর্ণ বস্ত্রে, কপালে শ্বেত চন্দনের ফোঁটায় শোভিত আপনাকে যে কি অপরূপ লেগেছিলো তা বলে বোঝানোর মতো শব্দ আমার জানা নেই। দিঘি কে তফাতে দাঁড় করিয়ে রেখে মন্দিরের পাশ দিয়ে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিলেন। আমার সামনে দাঁড়ানোর পরও বাকরুদ্ধ হয়ে আপনাকে দেখছিলাম কেবল। কিছুটা সম্বিৎ ফিরেছিল যখন আপনি বলেছিলেন “ কি? শুধু দেখেই যাবেন নাকি কিছু বলবেনও?”। মুখ থেকে কথা তখনও সরছিল না জানেন। চিবুকে হাত দিয়ে মুখটা একটু তুলে শুধু বলেছিলাম “রাজকন্যা”। দু’চোখ ভর্তি লজ্জা নিয়েও আপনি আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে ছিলেন। কম্পনরত গোলাপী অধরোষ্ঠর অমোঘ আকর্ষণে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিমজ্জিত হওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় মৃদু ঠেলা দিয়ে “দস্যু কোথাকার” বলেই উল্টো পথে দৌড় দিয়েছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা উঠেই ফিরে তাকিয়ে আপনার চারদিক আলোকিত করা হাসি দিয়ে বলেছিলেন “আমার দস্যুরাজ”। তারপর আর দাঁড়ান নি। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম শুধু। ঠিক যেমনভাবে স্মৃতি রোমন্থনোত্তর দাঁড়িয়েছিলাম রায়ডাকের পাড়ে। সময় কত বদলে গেছে তাই না রাজকন্যা? আজ আমাদের ছুঁয়ে চলা নদীও পৃথক।
এখন রাত্রি প্রথম প্রহর অবসানের মুখে। কিছুক্ষণ পূর্বে কর্মী আবাসন এর প্রধান রক্ষী জানিয়ে গেলো আমি যেন দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বে নিদ্রিত না হই। কারণ জানতে চাওয়ায় রক্ষী জানালো রাজপ্রাসাদ থেকে আমার জন্য কোনো আদেশ আসার সংবাদ আছে তার কাছে। এও জানালো এ বিষয়ে অন্য কারুর সাথে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এই মুহূর্তে যার পর নাই বিস্মিত, রাজকন্যা। আমার জন্য আদেশ? তাও আবার খোদ রাজপ্রাসাদ থেকে? আদেশ তো কর্মক্ষেত্রেই আসতে পারতো। তবে মধ্যরাতে কেন? কেনই বা অন্য কর্মচারী দের সাথে আলোচনা করা যাবে না? এটা কি আদেশ? নাকি শাস্তি বিধান? কিন্তু শাস্তি কেন হবে? আমি জ্ঞানত কোনো অন্যায় করিনি। কর্মে ভুল ভ্রান্তি থাকলে উমাপতি সিংহরায় নিশ্চই পূর্বেই শনাক্ত করতেন। তাহলে বিষয় টা কি? আমার ধীশক্তি অপারগ এই রহস্যের কিনারায়। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই আর। আজ তবে এখানেই শেষ করি।

আপনার সাত জন্মের শত্রু
আপনার দস্যুরাজ

 

রাজকন্যাও লিখছেন…

আমার দস্যুরাজ,
এখানে এখনও শরতের মিঠে রোদ্দুর আর কর্কশ উঠোনের প্রেমালাপ শুরু হয়নি। যুবতী ভাদ্রের বুকের ওঠানামায় কান পাতলেই শোনা যায় যেন। দিন দুয়েক হল ভট্টাচার্য মশাইয়ের আমবাত বৃদ্ধির কারণে তাঁর জলদগম্ভীর সূর্য প্রণামে ঘুম ভাঙ্গেনি আপনার রাজকন্যার বরং ভট্টাচার্য মশাইয়ের বাড়ি থেকে ভেসে এসেছে সূর্যতপার ভৈরবী রাগের “যাও ম্যায় তোসে নাহী বোলুঁ’র” করুণ আর্তি। চরাচর যেন নালিশ বিছিয়ে রেখেছে আপনার জন্য দস্যুরাজ। নালিশ আপনার গোপনে প্রস্থানের জন্য নয়। নালিশ আপনার প্রস্থানের পরেও গভীর অসুখের মতো চরাচরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার জন্য।

ত্রিপুরার পুষ্পদংশন গ্রামের জমিদার ব্রজনাথ রায় চৌধুরীর একমাত্র পুত্র হৃদকমল রায় চৌধুরীর সঙ্গে আমার বিবাহ স্থির হয়েছে। এটাই কি আমার অপরাধ দস্যুরাজ? আপনার এক অক্ষরের শেষতম চিঠি ‘এলাম’ এর আগে আপনি যে চিঠি দিয়েছিলেন তারও উত্তর না নিয়ে আপনি চলে গেলেন। আপনি আপনার রাজকন্যাকে চেনেন সেই কত বছর আগে থেকে, আপনি বলতেন, “শত বছর আগে থেকে”, তাই যদি হয় তাহলে চিঠিতে এমন কথা লিখেছেন কেন? কেন এই জমিদার পুত্রের তুলনায় নিজের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন? কেন আপনি নিজের সঙ্গে যার তার তুলনা করেন দস্যুরাজ? আমি কি এতটাই অবহেলার পাত্রী! যদি না হই, তাহলে ভরসা রাখতে পারলেন না কেন নিজের প্রেমের প্রতি?তাহলে কেন ভাবতে পারেননি আপনার রাজকন্যা যাঁকে ভালোবেসেছে, তিনি নিশ্চিত ভালোবাসার মতই, অপরাজেয়, অতুলনীয়!

“এদিকে মুখটা তোলো তো মা” আশীর্বাদ করতে আসা জমিদারজায়া প্রিয়বালা রায় চৌধুরানির কথা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এসেছিল কানে, যেন আমার উত্তরের কোন দায় নেই এমন শূণ্য দৃষ্টিতে আমি আপনাকে খুঁজছিলাম ওঁর বক্তব্যে দস্যুরাজ,।আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল এমনই করেই আপনার আমার চিবুক ধরে মুখ তোলার আর্তি।
সারা বিশ্বের সমস্ত ‘অকাজ’ এর দায়িত্ব যেন আপনারই সবল কাঁধে, হ্যাঁ আপনিই পৃথিবীর সব কাজকে অকাজ বলতে শিখিয়েছিলেন, আমি ভুলে গেলেই মনে করিয়ে দিতেন, আমাদের দেখা হওয়া আর পরস্পরে ডুবে যাওয়া সময়টুকু ছাড়া গোটা বিশ্বের সবটাই অকাজ। সমস্ত অকাজ সেরে আমার কাছে আসতে অবধারিত দেরি হলে আমি কপট অভিমানে মুখ ফুলিয়ে রাখলে, আপনি ঠিক এমনটাই করতেন। চিবুক ধরে মজা করে গাইতেন “ওহে চন্দ্রবদনি রাই বিনোদিনী, মুখখানি প্রিয়ে তোল, তোমারই নয়নে চাহিয়া আমার রজনী প্রভাত হল।” আমি হেসে ফেলতাম, কিন্তু আশীর্বাদের সময় চারিদিকে চেয়ে আপনাকে খুঁজে যখন পেলাম না, অকারণ জল এসেছিল চোখে। হ্যাঁ অকারণেই বটে!কেন যে আপনাকে খোঁজা! জানি আপনি চলে গেছেন। কঠিন সত্য। আর কে না জানে যত কঠিনই হোক, সত্যই সুন্দর। আমি জানি আমার অবয়ব জানে আপনি চলে গেছেন। আমার মন জানে না জানলেও মানতে চায় না যে।

সরকার বাড়ির একমাত্র কন্যার আশীর্বাদ সুসম্পন্ন হয়েছে গতকাল। খুব আড়ম্বরের সঙ্গেই সম্পন্ন হয়েছে। কেনই বা হবে না। জ্যাঠা কাকা মিলিয়ে আমাদের এই সরকার বাড়ির একটিমাত্র কন্যাসন্তান সেজো ভাই অর্থাৎ আমার বাবার ঘরেই তো এসেছে। সে তো আপনার অজানা নয় দস্যুরাজ। ঘটনাচক্রে সব মিলিয়ে বাড়ির সাতপুত্রের একটিই বোন বলে পড়শিরা সাত ভাই চম্পা বলেন। এই নিয়েও আপনি মাঝেমাঝে মস্করা করতেন মনে আছে? লোকে বলতো বাপ সোহাগী মেয়ে, আমি কি শুধু বাপ সোহাগী! আমি জ্যাঠা, কাকা, দাদা, ভাই, পিসি, জেঠিমা কাকিমাদেরও নয়নের মণি। আমি না চাইতে জিনিসে ভরে গেছে ঘর চিরদিন। অথচ আপনি আমার সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটি। ভরসা রাখতে পারলেন না আমার ওপর। আপাত সুখী রাজকন্যাটি তার দস্যুরাজকেই হারালো। দস্যুরাজের সামান্য ভুলের জন্যই রাজকন্যাটি তার আজন্মের তৃষ্ণা মেটাতে পারলোনা।

সূর্যতপার কণ্ঠে যেন কবি সুরদাস বসত করেন, সেই ভজনের সুর মূর্চ্ছনায় আপনার রাজকন্যা গতপরশু পাগলের মত ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল দস্যুরাজ।
“প্রভূজী মোরে অবগুণ চিত্ না ধরো,
সমদর্শী হ্যায় নাম তিহারো, চাহো তো পাড় করো…”
আমার মনে হয়েছিল আপনি এসেছেন। আপনি ঠিক রাজকন্যার ব্যথার খবর পেয়েছেন মনে মনে।পাবেন নাইবা কেন? আমরা তো অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আমাদের প্রশ্বাসের চলাচল, গতি, ছন্দ সবই যে একখাতে বয় কিন্তু কোথায় আপনি? আপনি কোথাও নেই অথচ কী ভীষণ রকম আছেন। এই যে যখন একছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে আপনাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম, ভিজে যাচ্ছিলাম অসীম শূণ্যতায়, আপনি শুনতে পাচ্ছিলেন না সেই ব্যথার অনুরণন? সেদিন সূর্য আসেনি সরকার বাড়িতে। শুধু য়মন রাগের কান্নায়, আর্তিতে উঠোন ভরে গিয়েছিল।
আজকাল আমার সূর্যতপাকে ছুঁয়ে থাকতে ভালো লাগে। এই স্বজনহীন দেশে ওই তো ছিল আপনার একমাত্র বন্ধু। এই যে আপনাদের পরস্পরকে ‘সখা’ বলে সম্বোধন, এই যে পরস্পরের প্রতি ভরসা! এই সম্পর্কের গায়েও আমার অভিমান লেগে গেছিল দস্যুরাজ। আমি ছাড়া আপনার ওপর কারো অধিকার থাকুক সেই সত্যকে আমি অনধিকার প্রবেশ বলেই মান্য করেছি বরাবর অথচ আমার শান্ত দস্যুরাজ, সৌম্য দস্যুরাজ আমার এই অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়েও আপনি আমাকে শীতল করেছেন। ভাসিয়েছেন আপনার আদর বৃষ্টিতে…। সেই বানভাসিতে আমার সবুজ ইর্ষারা ভেসে গেছে বারবার। আমি দেখেছিলাম আপনি একবার সূর্যতপার হাতের ক্ষততে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সে রাতে আমি ঘুমোতে পারছিলাম না দস্যুরাজ। পরদিন আপনাকে দেখেও আমি স্বাভাবিক থাকার ব্যর্থ প্রয়াস করেছিলাম মাত্র, আপনি সুযোগ পেয়ে আমার হাত দুটো ধরে বলেছিলেন “ওই দুই হাতে বন্ধুত্ব রাখা আছে, শ্রীকৃষ্ণের যেমন সুদামা সখা ঠিক তেমনই, আর এই দুই হাতে আছে জীবন, শ্রীকৃষ্ণের যেমন আছেন শ্রীরাধিকা। ওই দুটি হাত ছোঁয়া যায় শুধু এই দুটি হাত ছুঁয়ে থাকা যায় অনন্তকাল।”

আপনি কি সব বিস্মৃত হয়েছেন দস্যুরাজ? এই দু’টি হাতে আপনি অনন্ত অপেক্ষা রেখে কোথায় গেলেন, বলে গেলেন না একটিবার? এ কেমন অবিচার আপনার, এ কেমন প্রেম?
সূর্যতপার যে হাতে আপনি হাত রেখেছিলেন বলে তীব্র অভিমানে ভেসেছিলাম, আপনি বোঝাবার পর যখন চোখে বর্ষা নেমেছিল? আপনি অস্ফুটে বলেছিলেন ‘আদর’ আর আমার অভিমানে ভেজা কণ্ঠ বলেছিল ‘চাই না’ আপনি বলেছিলেন “আরও আরও আদর” আমি আবারও বলেছিলাম “চাই না” আর আপনি বর্ষাকালের জেদি মিঠে রোদ্দুরের মত বলেছিলেন “আরও আরও আরও আদর” আর আমি হাল ছেড়ে তখন রাপ্তী নদী হয়ে গিয়েছিলাম। ঝাঁপিয়ে অমলতাসের বুকে গড়িয়ে পড়ে অবশেষে বলেছিলাম “নিলাম”। সেই সূর্যতপার সে দুটি হাত একটু ছুঁয়ে দেখবো বলে, আপনার ছোঁয়া অনুভব করবো বলেই ওর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, দাঁড়াতেই শুনতে পেলাম…
“এ ভরা বাদর
মাহ ভাদর
শূণ্য মন্দির মোর”
এই মিশ্র মালহার এর প্রতিটি সুরকণা আপনাকেই খুঁজছে।ফিরে আসুন দস্যুরাজ। আমি অনন্তকাল অপেক্ষা করছি। আমার মন্দির শূণ্য হয়ে আছে। ফিরে আসুন…।

আপনার রাজকন্যা

 

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত