| 17 এপ্রিল 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

রাজকন্যা ও দস্যুরাজ (পর্ব-৭)

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

সুন্দরগড়ের রাজকুমারী প্রজ্ঞাপারমিতাকে  দুর্বৃত্তদের কবল থেকে উদ্ধার করে নিজের আস্তানায় নিয়ে যায় পৃথ্বী ও প্রতিবিম্ব। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে পৃথ্বীর দস্যুবৃত্তির প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপের সম্বন্ধে অবগত হয় রাজকুমারী। পৃথ্বী ও তাঁর কার্যকলাপের উপর কৌতূহল ও আগ্রহ ছাড়াও প্রতিবিম্ব ও পৃথ্বীর পরিচিতি বিষয়ে সন্দিহান হয়েছে সে। সকল ঘটনা প্রতিবিম্ব তাঁর নিজের রাজকন্যা রাজেশ্বরীকে চিরাচরিত প্রথায়  অদেয় পত্র মারফৎ জানিয়ে চলেছে।

প্রিয়তমা রাজকন্যা,

পরম বন্ধু পৃথ্বীর ডেরা থেকে রাজপ্রাসাদ হয়ে আপন বাসগৃহে ফিরেছি গতকাল। দুইজন পেয়াদা রাজপ্রাসাদ থেকে আমায় গৃহে পৌঁছে দিয়ে গেছে। আমার আর পৃথ্বীর বন্ধুত্বের কথা সবার কাছে গোপন রাখতে পারলেও রাজকুমারী প্রজ্ঞাপারমিতার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। তার জন্য আমার নির্বুদ্ধিতাই দায়ী। যথেষ্ট অপ্রস্তুতও হতে হয়েছে রাজকুমারীর কাছে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে রাজকুমারী পৃথ্বীর কার্যকলাপে যথেষ্ট প্রভাবিত এবং আমার কাছে পুনরায় গোপনে তাঁর ডেরায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশও করেছেন। আপনাকে বিস্তারিত বলি সব কথা।

পৃথ্বীর ডেরা থেকে ফেরার পথে ওর দলের লোকেরা আমাদের একটা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে গেলো। এবার আমাদের দুজনেরই হাত আর চোখ বাঁধা ছিল। আমি একা থাকলে পৃথ্বী যে  আমার চোখ বাঁধতো না, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমাদের একটা বিশেষ স্থানে পৌঁছে দিয়ে চোখ আর হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে দস্যুদলের লোকজন গভীর অরণ্যের মধ্যে অন্তর্হিত হল। রাজকুমারীর উদ্ধার করা ঘোড়ার পিঠে রয়েছে রাজকুমারী প্রজ্ঞাপারমিতা নিজেই। এই স্থান থেকে রাজপ্রাসাদের পথ আমার চেনা। সেই পথে রাজকুমারী অশ্বপৃষ্ঠে আর আমি পদব্রজে এগোতে লাগলাম। রাজার অনুসন্ধানী দল আমাদের উদ্ধার করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমায় রাজকুমারীর প্রশ্ন বানে জর্জরিত হতে হয়েছে। আমার বা পৃথ্বীর বানিয়ে বলা গল্পগুলো ঠিক বিশ্বাস যোগ্য হয়নি রাজকুমারীর কাছে। মহালয়ার দিন ভোরে রাজকুমারীর জ্ঞান ফেরে। অম্বা তার মাথার কাছেই জেগে বসে ছিল সারারাত। জ্ঞান ফিরতেই রাজকুমারী শয্যা ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। খবর দেওয়া হয় আমাকে ও পৃথ্বীকে। তাঁর কক্ষের সামান্য যা বস্তু ছিল সেসব ছোঁড়াছুঁড়ি করতে করতে রাজকুমারী চিৎকার করতে শুরু করেন। চিৎকার করে জানতে চান তিনি কোথায়? তিনি এখানে কীভাবে এসেছেন, এবং যেভাবেই এসে থাকুন তাঁর পিতা একবার তাঁর খোঁজ পেলে কাউকেই জীবিত রাখবেন না, ইত্যাদি।

আমাকে দেখে রাজকুমারী চিনতে পারেন এবং যারপরনাই হতবাকও হন। “তুমি? তুমি রাজকোষের কর্মচারী না? তুমি এখানে কী করছো? বুঝেছি। তুমি এদের সঙ্গে মিলিত হয়েছ। আমায় অপহরণ করিয়েছো। নিশ্চয়ই মোটা মুক্তিপণ চাও?” শুনে আমি কিছু বলার আগেই দেখলাম উত্তেজিত পৃথ্বী রাজকুমারীর দিকে অগ্রসর হল এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে রাজকুমারীর দুই বাহুর উপরিভাগ তাঁর পাথুরে শক্ত হাতে সজোরে চেপে ধরে কঠিন অথচ শান্ত চোখে রাজকুমারীর চোখে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে “রাজকুমারী আপনি অসুস্থ। আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনাকে অপহরণ করা হয়নি, বরং অপহরণকারীদের থেকে উদ্ধার করা হয়েছে মাত্র। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আপনি কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। দয়া করে উত্তেজিত হবেন না।শান্ত হোন। “প্রথমে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত সম্মোহিত ব্যক্তির মতো পৃথ্বীর দিকে তাকিয়ে থেকে তার সমস্ত কথা শুনলেন রাজকুমারী এবং তাঁর শয্যায় শান্ত হয়ে বসলেন। তারপর তাঁকে কীভাবে এখানে আনা হয়েছে সেইসব ঘটনা বিস্তারিত জানানো হল। সব ঘটনা সত্যি বলা হলেও আমি আর পৃথ্বী যে পূর্ব পরিচিত বা আমাদের মধ্যে যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে সে কথা গোপন করা হল। আমি নেহাৎই কাকতালীয় ভাবে রাজকুমারীকে উদ্ধারের সময় সেই স্থানে উপস্থিত ছিলাম এবং তাঁর সঙ্গ ছাড়তে অস্বীকার করার জন্যই পৃথ্বী বাধ্য হয়েছে আমায় তাঁর ডেরায় নিয়ে আসতে। তাঁর পিতার রাজ্যের উপকথাসুলভ দুধর্ষ দস্যুর ডেরায় রয়েছে, সে ব্যাপারে অবগত হওয়ায় রাজকুমারী বেশ রোমাঞ্চিত বলে মনে হল। তাঁর সুন্দর বড় বড় দু’টি চোখ আরও বড় বড় হয়েছে গিয়েছিলো উত্তেজনায়। তাঁর কাছ থেকেও জানা গেলো কীভাবে তিনি দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েছিলেন।

রাজামশাইয়ের সঙ্গে কোন কারণে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি তাঁর অভ্যাস মতো ঘোড়া ছুটিয়ে প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে ছিলেন। পথ হারিয়ে অরণ্য অভিমুখে চলে যাওয়ার পর কয়েকজন দুর্বৃত্ত তাঁর পিছু ধাওয়া করে। তাদের মধ্যে একজন যখন তাঁর পাশে এসে তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরে ফেলে তখন তিনি উত্তেজনায় জ্ঞান হারান। আসলে এই দুর্বৃত্ত আর কেউ নয়, সে ছিল স্বয়ং পৃথ্বী। প্রকৃত তিনজন দুর্বৃত্ত কে পরাস্ত করে সে যখন রাজকুমারীর ঘোড়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে যায় তখনই রাজকুমারী জ্ঞান হারান। পৃথ্বী যথাসময়ে যথাস্থানে উপস্থিত না থাকলে রাজকুমারী যে সমূহ বিপদের মধ্যে পরতেন তা বেশ ভালোভাবেই হৃদয়ঙ্গম করলেন তিনি। মাঝেমাঝে পৃথ্বীর দিকে রাজকুমারীর নিষ্পলক চেয়ে থাকায় কৃতজ্ঞতার আভাস ছিল। সেই অপরাহ্নেই রাজকুমারী ও আমায় যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়া হবে স্থির করলো পৃথ্বী।

পৃথ্বীর ডেরায় একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে লুণ্ঠিত বস্তু জমা করা হতো এবং সময়ে সময়ে তা গরীব মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হতো। সেদিন কোন এক বিশেষ গ্রামে বিলি করার জন্য খাদ্য শস্যের বস্তা গুদামঘর থেকে বার করে সামনের খোলা জায়গায় একত্রিত করা হচ্ছিল। আপনাকে বলা হয়নি পৃথ্বীর আস্তানা পাহাড়ের গায়ে গভীর অরণ্যের মধ্যে। কিছুটা জায়গা জুড়ে গাছ কেটে পরিষ্কার করে কিছু অস্থায়ী ঘর বানানো হয়েছে আর পাহাড়ের গায়ে কিছু গুহাও ব্যবহার করা হয়েছে থাকার জন্য। আমি আমার গিরিগুহা কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে পৃথ্বী এবং তাঁর দলবলের এরূপ কর্মযজ্ঞ চাক্ষুস করছি এমন সময়ে পিছন থেকে রাজকুমারীর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি। রাজকুমারী জানতে চান “এখানে কী হচ্ছে?”। আমি পৃথ্বীর এরকম দীন হিতৈষী কার্যকলাপে আগাগোড়াই মুগ্ধ ছিলাম এবং সেই মুগ্ধতাজনিত উচ্ছ্বাসে রাজকুমারীকে পৃথ্বীর দস্যুবৃত্তির আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবগত করি। আমার কাছে রাজকুমারী সকল খুঁটিনাটি জানার পর মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সমস্ত কর্মকান্ডের উপর তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ জানতে চাইলেন “তুমি এতসব জানলে কী করে? তুমিও তো আমার মতোই আজই এখানে প্রথমবার এলে?” এই প্রশ্নের জন্য আমি একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার উচ্ছ্বসিত বর্ণনা আমায় ধরা পড়িয়ে দিয়েছে রাজকুমারী প্রজ্ঞাপারমিতার কাছে। আমার আর পৃথ্বীর পূর্বপরিকল্পিত মিথ্যা গল্পের স্বচ্ছ আবরণ ভেদ করে সত্য দেখে ফেলার চেষ্টা করছেন রাজকুমারী। সদুত্তর দিতে পারিনি আর রাজকুমারীও দ্বিতীয়বার জানতে চাননি তখন। আমার এরকম অপ্রস্তুত হওয়ার ঘটনা লিখতে লিখতে আপনার ব্যঙ্গ করে অট্টহাস্য শুনতে পেলাম যেন রাজকন্যা। তবে রাজকুমারী তখন ছেড়ে দিলেও রাজপ্রাসাদে ফেরার সময়ে রীতিমতো জেরা করেছেন আমাকে। রাজপ্রহরীরা আমাদের আবিষ্কার করা পর্যন্ত নাজেহাল হতে হয়েছে আমায়। আমি আর পৃথ্বী যে পূর্বপরিচিত সেটা অনুমান করেছেন রাজকুমারী। রাজপ্রাসাদে পদার্পণের পর রাজকুমারীকে পৃথক স্থানে নিয়ে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আমার কাছে এসে সবার অলক্ষ্যে নিচু স্বরে বললেন “আমি আবার দস্যুরাজের ডেরায় যেতে চাই। তুমিই আমাকে নিয়ে যাবে”। রাজকুমারী প্রজ্ঞাপারমিতার মুখনির্গত ‘দস্যুরাজ’ নামটা শুনে চমকে উঠেছিলাম। যেন আরেক রাজকন্যা আর তাঁর দস্যুরাজের গল্পের সূচনা হচ্ছে। সত্যিকারের রাজকন্যা আর দস্যুরাজের। সামান্য কিছু জিজ্ঞাসাবাদ এর পরে আমাকে আমার গৃহে পৌঁছে দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য আমার আর পৃথ্বীর বন্ধুত্বের কথা গোপন রেখেছি, পূর্ব পরিকল্পিত মিথ্যাচারিতার সাহায্যে।

আচ্ছা রাজকন্যা, আমাদের চিন্তাভাবনার তো যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে আগাগোড়াই, ধরুন যদি রাজকুমারী প্রজ্ঞাপারমিতা আর দস্যু সর্দার পৃথ্বীর একটা সম্পর্ক তৈরী হয়! আমি জানি আপনার চোখ চকচক করে উঠবে এই সম্ভাবনার কথা ভেবে। দশদিক আলো করা সেই হাসিটা আপনার মুখ জুড়ে যেন দেখতে পাচ্ছি আমি। কিন্তু সমস্যা হল রাজকুমারী আর দস্যুসর্দার এর সম্পর্ক তৈরী হলেও এই দস্যুরাজ আর তাঁর রাজকন্যার সম্পর্কেই মতোই তা হবে পরিণতিবিহীন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র কন্যার চালচুলোহীন ব্যক্তির সঙ্গে পরিণয় যেমন বেমানান, তেমনই কোনো রাজ্যের রাজকুমারীর সঙ্গে দুর্ধর্ষ দস্যুদলের সর্দার এর সম্পর্ক তার থেকেও বেশি দুরূহ। অপরিসীম বেদনা আর অন্তহীন অপেক্ষা এই সম্পর্কের নিয়তি রাজকন্যা, যা আপনার এই দস্যুরাজ তাঁর প্রত্যেকটি রোমকূপে অনুভব করে। আজ এখানেই শেষ করি। আশা করি ভালো আছেন, ভালোবাসায় আছেন।

আপনার

দস্যুরাজ

অনুর্বর, অনাবাদী জমির শরীরেও চাষির অপত্য স্নেহটুকু লেগে থাকার মতোই, বৃষ্টির প্রতি মাটির টানও চিরপুরাতন রোগ যেন।ফেলেও দেওয়া যায় না আবার সযতনে গচ্ছিতও রাখা যায় না। নিজের প্রেমের অসমাপ্ত গাঁথা যেন রাজেশ্বরীর কাছে তেমনটাই। রাজনন্দিনীর জন্ম ইতিহাস যেমন আচ্ছন্ন করে রাখে রাজেশ্বরীকে তেমনই সে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা বোধ করে হৃদকমলের রাজনন্দিনীর প্রতি ভালোবাসায়। নিজের অসমাপ্ত প্রেমের কথা ভেবে অঝোরে বাহিত হয় তাঁর মন। কাহিনী এখানে কিশোরীর চপলতা শেষে চটি খুলে বসে বৃষ্টির পাশে।

আমার দস্যুরাজ,

অঝোর বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ভালোবাসার নিগূঢ় সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। তাই হয়তো কিছুদিন হলো, আপনার কথা এত বেশি মনে পড়ছে।বা হয়তো সে কারণেও নয়,দুটি ভালোবাসার মানুষের পরস্পরের কাছে আসার গল্পটা খুব চেনা লাগছে। সে কারণেই আপনি আমার অতীত থেকে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন যখন তখন।

সপ্তাহখানেক ধরে নাগাড়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। এদিকে ভট্টাচার্য মশাইয়ের শরীরটা বেশি খারাপ থাকায় আজকাল সূর্যতপা বাড়ির পুজোর দায়িত্ব নিয়েছে।প্রথাগত পুজো সে কখনওই করতে পারে না। এ তো আপনার অজানা নয় দস্যুরাজ, অথচ তাঁর সংস্কৃত উচ্চারণ ভট্টাচার্য মশাইয়ের শিক্ষার সাক্ষী বহন করে। সূর্যতপার ভজনে আজকাল আপনার রাজকন্যার ঘুম ভাঙ্গে, তারপর দীঘি এসে বয়ে যাওয়া সময়ের মতোই ধারাবিবরণীতে হীরার দুষ্টুমির কথা বর্ণময়তায় বর্ণনা করে। আপনাকে বলা হয়নি দস্যুরাজ, দীঘির পরমা সপ্তাহ তিনেক আগে একটি নধর বাছুরের জন্ম দিয়েছে।বাছুরটির শ্বেতশুভ্র চকচকে হীরক দ্যুতিময় শরীরের জন্য ওর নাম দিয়েছি হীরা। আপনার অযথা ও আকস্মিক প্রস্থানের পর আমার মতোই দীঘির দীঘল চোখেও সবসময় ব্যথা জমে থাকতো। থাকবে নাইবা কেন? ওর রাজদিদি যে ওর প্রাণের দোসর।সে এমন মৌন থাকলে দীঘিই বা স্বস্তিতে মুখর হয় কী করে? হীরার জন্মের পর সরকার বাড়ির উঠোন আবার ঝলমলে রোদ্দুরে ভরে গেছে দস্যুরাজ। আমিও আর মুষড়ে থাকি না। আমি বিশ্বাস করি, আপনি কোথাও যাননি। আপনি আছেন আমার গভীরেই।

আজকাল আমাকে রাজনন্দিনী ও হৃদকমলের সম্পর্কটা খুব ভাবায় দস্যুরাজ। একটা মানুষ কতটা ভালোবাসতে পারলে প্রথাগত রীতি বা অহেতুক সামাজিক নীতির দিকে দিকপাত পর্যন্ত  না করে শুধু সামনে ভালোবাসার মানুষটিকেই দেখতে পান।এঁদের প্রেমগাঁথাটিও তেমনই দস্যুরাজ। বিবাহের পর রাজনন্দিনীর অসুস্থ শরীর একটি দিনের জন্যও শয়নকক্ষে মাথাটুকু তুলে বসতেও পারেনি। ওদিকে হৃদকমলের প্রান্তিক কৈশোর মনে বেদনার ছায়া এতটাই ঘনীভূত হয় যে দেশ বিদেশের বৈদ্যিরাও তাঁকে সুস্থ করতে অপারগ হয়ে জবাব দেয় শেষে। রায়চৌধুরী বাড়ির চৌকাঠে শোকের ছায়া নেমে আসে। পুষ্পদংশন গ্রামের শেষ প্রান্তেই রাধিকারঞ্জন গ্রামের শুরু। সাপ্তাহিক হাট বসলে পাশাপাশি দুই গ্রামেরই ক্রেতা বিক্রেতার পারস্পরিক আদানপ্রদান আর কুশল বিনিময়ের ফলে সেখানে রাষ্ট্র হয়ে যায়, রাধিকারঞ্জন গ্রামের জমিদারদের খাজাঞ্চিবাবুর ভ্রাতুষ্পুত্রের স্ত্রী চিররুগ্ন রাজনন্দিনীকে লুকিয়ে বিবাহ দেওয়া হয়েছে। বীরেন্দ্রনাথ বেঁকে বসেন এই অবসরে, তিনি কিছুতেই এই রুগ্ন স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে সম্মত নন সগৌরবে ঘোষণা করলে রাজনন্দিনীকে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ফিরিয়ে দিয়ে যায়।

দস্যুরাজ, কাহিনী এখানে অন্য ধারায় বইতে থাকে। রাজনন্দিনী ফিরে আসার পর সে যেমন সুস্থ হতে থাকে তেমনই এই খবর কানে প্রবেশমাত্রই সুস্থ হতে থাকেন হৃদকমল। তাঁর জীবনের আশা ছেড়ে দাওয়া বাড়ির লোকজন এই অকস্মাৎ সুস্থতার কারণ লক্ষ্য করেন না। জমিদার বাড়িতে আনন্দ উদযাপন শুরু হয়। দস্যুরাজ আপনার মনে আছে, আমাদের বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসায় পদার্পণের পথটি কিন্তু সুগম ছিল না অতটা। আমরা পরস্পর যে সারাদিন শুধুমাত্র পরস্পরে ডুবে আছি, তা জানা সত্ত্বেও আমরা ধরা দিতে পারিনি দুজনের কাছে বহুদিন। মনে আছে, বন্ধুদের সঙ্গে আপনার নৈশাহার ও সুরাপানের দিনটির কথা জানতে পেরেও আমি নিশ্চুপ থাকায়, দীঘির হাতে যে চিরকুট আপনি পাঠিয়েছিলেন, ওতে লিখেছিলেন “আমি কি অন্যায় করছি?” আর আমি ততোধিক নিস্পৃহ উত্তর দিয়েছিলাম,  “আমি তো আপনাকে নিষেধ করিনি।” মনে পড়ে দস্যুরাজ পরের চিরকুটে আপনি কী লিখেছিলেন? লিখেছিলেন, “আমি তো চাই আপনি আমাকে নিষেধ করুন, সর্বান্তঃকরণে চাই” সেই একটি চিরকুটে আপনার আত্মাটির কাছে আমি আত্মসমর্পণ করেছিলাম দস্যুরাজ। রাজনন্দিনী ও হৃদকমলের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটলো। ওঁরা সুস্থ হয়ে ওঠার পরও ওঁদের যৌবনভারে আনত মন, দুজনের কাছে পৌঁছোতে পারছিল না অনাহূত দ্বিধায়। কৈশোরে কথায় কথায় রাজনন্দিনীর কাছে ছুটে যাওয়া হৃদকমলের যৌবনের পা যেন অদৃশ্য লক্ষ্মণ রেখায় আবদ্ধ ছিল। একদিন পিতামহীর থেকে জন্মদিনে উপহার পাওয়া লক্ষ্মীবিলে উদাসীন বসেছিলেন হৃদকমল। বিলের জলে পাথর ছুঁড়ে আলপনা আঁকছিলেন আনমনে।ঘটনাচক্রে লক্ষ্মী বিলে জল নিতে আসা  অনভ্যস্ত ঘোমটা টানা রাজনন্দিনী পা হড়কে পড়ে যেতে গেলে ধরে ফেলেন হৃদকমল। ঘোমটা টানা থাকলেও এই সিঞ্জিনীর শব্দ বিলক্ষণ চিনতেন হৃদকমল। কোথায় উড়ে গেল ঘোমটা, কোথায় উড়ে গেল অতিথির মতো আসা দ্বিধারা…। একসঙ্গে বড় হওয়া চারটি অনিমিখের যেন সেই প্রথম দেখা। সেই যেন শুভদৃষ্টি।

দস্যুরাজ, কিছু ভালোবাসায়, ‘ভালোবাসি’ শব্দটুকুও যেন বাহুল্যই। কিছু ভালোবাসায় ভালোবাসাটাই অবধারিত সত্য বলে, মৌখিক প্রকাশের অপেক্ষা রাখেনা।দস্যুরাজ ও রাজকন্যার কাহিনীর মতোই তাই রাজনন্দিনী ও হৃদকমলের কাহিনীর ভিত ওই ভালোবাসাটাই। আপনাকে দেওয়ার মতো ভালোবাসাটুকুও আর আমার কাছে অবশিষ্ট নেই আর দস্যুরাজ। সবটাই আপনার অদৃশ্য অবয়বের কাছে সযত্নে গচ্ছিত রাখা। আজ এখানেই শেষ করছি।

আপনার “রাজকন্যা”

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত