| 29 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

রাজকন্যা ও দস্যুরাজ (পর্ব-৫)

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

 

প্রকৃত ভালোবাসার মাহাত্ম্য এই যে দূরে গিয়েও দূরে চলে যাওয়া যায় না। মনের ঘরে ভালোবাসার মানুষের একটা স্থায়ী বাসগৃহ তৈরী হয়ে যায় অজান্তেই। মনের সেই মানুষটির সঙ্গে কথাবার্তা, অনুভূতির আদান প্রদান চলতে থাকে মনে মনেই। জমিদার বংশের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে  রাজেশ্বরীর বিবাহ স্থির হওয়ার তোড়জোড় যখন শুরু করে সরকার বাড়ির লোকজন, তখন রাজেশ্বরীর একটা নিছক মস্করায় মনে আঘাত লেগে যায় তার দস্যুরাজ প্রতিবিম্বর। এতটাই আঘাত লাগে মনে যে প্রতিবিম্ব স্থির করে তার রাজকন্যার জীবন থেকে দূরে চলে যাওয়াই উচিৎ। তার মনে হয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র কন্যার তার মতো কর্মহীন অস্বচ্ছল একজন মানুষের সঙ্গে জীবন-যাপন সঙ্গত নয়। একদিন রাজেশ্বরীর কাছে জানতে চায় সে “তোমার বিবাহ স্থির হচ্ছে কোনো জমিদার বাড়িতে শুনতে পেলাম, তুমি চাও তোমার বিবাহ সেখানেই হোক?“ রাজেশ্বরী তার দস্যুরাজের এই মনের অবস্থা খুব ভালো ভাবে চিনতো। এবং এইসময় একটু রহস্য করলে তার মনে যে ঈর্ষার উদ্রেক হবে সেটাও ভালো করে জানতো। সেটা উপভোগও করতো সে। রাজেশ্বরী তাই চোখ নামিয়ে রঙ্গ করে উত্তর দেয় “রাজেশ্বরী সরকার এর জন্মই  হয়েছে কোন রাজার অর্ধাঙ্গিনী হওয়ার জন্য।” বজ্রাঘাতের মতো কথাগুলো কানে বেজেছিল প্রতিবিম্বর। বরাবরের অভিমানী সে। মুহূর্তের মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল আর রাজেশ্বরী ফেটে পড়েছিল অট্টহাস্যে। ভালোবাসার মানুষের মনের সঠিক ভাব বুঝতে পারেনি দুজনের কেউই। রাজেশ্বরী যে রাজা বলতে তার দস্যুরাজ প্রতিবিম্বকেই বুঝিয়েছে সেটা যেমন বোঝেনি প্রতিবিম্ব, তেমনই তার দস্যুরাজের যে অভিমান নয় আঘাত লেগেছিল মনে, সেটাও বুঝতে পারেনি রাজেশ্বরী। এরপর আর দেখা হয়নি তাদের। সুদূর সুন্দরগড়ে একটি চাকরি নিয়ে তার রাজকন্যার জন্য এক শব্দের একটি চিঠি রেখে চলে যায় সে। সুন্দরগড়ে এসে তার রাজকন্যাকে ভুলতে পারেনি এক মুহূর্তের জন্যেও। তার সঙ্গে কথোপকথন চলতে থাকে নিয়মিত চিঠি লেখার মাধ্যমে। যে চিঠি নিজের কাছেই জমিয়ে রাখে সে। একই ভাবে দস্যুরাজের আকস্মিক প্রস্থানে বিহ্বল রাজকন্যাও চিঠি লেখা শুরু করে তার দস্যুরাজকে। সেই চিঠিও তার নিজের কাছেই রেখে দেয় সে। উভয়ের চিঠিতেই পারস্পারিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে মান অভিমান ও মনোকষ্ট পরতে পরতে জমা হতে থাকে। একদিকে প্রতিবিম্ব যেমন কর্মনিপুণতা ও সাহসের জন্য সুন্দরগড়ের রাজপরিবারের খুব কাছে চলে এসেছে অন্যদিকে পুষ্পদংশন জমিদার পুত্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর রাজেশ্বরী জানতে পারে তিনি রাজনন্দিনী নামের এক নর্তকীকে ভালোবাসেন এবং তাকেই বিবাহ করতে চান। এরকম আনন্দ সংবাদে আপ্লুত রাজেশ্বরী প্রার্থনা করছে তার দস্যুরাজের ফিরে আসার, আর প্রতিবিম্ব আর একটিবার তার রাজকন্যাকে দেখার জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ছে ক্রমশ। দৈবক্রমে সুন্দরগড়ের রাজার পারিবারিক বন্ধু পুষ্পদংশন গ্রামের জমিদার ব্রজনাথ রায় চৌধুরী মশাই। সপরিবারে কিছুদিন সুন্দরগড় রাজ্যে কাটিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণে সম্মতিও জানিয়েছেন তিনি। রাজঅতিথির আমন্ত্রণের সব ব্যবস্থার দায়িত্বভার পড়েছে প্রতিবিম্বর উপর। নিয়তি কি দস্যুরাজ আর তার রাজকন্যাকে আরও একবার কাছে আনার ষড়যন্ত্র রচনা করে রেখেছে? রাজকন্যা ও দস্যুরাজ কেউই এ ব্যাপারে অবগত নয়।  তাদের একে অপরকে অজ্ঞাবাহী চিঠি লেখা চলছেই। 

প্রিয়তমা রাজকন্যা, 

সুন্দরগড়ে আসার পর থেকেই বিভিন্ন স্থান, কাল এবং পাত্র আপনাকে আরও বেশি করে মনে পড়িয়ে দিচ্ছে আমাকে। আমার নতুন বাসস্থানে আসার পর থেকেই আমার প্রতিবেশী রাজ পুরোহিত ত্রিলোকেশ্বর ভট্টাচাৰ্য মহাশয়ের “ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং, কাশ্যপায়েং মহাদ্যুতিম” মন্ত্র উচ্চারণ শুনে ঘুম ভাঙছে আমারও। ঠিক যেভাবে আপনার ঘুম ভাঙতো আপনাদের পুরোহিত ভটাচার্যি মশাইয়ের এই মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে। আমি জানি না আপনার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে কিনা এতদিনে। আমি জানিনা আপনি আপনার রাজার গৃহে,  আপনার শ্বশুরালয়ে চলে গেছেন কিনা। সেখানে ভট্টাচার্যি মশাইয়ের মন্ত্র উচ্চারণের পরিবর্তে হয়তো আপনার রাজকুমারের মিষ্টি কথা শুনে নিদ্রাভঙ্গ হয় আপনার। আপনার জীবনে পৃথিবীর সমস্ত সুখ অঝর ধারায় ঝরে পড়ুক ঈশ্বরের কাছে এটাই প্রার্থনা করি। 

আপনার মনে আছে রাজকন্যা, সংস্কৃত আর অঙ্ক পড়াতে পড়াতে ভট্টাচার্যি মশাইয়ের কন্যা  সূর্যতপার সঙ্গে  একটা সখ্য তৈরী হয় আমার। আপনি সেই নিয়ে কত অভিমান ব্যক্ত করেছেন আমার কাছে। আপনি কিছুতেই বুঝতে চাইতেন না  আমরা শুধু একে ওপরের শুভার্থী মিত্র ছিলাম মাত্র। আপনার মান ভাঙতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হতো আমাকে। আর ঠিক একই ভাবে আপনি কোন কথায় গঙ্গাধরের উল্লেখটুকু করলেও গাত্রদহন হতো আমার। গঙ্গাকে সামান্য পড়া না পারার জন্য অতিরিক্ত শাস্তিও দিয়েছি এর জন্য কতবার। আর আপনি আমার সেই অভিমান তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতেন। অনেক্ষণ উপভোগ করার পরে আমার মান ভাঙাতে উদ্যত হতেন। শুধু আমার শেষ অভিমান ভাঙানোর সুযোগ আপনাকে দিইনি। সেই উপায়ও আপনার ছিল না। সম্ভ্রান্ত বাড়ির কন্যা যে আরেক সম্ভ্রান্ত বাড়িতেই পুত্রবধূ হিসেবে যাবেন সেটা আর আশ্চর্যের কী? আপনি হয়তো বাড়ির গুরুজনদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতেও পারতেন না। তাই আমাকেই আপনার জীবন থেকে সরে আসতে হলো। হয়তো একটু তাড়াহুড়ো করেই চলে এসেছি, কিন্তু এছাড়া আমার আর কোন উপায়ও ছিলনা বিশ্বাস করুন। আজ সবার কথা মনে পড়ছে খুব। সূর্যতপার কথা, গঙ্গার কথা, দিঘির কথা, সারদা মায়ের ঘাটের কথা, আমাদের ফেলে আসা সময়ের কথা। আর আপনার সঙ্গে একটিবার, মাত্র একটিবার সাক্ষাতের জন্য মন বড় ব্যাকুল হয়ে উঠছে দিনের পর দিন। জানি না সেটা কি ভাবে সম্ভব হবে। আমি এটাও জানি না আপনাকে বধূর বেশে দেখে আমারই বা মনের কীরকম অনুভূতি হবে। 

আজকাল সারাদিন কর্মব্যস্ততায় কাটে আপনার দস্যুরাজের। রাজঅতিথিদের আদর আপ্যায়নে কোন ত্রুটি রাখা যাবে না। যদিও তাদের আসার এখনও অনেক সময় বাকি, তবুও। আপনি তো জানেন আমার শেষ মুহূর্তের জন্য কাজ ফেলে রাখার বদভ্যাস আছে। আপনার কাছে কম তিরস্কার পাইনি তার জন্য। আপনি বলতেন শেষ মুহূর্তে তাড়াতাড়ি করে করা কাজ কখনো সুন্দর হয় না। আমার অনেক লেখা আপনার কথা অনুযায়ী আরো অনেক ভালো হতো যদি তাড়াহুড়ো না করতাম। এখানে কিন্তু সেই অভ্যাস বদলে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। অথচ দেখুন আপনি সেটা জানতেই পারছেন না। অতিথি আপ্যায়ন সংক্রান্ত প্রত্যেকটা কাজ করার সময় আপনার কথাই মনে পড়ে বারবার। আশ্চর্যজনক ভাবে আপনার পছন্দ অনুযায়ী সমস্ত কিছু সাজিয়ে নিচ্ছি মনে মনে। মনে হচ্ছে যেন আপনি আসছেন এই রাজ্যে অতিথি হয়ে। আর আমি সেই জন্য আপনার পছন্দ মতন সব কিছু করার নির্দেশ দিচ্ছি কর্মীদের। অতিথি কক্ষের সাজশয্যা, বিনোদন, আহারাদির তালিকা সব কিছুতেই আপনার পছন্দের আধিক্য থাকছে। আপনি এতটাই জুড়ে রয়েছেন মননে আমার।

আমাদের আবার কবে সাক্ষাৎ হবে তা আমি জানি না রাজকন্যা । কিন্তু সাক্ষাৎ যে হবেই সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কীভাবে, কেন আমি এতটাই নির্দিষ্ট ভাবে বলছি সে ব্যাপারে আমি নিজেই অবগত নই। হতে পারে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র ইঙ্গিত এটা। অনেকে বলে সর্বাত্মকরণে কিছু প্রত্যাশা করলে বিলম্ব হলেও তা পাওয়া যায়। আমার সারাটা অস্তিত্ব জুড়ে একটাই প্রত্যাশা এখন। আপনার সঙ্গে একটিবার সাক্ষাৎ। এর বেশি আমার কিছু চাওয়ার নেই এই ব্রহ্মাণ্ডে। 

আপনার সাত জন্মের শত্রু 

দস্যুরাজ

 দস্যুরাজ, 

এখানে আষাঢ় এসেছে নববঁধূর কান্নার সাজে সেজে। পরিজন ছেড়ে আসার বেদনা যেমন আছে এই বরষায়, তেমনই আছে নতুন মিলনের আকাঙ্ক্ষাও। “আষাঢ়ের বারিধারা যেন মীরার শ্রীকৃষ্ণ প্রেম, ত্যাগের আখ্যান, আর শ্রাবণের ধারায় যেন রাই বিনোদিনীর প্রেমের অহঙ্কার প্রতিফলিত হয়…।”

মনে আছে দস্যুরাজ, সেবার দমনপুর থেকে ফেরার পর আষাঢ়ের দ্বিতীয় দিনে আপনি এসেছিলেন আপনার রাজকন্যার কাছে। মানভঞ্জনের উদ্দেশ্যেই। সেদিন অনেকক্ষণ নৈঃশব্দ্যে কাটাবার পর আপনি এই কথাগুলো বলেছিলেন। যেন অনেক দূরের কোন নদীর তরঙ্গ থেকে ভেসে এসেছিল কথাগুলো…। অনেকটা সময় বিদ্যাকুটিরে কাটিয়ে ছিলাম আমরা…।” প্রত্যেকটি যন্ত্রণারই একটা নিজস্ব রহস্য থাকে দস্যুরাজ, সঠিক সময়ে সেটা খুঁজে নিতে হয় “উত্তর দিয়েছিলাম।”

জানিনা কতটা বেদনাভারে নত ছিল কথাগুলো,আপনি আমার হাত ধরে দ্রুত টেনে নিয়েছিলেন আমাকে নিজের বুকে, আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে আপনার বুকের মাঝে আশ্রয় নিয়েছিলাম, আর তারপরই ঘটেছিল সেই অঘটন। আপনার ওষ্ঠাধর সমস্ত কুয়াশার আস্তরণ ছিন্ন করে উৎসর্গমনস্ক কাব্য রচনা করেছিল আমার অধরে। আমার কুচযুগের স্নিগ্ধতাকে ছিঁড়ে, শরীরে পদ্মশালুক ফুঁটিয়েছিল আপনার বিলোল উষ্ণ করতল। সূর্যতপার ঘর থেকে তখন ভেসে আসছিল কবি জয়দেবের অষ্টপদী-

               “রতি সুখসারে গতমভিসারে

                   মদন মনোহরবেশম্

                   না কুরু নিতম্বিনি গমনবিলম্বন

                    মনুসরতম হৃদয়েশম্….”

রাজকন্যার অনিমিখে অযথা বারিপাতে আপনি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন দস্যুরাজ, আসলে আপনার রাজকন্যার অহম বোধ ছিন্নভিন্ন হয়েছিল সেদিন…জন্ম হয়েছিল ‘আমাদের’ শব্দের…আপনি কাছে নেই দস্যুরাজ। শুধু আপনার উপহার দেওয়া প্রতিটি দিন জমা আছে গভীরে।

                     

বিগত কিছুদিন হল আমার জীবনের ঘটনাসমূহ ময়ূরের পেখমের মতই বর্ণময় হয়ে উঠেছে। ভট্টাচার্য মশাইয়ের সূর্যবন্দনা আজকাল প্রতিদিন শোনা না গেলেও, অন্নদামাসির ঝাঁটার ডগায় উঠোনের পাপস্খালনের কোন অব্যাহতি নেই এতটুকুও। যেমন বিরাম নেই দিঘির আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করার, যেমন বিরামহীন গঙ্গার বন্ধুত্বপূর্ণ ভালোবাসারা। এতসব অবধারিত ঘটমান জীবনের  মাঝে একটি কথাই চরম সত্য, আপনি নেই দস্যুরাজ। তাই থমকে গেছে জীবনের জয়গান।

আগে থেকে  ঠিক করা নির্দিষ্ট দিনে আপনার রাজকন্যা তার দুই সাগরেদ গঙ্গা ও দিঘিকে নিয়ে সঙ্কোশ নদীঘেরা দমনপুরে হাজির হয়েছিলো। দেখা হল হৃদকমল রায় চৌধুরী ও ওঁর বান্ধবী রাজনন্দিনীর সঙ্গে। ব্যবহারে আভিজাত্যের গমক, সৌন্দর্য্যে শিউলি ফুলের স্নিগ্ধতা, চলনে সুরের মূর্ছনা, স্বয়ং কবিতা যেন রাজনন্দিনী। কিন্তু সে গল্প আজ নয় দস্যুরাজ, অন্য দিন।

আপনাকে অদেয় কিছু নেই, তবুও আরেকটিবার অনিঃশেষ ভালোবাসা জানালাম।

আপনার রাজকন্যা 

 

 

 

 

ক্রমশ…

 

 

 

 

গত সব কটি পর্ব ও লেখকের অন্যসব লেখা পড়তে ক্লিক করুন

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত